উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩১। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের মেধা এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যান। অনেক সময় প্রশ্ন জেগেছে মনে, এরা হারিয়ে যান, নাকি হারিয়ে যেতে চান। অনেকে বলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত। আমি জ্যোতিষী নই, ভাগ্যকে দেখিনি কোনওদিন, সুতরাং বলতে পারব না। কেউ বলেন কর্মফল। তারা গীতায় লিখিত শ্রীকৃষ্ণের বাণীর কথা বলেন। আমি তো বলি, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ফলের কথা ভেবো না কর্ম করে যাও। মা ফলেষু কদাচন। তা কর্ম তো করে গেল সারাজীবন, ফল তো পেল না। সারা জীবন হেরো হয়েই থেকে গেল। আবার এক খ্রিস্টান পাদরি বলতেন, পাপ তাকে পরাজিত করেছে। শয়তানের প্রবল প্রতাপের করায়ত্ব সে। মনে পড়ল প্রাচীন খ্রিস্টানরা অনুশোচনা করে প্রার্থনা করতেন, ‘নিজেরই দোষে, নিজেরই দোষে গুরতর পাপ করেছি। প্রভু আমাকে এই পাপ-অপরাধ থেকে ক্ষমা কর’। বুকে আঘাত করতে করতে এই প্রার্থনা উচ্চারণ করতেন। এখনও ক্যাথলিক গির্জায় এই প্রার্থনা মাঝে মধ্যে হয়। কিন্তু তাতেও দিন বদল হয়? এমন উদাহরণ তো চোখে পড়েনি।

সেদিন একজন বললেন, আসলে লেগে থাকেনি। লেগে থেকেও যে লগি পায়নি তার উদাহরণ তো রণজিতদা। রণজিৎ সিকদার। যারা প্রাচীন তারা কেউ কেউ মনে করতে পারবেন, যারা নবীন তাদের সীমানার বাইরে তিনি। আমি লেখকদের কথা বলছি। গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত প্রবলভাবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। সাহিত্যের প্রধানতম গতিপথে থেকেও ছিলেন না। নিজেই অন্যপথও তৈরি করে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে কবিতা লিখেছেন বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকায়। গল্প লিখেছেন লিটল ম্যাগাজিনে। উপন্যাস লিখেছেন অর্ধবাণিজ্যিক পত্রিকায়। বন্ধুদের সঙ্গে বের করতেন ‘দরবারি’ নামে লিটল ম্যাগ। তা হলে? এই তাহলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্য।

নিজের ভিতরের প্রবল প্রত্যাশাটাকে ফুৎ করে উড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ তিনি ইচ্ছা করলেই পঞ্চাশ-ষাঁট দশকের প্রজ্ঞাপিত লেখকদের পাশে অচিরেই জায়গা করে নিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। কেন করেননি, তা তিনিই জানতেন। প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যেতেন। বদলে নিজেকে ধরতে না পারা চরিত্রে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। অনেকে বলতেন বোহোমিয়ানিজম কথাটাও তার কাছে তুচ্ছ।

কলকাতার টালা পার্কে ছিল তাদের পৈত্রিক বসতবাড়ি। পাশেই থাকতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন। পেয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্রয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ছিল কাছের সম্পর্ক। একদা কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা পিতার কর্মসূত্রে বাল্যবন্ধু মজনু মোস্তাফা অর্থাৎ নির্মাল্য ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছিল আমৃত্যু বন্ধুত্ব। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রণজিৎদা কোনওদিন চাকরি করেননি। কোনও কাজ তাকে বেঁধে রাখতে পারতো বলে মনে হয় না।

তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অনেক আগেই আমরা পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম মজনুদা মারফৎ। কলকাতায় দু-জনে মিলিত হয়ে বারদুয়ারিতে মদ্যপান করে কী কী ধ্যাস্টামো করতেন, সে সব কথা রসিয়ে রসিয়ে বলতেন মজনুদা। আর খ্যা খ্যা করে হাসতেন। এভাবেই তিনি একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলেন রণজিৎদার। একথাও শুনেছি তার মুখে, মজনু অর্থাৎ নির্মাল্যদা আর রণজিৎদা একই সঙ্গে ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন করতেন। বেশ ডাকাবুকো কমরেড ছিলেন তিনি। একবার কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা ড. নলিনাক্ষ স্যান্যাল কৃষ্ণনগর টাউন হল ময়দানে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি বোধহয় কমিউনিষ্ট পার্টি বিরোধী কোনও মন্তব্য করেছিলেন, রণজিৎদা তার কমরেডদের নিয়ে সেই সভা ভণ্ডুল করে দেন।

কৃষ্ণনগরে তার থাকা হয়নি, পিতার কারণেই তাকে কলকাতায় থিতু হতে হয়েছিল। আমরা জানতাম তার সংসার চলে যৌন পত্রিকায় লিখে। এই যৌন পত্রিকা সম্পর্কে ঈষৎ ধারণা দেওয়া যাক। গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের প্রথমার্ধে কলকাতায় বেশ কিছু যৌন পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ইংরাজিতে যাকে বলে ‘সফ্‌ট পর্ণো’। সম্পাদক, প্রকাশক, এমনকি প্রেসের ঠিকানাও ছদ্মবেশ ধারণ করতো। ধরুন, কোনও পত্রিকার সম্পাদক অজিতাভ রায়, আসলে তার নাম অন্য। বেশ কিছু পত্রিকা সেই সময় পরিচিতি লাভ করেছিল। জীবনযৌবন, যৌবন, পঞ্চাশর, স্বর্গের আমরা এমন প্রায় আট-দশটি পত্রিকা নিয়মিত বের হতো। যৌন উত্তেজনামূলক বা রগরগে দু চারটে লেখার পাশাপাশি বেশ কিছু উন্নত সাহিত্যও চোখে পড়তো। অনেক পরিচিত ও তরুণ লেখক বেনামে এই সব পত্রিকায় গল্প উপন্যাস লিখতেন মোটা অর্থের লোভে। পত্রিকাগুলোর বিক্রিও যেমন ছিল, লেখকরাও ভালো টাকা পেতেন। এই উড়নচণ্ডীর জানা এক কবি এই সব পত্রিকায় অনুবাদ গল্প লিখে যা রোজগার করতেন, তা দিয়ে পত্রিকা বের করতেন।

রণজিৎদা ছিলো এই সব কাগজের নিয়মিত লেখক। তিনি যৌনগন্ধী লেখা লিখতেন না। দু-চারটে উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই সব উপন্যাস কোনও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় লিখলে তো তিনি জনপ্রিয় হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। কেন হাঁটেননি, তা তিনিই জানতেন। কোনও উত্তর মেলেনি। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, আপনার এই ছোটো উপন্যাস আর গল্পগুলো নিয়ে বই করছেন না কেন?

তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন, ধুস্‌, আমার বই কেউ করবে না। অথচ সেই সময় একটি পত্রিকায় বেনামে রাজনৈতিক কলম লিখতেন। বাংলাদেশের একটি পত্রিকাতেও নিয়মিত লিখতেন। সেটাই ছিল তার রোজগার। কিন্তু তা দিয়ে তো সংসার চলে না। ফলে তাকে পরমুখাপেক্ষী হতে হতো। সেটা ছিল তার নিদারুণ কষ্টের সময়। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে আলাপ পর্বটা সেরে নিই।

গত শতকের সত্তরের দশকের প্রথম পর্ব। বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। উড়নচন্ডীর সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশ ভ্রমণও শেষ হয়েছে। এক রোববার সকালে যথারীতি আমরা আসর গুলজার করছি লেখরাজদার দোকানে। হঠাৎই এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। স্বাস্থ্যবান, গোঁফ-দাড়ি বিহীন, প্যান্টের ভিতর জামা গোঁজা। মাথায় সুবিন্যস্ত চুল, পায়ে চটি, পিছনের পকেটে একটি ইংরেজি দৈনিক ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখা, সোজা লেখরাজদার উল্টো দিকে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন লেখরাজদা?

আমরা এতক্ষণ নজরে রেখেছিলাম ভদ্রলোককে। এবারে বুঝলাম, ইনি এই শহরেরই মানুষ। এখনও আছেন, অথবা নেই। কিন্তু লেখরাজদার দোকানে নিত্য যাতায়াত ছিল। লেখরাজদা চোখ তুলে বললেন, রণজিৎ! তারপর একগাল হাসি ছড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, কেমন আছো? ততক্ষণে তার সামনে এক গেলাস চা হাজির করেছে কেষ্ট। ওর সম্পর্কেও দুকথা বলে নেব।

তিনি চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতেই ঝড়ের গতিতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে নির্মাল্যাদা ঢুকলেন। তাকে দেখেই লেখরাজদা কথিত রণজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন। এতক্ষণ আমরা ফিসফিস আলোচনা করছিলাম ইনিই সেই রণজিৎ সিকদার কিনা। এবার নিশ্চিত হলাম। তিনি চা-পান শেষ করতেই নির্মাল্যদা আমাদের টেবিলে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিলেন। তারপর নানা গল্প। মনে হল, তিনি সদ্য পরিচিত কেউ নন। এতটাই আন্তরিক তিনি এবং কৃষ্ণনগরীয় আড্ডার প্রকরণ তিনি ভোলেননি। সেটা টের পাওয়া গেল, একটু পরেই। কথায় কথায় জানা গেল, তিনি মরিশাস যাচ্ছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে ভারত সরকার। তিনি সেই দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

আমরা কৌতূহলী। কেউ বোধ হয় জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি কবি হিসাবে যাচ্ছেন কিনা। উত্তরে বললেন, ঠিক বললে না, ছুঁড়ে দিলেন, সেক্স রাইটার হিসাবে। বলেই এক অদ্ভুত শব্দ করে হাসলেন। সেই শব্দ বহুদিন কানে বেজেছিল। অথচ এই মানুষটিই জীবনের পড়ন্ত বেলায় আর হাসতে পারতেন  না। গভীর বিষাদমাখা চোখে তাকিয়ে থাকতো একমুখ যন্ত্রণা নিয়ে। তখন তিনি কলকাতার পথে এক নিতান্ত পরিব্রাজক।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *