পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ৮। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

(গত পর্বের পর)

‘মেক্সিকোয় আর কোনও প্রজাপতি থাকবে না’ – বৃক্ষ ও পরিবেশকর্মীহননে ভয়ঙ্কর মেক্সিকো

 

২০১৭-র ৩ ফেব্রুয়ারি মেক্সিকোর মিচুয়েক্যানের মনার্ক বাটারফ্লাই রিজার্ভের একটি অংশ (ছবিসূত্র – ইকোওয়াচ)

অক্টোবর থেকে মার্চ। কানাডা-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লক্ষাধিক মনার্ক বাটারফ্লাই তুলনামূলক উষ্ণপ্রধান মেক্সিকোয় শীত কাটাতে আসে প্রায় ৩৪০০ মাইল রাস্তা পেরিয়ে। কারণ ছাড়া আকাশের দিকে তাকায় না মানুষ। তাকালেও কি দেখতে পেত? দেশের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলের মিচুয়েক্যান ও স্টেট অফ মেক্সিকোয় বিস্তৃত  ট্রান্স-মেক্সিকান আগ্নেয়-বেল্ট অঞ্চলের পাইন-ওক অরণ্যের ৫৬,২৫৯ হেক্টর এলাকার ২২টি কলোনি জুড়ে থাকা গাছের আশ্রয়ে প্রজাপতিদের ঘর, সংসার। মেক্সিকো সিটি থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে মিচুয়েক্যান রাজ্যকে প্রজাপতিদের শীতঘুম অঞ্চল হিসেবে দেখায় ১৯৭৬ সালে কানাডীয় প্রাণিবিদ ফ্রেড উরকুহার্টের একটি রিপোর্ট। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ওটোমি ও মাজাহুয়া আদিবাসীদের সাক্ষী রেখে আসা-যাওয়া এই প্রজাপতিদের স্থায়ী নিরাপদ সংসার দিতে ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্সি ডিক্রি থেকে পাকাপাকিভাবে শুরু হয়ে ২০০৮-এ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় আসে মনার্ক বাটারফ্লাই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এবং এই অরণ্যকে বাঁচাতে, প্রজাপতিদের বাঁচাতেই মেক্সিকোর পরিবেশকর্মী হত্যার ক্রনোলজি। ২০২০-র ১৩ জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ রিজার্ভের অন্যতম একটি অংশ ‘এল রোজারিও বাটারফ্লাই রিজার্ভ’-এর ম্যানেজার হোমেরো গোমেজ গঞ্জালেজ। ২৯ জানুয়ারি মিচুয়েক্যানের ওকাম্পা অঞ্চলের সেই রিজার্ভের কাছে চাষাবাদের জন্য একটি খোঁড়া কুয়োর ভেতর বছর পঞ্চাশের হোমেরো’র শরীর পাওয়া যায়, বিশদ রিপোর্টে ছিল মাথায় গভীর আঘাতের দাগ। শুরুতে স্থানীয় কমিউনিটির অরণ্যে যাতায়াতে বাধা আসার চিন্তায় বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তে স্বভাবতই মানতে পারেনি হোমেরোদের ট্রাডিশনাল চিন্তাভাবনা। ক্রমশ, আলোয় ফেরেন মানুষটি। স্থানীয় অবৈধ লগারদের সঙ্গে বিরোধ, প্রজাপতি এবং পবিত্র ওয়ামেল ফার গাছের সংরক্ষণ, ২৬০-এর ওপর জমি-মালিককে বুঝিয়ে গাছ কেটে ফাঁক করে দেওয়া অংশে বৃক্ষরোপণ, নিজের উদ্যোগে ১৫০ হেক্টর অঞ্চলকে সবুজ করে দেওয়ার কাজে সক্রিয় এই মানুষটির পেছনে ছিল খুনীর চকচকে নজর। দিনতিনেকের মধ্যেই আঙ্গাঙ্গুয়েও অঞ্চল থেকে নিখোঁজ হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি শরীর পাওয়া যায় বাটারফ্লাই রিজার্ভের অন্য একটি অংশের ট্যুর গাইড রাউল হার্নান্ডেজ রোমেরো। একসময় লগার হলেও রাউল ফিরে এসেছিলেন অরণ্য সংরক্ষণে, বোঝাচ্ছিলেন স্থানীয় আদিবাসী থেকে পর্যটকদের। ২০২০-এর একটা মাস হঠাৎ প্রজাপতিরক্ষকদের ওপর নজর, অস্তিত্ববিলোপ। প্রসঙ্গত, এইসমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রিসেন্সিও মোরালেজ অঞ্চলের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় পুলিশের ওপর ভরসা না করে তৈরি করেছে নিজস্ব নিরাপত্তা দল – গার্দিয়া কমিউনালিস। রক্ষকদের সঙ্গে অসুখের সংক্রমণ পড়ছে খোদ মনার্ক বাটারফ্লাইদের ওপর। ২০০১-র তুলনায় ২০১২-য় রিজার্ভের মোট ক্যানপি কভার দশ শতাংশ কমে গেলে রাষ্ট্র থেকে বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া হয়। ২০২০ অবধি কিছুটা স্থিতাবস্থা থাকলেও তা আবার পড়তির দিকে। গত ২০২২ থেকে ২০২৪-এর শুরুটা ঘাঁটলে, অরণ্যের রিপোর্ট বলছে, ২০২১-এর থেকে ২০২২-এ প্রজাপতি মাইগ্রেশন ৩৫ শতাংশ বাড়লেও ২০২২-এর থেকে ২০২৩-এ কমেছে ২২ শতাংশ এবং ২০২৩-এর চেয়ে ২০২৪-এ কমেছে ৫৯ শতাংশ, যা ভয়ঙ্কর। ১৯৯৬-৯৭ সালের হিসেবে দেশের ৪৫ একর অরণ্য প্রজাপতি-পূর্ণ ছিল, যা ২০২২-এ কমে হয়েছে ২.২ একর। আবহাওয়া পরিবর্তন, বৃক্ষচ্ছেদন এবং যাঁদের ভরসায় আসা, সেইসমস্ত মানুষ এক এক করে কমে যাওয়া। দেশের এন্ডেঞ্জার্ড স্পিসিস অ্যাক্ট-এ বিপন্ন তকমায় তবু ঢুকছে না মনার্ক বাটারফ্লাইদের নাম। মেক্সিকোয় আর কোনও প্রজাপতি আসবে?

বাটারফ্লাই ও ওয়ামেল ফার রিজার্ভ এবং পরিবেশকর্মী হোমেরো গোমেজ (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

২০২০-র ৩০ জানুয়ারি, হোমেরো’র কফিনের কাছে শোকস্তব্ধ পরিবার, পরিজন (ছবিসূত্র – ভিওএ নিইজ)

প্রজাপতি থেকে ভূতত্ত্ব। মেক্সিকান জিওলজি-বিস্ময় এবং তা লোপাট করার লেগ্যাসি। দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিনসুলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০০০ চুনাপাথরের গুহা, মাল্টিপল কেভ সিস্টেম। ভূগর্ভস্থ এই গুহাগুলির বিশেষ নাম ‘সেনোট’। তেমনই একটি সেনোট, সাক আক্টুন অ্যাকুইফার, যা গ্রহের বৃহত্তম, অবস্থিত এই ইউকাটান অঞ্চলেই। এই ভূগর্ভস্থ সেনোটটি অ্যাকুইফার হিসেবে কুইন্টানা রু রাজ্যসহ প্রায় পাঁচ লক্ষ মেক্সিকোবাসীকে খাবার জলের জোগান দিচ্ছে। দুই আমেরিকা মিলিয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রপিকাল ফরেস্ট কালাকমুল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অবস্থান, জাগুয়ার, স্কারলেট ম্যাকাও বা স্পাইডার মাঙ্কির অন্যতম ঠিকানা এই ইউকাটান পেনিনসুলা। আর এখানেই বিতর্কিত ‘ট্রেন মায়া’র খননকার্য। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ইউকাটান পেনিনসুলার ৯৬৫ মাইল (১৫০০ কিলোমিটার) বিস্তৃত অঞ্চলে প্রোজেক্ট ‘ট্রেন মায়া’র কাজ শুরু হয়, যা বিখ্যাত মায়ান বিস্ময়গুলি পর্যটকদের জন্য জুড়ে দিতে একটি আপাত বিস্ময়কর প্রকল্প হিসেবে মনে করা হয়। শুরুতে ইউকাটান রিভিয়েরা মায়া কোস্টলাইন বরাবর হাইওয়ে ৩০৭-এর ঠিক পাশ দিয়ে সমান্তরালে খননকাজ এগোলেও স্থানীয় রেসর্টগুলি থেকে আপত্তি আসায় আরও ৪ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কাজ, এবং এভাবেই কানকুন থেকে টুলুমের মধ্যবর্তী বিতর্কিত সেক্টর-ফাইভ অঞ্চলে খননকাজে সরাসরি সাক আক্টুন অ্যাকুইফারের ওপর কোপ। ২০১৮ সালে সরকার থেকে বলা হয় একটিও গাছ কাটা পড়বে না কাজে, ২০২২-তে দেখা যায় তিন লাখ গাছ কাটা হয়েছে, বেসরকারি হিসেবে তা ৯ মিলিয়নের ওপর। কার্টোক্রিটিকা-র একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালে অরণ্যপূর্ণ ৬৬৫৯ হেক্টর এলাকা ২০২৩-এ ট্রেন মায়ার কাজে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত, গাছ জায়গা করে দিয়েছে রেলযন্ত্রপাতি, বালি, সিমেন্ট এবং বাসস্টপের। এবং এই ৬৬৫৯ হেক্টর অংশের ৮৭ শতাংশ বৃক্ষচ্ছেদন মেক্সিকোর পরিবেশ মন্ত্রক বা ’সেমারনাট’-এর বাধ্যতামূলক ‘চেঞ্জ অফ ইউজ অফ ফরেস্ট ল্যান্ড’ (সি.ইউ.এস.টি.এফ.) নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এধরণের কাজে স্বাভাবিকভাবে লাগা ১৫ বছরকে কমিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সময় লাগল মাত্র ৪ বছর। স্থানীয় হাইকোর্ট থেকে দেওয়া বিতর্কিত সেক্টর ফাইভ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে ২০২১-এর ২২ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরাসরি ন্যাশনাল সিকুইরিটি প্রোজেক্ট-এর ডিক্রি ধরিয়ে বাধ্যতামূলক অনুমতি আদায় করা হল। প্রোজেক্টকে ছোটছোট ভাগে ভাগ করে মূল ই.আই.এ.কে এড়িয়ে গিয়ে করা হল বেশ কিছু র‍্যাপিড ই.আই.এ, যার পেছনে স্থানীয়দের মতামত গুরুত্ব পায়নি আদৌ। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রেকর্ড করা হয়েছিল ট্রেনলাইনের নীচ দিয়ে যাওয়া স্থানীয় সমস্ত অ্যাকুইফারের নাম, যাতে পরবর্তীকালে কিছু বাকি থেকে গেলে তার দায় সহজেই বিশেষজ্ঞদের ওপর চাপিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে সরকার। স্ট্যালাকটাইটস ও স্ট্যালাকমাইটস সমন্বিত অনন্য এই সেনোটগুলি কংক্রিট, সিমেন্ট এবং স্টিল রড দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে জিওলজিকাল সিমেট্রি এবং স্থিতাবস্থা শেষ হয়ে, গুহার ছাদ উপরস্থ ভাইব্রেশনে ক্রমভঙ্গুর হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা পাঁচ লক্ষ মানুষের বিশুদ্ধতম পানীয় জলের জোগান চুলোয় গেলে, যাক। তুমুল সরকারি অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধ করা একটা বিরাট অংশের স্থানীয় মানুষকে পাশে না পেয়ে আশা হারাচ্ছেন ভূগবেষক ও পরিবেশবিদেরা, চোরাগোপ্তা মৃত্যু-পরোয়ানা পাচ্ছেন পরিবেশসংস্থা ‘সালভাম দেল ট্রেন’ (‘সেভ মি ফ্রম দ্য ট্রেন’) বা ২০১৮ সালে ২৫টি মায়ান কমিউনিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি ‘অ্যাসেম্বলি অফ মায়ান টেরিটরি ডিফেন্ডার্স-এর একাধিক কর্মী।

ট্রেন মায়া রুটের নিচে একটি প্রাচীন সেনোট (ছবিসূত্র – বিবিসি)

ট্রেন মায়া রুটের একটি অঞ্চলে জড়ো হওয়া পরিবেশকর্মীদের প্রতিরোধ (ছবিসূত্র – বিবিসি)

 

মেক্সিকোর সামগ্রিক পরিবেশ-কর্মী হত্যার ছবি। টমাস রোহো ভ্যালেন্সিয়া। উত্তর মেক্সিকোর পোটাম অঞ্চলে ইয়াকুয়ি আদিবাসী নেতা টমাস রোহো স্থানীয় অবৈধ লিথিয়াম মাইনিং অথবা ২০১৩ থেকে ইয়াকুয়িদের জল সাইফন করে একটি বিরাট পাইপ দিয়ে সোনোরার রাজধানী হারমোসিল্লোর দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রকল্প শুরু করা সোনোরা স্টেট অথরিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২০২০ সালে টমাস ও বন্ধু ফার্নান্দো জিমেনেজের নেতৃত্বে একমাস ব্যাপী রাস্তা রোকো, পরিণতিতে দুজনকে ভুয়ো অভিযোগে গ্রেপ্তার – চলতে থাকে। ২০২১-এ তিন সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ টমাসের পচে যাওয়া শরীর পাওয়া যায় ২৭ জুন, শনাক্ত করতে হয়েছিল ডিএনএ টেস্ট করে। ক্রীতদাস পরিবার থেকে উঠে আসা টমাসের পিতা গুইলারমো নীল ক্রসে আঁকা টমাসের শুয়ে থাকা মাটিতে রোজ স্যালিউট ঠোকেন, বছর চুরাশির কপালের ভাঁজে শোক না, লড়াইয়ের কথা। অথবা ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের পাতার পর পাতা। ২০২১-এর ২৭ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ পরিবেশকর্মী বছর আটত্রিশের তরুণী ইরমা গ্যালিন্ডো ব্যারিওজ। ২০১৮ থেকে ক্রমাগত ডেথ-থ্রেট পাওয়া ইরমা স্থানীয় অবৈধ লগারদের বিরুদ্ধে পুলিশি ডায়েরি করলেও গুরুত্ব পাননি। ইরমার ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু ওয়াক্সাকা’র লা মিক্সটেকা অঞ্চলের সান এস্তাবান আটাটলাহুকা মিউনিপ্যালিটিতে মাত্র কয়েকদিন আগেই ২১-২৩ অক্টোবর তিনটে কমিউনিটি জুড়ে ৭০ জন লগারের তাণ্ডবে জ্বলে শেষ হয়ে গেছে ৯০টি ঘর, নিহত হয়েছেন স্থানীয় ৭জন আদিবাসী, যার ভেতর দুজন ৯০ পেরনো দম্পতিও ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার দিন রাষ্ট্রপতির কাছে একটি পিটিশন দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন ইরমা। আক্রান্ত সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মীদের নিয়ে একটি জয়েন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন প্রোজেক্ট তৈরির জন্য ভার্চুয়াল মিটিং করার কথা ছিল সেইদিনই। অপেক্ষা করেও পাওয়া যায়নি ইরমাকে। ১৯৬৪ সাল থেকে দেশে ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের বলি হয়েছেন এক লাখের ওপর মানুষ। ২০২১-এ পরিবেশকর্মী নিরিখে এই সংখ্যা ১৯। ’২১-এর জুলাই মাস থেকে পরিবেশ ও জমি অধিকার নিয়ে কথা বলে নিখোঁজ ছিলেন ১০ জন। দক্ষিণ সোনোরার ইয়াকুয়ি টেরিটরি অঞ্চলে পাওয়া ৬টি সেটের দেহাংশ পাওয়া যায়, যা ওই ১০ জনের বলেই সন্দেহ করা হয়।

নিহত পরিবেশকর্মী টমাস রোহোর স্মরণসভা (ছবিসূত্র – ডয়েশ ওয়েল)

মেক্সিকোর পোটাম অঞ্চলে নীল ক্রস দেওয়া ছেলে টমাস রোহোর সমাধির সামনে পিতা গুইলারমো (ছবিসূত্র – দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস)

নিখোঁজ পরিবেশকর্মী ইরমা গ্যালিন্দো ব্যারিওজ (ছবিসূত্র – কমনড্রিমস)

দেশের সামগ্রিক ছবিটা কিরকম? গ্লোবাল উইটনেস বলছে ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে মেক্সিকোয় ১৮৫ জন পরিবেশ ও জমি অধিকার রক্ষক নিহত হয়েছেন, ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যে সংখ্যাটা ১৩১। গোটা পৃথিবীর নিরিখে চতুর্থ ভয়ঙ্করতম দেশ মেক্সিকো। অবশ্য শুধু ২০২১ ধরলে সংখ্যাটা ৫৪, একক বছরের নিরিখে সেবছর মেক্সিকো পরিবেশকর্মী হত্যার নিরিখে পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম দেশ, ২০২২-এ সংখ্যাটি একটু কমে এসে দাঁড়ায় তিরিশে। মেক্সিকান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-এ পরিবেশকর্মীদের ওপর আক্রমণ ৩৯ থেকে বেড়ে গিয়ে ২০২০-এ দাঁড়িয়েছে ৬৫-তে, যার ভেতর ১৮টি হত্যা। এই হত্যার ৪০ শতাংশ দেশের আদিবাসী অংশ। দুই তৃতীয়াংশ হত্যা সংঘটিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর ওয়াক্সাকা ও সোনোরা রাজ্যে। প্রসঙ্গত পরপর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হত্যার কথায় আসি। ২০২৩-এর ২৪ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ পরিবেশকর্মী আদিবাসী আয়োটিটলান সম্প্রদায়ের হিগিনিও ত্রিনিদাদ ডি লা ক্রুজের শরীর পাওয়া যায় পরেরদিন উত্তরপশ্চিম মেক্সিকোর জালিস্কো অঞ্চলে। ২০২৩-এর ২১ ফেব্রুয়ারি সেবছরের পঞ্চম পরিবেশকর্মী হিসেবে নিহত হন মিচুয়েক্যান রাজ্যে সরকারি জমি অধিগ্রহণ ও বাধ্যতামূলক অ্যাভোকাডো চাষ করে পিউরেপেচা পাইন অরণ্যকে শেষ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা আলফ্রেডো মড্রিগেল। আলফ্রেডোকে ধরে বাটারফ্লাই রিজার্ভখ্যাত এই মিচুয়েক্যানে গত দুদশকে পরিবেশকর্মী খুনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০-এর ওপর। ২০২৩-এর ১ এপ্রিল মিচুয়েক্যানের হুইটজোন্টলা গ্রামের নাহুয়া আদিবাসী নেতা ও খনি-বিরোধী কর্মী বছর আটষট্টির ইউস্তেচিও আলকালা ডায়াজ দুজন ক্যাথলিক মিশনারির সঙ্গে একটি গাড়িতে যাতায়াতকালীন অপহৃত হন, ৩ এপ্রিল ডায়াজের একাধিক গুলিবিদ্ধ শরীর পাওয়া যায়। ২০১২ সাল থেকে লাগাতার আন্দোলন করা ডায়াজ ২০২০ সালে সরকার কর্তৃক আরসেলর-মিত্তল ও টারনিয়াম স্টিল কোম্পানির দুই সাবসিডিয়ারিকে আদিবাসী মতামত ছাড়াই জমি দিয়ে দিলে আন্দোলন আরও তীব্রতর করেছিলেন। ১৫ জুন মিচুয়েক্যানের অ্যাকিলায় একটি মিটিং সেরে ফেরার পথে খনি-বিরোধী কর্মী রিকার্ডো লুগুনেজ গাসকা ও অ্যান্টনিও ডায়াজ ভ্যালেন্সিয়ার বুলেটবিদ্ধ গাড়ি পাওয়া যায়, অথচ এখনও নিখোঁজ দুজন। এসবের পাশাপাশি একের পর এক বিজ্ঞানী, গবেষকদের ওপর হামলা। মেক্সিকো সিটি থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে লালমানালকো অঞ্চলে ২০২৩-এর ১২ জুন নিজের বাড়িতে কৃষি-অর্থনীতি গবেষক ও মধুমক্ষীপালক মার্কেজ ফার্নান্ডেজ ও ১৯ জুন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টলি ল্যাবের ভেতর গবেষক আরভিজু অ্যাগুইনিগা নিহত হন, যাঁরা প্রাকৃতিক সম্পদ ও জল সংরক্ষন নিয়ে কাজ করছিলেন নিরলস। ১৯ জুন থেকে নিখোঁজ সেফাল্যান্থাস গুল্মের সন্ধানে সোনোরার দিকে যাওয়া মার্কিন-মেক্সিকান গবেষক তরুণ গ্যাব্রিয়েল ট্রুজিল্লো শরীর পাওয়া যায় ২২ জুন, সোনোরার ইয়েকোরা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে। প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে যোগসাজশ ধরা হচ্ছে অবৈধ লগিং এবং ড্রাগ চক্রের।

নিহত খনি-বিরোধী পরিবেশকর্মী ইউস্তেচিও ডায়াজ (ছবিসূত্র – মেক্সিকো নিউজ ডেইলি)

 

দেশে বৃক্ষচ্ছেদনের পরিসংখ্যান কেমন? গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ বলছে ২০০২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট শেষ হয়েছে ৭৩৬ কিলোহেক্টর (বা আট শতাংশ জমি), যা ওই সময়ে মোট ট্রু ফরেস্ট ধ্বংসের ১৬ শতাংশ (৪.৬৬ মিলিয়ন হেক্টর)। এলাকা বিচারে কম হলেও ট্রেন মায়ার মতোই প্রাসঙ্গিক এবং ভয়ঙ্কর জালিস্কোর ১৩৯৬ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে থাকা সিয়েরা ডি মানাটলান ইউনেস্কো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভে চলা পেনা কলোরাডা ওপেন পিট মাইনিং। গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে লুক্সেমবুর্গের আরসেলর মিত্তল ও টারনিয়াম স্টিল কোম্পানির অধীনস্থ এই খনির কাজে ঘন সবুজ সেরো ডি লস জুয়ানেজ পাহাড় বীভৎস এক বর্জ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোম্পানির নিখুঁত ঘেরাটোপে মুখ বন্ধ করা হচ্ছে একের পর এক আইনজীবী, পরিবেশকর্মীর। পেনা কলোরাডার বিরুদ্ধে লাগাতার কথা বলেছিলেন আয়োটিটলান আদিবাসী জালিস্কো অঞ্চলের আইনজীবী হোসে সান্টা আইজ্যাক শাভেজ। ২০২১-এর এপ্রিলে  শাভেজের একাধিক অত্যাচারের চিহ্ন থাকা শরীর মেলে একটি পাহাড়ি খাদ থেকে পড়ে যাওয়া তাঁর গাড়ির ভেতর। আয়োটিটলান আদিবাসী কর্মী হোসে স্যান্টোস রোজালেজ-এর ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ১৯৯৩ সাল থেকে, রোজালেজের ছেলে ১৭ বছরের রোগেলিও রোজালেজ র‍্যামোজ ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে শেষ। দুই সম্ভাব্য হত্যার মাঝে দাঁড়িয়ে হতবাক, কিছুটা অভ্যস্ত এখনও পিঠ টানটান পরিবেশকর্মী হোসে। এখনও ডেথ-থ্রেট নিয়েও পেনা কলোরাডার বিরুদ্ধে লড়ছেন এডোয়ার্ডো মোসকেডা বা ফেলিপে রোবলাডার মতো পরিবেশকর্মী। এক বা একাধিক পরিবেশ-হিংস্রতার খবর এসেছে সোনোরার গ্রুপো মেক্সিকো কোম্পানির বুয়েনাভিস্তা ডেল কোবরে কপার মাইন থেকে। ২০১৪-র ৬ আগস্ট সোনোরা ও বাকানুচি নদীতে কারখানা থেকে ৪০ মিলিয়ন লিটার কপার সালফেট ও একাধিক হেভি মেটাল লিকেজ হয়। কোম্পানি থেকে ট্রাস্ট তৈরি করে বলা হয় ৩৬টি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট স্টেশন ও একটি টক্সিকোলজিকাল ক্লিনিক খুলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। আদপে হয়েছে একটি স্টেশন, ক্লিনিক খুলে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অঞ্চলের পর অঞ্চল ভরে গেছে আর্সেনিকে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রাস্ট ২০২৬ পর্যন্ত চালু থাকার সাময়িক আশ্বাস দেওয়া হলেও যা ক্ষতি হচ্ছে, হয়ে গেছে তার উত্তর রাষ্ট্রের নেই।

সোনোরায় বুয়েনাভিস্টা কপার মাইন (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

জালিস্কো অঞ্চলের পেনা কলোরাডা ওপেন পিট মাইনিং (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

পেনা কলোরাডা মাইনের বিরুদ্ধে এখনও লড়ছেন আয়োটিটলান আদিবাসী পরিবেশকর্মী ফেলিপে রোবলাডা (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

মেক্সিকোর ভয়াবহতার কোনও ওষুধ নেই। রাইটস অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনিশিয়েটিভ থেকে ২০১৫ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মেক্সিকোর মোট জমির ৫২ শতাংশ আদিবাসী ও স্থানীয় অধিবাসীদের মালিকানায় আছে, যা পৃথিবীর নিরিখে দৃষ্টান্ত। অথচ, রাষ্ট্রের বেআইনি চাপে সে মালিকানা অনেকাংশেই হাতছাড়া। পরিবেশকর্মীদের ওপর অত্যাচার প্রতিরোধের অন্যতম একটি আইন এসক্যাজু এগ্রিমেন্টে মেক্সিকো সরকার র‍্যাটিফাই করে ২০২১-এর ২২ জানুয়ারি, যা সেবছর এপ্রিলে কার্যকরী হয়। অথচ আইনকে রূপায়িত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনওরকম আর্থিক বা মানবিক তাগিদ নেই। চলছে ট্রেন মায়ার মতো পরিবেশ-বিরোধী কাজ। মেক্সিকো সিটিতে ফেডারেল কোর্ট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিস্ট্রিক্টের একটিমাত্র স্পেশালাইজড চেম্বারে ৫৬০-এর ওপর পরিবেশ ও জমি অধিকার মামলার কাজ চলছে, অথচ এসক্যাজু এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত বিশেষ আদালত থাকার কথা, নেই সেসবের কোনও ইয়ত্তা। এতো বিশাল সংখ্যার পরিবেশকর্মী হত্যার মাত্র ০.৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সুরাহা হচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে ন্যূনতম পুলিশি রিপোর্টটুকু হচ্ছে না ৯৪ শতাংশ ঘটনায়। নিজের ফেসবুক পেজে ২৭ অক্টোবর নিখোঁজ হওয়ার দিন শেষ পোস্টে লিখেছেন পরিবেশকর্মী ইরমা ইরমা গ্যালিন্ডা ব্যারিওজ – ‘রাষ্ট্র কর্তৃক পরিবেশধ্বংসের বিরুদ্ধে যে যে সাংবাদিক বা কর্মী কথা বলে যাচ্ছেন, তাঁদেরই হয় মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, বা অত্যাচারিত বা নিহত হচ্ছেন। হোয়্যার ডাজ দিজ এন্ড? হোয়াট ফলোজ? কোথায় এর শেষ? কী পড়ে আছে শেষে?’ স্মৃতিতে আসছে এডোয়ার্ডো গ্যালিয়ানো’র ‘মিরর’। গ্যালিয়ানো লিখছেন – ‘গুহার ছাদ থেকে ঝুলছে স্ট্যালাকটাইটস। মাটি থেকে উঠছে স্টালাকমাইটস। হাজার হাজার বছর ধরে অন্ধকারে, বিন্দু বিন্দু করে বাড়তে বাড়তে একে অপরকে খুঁজে যাচ্ছে এই দুজন। হয়তো ওদের অনেকের মিলিয়ন বছর লাগছে একে অন্যকে ছুঁতে। ওদের কোনও তাড়া নেই। দে আর ইন নো হারি।’

 

অথচ, এই স্ট্যালাকটাইটস ও স্ট্যালাকমাইটসের প্রাচীন গুহা, বৃক্ষ,‌ বিপন্ন পশুপাখি, পরিবেশকর্মী, আদিবাসী মেক্সিকো – এদের লোপাট করতে রাষ্ট্রের তাড়া এতো!

২০২২-এর আর্থ ডে পালনের দিন নিহত ও নিখোঁজ পরিবেশকর্মীদের বিচারের দাবিতে মেক্সিকোর জোকালো স্কোয়্যারে প্রতিবাদ (ছবিসূত্র – রয়টার্স ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস)

 

 

 

ঋণস্বীকার

 

১. Associated Press Report. Family, friends mourn Mexico’s monarch butterfly activist. January 31, 2020. Voice of America.

২. Bennett, Paige. Monarch butterfly’s wintering in Mexico drop to second-lowest level ever recorded. February 8, 2024. EcoWatch.

৩. Castillo, del Augustin. Two deaths trigger alarm at Mexico’s Monarch Butterfly Biosphere Reserve. February 20, 2017. Mongabay.

৪. Duran, Thelma Gomez. Mexico groups say Maya Train construction has caused significant deforestation. September 14, 2023. Mongabay.

৫. Grant, Will. Tren Maya: Mexico’s Yucatan mega train – world beating or environmental disaster? December 15, 2023. BBC News.

৬. Hines, Ali. Decade of Defiance: Ten years of reporting land and environmental activism worldwide. September 29, 2022. Global Witness.

৭. Kishwari, Soraya. A new tourist train in Mexico will destroy indigenous land and livelihood. January 12, 2023. Time Magazine.

৮. Lakhani Nina & Nuno, Analy. Environmental defenders reel from Mexico and Central America attacks. April 10, 2023. The Guardian.

৯. Lopez, Oscar. Mexico named deadliest country for environmental activists. September 29, 2022. The New York Times.

১১. Mosqueda, Eduardo. Making good on promises: How Mexico can transform the lives of environmental defenders by implementing the Escazú Agreement. January 24, 2023. Global Witness.

১২. Ore, Diego. Disappeared Mexican activist underscores deadly threat to environmental defenders. May 12, 2022. Reuters.

১৩. Rights and Resources Initiative. Who Owns the World’s Land? A global baseline of formally recognized indigenous and community land rights. September, 2015.

১৪. Rocha, Jorge Antonio. Mexican environmentalists murdered near Mexico City. June 29, 2023. Aztec Reports.

১৫. Shailer, Daniel. 9 years after mine spill in Northwrn Mexico, new report gives locals hope for long-waited cleanup. September 29, 2023. Associated Press.

১৬. Solar, Gerard. Tren Maya, the Mexican megaproject threatning the ecosystems of the Yucatan Peninsula. March 18, 2022. Equal Times.

১৭. Stevenson, Mark. Mexico is world’s deadliest spot for environemntal activists. September 29, 2022. Associated Press.

১৮. Sundaram, Anjan. Indigenous activists are risking their lives for butterflies. December 20, 2023. Vox.

 

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *