উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩২। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

রণজিৎদার সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ কৃষ্ণনগরের ভূমিতেই। নির্মাল্যদার স্মৃতিসভায়। সেদিন ছিল নিয়মভঙ্গ। আগের দিন ছিল শ্রাদ্ধবাসর। আমরা বেশ কয়েকজন জমায়েত হয়েছি জজ কোর্টের মোড়ে। ১৯৮৩ সাল। সম্ভবত মার্চ মাস। সম্ভবত কারণ সে সময় বেশ গরম ছিল, কিন্তু তীব্রতা ছিল না। বোধহয় আমরা অপেক্ষা করছিলাম আরও কেউ কেউ আসবে বলে। গৌতম মুখোপাধ্যায় এলো সঙ্গে একজনকে নিয়ে। পরনে পাজামা পাঞ্জাবf। মাথার চুল সাদা, দাড়ি-গোঁফে মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত। তার ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে গোটা গোটা দুটি গাভীর মতো জলচক্ষু। আমাদের সামনে এসে ছড়িয়ে দিলেন বিষাদচক্ষু। গৌতম জানালো, পোস্ট অফিসের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গৌতম কৌতূহলী হয়ে সামনে যেতেই তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। চিনতে পারে গৌতম। জানতে পারে তিনি শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে এসেছেন। গৌতম জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পারছিস?

আমরা উসখুস করতেই গৌতম বলল, রণজিৎ শিকদার।

সমস্বরে হই হই করে উঠলাম আমরা। তিনি বললেন, ও বাড়িতে কী করে যাব বলতো? যাওয়া যায়।

গৌতম বলল, আমি ওঁকে নিয়ে এগোচ্ছি তোরা আয়।

আমরা গিয়ে দেখি রণজিৎদার তত্ত্বাবধান করছে গৌতম আর বিষ্ণু। বিষ্ণু তখনও বোধ হয় নির্মাল্যদার জামাই হয়নি অথবা হয়ে গিয়েছে, ঠিক স্মরণে নেই।

নির্মাল্যদার বাড়িতে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আমরা চলে এলাম টাউন হলের মাঠে। বিকালে শুরু হল স্মরণসভা। এই স্মরণসভার মূল সংগঠক ছিল গৌতম মুখোপাধ্যায়। বেশ লোক হয়েছিল। সকলের সম্মতিতে রণজিৎদাকে করা হল সভাপতি। কৃষ্ণনগরের প্রায় সব কবি সাহিত্যিক-শিল্পীরা যোগ দিয়েছিলেন। সন্ধ্যের আগেই সভা শেষ করে রণজিৎদাকে কলকাতায় ফেরার ট্রেন ধরিয়ে দেওয়া হল।

তারপর অনেকটা দিন গড়িয়ে গেছে, বাংলার মাটির ওপর দিয়ে। আমিও থিতু হয়েছি কলকাতায় ইত্যাদি প্রকাশনীর চাকরিসূত্রে। আটের দশকের শেষ দিক। কারো সঙ্গে দেখা করার জন্য সেন্ট্রাল কফি হাউসে গিয়েছিলাম। দেখি অবাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে গভীর আলাপনে ব্যস্ত রণজিৎদা। কৃষ্ণনগরে শেষ দেখার সময় তার সে রূপ দেখেছিলাম, তা একটুও বদলায়নি। আমি সোজা গিয়ে সামনে। চোখ তুলে তাকালেন, চিনতে পারলেন না। পরিচয় দিলাম। হেসে বললেন, বস।

সব খোঁজ খবর নিয়ে বললেন, আমি রোজই আসি। চলে আসিস। তারপর মাঝে মধ্যেই যেতাম। দেখে কী অসম্ভব দারিদ্র্যের মধ্যে একটা মানুষ নির্বিকার থাকতে পারেন। ক্রমশ জেনেছিলাম, তিনি কন্যার বিবাহ দিয়েছেন। সে এখন ভিন প্রদেশী। স্ত্রী অসুস্থ। প্রায় চলচ্ছক্তিহীন। রণজিৎদা গৃহস্থালির কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়েন ঝোলা কাঁধে। প্রতিদিন অন্ন জোটাতে হয় প্রায় ভিক্ষা করে। কিন্তু এই দারিদ্র্যকে লুকিয়ে রাখতেন পাঞ্জাবির ভিতর বুকের খাঁজায়। সাবধানী ছিলেন, যেন সে কখনো কঁকিয়ে না ওঠে। বাইরে ব্যবহার ছিল বাদশার মতো। কফি হাউসে বেশ কিছু গুণগ্রাহী ছিল তার। তারাই রণজিৎদার চাকাটাকে গড়িয়ে দিচ্ছিল। কয়েকজন অবাঙালি ব্যবসায়ীকে পরামর্শ দিতেন এবং পরিবর্তে পকেটে কিছু রেস্ত আসতো। বিকেলের দিকে কাউকে হয়তো বললেন, আমাকে একটা রুটি এনে দাও তো।

বলতেন, তোর বৌদি গ্রেট ইস্টর্নের রুটি ছাড়া খেতে পারে না। আর তো কিছু দিতে পারি না। এটাই দিই। গ্রেট ইর্স্টান হোটেল আর বেকারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছিলেন। স্ত্রীকে তিনি প্রচণ্ড ভালবাসতেন। যেমন ভালবাসতেন টালা পার্কের বাড়ি। পারিবারিক কারণে মাঝে মাঝেই বিরক্ত হতেন। অনেকেই বলতেন তার অংশটুকু বিক্রি করে দেওয়ার। তিনি রাজি হতেন না। বলতেন তার বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান, তার যৌবনকালের স্মৃতি আঁকড়ে আমৃত্যু পড়ে থাকতেন। শত দুঃখ-বেদনার মধ্যেও থাকতেন।

এতো দুঃখ-দারিদ্রদীর্ণ সময়ের মধ্যে প্রতিদিন নতুন আশা নিয়ে বেঁচে উঠতেন বৃদ্ধ বয়সেও। একদিন বলেছিলেন, তিনি এক লগ্নিকারী পেয়েছেন, একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র করবেন। কাঁধের ঝুলিতে ছিল পত্রিকার পরিকল্পনা আর লেখক তালিকা। কিন্তু সেটাও হয়নি। এক বিকেলে হতাশ কণ্ঠে বললেন, হলো না বুঝলি। ওরা যেভাবে চাই ওভাবে কাগজ করা সম্ভব নয়। রণজিৎদা চেয়েছিলেন সংবাদ বিশ্লেষণমূলক পত্রিকা। সঙ্গে গল্প ও নিবন্ধ থাকবে। থাকবে বিদেশের খবর। কিন্তু লগ্নিকারী চেয়েছিলেন শুধুমাত্র হালকা বিনোদনমূলক কাগজ। সেদিন অনুভব করেছিলাম, তার ভিতর শুদ্ধতার চোরাবাসভূমি।

স্ত্রীর প্রতি অসীম প্রেম টের পেয়েছিলাম আরও এক সন্ধ্যায়। তার অন্যতম বিলাসিতা ছিল দেশি মদ্যপান। কলেজ স্ট্রীটের রাস্তায় কোনও ঠেকে মদ্যপান করে ফিরছেন, দেখা হতেই কেঁদে ফেললেন। মদ্যপানের পর এরকম কাঁদতে দেখেছি নির্মাল্যদাকে। ফলে মজাই পাচ্ছিলাম। কিন্তু তারপরের বাক্যটা আমার বুকে পাথর ছুঁড়ে মারল। রণজিৎদা ভিক্ষাপ্রার্থী হয়ে বললেন, তোর কাছে কিছু টাকা হবে বউয়ের ওষুধ কিনব।

একজন ঋজু মানুষকে এভাবে নুইয়ে পড়তে দেখে আমার লুকিয়ে থাকা আবেগ কথা বলে উঠল। আমার পকেটে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল খুব বেশি নয়, তা থেকেই কিছুটা দিলাম। রণজিৎদা হাঁটতে শুরু করলেন। একজন ঝুঁকে পড়া মানুষ ক্রমশ কলেজস্ট্রিটের সারি সারি মাথার ভিতর মিলিয়ে গেলেন।

কাল ক্রমশ এগিয়ে চলছিল। আমিও বৃত্ত থেকে বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে ঠাঁয় করেছি একটি সদ্য প্রকাশিত দৈনিকে। কাজ সিনেমার পাতায় লেখালেখি। ফলে স্টুডিও পাড়ায় আবার মাঝে মধ্যে যাতায়াত। কাজের মধ্যে ছিল বিশেষ কিছু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, আর চিত্রসমালোচনা। তবুও যেতে হতো স্টুডিও পাড়ায়। একদিন টেকনিসিয়ান স্টুডিওতে ঢুকছি, দেখি রণজিৎদা দাঁড়িয়ে। আমি অবাক চোখে প্রশ্ন করলাম, আপনি?

-পয়সাকড়ি দিয়েছে?

ম্নান কণ্ঠে উত্তর দিলেন, অল্প কিছু দিয়েছে। আজ দেবার কথা আছে। পরিচালকের ঘরের সামনে গিয়ে দেখি নতুন পরিচালক। কয়েকটি অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গুলতানি মারছে। রণজিৎদা বাইরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। খুব খারাপ লাগল। বললাম, চলুন, পরিচালকের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।

রণজিৎদা নিয়ে গেলেন। কাগজের লোক শুনে পরিচালক একটু চুপসে গেলেন। একথা-সেকথার পর বললাম, রণজিৎদার টাকাটা আজই মিটিয়ে দেবেন। নাহলে কিন্তু খবর হয়ে যাবে। সরকারের কানে উঠলে কিন্তু বিপদ হতে পারে।

এসব কথা শুনে পরিচালক আমতা আমতা করে বললেন, আজই দিয়ে দেব।

প্রায় মাস খানেক পরে একদিন স্টুডিওতে ঢুকে কী মনে হতেই সেই পরিচালকের ঘরের সামনে গিয়ে দেখি ঘর বন্ধ। খোঁজ করতেই জানা গেল বেশ কিছু অভিনয়-প্রত্যাশী ছেলে-মেয়ের কাজ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে চম্পট দিয়েছে। বুঝলাম রণজিৎদাকেও পথে বসিয়েছে তার সরলতার সুযোগ নিয়ে।

তবে সিনেমার ভূতটা রণজিৎদার ঘাড় থেকে নামেনি। মাঝে মাঝে মধ্য কলকাতার কফি হাউসে যাই দুপুরের দিকে। একদিন ঝোলা থেকে একটা পুরনো শিলাদিত্য পত্রিকা বের করে বললেন, এটা রাখ। বলছি।

রণজিৎদা এমন আচরণে অবাক হবার কিছু নেই। বুঝলাম মাথায় নিশ্চয় নতুন পোকা ঢুকেছে। আমি কোনও কথা না বলে আমার ঝোলায় পত্রিকাটা চালান করে দিলাম। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আমার উপন্যাসটা পড়। একটা চিত্রনাট্য লেখ। একজন একটা ছবি করবে।

বললাম, চিত্রনাট্য লিখতে পারি। টুকরো টুকরো করে লিখব। যেদিন পড়ব, সেদিন টাকা দিতে হবে। টাকা দেওয়া বন্ধ হলে চিত্রনাট্যও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আগে এগ্রিমেন্ট করতে হবে।

চুপ করে শুনলেন রণজিৎদা। উপন্যাসটা পড়লাম। এক হতদরিদ্র মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। সিনেমা করার সমস্ত উপাদান আছে। বেশ কিছুদিন পর তিনি এক রবিবার রাজাবাজারে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আলাপ হল এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে। তিনিই প্রযোজক, তিনিই পরিচালক। রণজিৎদা পরামর্শদাতা। দেখলাম সরকারি কাগজে চুক্তিপত্র তৈরি করে আনা হয়েছে। সই সাবুদ করার পর কিছু অর্থ প্রাপ্তিও হল। শুরু হল চিত্রনাট্য লেখা। অল্প লিখি। পড়া হয়। আবার লিখি, আবার পড়া হয়। এভাবেই চলছিল। খুব সামান্য হলেও কিছু কিছু অর্থ হাতে গুঁজে দিলেন। তবে তিনি সরাসরি দিতেন না। রণজিৎদার হাত মারফৎ দিতেন। এভাবে মাস তিনেক চলার পর, জানলাম তাদের কি একটা পারিবারিক ঝামেলার জন্য প্রকল্প বন্ধ রাখতে হয়েছে। সম্ভবত ভ্রাতৃবিবাদ বা ওই ধরনের কিছু। মূলত সম্পত্তি নিয়েই গোলযোগ। চিত্রনাট্য লেখাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরিচালক যুবক, ও হ্যাঁ ওর নাম ছিল ওয়াজেদ। ওর হাতে চিত্রনাট্যের পাতাগুলো দিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য কিছু টাকা তখনও বাকি ছিল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *