সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৭। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

কালিম্পং শহরপত্তন: গীর্জা ও মিশন

পড়তে পড়তে মনে হলো, কালিম্পং-এর চড়াই বেয়ে বাসে গাড়িতে উঠতে উঠতে এ ছবি কতবার দেখেছি। পাহাড়ের বাঁকে, মোড় ঘুরলেই লম্বাটে পাহাড়ি গিরিশিরা, তার ওপরে, গায়ে বনজঙ্গল গাছপালা সবুজ পিন্ড হয়ে আছে, ডানদিকের বাঁদিকের পাহাড়েও তাই, তবে সেগুলো আরো উঁচু। তবে কিনা যত্ন করে না রাখলে কোন ছবিই তো আর একরকম থাকে না, তার গায়ে ময়লা পড়ে, রঙ চটে, ছোপ ছোপ দাগ ধরে। সেইরকম, শ দেড়েক বছর আগেকার কালিম্পং-এর ছবিটাও বদলেছে। দেয়লো থেকে দূরবীন অবধি মূল গিরিশিরায়, গাছপালা বনজঙ্গল নয়, অসংখ্য অগুন্তি বাক্সমতো বাড়ি গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের মাথায় মাথায় এদিক ওদিক গাছ কিছু আছে বটে, তবে বাড়িটাড়িই  বেশি। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে আসিযাই, দেখি, গাছ কমে বাড়ি বাড়ে।

বাড়ি বাড়ে এবং বদলায়। তিস্তা উপত্যকা থেকে কালিম্পং-এর চড়াইশুরুর যে জায়গাটাকে এখন ডাকা হয় চিত্রে(নেপালিতে চিত্রে মানে বাঁশের বেড়া) বলে, সেখান থেকে কালিম্পং অবধি পুরো ৯ মাইল বা চোদ্দ কিলোমিটার পথের প্রথম কয়েক মাইলের জঙ্গল এলাকা বাদ দিলে, বাকিটা জুড়ে হোটেল হোমস্টে-র নামে পাকা ও উঁচু বাক্সবাড়ি উঠছেই,  পুরোনো বসতবাড়ি ভেঙে, ক্ষেতের মধ্যিখানে, ঘাসে ভরা সবুজ পাহাড়ি ঢাল কেটে দুরমুশ করে। এ সব এলাকায়, লেপচাদের বহু দিনের বাস। কাঠের খাঁচায় বাঁশের বেড়া বসিয়ে তার ওপরে মাটি কি সিমেন্টের গোলায় বালি মিশিয়ে ঢাকাঢুকি দিয়ে বানানো টিনের ছাদওয়ালা যে সব ছোট বড় একতলা, কখনো সখনো দোতলা বাড়িগুলো রাস্তার ধারে পাহাড়ের গায়ে বসানো থাকতো, সেই সব রঙীন নরমসরম বাড়িরা উবে যাচ্ছে ক্রমাগত। উবে, বা ঢেকে যাচ্ছে শহরের আশপাশের পুরোনো সায়েবি বাড়িগুলোও। ৫ বা ৭ মাইল থেকে(এদিককার বহু পাহাড়ি পথের মত, তিস্তা থেকে আলগাড়া পর্যন্ত বিশ মাইল বা ৩২ কিমি পথের জায়গাগুলোর নাম মাইল ধরে ধরে।) পথের বাঁ পাশে প্রায় নিশ্ছিদ্র বাড়ির দেয়াল। সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাও, বাড়ির পর বাড়ির পর বাড়ি, ঢাল বেয়ে নেমে আসছে, ঝুলে আছে। খুব ঠাওর করে দেখলে হয়তো পুরোনো গীর্জার চুড়োটা দেখা যায়, বাকিটা বাক্সঠাসা ঘিঞ্জি শহর, চৌকোনো মলবাজার, ইয়াব্বড় সব ইস্কুলবাড়ি(কালিম্পং-এ শিক্ষাবাজারটি চনমনে), সেইসঙ্গে হোটেল, হোটেল এবং হোটেল। ভিড় ঠেলে বাজারের বড় রাস্তা ধরে এগুলে খাড়া সরু চড়াই উঠে গেছে গীর্জার দিকে। ম্যাকফারলেন সায়েবের নামের এই গীর্জা ওই অঞ্চলের আদি উপাসনাগৃহ নয়। মাথার শিরা ছিঁড়ে ঘুমের মধ্যে মারা যাচ্ছেন ম্যাকফারলেন,  ১৮৮৭-তে। গ্রাহাম দম্পতি এসে কালিম্পং-এ ডেরা বাঁধছেন ১৮৮৯-তে। কালিমপং গীর্জার দায়িত্ব যখন গ্রাহাম সায়েবের ওপর তুলে দেওয়া হচ্ছে তখনো গীর্জাবাড়ি তৈরিই হয়নি। গ্রাহাম সায়েবের প্রথম কাজ হলো বাড়ি বানানো। যে সে যেমন তেমন বাড়ি নয়, এমন কিছু যা দেখে তাক লেগে যায়, আশপাশের দশ গাঁয়ের নেটিভ হিদেনরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চোখ তুলে দেখে, দেখে দলে দলে ঈশ্বরের শরণ নেয়। কালিমপং পাহাড়ে পাদ্রিবাবাদের কাজ নিয়ে বিশদে আরো বলা যাবে। আপাতত কালিমপং গীর্জার ইতিবৃত্তান্ত।

গ্রাহামের জীবনীকার জেমস আর মিন্টো বলছেন, স্থানীয় উপাদান দিয়ে, দেশজ স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী একটা ছোটখাটো কিছু তৈরির কথা ভাবা হলোই না। আশপাশের বনজঙ্গল পাহাড়ের সঙ্গে মানানসই আটপৌরে বাড়ি না বানিয়ে ভাবা হলো পশ্চিম উরোপের বিশাল গীর্জাগুলোর কথা। এডিনবরা থেকে ১৯৭৪-এ প্রকাশিত কালিম্পং-এর গ্রাহাম(গ্রাহাম অব কালিম্পং) বইতে মিন্টো মন্তব্য করছেন, ‘গীর্জা বলতেই এমন একটা কিছু, যা যত বড়, যত জমকালো হয় তত ভালো…হুবহু উরোপের গীর্জার মতো, অন্তত যতটা ওইরকম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব। গীর্জা যত গথিক গোছের দেখতে হবে, তত লোকে ধন্য ধন্য করবে।’ পাহাড়ের গরীব চাষীদের কাছ থেকে এমন বাড়ি তৈরির খরচা ওঠানো সম্ভব নয়, ফলে তরুণ গ্রাহাম কোমর কষে নেমে পড়লেন টাকা ওঠাতে। কালিম্পং গীর্জার জন্য টাকা উঠতে থাকলো কলকাতা, বোম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, দার্জিলিং থেকে। স্কটদেশ থেকে তো বটেই। টাকা তোলার জন্য পেশাদার এজেন্ট লাগিয়ে দেওয়া হলো। ওদিকে কালিম্পং মিশনের কর্তা, গ্রাহামের ওপরালা সাদারল্যান্ড সাহেব একটা লাগসই জায়গা বেছে ফেললেন, কালিম্পং গিরিশিরা থেকে যে পাঁচটা উপত্যকা পাঁচদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তার যে কোনটা থেকেই যাতে দৃশ্যমান হতে পারে নতুন গীর্জা। মিন্টো বলছেন, গীর্জা মানে যীশুর ঐশী শক্তি, মিশনের সাফল্য, খ্রীষ্ট ধর্ম অনুসারীদের গর্ব। ছোটখাটো সাদামাটা বাড়ি নয়, বিশাল এলাহী ব্যাপার, রীতিমতো শ পাঁচেক লোক বসতে পারে।

এডিনবরা থেকে ১৯০০ সালে ছাপা স্কটদেশীয় গীর্জার বিদেশি মিশনের ইতিহাস(হিস্ট্রি অব দি ফরেন মিশনস অব দি চার্চ অব স্কটল্যান্ড) বই থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৯২ সালের ১লা নভেম্বর ম্যাকফারলেন গীর্জা উপাসনার জন্য খুলে দেওয়া হয়। ৭০০ খৃষ্টান জড়ো হয়েছিলেন, ১৩৪ জন ধর্মান্তরিতকে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিলো। দশটি স্থানীয় ভাষায় গসপেল অর্থাৎ খ্রীষ্টবাণী লেখা হয়েছিলো।

গুগল বই থেকে পাওয়া যে সংস্করণটি আমি দেখছি, তাতে সেই প্রথম বাড়িটার একটা সাদা কালো ছবি দেওয়া আছে। লম্বা ঘন্টাঘরের সঙ্গে গীর্জার বাড়ি, আকাশে হাল্কা ও ঘন পেঁজা মেঘ। ১৮৯২ মানে কালিম্পংপত্তনের আদিকাল, শহর বলতে গীর্জার নিচে একফালি পথ, নোংরা বাজার, একটা পাকা বাড়িও নেই। পুরোনো বাজার ও গীর্জার সেই ছবি গ্রাহামের বইতে তো আছেই, কালিমপং শহরের ছোট বড় হোটেলের দেয়ালেও তার প্রতিচ্ছবি টাঙানো।

সেই থেকে কত দিন গেলো। ছোট বাজার বড় হলো, কাঠের মাটির বাঁশের বাড়ি পাকা হলো, একে একে আস্তে আস্তে যাবতীয় সায়েবমেম পাহাড় ছেড়ে চলে গেলেন, পাহাড়ের আদি বনজঙ্গল হাসিল হলো, অন্যদিকে ন্যাড়া পাহাড়ে সায়েবদের লাগানো গাছ বড় হয়ে মহীরুহের চেহারা নিলো। বাজারের বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে,  খাড়া সরু চড়াই বেয়ে গীর্জার দিকে গেলে দু চারটে মলিন পুরোনো বাড়ি দেখা যায়। ২০১১-র ভূমিকম্পে গীর্জাবাড়ির চুড়ো ভেঙে যায়, পুরো বাড়িটার গায়ে আড়াআড়ি ফাটল ধরে। সারিয়েসুরিয়ে রাখা হয়েছে এখন, রঙ করাও হয়েছে। গীর্জার আঙিনা থেকে এখনো গাছে ঢাকা দূরের পাহাড় দেখা যায়, গীর্জার চুড়োর ওপরের আকাশ, আকাশে মেঘ। গীর্জার ভিতরে দীর্ঘ উঁচু উপাসনাঘর, তার দেয়ালে রেওয়াজমাফিক মৃত সাহেবদের নাম লেখা, দশ ভাষায় লেখা খৃষ্টবাণী। রবিবার, অন্য বিশেষ দিনে শহরের খৃষ্টানরা জড়ো হন, ঘণ্টা বাজে, সমবেত প্রার্থনাসংগীত গাওয়া হয়, সেই ধ্বনি পাহাড়ে ছড়ায়। মুহূর্তের জন্য বিভ্রম হয়, কোন সময়ে আছি, কোন কালিম্পং-এ?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *