উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩৪। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

পরিচয় থেকে ক্রমে গড়ে উঠল সখ্যতা। সে চলে আসতো ইত্যাদি প্রকাশনীতে। বেরোতাম এক সঙ্গে। কিছুটা পথ একসঙ্গে হাঁটার পর সে কোথায় উধাও হয়ে যেতো। আবার দেখা হতো দুতিন দিন পর। ভালো কবিতা লিখতো। গল্পও। কবিতার প্রতি ছিল তার তীব্র ভালবাসা। তাকে তার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করলে, সযত্নে এড়িয়ে যেতো। এটুকু জেনেছিলাম, বাড়িতে তার বিধবা মা আছে। সে একমাত্র পুত্র। সাতের দশকে তরুণ গল্পকারদের মধ্যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিলেন সমীর মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন অমলের অগ্রজ। সম্ভবত খুড়তুতো-জেঠতুতো দাদা। তাকে নিয়ে অমলের বেশ গর্ব ছিল। কথায় কথায় টের পেয়েছিলাম, সংসারে তীব্র অভাব ছিল না। ওদের বাড়ি ছিল হুগলির পাণ্ডুয়া। তবে ওর ঝোঁক ছিল জ্যোতিষ চর্চার। শিল্পী মহলে বেশ জনপ্রিয় ছিল। হাতের রেখা বিচার করে ভবিষ্যত বলে দিত। প্রয়োজনে পাথর দিত। এটা ওর ব্যবসাই ছিল বলা চলে। পাথর সরকারি পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে তার শংসাপত্র দিয়ে দিতো। এই নিয়ে নানা গল্প ছিল তার কাছে। একবার এক তরুণ শিল্পীর দাম্পত্য-অশান্তি চলছিল বেশ কিছুদিন। তিনি অমলকে বোধহয় বিধানের নিমিত্ত অনুরোধ করেন। অমল সেই শিল্পীর উত্তর কলকাতার বাড়িতে গিয়ে দুজনের সঙ্গে কথা বলে পাথরের নিদান দেন। শুনেছিলাম, তাদের গৃহশান্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই সেই শিল্পী অকস্মাৎ মারা গেলেন। ভরাট কণ্ঠের অধিকারী, আকাশবাণীর নাটক, বিশেষ করে বিজ্ঞাপনী নাটকে তার কণ্ঠ হারিয়ে গেল। চলচ্চিত্রেও তিনি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতেন। এ নিয়ে অমলকে প্রশ্ন করলে সে এড়িয়ে যেতো।

‘উত্তরণ’ নামে একটা ছোট পত্রিকা বের করতো সে। প্রতিষ্ঠিত ও বাজারি লেখকদের সঙ্গে তার সুপরিচয় থাকা সত্ত্বেও, তাদের কোনও লেখা সে ছাপত না। অপেক্ষাকৃত কম নামী এবং অপরিচিত লেখকদের লেখাই সে ছাপতো। ওর অনুরোধে বেশ কিছু গল্প আর মুক্তগদ্য আমিও লিখেছি। পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতো সে। তাতে সে পত্রিকার খরচ তুলে নিতো।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বিনোদন পত্রিকা হিসাবে ‘ঘরোয়া’ বেশ নাম করেছিল। তখন তো বেশ কিছু বিনোদন পত্রিকা বের হতো, যাদের সাহিত্যমূল্যও কম ছিল না। প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ উভয় দলের অনেক উজ্জ্বল উপন্যাস বা গল্প পেয়েছি প্রসাদ, উল্টোরথ, নবকল্লোল বা ঘরোয়া-তে। এগুলোই ছিল নিয়মিত এবং মাসিক পত্রিকা। এছাড়া মৌসুমী, উত্তম, রূপমঞ্জরী এইসব নামের পত্রিকাও বেরিয়েছিল ষাটের দশকে, যা স্থায়ী হয়নি। তা সেই ‘ঘরোয়া’ পত্রিকা বের করতেন বীরেন সিমলাই। মধ্য কলকাতায় তালতলা অঞ্চলে তার ছোট্ট অফিস। সেখানেই আসতেন সেকালের বিখ্যাত লোকরা। সাতের দশকের শেষ দিকে ‘ঘরোয়া’ সাময়িক বন্ধ হয়ে গেল বীরেন বাবুর অসুস্থতার কারণে। বৃদ্ধ বয়সে আর টানতে পারছিলেন না। আটের দশকে ‘ঘরোয়া’ সম্পাদনার দায়িত্ব পেলেন কবি শান্তনু দাস। সম্পাদকের নাম থাকতো বীরেন সিমলাই। শান্তনুবাবু বকলমে সম্পাদনা করতেন। তখন তিনি দুই ভাবে খ্যাত। এক, কবি দীনেশ দাশের পুত্র, দুই, ‘গঙ্গোত্রী’ নামে একটি উচ্চবর্গের লিটল ম্যাগাজিন করতেন। কত তরুণ কবির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ওই পত্রিকায়। ‘গঙ্গোত্রী’ ঘিরে বেশ একটা উন্মাদনা ছিল তরুণ কবি মহলে। তাছাড়া শান্তনু নিজেও তো কবিতা লিখতেন নিয়মিত। ছিল বেশ কিছু কবিতার বই। নিয়মিত চাকরি করতেন না। শুনেছি ওর স্ত্রী অভিনয় করতেন পেশাদারী মঞ্চে। সেটাই সংসারে কাজে লাগতো। আর ছিল কবি পিতা দীনেশ দাসের রোজগার।

অনেক কবি ভালো সম্পাদক হন, কিন্তু সব কবি নন। শান্তনু ভালো লিটল ম্যাগাজিন করতেন, কিন্তু বিনোদন পত্রিকা নয়। ফলে যা হবার তাই হল। বীরেন সিমলাইয়ের প্রচুর টাকা ক্ষতি হল। তিনি পত্রিকা বন্ধ করে দিলেন। তার নিজের পক্ষে আর পত্রিকা করার মতো শক্তি ছিল না। তিনি পত্রিকা বিক্রি করে দিতে মনস্থ করলেন। হঠাৎই একদিন অমলের সঙ্গে দেখা। তখন সে বেশ অনিয়মিত আমাদের সঙ্গে। জানালো সে ‘ঘরোয়া’ সম্পাদনা করছে। এক বিকেলে গেলাম ওর অফিসে। জানলাম রবি রায় নামে একজন পত্রিকা কিনে নিয়েছেন। অফিস ঘরটা ভাড়া দিয়েছেন বীরেন বাবু। অমল চেষ্টা করেছিল পুরনো চেহারায় ‘ঘরোয়া’-কে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আটের দশক থেকেই তো মানুষের রুচি বদলাতে শুরু করেছে। একচ্ছত্র আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠান বিনোদন পত্রিকার সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছিল। মানুষের রুচির উপরেও প্রভাব বিস্তার করছিল, ফলে অমল সীমিত অর্থ সামর্থে পেরে উঠল না। স্বাভাবিক ভাবেই একদিন ‘ঘরোয়া’ বন্ধ হয়ে গেল। অমল আবার বেপাত্তা। মাঝে মাঝে উদয় হয় ‘উত্তরণ’ নিয়ে। আবার ডুব দেয় শুশুকের মতো। তারপর একদিন এসে বলল, নতুন পত্রিকা বের করেছে। পাক্ষিক। সংবাদ নিবন্ধের কাগজ। সঙ্গে গল্প আর বিনোদন। যাকে পাঁচমিশালি বা পাঁচফোড়ন পত্রিকা বলা যায়। মধ্য কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে পানবাগানে অফিস, মানে পত্রিকা দপ্তর। বিকালে দপ্তর খোলে। সারাদিন সম্পাদকীয় দপ্তর চালায় পথে পথে। এক সন্ধ্যায় গেলাম। পরিচিত হলাম ওর বন্ধু সমর বন্দ্যোপাধ্যায়র সঙ্গে। একদিন নিরালা আলাপচারিতায় জেনেছিলাম, সমর বেশ কিছু অর্থ  লগ্নি করেছে। অমলও কিছু বিনিয়োগ করেছে মায়ের অলঙ্কার বন্ধক দিয়ে। প্রতিসন্ধ্যা বেশ গমগম করতো ওর দপ্তর। আসতেন কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক, বিভিন্ন কাগজে কাজ করতেন এবং বেনামে অমলের পত্রিকায় লিখতেন কয়েকজন (যার মধ্যে এই উড়নচণ্ডীও ছিল), বিজ্ঞাপন সংগ্রাহকরা। একপাশে রতন নামে এক শিল্পী পত্রিকার অঙ্গসজ্জা করতেন। তিনি ‘বর্তমান’ কাগজে কাজ করতেন, এখানে বে-পরিচয়ে ছবি আঁকতেন, পত্রিকার অঙ্গসজ্জা করতেন। অবশ্য অমল নিজেও প্রচুর বিজ্ঞাপন জোগাড় করতো। সে সব ছিল বিভিন্ন জ্যোতিষী আর গ্রহ-রত্নের দোকানের। এদের সঙ্গে তার বেশ গভীর পরিচয় ছিল।

বেশ চলছিল পত্রিকাটি। বোধহয় খান দু-তিনেক গল্পও লিখেছিলাম। যৎসামান্য অর্থপ্রাপ্তিও ঘটেছিল। অমল চেষ্টা করতো সকল লেখককে সামান্য হলেও সম্মানদক্ষিনা দেওয়ার। ও বলতো, আমি তো তোদের লেখা নিয়ে ব্যবসা করছি। লেখকদের যদি যাতায়াতের খরচটাও না দিতে পারি। ভালো লেখা পাবো কি করে?

কথা বেশ মনে লেগেছিল। এমনভাবে কজন ভাবে! সৎভাবে ব্যবসা করতো চেয়েছিল সে। কিন্তু পারলেন না। সঞ্জয়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন অসন্তোষ হল। সে তার পুঁজি নিয়ে বেরিয়ে এলো। সঞ্জয় একাই পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক হয়ে বসলো। সে বেশ কিছুদিন পত্রিকা চালালো। কিন্তু অচিরেই বিজ্ঞাপন সংগ্রাহকরা মরে গেল। শুনেছিলাম তারা তাদের বকেয়া অর্থ পাচ্ছে না। যে সব সাংবাদিকরা অমলের জন্য লিখবে এসেছিলেন, অমল চলে যাওয়াতে তারাও আর লেখা দিলে না। চিত্রশিল্পী রতনও অনুপস্থিত হলো। ক্রমশ পত্রিকার ক্ষয় রোগ ধরল। অমলের যে সমন্বয়-জাল ছিল, সঞ্জয়ের তা ছিল না। ফলে অর্থ থাকলেও সে পত্রিকা চালাতে পারলো না। অচিরেই বন্ধ করে দিতে হল। রতন ওই ঘর থেকেই নিজে একটা পত্রিকা শুরু করলো। কিন্তু সেও পরাজিত হল।

অমল কিন্তু বসে ছিল না। সে বোধ হয় ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। বেশ কয়েকবছর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। জীবিকার তাগিদে আমার পথ অদল-বদল হয়ে যাওয়ার ফলে, অথবা কাগজের কাগজে নির্দিষ্ট ব্যস্ততার কারণে প্রকৃত অর্থেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। এমনই এক ব্যস্ততার দিনে গণশক্তিতে বন্ধু সমীরণ মুখোপাধ্যায় জানালো, অমল ‘ভালবাসার দুই দিগন্ত’ নামে নিয়মিত কবিতা সংকলন বের করছে। বটবাজারে অফিস নিয়েছে। শুনে বেশ ভালো লেগেছিল। যাক, অমল তাহলে হারেনি।

তারও কিছুদিন পর অমলের সঙ্গে দেখা। অনুযোগ করলো, তোর দেখা পাচ্ছি না কেন? তারপর ঝোলা থেকে একখণ্ড বই বের করে বলল, পত্রিকা নয়, বাঁধানো বই আকারে করছি। শুধু কবিতা। বাংলাদেশে ভালো বিক্রি হচ্ছে।

দেখলাম বইয়ের মধ্যে বেশ কয়েক পাতা বিজ্ঞাপন। জিজ্ঞাসা করলাম, বইয়ে বিজ্ঞাপন কেন?

ও হেসে বলল, আসলে এটা পত্রিকা। বইয়ের মতো করছি। বছরে দুবার বের হয়। লেখা দিবি।

বোধ হয় কয়েক সংখ্যায় লিখেওছিলাম। একবার মহালয়ার সন্ধ্যায় কবি সমাবেশ করলো কবি মৃত্যুঞ্জয় সেনের বাড়ির ছাদে। ভালো খাইয়েছিল। বেশ চলছিল, ‘ভালবাসার দুই দিগন্ত’ চালাচ্ছিল মন দিয়ে। ততদিনে সে বিয়ে করেছে। এক কন্যার জনক। ফলে একটা চাপ ছিলই। সংসারের চাপ, পত্রিকার চাপের বাইরে আর কোনও চাপ ছিল কি? জানা নেই। অকস্মাৎ আত্মহনন অনেক কথা বাতাসে মিলিয়ে দিয়েছে। আজও মনে হয় অমল সত্যিই রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *