খড়কুটোর জীবন : খেলা নিয়ে কেটেছে যে বেলা । পর্ব ৯ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

সর্ষের তেল মাখিয়ে নরম রোদ্দুরে শুইয়ে দেওয়া হতো আমাকে। তখন আমি ক্ষুদ্র শিশু হাত-পা নেড়ে খেলতাম আপন মনে। চুষিকাঠির বদলে আঙুল চোষাও ছিলো আমার নিত্যদিনের খেলা।

তবে স্বজনেরা আমাকে নিয়েই খেলতো বেশি। কচি হাত-পা গুলো এক জায়গায় করে ছেড়ে দিতো। সেগুলো ছড়িয়ে নিজের জায়গায় আসতেই আমি খিল খিল করে উঠতাম তাদের বয়ানে। মাঝে মাঝে কেউ  – ‘দুধ দিই, ভাত দিই, কালো মেকুরের গু দিই ‘- এই বলে কাতুকতু দিতো। আমি সুরসুরিতে হাসতাম। তবে তারা কেউ সুকুমার রায়ের কাতুকুতু বুড়ো ছিলোনা। তাদের কত আমোদ। স্নেহের পরশ ছড়িয়ে থাকতো কচি শরীরে। কেউ আমাকে নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ধরে নিতো। ভয়ে চোখ বুজে আসতো। কিন্তু বিড়ালছানার মতো তখন আমি অমৃতের পুত্র। তারপর হামাগুড়ি থেকে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করতে করতে কখন যে খেলার ময়দানে প্রবেশ করি তার সন- তারিখ লিখে রেখেছে মহাকাল।

খেলনা নিয়ে খেলেছি কত। মাটির পুতুল বা মাটির ঘাড় নাড়ানো বুড়ো নিয়ে খুব মজা হতো। বল, বেলুন, পাতার বা প্লাস্টিকের বাঁশি গ্রাম্য শিশুর কাছে ছিলো খেলার নানান উপাদান। একটু বড়ো হতেই দিদিদের মেয়েলি খেলার সঙ্গী হতাম আমি। কড়ি খেলা, ঘুঁটি খেলা বা রান্না বাটির খেলায় মশগুল হয়ে থাকতাম। কড়ি খেলাতে মাটিতে কড়ি গুলি ছড়িয়ে দিয়ে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে একটা কড়ির সঙ্গে আর একটা কড়ি লাগিয়ে মারা হতো। আর ঘুঁটি খেলাতে ঘুঁটি গুলোকে অঙ্গল এক অঙ্গল দুই ক্রমান্বয়ে বলতে বলতে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ধরে নেওয়া হতো। পরে গেলেই অপর জনের দান। আর রান্না বাটিতে ধুলোর ভাত, জীয়ল গাছের আঠার মাংস, জলের ডাল, ভেরেণ্ডার ফল ভাজা খেতে হতো। সেটাও মিছি মিছি। মুখে ঠেকিয়ে ফেলে দেওয়া। এবং ‘কয়া কয়া মাছের ঝোল / আর খাবো না হরিবোল’ – বলে উঠে যাওয়া। পুতুলের বিয়েতেও বর বা কনে যে- কোনো পক্ষে আমন্ত্রিত হতাম। সে শুভ উৎসব আন্তরিকতার পাঠ দিয়েছিলো আজ বুঝি। পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলে কেঁদে বুক ভাসাতো অনেক দিদি। আড়ি হয়ে যেতো চেনা মুখের সঙ্গে চেনা মুখের। তবে ভাব জমতে সময় লাগতো না। সে তো পুতুল খেলা।
ডিগডিগাডিগ নামে একটা খুব মজার খেলা  ছিলো আমাদের । একজন মাটিতে হাত দিয়ে পিঠটা উঁচু করে দাঁড়াতো । বাকিরা এক একটা ছড়ার লাইনের অংশবিশেষ বলতে বলতে পিঠের উপর দিয়ে লাফ দিতো। পিঠে লাফ দানকারীর শরীরের কোনো অংশ স্পর্শ করলে সে হবে মুচি। তার পিঠের উপর দিয়ে বাকিরা লাফাবে । ছড়া গুলো আজো স্মৃতিতে অমলিন। যেমন –
‘ডিগডিগাডিগ ডিগ
কী স্বপ্ন বাজে
আগে যায় গরুর গাড়ী
পিছে যায় হাতি
কাজলে ব্যাঙ ছাতি। ‘

আবার কখনো বলতাম —
‘আমপাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চলবে ঘোড়া
ওরে বিবি সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে
বন্দুক ছুঁড়ে মেরেছে। ‘

আরো কত ছড়া —
‘আমার নাম চম্পা
গলায় গামছা
হাতে বেলতি
কাঁকে কলসী
কলমী ফুল ডগাডগা
কানে গুঁজেছি
পদ্ম পাতার রস দিয়ে
লুচি ভেজেছি ।’

যখন হাততালি দিয়ে দিয়ে লাফ দিতাম তখন বলতাম —
‘হাতের তালি এক ভল্টু
ডবল তালি ডবল ভল্টু
বেগুন ভাজি।’

কখনো এক চোখ বা কখনো দু’চোখ ধরে লাফ দিতে গিয়ে বলতাম —
‘এক চোখ কানা
দু’চোখ কানা।’

পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে বলতাম —
‘এক পা খুঁড়া
এক পা খুঁড়া
দু’পা খুঁড়া
দু’পা খুঁড়া
ভূভূভা।’

মজার আর একটি ছড়া —
‘ঐ পাড়ের ঐ খই গাছটি
খই ঝুর ঝুর করে
একটি খই ছিঁড়ে পড়ে
সদানন্দ বকে
আশি টাকা দিয়ে খাসি কিনেছিলাম
খাসি লাল বাগানে চড়ে
ডোবা ঘাস খেয়ে খাসি
ব্যা ব্যা করে
খাসি ব্যা ব্যা করে।’

খেলার এই ছড়ার মধ্যে কখনো কখনো মিশে থাকতো প্রোষিতভর্তৃকার যন্ত্রণা। —
‘বাড়ির কাছে ঝাউ গাছটি
বড়ো বড়ো শিষ ,
বন্ধু তুমি বিদেশ গেলে
আমি খাবো বিষ ।’

নতুন বউ দেখতে যাওয়ার কৌতূহল —
‘ক্রিং ক্রিং সাইকেল
লিচু বাগানে
একটি লিচু পড়ে গেলো
চায়ের দোকানে
চা ওয়ালা চা ওয়ালা
দোকান খোলো না
টিংকু ময়রার বউ আসবে
দেখতে চলো না ।’

বড়ো লেকের ছেলের কলেজ যাওয়ার চিত্র —
‘ডুম ডুমা ডুম ডুম
কিসের ডুম বাজে
রাজার ছেলে কলেজে যায়
তাইতো ভারি সাজে ।’

নারী জীবনের নানা আশা আকাঙ্ক্ষার চিত্রে ভরপুর শৈশবের এই ছড়া গুলো। চোখের জলের গোপন ইতিহাস তার পরতে পরতে। খেলতে খেলতে এতো বাস্তব জীবনের পাঠ নেওয়া। —
‘সুষণের শাক তুলতে গেলাম
পা পিছলে পড়ে গেলাম
দেখলো ভাসুর তুললো না
তোর ভায়ের ভাত খাবো না
চলে গেলাম বাপের বাড়ি
বাপ দিলো তাঁতের শাড়ি
ঐ শাড়ি কি পরা যায়
বিয়ানবাড়ি যাওয়া যায়
বিয়ানবাড়ি তুঁত গাছ
তুঁত পাখিতে খায় ।’

অথবা,
‘মাসি গো মাসি
কী করছো
কল পুঁতছি
কী কল
দমকল
কী দম
আলুর দম
কী আলু
চটকা আলু
কী চটকা
গু চটকা
কি গু
মানুষের গু
কী মানুষ
বন মানুষ
কী বন
কচু বন
কী কচু
মান কচু
কী মান
বর্ধমান
কী বর্ধমান
চুপ করতো।’

স্বামী কেমন হবে সে নিয়ে নারীর স্বপ্ন ইচ্ছে–
‘টিপ টিপ টিপের পাতা
ঐ টিপটা পরবো
কালো যদি স্বামী হয়
জলে ডুবে মরবো
ফরসা যদি স্বামী হয়
তবেই পাশে বসবো
সিঙাড়া চপচপ
জামাই এলো ঝপঝপ
ঐ জামাই, বসুন তো, দু’টি কথা শুনেন তো
আপনার মেয়ে হাটে যায়
প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট খায়
আমরা যদি বলতে যায়
টাক ডুমা ডুম বাঁধিয়ে দেয় ।
ছাদে কোকিল বসেছে
দিদির বর এসেছে
দিদি চিনতে পারেনি
দিদির মা চিনেছে
কাল মুখো জামাই আমার
স্যাম্পু করেছে।’

একটা সময় কলকাতা শহরে পাঞ্জাবী বাসচালক বা হেল্পাররা  ‘ডিগা ডিগা’ বলে বাসের গায়ে থাবা দিতো। যা নিয়ে হিন্দি গান ‘ডম ডম ডিগা ডিগা / মৌসম ভিগা ভিগা।’  ঐ ডিগা ডিগা থেকেই হয়তো এসেছে আমার এই খড়কুটোর জীবনে ডিগডিগাডিগ খেলা।

নাচের ছন্দে খেলতাম —
চারটি পুতুল পুতুল নাচ, বড় ভেচকু, ছোটো ভেচকু, লবণের বস্তা, ছোটো নৌকা, রাজার ছেলে চা খায় পেপার পড়ে, রাজার ঘরে সাপ ঢুকেছে নানান খেলা। মূকাভিনয়ের মতো ছিলো এই খেলাগুলো। আমাদের যদিও যোগেশ দত্তের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না।

চারিদিকে একপক্ষ পাহারা দিতো। অন্যদিকে হাতে হাত দিয়ে শিকল রচনা করে একদল পাক দেবে। এবং পাক দিতে দিতে পাহারার ফাঁক গলে একজন বেরিয়ে যাবে। তার পর আবার ফিরে এসে তাকে দলে যোগ দিতে হবে। মাঝে ধরা পড়লে মইর হবে। অন্যপক্ষ ফুলের পাপড়ির মতো বৃত্ত রচনা করবে। এ আমার শৈশবের ফুল খেলা।

শিরগাদি খেলা, খেটে খেলা, বোম্বাই লাঠি খেলা, ভেটা খেলা, লাটিম খেলা, মার্বেল খেলা, বাঘ বন্দী খেলা কতইনা ছিল আমাদের খেলা। এর পাশাপাশি চলতো ফুটবল আর ক্রিকেট। স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটতাম দল ভাগ হয়ে গেলে আর ফুটবল খেলা হবে না। সাইড লাইনে বসে থাকতে হতো । মাঝে মাঝে টুর্নামেন্ট হতো। বছরে একদিন হতো বিবাহিত আর অবিবাহিত পুরুষদের ফুটবল ম্যাচ। যারাই জিততো অপর দলকে দুয়ো দিতো। বাপ ছেলেকে অথবা ছেলে বাপকে করতো রসিকতা। হাডুডু বা কাবাডি ছিলো বেশ উত্তেজনা ময়। আজো মনে আছে মোজাম্মেল কাকার কাবাডি কাবাডি বলতে বলতে অপর দলের খেলোয়ারকে মইর দিয়ে লাফ দিয়ে নিজের কোর্টে ফিরে আসা। হাডুডু ম্যাচে পুরষ্কার থাকতো খাসি ছাগল।

প্রতি বছর তেইরির দিন হতো লাঠি খেলা। লাঠিতে লাঠিতে বাজনার তালে তালে সে এক শৈল্পিক লড়াই। আজ সেই লাঠি খেলার কাল ফুরিয়েছে । মাঝে মাঝে আসতো মাদারিরা। নানারকম জাগলারি চলতো। দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা, রিং-এর মধ্যদিয়ে লাফ, লাঠির মতো করে মোটা রশি ঘোড়ানো, আর্চ করে চোখ দিয়ে সূচ তোলা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম শিশু মনের প্রসন্নতা নিয়ে ।

সার্কাস বা জাদু খেলা প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে দেখার সৌভাগ্য হতো না। তবে প্রতি বছর আসতো সাইকেল খেলা। তিনটে বাজতেই হাজির হয়ে যেতাম । নিজাম ভাই ততক্ষণে সাইকেলে চক্কর দিতে দিতেই স্নান শুরু করে দিয়েছেন । পাড়ার ছেলেরা বালতি ভরে জল এনে রেখে দিয়েছে গণ্ডীর চারিদিকে । সাইকেলে চালাতে চালাতে সাবান মাখা, তেল মাখা, পোশাক বদলানো সবই চলছে । পাঁচদিন নিজাম ভাই সাইকেলেই থাকবেন । মাচাতে ঘুমাবেন। মাটি ছুঁলেই নাকি মারা যাবেন । তাই অনর্গল সাইকেলে চক্কর কাটা আর নানান কায়দাবাজি   – যা আমাদের চোখে অবিশ্বাস্য এবং রোমাঞ্চকর । সঙ্গে সার্কাসের ক্লাউন দের মতো পটলের সঙ্গত। তার কায়দাবাজি করতে গিয়ে কেস কেলো করা আমাদের হাসির খোরাক জোগাতো ।

এই পটলকেই নিজাম ভাই তার জাদুবলে জিন্দা কবর দিয়ে আবার বাঁচিয়ে তোলেন । কখনও কবরে তাকে সাপ বানিয়ে দেন আবার কখনও কোনো গাছের ডালে চালান করে দেন । সকলে গিয়ে তাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনে । নিজাম ভাই এর বশে নাকি জিন্ আছে । তার শক্তিতেই তিনি অদ্ভুত সব কর্ম সমাধা করেন ।

পিঠে টিউব লাইট ভাঙা, গলা দিয়ে ফলা লাগানো লোহার শিক বাঁকানো, গামছাতে কুলো নাড়িয়ে মুড়ি ভাজা, কারোর পিছনে পিঁড়ি আটকে দেওয়া এসব কর্ম নিজাম ভাই এর কাছে নস্যি । সাইকেলে পাক দিতে দিতে তিনি আমাদের মশগুল করে দিতেন । আমরাও সেপ্টিপিন দিয়ে টাকা সাঁটিয়ে দিতাম তার সার্টে। এভাবেই খেলা শেষ হতো একদিন । নিজাম ভাই ফিরে যেতেন তার দেশে । শুরু হতো সদ্য শেখা সাইকেলে আমাদের কায়দাবাজি। যে কায়দাবাজি আজও বহমান।

খেলা করা আর খেলা দেখা এনিয়েই কেটে গেলো জীবনের এতটা সময়। খেলা নানার্থে নক্সা আঁকে সময়ের খোলা মাঠে। জীবন খিদ্দার মতো বলে চলে – ‘ফাইট কোনি, ফাইট।’ থিসিফাস আমি বলি – ‘খেলা হবে।’

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *