কাগজের নৌকো। পর্ব ১০। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
সকাল এগারোটা, চালসা হাসপাতালের আউটডোর রোগজর্জর মানুষের কোলাহলে মুখর-প্রায় সবাই হতদরিদ্র, মলিন ক্লান্ত শরীরে বারান্দায় লাইন দিয়ে বসে রয়েছে, হাতে একখানি কাগজের টুকরো, হাসপাতালের ভাষায় ‘টিকিট’! বারান্দায় অবশ্য সবার স্থান হয়নি, তারা চিকিৎসালয়ের সামনে বড়ো মাঠে ধুলার উপরেই বসেছে, চৈত্র মাসের বেলা, খররৌদ্র ফটিকজল পাখির আকুল কণ্ঠস্বরের মতো বিবর্ণ চরাচরে ডানা মেলে ভেসে রয়েছে, এর মধ্যেই পথঘাট প্রায় নির্জন, দূরে গাছগুলির মাথা অলীক ধূম্রজালে আচ্ছন্ন। মাঠের একপাশে দুটি শিমুল আর একটি কাঠচাঁপা গাছের ছায়ায় বসে রয়েছে আরও কিছু মানুষ-দেরী করে আসায় এদের টিকিট মেলেনি, কখন ডাক্তারবাবু তাদের দেখবেন তাও জানে না, অবশ্য সে-নিয়ে তেমন উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না, নির্বিকার মুখ, যদি ভাগ্যে লেখা থাকে তবে ডাক্তারবাবুর দয়া হবে নাহলে কাল আবার আসবে, অরণ্য নিবাসী দরিদ্র মানুষের জীবন এমনই নিস্তরঙ্গ!
আতপ মুখর চৈত্র দিনে শিমুল গাছ থেকে নিঃশব্দে আলো ছায়ায় ঢেউ তুলে দু-একখানি পাতা খসে পড়ছে, ঝিমঝিম বাতাসে ধুলার রেণু, একটি বালক পাতাগুলি সযত্নে কুড়িয়ে ধুলাপথে আলপনা সাজাচ্ছে-কয়েক মুহূর্ত পর আবার পুরাতন নকশা ভেঙে দিয়ে পাতার অক্ষরে গড়ে তুলছে নতুন কোনও ছবি। বালকটির বয়স মাত্র সাত, গত কয়েকমাস ধরে কামলা রোগে ভোগায় হেমন্ত অপরাহ্নের পীতবসনা আলোর রঙ লেগেছে সমস্ত শরীরে, শীর্ণ কঙ্কালসার দেহে তিরতিরে বাতাসের মতো দুটি চোখ, একখানি সুতির হাফপ্যান্ট আর মলিন হাফহাতা জামা পরনে, অদূরে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা তরুণী জননীও চিররুগ্না, একবার ক্লান্ত চোখে চেয়ে বালককে ডাকলেন কিন্তু পিতৃহীন রোগক্লিষ্ট শিশুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই, জ্বর গায়েই ধুলা আর পাতা নিয়ে আপনমনে হাসিমুখে খেলছে-মাথার উপর খর চৈত্র, খইফোটা উষ্ণ বিবাগী বাতাস বইছে দক্ষিণ মুখে, তার মাঝেই রচিত হয়েছে বালকের নিজ ভুবন।সেই কোন্ সকালে দুমুঠি জলে ভেজা ভাত লবণ মেখে খেয়ে এসেছে অথচ এখন ক্ষুধা নাই তৃষ্ণা নাই, এই আনন্দ চরাচরে বাতাস রৌদ্র গাছের পাতাই তার খেলার সঙ্গী, অভাব অভিযোগর পরিবর্তে কী এক অপরূপ পদ্মকুসুম সুবাসে মুখখানি টলোমলো, আর ক’দিন বাঁচবে তাও জানে না তবুও এই মেলাখেলার ভুবনডাঙা শিশুর বড়ো প্রিয়!
হাসপাতালের ভেতর ঘরে একজন বয়স্ক মানুষকে দেখে ক্লোরোকুইনিন ট্যাবলেট লিখে পরের টিকিটের নাম ডাকতে যাওয়ার আগে অবিনাশের পাশে এসে দপ্তরী রতন নিচু স্বরে বলল, ‘বড়ো সাব আপনেরে ডাক দিচে!’
একটু অবাক হয়েই অবিনাশ মুখ তুলে রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখনই?’
— হাঁ। বলচেন আরজেন!
স্টেথোটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকা রোগগ্রস্ত মানুষগুলির দীর্ঘ লাইনের পানে চেয়ে অবিনাশ রতনকে শুধোল, ‘কতজন আছে রে?’
— শ’ বিশ জন!
— আরও একশো কুড়ি জন?
— আজ্ঞা!
নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কম্পাউন্ডার ভুবন বাবুর দিকে একবার চাইল অবিনাশ, ‘দশটা টিকিটের প্রেসার আর ওজন আপনি দেখে রাখুন, সুপারের সঙ্গে কথা বলে আমি এখনই ফিরে আসছি।’
সুপারের ঘরটি যথেষ্ট বড়ো, অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঠের টেবিলের ওপারে মাঝবয়সী সত্যব্রত দাম একটি সরকারি ফাইলে চোখ রেখে বসে রয়েছেন, মুখখানি যথেষ্ট গম্ভীর, পরনে দামী সাদা ফুলহাতা জামা আর টেরিকটনের পাৎলুন, পরিষ্কার কামানো মুখে ফিনফিনে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মাথাজোড়া টাক এই যেন সৌম্যদর্শন গৌরবর্ণ মানুষটিকে অধিক রূপবান করে তুলেছে। কাঠের দু-পাল্লা-আধখানা দরজায় টোকা দিয়ে অবিনাশ নম্র সুরে অনুমতি চাইল, ‘স্যর আসব?’
গলার স্বর শুনে মুখ না তুলেই সত্যব্রতবাবু বামহাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বললেন।
মাথা নিচু করে ফাইলে কিছু লিখছেন, পেছনে জানলার পাশেই একখানি শিরীষ গাছ বাতাসে ঝুমঝুম শব্দে পাতার নূপুর বাজিয়ে চলেছে, অদূরে মাঠে শিমুল তলায় সেই বালকটির খেলা এখনও সাঙ্গ হয় নাই! ঘট ঘট শব্দে পুরাতন পাখাটি মন্থর অথচ অভিজাত ভঙ্গিমায় ঘুরে চলেছে, বামদিকে বড়ো আলমারির পেছন থেকে টিকটিকি মুখ বাড়িয়ে একটি মথকে জিহ্বায় তুলে নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সে পাখা মেলে জানলার গরাদে এসে বসল-অবিনাশ দৃশ্যটির পানে চেয়ে মনে মনে মুচকি হেসে ভাবল, জীবন এমনই, শিয়রে আলুলায়িত অন্ধ কৃষ্ণকেশরাজির অন্তরালে আত্মগোপন করে থাকা মৃত্যুদেবীর সামনে বাতাস মেঘ আর রৌদ্রে-ষড়ঋতুর মোহিনী অঞ্চলছায়ায় প্রেম অভিমান অশ্রু এবং বিবাদ একইসঙ্গে দুই হাতে নিয়ে কাল-প্রাঙ্গনে সে নিশ্চিন্তে খেলা করে! তাই বোধহয় বেঁচে থাকা এত মধুর!
কয়েকটি মুহূর্ত নীরব স্রোতে বয়ে যাওয়ার পর সামান্য অধৈর্য্য হয়েই হাতঘড়িটি দেখল অবিনাশ, এগারোটা বেজে দশ মিনিট, একশো কুড়ি জন মানুষ তার আশায় সকাল থেকে বসে রয়েছে, বাধ্য হয়েই ছদ্ম মৃদু কাশির মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ধীর স্বরে অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমায় আপনি ডেকেছিলেন স্যর?’
মুখ তুলে আড়চোখে অবিনাশের দিকে তাকিয়ে সত্যব্রত পুনরায় ফাইলে চোখ নামিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হুঁ! বসো!’
— স্যর, ওদিকে আউটডোরে অনেক পেশেন্ট, আজ ড. বক্সীও ছুটি নিয়েছেন! আমি আউটডোর শেষ করে আসি?
এবার চোখ থেকে চশমা খুলে সোজা অবিনাশের চোখে দৃষ্টি রেখে শীতল গলায় বললেন, ‘আমি জানি আউটডোর রয়েছে। বসো, কথা আছে! ইটস আর্জেন্ট।’
সরকারি ফাইল পাশের দেরাজে রেখে একটি সিগারেট ধরিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ছাইদানে আধখানা সিগারেট নিভিয়ে সত্যব্রত দৃঢ় অথচ শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল বিকেলে তুমি একটা ওটি করেছিলে?’
একটু অবাক হয়েই অবিনাশ বলল, ‘হ্যাঁ, মাধব পাল, রাজমিস্ত্রি। নাভির পাশে লোহার রড ঢুকে যাচ্ছেতাই কান্ড, সেই অবস্থাতেই হাসপাতাল নিয়ে এসেছিল।’
— তারপর?
‘সাদা কাপড় বাঁধা ছিল, আর্টারি ফরসেপ্স দিয়ে কাপড় সরাতেই রক্ত বন্যা!’, একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর অবিনাশ বলল, ‘ওটিতে নিয়ে এক্সপ্লোরেটরি ল্যাপারোটমি ছাড়া উপায় ছিল না!’
— হুঁ, তা পেট কেটে কী দেখলে?
— পেরিটোনিয়াম অ্যাজ ইট ইজ, আমি বাইরের উন্ড ড্রেস করে অ্যান্টিবায়োটিক আর সিডেটিভ দিয়েছি।
আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বাঁকা সুরে সত্যব্রত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর ইউ সিওর পেরিটোনিয়াম রাপচার হয়নি?’
বিস্মিত কণ্ঠে বেজে উঠল অবিনাশ, ‘অ্যাবসোলিউটলি স্যর!’
— ইজ ইট?
সত্যব্রতের কথা শুনে এবার সামান্য অধৈর্য হয়েই অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘ইজ এনিথিং রং স্যর? হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
ক্ষীণসুরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে, টিক টিক টিক, অদূরে কোথাও একটি কোকিল ডাকল, একবার দুবার তিনবার, সেই সরীসৃপ আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে জানলার দিকে মন্থর পায়ে এগিয়ে চলেছে, চৈত্র রৌদ্রের রক্তচক্ষুর সম্মুখে জগত রক্তাল্পতায় ভোগা গর্ভবতীর মতো বিবর্ণা, নির্বিকার গলায় সত্যব্রত বললেন, ‘লোকটি সকাল দশটায় মারা গেছে!’
চেয়ার থেকে মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল অবিনাশ, ‘হোয়াট? ইমপসিবল্!’
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সত্যব্রত বললেন, ‘আমি নিজে ছিলাম তখন, পেরিটোনিয়াম রাপচার হয়েছিল অ্যান্ড নট ওনলি দ্যাট, পেটের নাড়িও ছিঁড়েছিল! তুমি কী অপারেশন করেছ, রিয়েলি আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ক্লু অবিনাশ!’
— বাট ইট ইজ ইমপসিবল্ স্যর! আমি সাতটায় রাউন্ডে এসে দেখেছি এভরিথিং ইজ অলরাইট, প্রেসার, পালস্ অ্যাবসোলিউটলি নরম্যাল! কীভাবে সম্ভব?
দু-এক মুহূর্ত অবিনাশের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন সত্যব্রত, ‘তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলছি?’
কী বলবে বুঝতে না পেরে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল অবিনাশ, তারপর দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আমি একবার ওকে দেখব, আপনিও সঙ্গে চলুন।’
— নোপ। আমি থানায় খবর দিয়েছি, ওর বাড়ির লোকও আসছে। তুমি ওসিকে বলবে, আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু এক্সেসিভ ব্লাড লসে পেশেন্ট মারা গেছে।
— কিন্তু স্যর, দ্যাট ইজ লাই, সম্পূর্ণ মিথ্যা!
অবজ্ঞার একচিলতে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল সত্যব্রতর মুখে, হাতের সিগারেট ছাইদানে নিভিয়ে বললেন, ‘দেন হোয়াট ইউ আর সাজেস্টিং? ওসিকে বলবে যে তুমি এক্সপ্লোরেটরি ল্যাপারোটমি করেও পেরিটোনিয়াম রাপচার বুঝতে পারোনি?’
মুখ নিচু করে অবিনাশ দুর্বল স্বরে বলল, ‘আমি ভুল করিনি স্যর! প্লিজ বিলিভ মি! আপনি ওটি সিস্টার মিসেস দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখুন!’
কঠিন সুরে বেজে উঠলেন সত্যব্রত, ‘লুক অবিনাশ, এনাফ ইজ এনাফ! সবার সঙ্গেই আমি কথা বলেছি, সাসপেন্ড হতে না চাইলে যা বলছি তাই করো। এন্ড প্লিজ রিমেমবার, আমাদের সবার রেপুটেশন তোমার একটা ভুলে আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। নাউ ইউ মে গো।’
সুপারের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা পার হয়ে মাঠে এসে দাঁড়াল অবিনাশ, সারি সারি মুখ চেয়ে রয়েছে তার দিকে, হয়তো ভাবছে আজ আর ডাক্তারবাবু দেখবেন না কাউকে, বারান্দার একপাশে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ মানুষের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে অবিনাশ বলল, ‘চলে যাবেন না, আমি এখনই আসছি!’
মাধব পালের আকস্মিক মৃত্যু মন ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে, একটি সিগারেট ধরিয়ে অবিনাশ ভালো করে ঘটনাটি চিন্তা করল, নাহ পেরিটোনিয়াম রাপচার হয়নি! এতবড়ো ভুল তার হতেই পারে না। মিসেস দাস সমস্ত ঘটনার সাক্ষী কিন্তু তিনিও কি সুপারকে মিথ্যা বললেন? এই ঘটনায় কার লাভ হবে? সহসা মনে ক্ষীণ সৌদামিনীর মতো সন্দেহ দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, তবে কি পুরো বিষয়টি সাজানো? কোনও পুরনো ঘুঘুর বাসায় হাত পড়েছে বলেই সকলে একজোট হয়ে তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে? শুধু তার জন্য রচিত এই ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হল একজন নিরীহ মানুষকে, মাধবের যন্ত্রণাক্লিষ্ট করুণ মুখখানি স্মৃতিপটে ভেসে উঠতেই অবিনাশ নিজেকে শুনিয়েই যেন আপনমনে বলল, ‘নাহ, পালাব না। এর শেষ দেখে ছাড়ব।’
সিগারেট নিভিয়ে আউটডোরে ফেরার পথে শিমুল তলায় বালকটিকে খেলা করতে দেখে এগিয়ে গেল অবিনাশ, চেনা মনে হচ্ছে, কাছে এসে দাঁড়াতেই বালক সজল দুধচোখ মেলে তার দিয়ে চেয়ে শুকনো পাতার মতো মলিন হাসল, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ছেলেটির নাম চন্দ্র, চন্দ্র রাজবংশী, অবিনাশও হাসিমুখে তাকে শুধোল, ‘কী রে? শরীর ভালো আছে?’
দুটি পাতা আর একখানি ভাঙা ডাল হাতে নিয়ে ধুলাপথে বসেই চন্দ্র ঘাড় কাত করে বলল, ‘হঃ!’
— মা আসেনি?
দু’জনের কথার মাঝে সবার অলক্ষে ক্ষীণকায়া জননী গাছতলা থেকে উঠে অবোধ পুত্রের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, পরনে পুরনো ছাপা শাড়ি, আধেক ঘোমটার নিচে টলটল করছে প্রদীপের মতো মুখখানি, চোখ দুটি যেন সন্ধ্যার করুণ আকাশতলে ফুটে ওঠা ম্রিয়মান নয়নতারা ফুল-একপলক তাকিয়ে অবিনাশের সহসা মনে হল বহু পুরাতন কোনও ভদ্রাসনের ভগ্নপ্রায় নির্জন পূজার ঘরের দুয়ারে স্বয়ং মলিনবসনা গৃহলক্ষ্মী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর পূজার দীপ ধূপ উপচার সমস্ত কিছু হারিয়ে গেছে কালগর্ভে, কেউ তাঁকে মনে রাখেনি, সবাই এই ভিটা ছেড়ে চলে গেছে কোনও দূর গৃহে শুধু দেবী ভদ্রাসন ত্যাগ করে এখনও চলে যান নাই, সন্ধ্যার অস্ফুট আলোয় বনকুসুমের সুবাসে থইথই কালকাসুন্দে আর কচুবনের মাঝে এই ভগ্ন দেবালয়ে নিরাভরণ রূপে আবির্ভূতা হয়েছেন, ধুলামলিন পদচিহ্নে হতভাগ্য গৃহহীন দরিদ্র মানুষের জন্য এঁকে রেখেছেন অরূপ প্রেমাখ্যান-মনে মনে সেই পরম করুণাময়ীকে প্রণাম জানিয়ে অবিনাশ নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘চন্দ্র ভালো আছে এখন? জ্বর আর আসেনি তো?’
তিরতির বারিবিন্দুর মতো চোখ দুটি নামিয়ে নিলেন জননী, হঠাৎ কী মনে হওয়ায় চন্দ্রকে কাছে টেনে বামহাতখানি কপালে রেখেই চমকে উঠল অবিনাশ, ‘এ কী! জ্বর এসেছে তো! আপনি কি ওকে দেখাতে এনেছেন?’
ম্লান কণ্ঠে তরুণী বললেন, ‘টিকট পাইনো বাবা!’
দ্রুত হাতে পালস দেখে অবিনাশ চিন্তিত গলায় বলল, ‘পথ্য ওষুধ কিছুই দেননি ওকে। এভাবে চলবে না মা, চন্দ্রকে এখনই ভর্তি করতে হবে।’
আশঙ্কার মেঘ হয়ে বেজে উঠলেন জননী, ‘আর ট্যাহা?’
— টাকা লাগবে না, সরকারি হাসপাতালে টাকা লাগে না। আসুন আমার সঙ্গে, দেখছি।
নিজের কোলের কাছে চন্দ্রকে টেনে নিয়ে তরুণী বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মু? থাকিনি পারম?’
মৃদু হাসল অবিনাশ, ‘আপনি দুবেলা এসে দেখে যাবেন। মা, চন্দ্রকে ভর্তি না করলে’, বাক্যটি সম্পূর্ণ না করে অবিনাশ প্রসঙ্গ বদলে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
নিচু হয়ে চন্দ্রের চোখের দিকে তাকাল অবিনাশ, নতুন জায়গায় থাকার কথা শুনে বালকের চোখদুটি চঞ্চল হয়ে উঠেছে, হয়তো একইসঙ্গে মায়ের জন্য মন মেঘাচ্ছন্ন, পাখির পালকের মতো মুঠোয় মায়ের আঁচলটি চেপে ধরে আছে, নরম সুরে অবিনাশ শুধোল, ‘কী রে, থাকবি তো আমাদের কাছে?’
কোনও উত্তর না দিয়ে রৌদ্রে ভেসে যাওয়া মধুবাতাসের মতো হাসল চন্দ্র।
শিমুল গাছ থেকে টুপটুপ শব্দে খসে পড়ছে জীর্ণ পাতা, বাঁশুরিয়ার করুণ সুরে বেজে উঠেছে দ্বিপ্রহর, দূরে বড়ো রাস্তার উপর দিয়ে মাঝে মাঝে শনশন বয়ে যাচ্ছে লরি বা যাত্রী বোঝাই বাস, ওপারে কতগুলি বাড়ি, বাগান, সবজি খেত তারপর খসে যাওয়া গর্ভফুলের মতো বিবর্ণ প্রান্তর, উষ্ণতায় অস্পষ্ট দিকচক্রবালরেখা, জলে আঁকা ছবি হয়ে তিরতির করে কাঁপছে অরণ্য সীমানা, কী একটি পাখি একটানা ক্লান্ত সুরে ডেকে চলেছে, বোধহয় ব্রেনফিভার, চন্দ্রের হাতটি ধরে অবিনাশের মনে হল, আরোগ্য দানের জন্য সে আজীবন লড়াই করবে! হেরে যাবে না কিছুতেই, যন্ত্রণা অপমান দারিদ্র যেমন সত্য তেমনই এই বারংবার ফিরে তাকানোও সত্য! জগত সত্যি মধুর, আমরা তাকে অসহনীয় করে তুলেছি!
চন্দ্র আর তার মা’কে নিয়ে আউটডোরের দিকে যাওয়ার পথে অবিনাশের অকারণেই ঐন্দ্রীর কথা মনে পড়ল, আগামীকাল তার জন্মদিন, ভারি মিষ্টি হয়েছে মেয়েটি! খেলনা নাকি জামা, কোনটি উপহার হিসাবে পেলে সে খুশী হবে?
সহসা চন্দ্রের দিকে তাকাতেই দেখল, জ্বরতপ্ত টলোমলো মুখখানি রৌদ্র তাপে লাল হয়ে উঠেছে, ধুলায় সর্বাঙ্গ মলিন, হাতের ক্ষুদ্র মুঠির মাঝে একগোছা শিমুল পাতা-পিতৃহীন দরিদ্র শিশুর অপরূপ খেলনা-অবিনাশের চোখদুটি সম্ভবত খর বাতাসে সজল হয়ে উঠল! এই বালকের জন্মদিন কেউ কখনও মনে রাখেনি, একটি নতুন জামার মুখ দেখেনি কতকাল, কামলা রোগে শীর্ণ চন্দ্র কতদিন বাঁচবে তাও জানে না অবিনাশ, হয়তো যকৃতের কোষগুলিও ক্লান্ত, সামান্য পথ হেঁটেই ঠোঁট ফাঁক করে শ্বাস নিচ্ছে ছেলেটি, একমুহূর্তের জন্য হাঁটা থামিয়ে চন্দ্রকে কোলে তুলে নিয়ে অবিনাশ অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তির ভঙ্গিমায় বলল, ‘কিচ্ছু হবে না, আমি আছি, তোর ভয় নেই কোনও!’
রৌদ্র বাতাস আর মধুমাসের ভুবনে হেঁটে চলেছে ক্লান্ত জননী, রোগজর্জর শিশু আর একজন দীর্ঘকায় তরুণ চিকিৎসক! চঞ্চলা কালস্রোতে এমন দৃশ্য কতবার তৈরি হয় আবার মুছেও যায় নিমেষে, আজ ভবহাটের দুয়ারে দাঁড়িয়ে প্রসন্না প্রকৃতি স্মিত হেসে হয়তো বালকটির জন্যই সহসা নিজের কাজললতার স্পর্শে আকাশ সাজিয়ে তুললেন, সহচরী বাতাসে ফুটে উঠল সহস্র পদ্মকুসুম, নিঃশব্দে মধুবাক্যরূপে অবিনাশের কণ্ঠে বিরাজ করে যেন তিনি বললেন, ‘কিচ্ছু হবে না, আমি আছি, তোর ভয় নেই কোনও!’
(ক্রমশ)