পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ৯। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

(গত পর্বের পর)

নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গল – মধ্য আমেরিকা ও পরিবেশকর্মীহত্যা

মেক্সিকো থেকে মানচিত্রে নিচে নেমে এলে হাঁসের শরীরের মতো আকারে সেন্ট্রাল আমেরিকার নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গল। দীর্ঘ রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পরিবেশ। ছোট ছোট দেশে হেরে যাওয়া আর পাল্টা জেতার লড়াইয়ে কাটা পড়ে গাছ, নদী, মানুষ। জনপ্রিয় ক্রনোলজিতে চাপা পড়ে গেলেও পরিবেশকর্মী হত্যার সালতামামিতে বড়োই ওপরের দিকে এই নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গল। আদিবাসী জমি, অরণ্য ও নদী রক্ষা আন্দোলন। হার, জিত, হার, হয়তো আবারও হার। তবু, লড়ছে চাঁদের উল্টো পিঠ, লড়ছে সেন্ট্রাল আমেরিকা।

কিংবদন্তি বার্টা ক্যাসেরেসের হন্ডুরাসের সঙ্গে সমান প্রাসঙ্গিক নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গলের অন্য দুই দেশ এল সালভাদোর এবং গুয়াতেমালা। আকারে দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্রতম দেশ এল সালভাদোর মহাদেশের সর্বাধিক জনঘনত্বপূর্ণ দেশ। বৃক্ষচ্ছেদনের দিক দিয়ে হাইতির পরেই মহাদেশের দু নম্বরে। পানীয় জলসম্পদ তলানিতে। একাধিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে একই ছবি – দেশের ৯০ শতাংশ সারফেস ওয়াটার দূষিত হয়ে আছে। মাত্র দুই শতাংশ ক্ষেত্রে ট্রিটমেন্ট করে জল ফেলা হচ্ছে জলাশয়ে, বাকি আটানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে বর্জ্য জলের কোনও পরিশোধন নেই। দেশের গ্রামীণ অংশের ৭৫ শতাংশ বিশুদ্ধ পানীয় জল পাচ্ছে না। আগামী আশি বছরের ভেতর গোটা এল সালভাদোর পানীয় জলবিহীন হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ক্যাবানাস অঞ্চলের রিও লেম্পাকে দূষিত করা ওসিয়ানা গোল্ড-প্যাসিফিক রিমের কুখ্যাত এল ডোরাডো গোল্ড মাইন, মার্কিন কমার্স গ্রুপ কর্পোরেশনের সান সেবাস্টিয়ান গোল্ড মাইন থেকে সান সেবাস্টিয়ান নদীতে ঢালা টক্সিক সায়ানাইড, ম্যাগনেসিয়াম, আর্সেনিক, মার্কারি। তীব্রতম অ্যাসিড মাইন ড্রেইনেজে বীভৎস কমলা রঙের সান সেবাস্টিয়ান নদী। ২০১২-র একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে জলের সায়ানাইড ও আয়রনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ৯ ও ১০০০ গুণ বেশি।

টক্সিক বর্জ্য মিশে ক্রমশ হলুদ হয়ে যাওয়া সান সেবাস্টিয়ান নদী (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

দূষিত সান সেবাস্টিয়ান নদীর এরিয়াল ভিউ (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

পরিবেশের সঙ্গে পরিবেশ-রক্ষক। ২০০৯-এ পরপর একাধিক শিকার। ক্যাবানাস এনভায়রনমেন্টাল কমিটি (সি.ই.সি.)-র একাধিক কর্মী মারণ ও প্রায় মারণ-আঘাতের টার্গেট। ক্যাবানাসের কুখ্যাত এল ডোরাডো গোল্ড মাইনিং, নেপথ্যে কানাডার ভাঙ্কুভারের কোম্পানি ওসিয়ানা গোল্ডের সাবসিডিয়ারি প্যাসিফিক রিম-এর নেতৃত্বে ক্রমাগত মারণ-খেলা। পরিবেশকর্মী গুস্তাভো মার্সেলো রিভেরো মোরেনো ২০০৯-এর ১৮ জুনের পর থেকে নিখোঁজ, ৩০ জুন তাঁর অত্যাচারিত নিথর শরীর ভেসে উঠল স্থানীয় একটি কুয়োয়। সি.ই.সি.-র ভাইস প্রেসিডেন্ট রামিরো রিভেরা গোমেজ ২০০৯-এর আগস্টে আটটা বুলেটের আঘাত থেকে বাঁচলেন, অবশ্য চার মাসের জন্য। ২০ ডিসেম্বর ১৪ বছরের কিশোরী কন্যাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলে আবার গুলি, সেবার আর ফিরতে পারেননি রামিরো। ২৬ ডিসেম্বর সি.ই.সি.-র সক্রিয় কর্মী ডোরা অ্যালিসিয়া রেসিনোস স্থানীয় নদী থেকে কাপড় কেচে ফিরছিলেন, সঙ্গে দুবছরের ছেলে। ডোরার ফেটাল গানশট, পায়ে গুলি লেগে কোনওক্রমে বেঁচে ফেরে শিশুটি। আট মাসের গর্ভবতী ডোরার দ্বিতীয় সন্তান এল না, দেখতে পেল না মা’কে। ২০১১-র ২ জুন টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির লিঙ্গুইস্টিক্সের ছাত্র জুয়ান ফ্রান্সিসকো ডুনান সি.ই.সি.-র পরিবেশ আন্দোলনের লিফলেট, পোস্টার নিয়ে প্রচার করছিলেন। সেদিন থেকেই নিখোঁজ। ৪ জুন মাথায় গুলিবিদ্ধ জুয়ানের যে শরীর পাওয়া গেছিল তা শনাক্তকরণের অভাবে ক্যাবানাসের গণ-কবরে নিরুদ্দিষ্ট হিসেবে সমাধিস্থ করা হয়, লাগাতার প্রতিবাদে ১৪ জুন শরীর তুলে জুয়ানকে শেষবার চিনে আসেন পিতা। হত্যার সঙ্গে হত্যার চেষ্টা ও হেনস্থা। গুস্তাভো মোরালেসের হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে ২০১২-র জুনে সি.ই.সি.-র বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাদার নেফতালি রুইসের বাড়িতে গুন্ডা হামলায় সি.ই.সি.-র বেশ কিছু পরিবেশ-মামলার নথি চুরি হয়ে যায়। প্রতিবাদী রেডিও ভিক্টোরিয়া কমিউনিটি স্টেশনের একাধিক কর্মী এবং ক্যাথলিক যাজক ফাদার লুইস অ্যালবার্টো কুইন্টানিল্লা ক্রমাগত মৃত্যুপরোয়ানা পেয়ে অভ্যেস করে নিয়েছেন।

নুয়েভা ত্রিনিদাদ অঞ্চলের একটি দেওয়াল মিউরাল, মার্কিন ডলারের ওপর অত্যাচারিত কৃষক-পরিবেশকর্মী, নিচে লেখা – ‘আমরা গরিব নই, ওরা আমাদের গরিব করে দিয়েছে’ (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

 

এই রেডিও ভিক্টোরিয়ার নেতৃত্বে দেশের মেটাল মাইনিং নিষিদ্ধ করার আন্দোলন ২০০৮ থেকে। ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট’ (এ.ডি.ই.এস.) অথবা কোয়ালিশন ‘ন্যাশনাল রাউন্ডটেবিল অন মেটালস মাইনিং’-এর মতো সংস্থার তীব্রতর আন্দোলন। ২০০৯-এ তৎকালীন বামপন্থী এফ.এম.এন.এল. সমস্ত মাইনিং প্রোজেক্টের ওপর অনির্দিষ্টকালীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেষমেশ ২০১৭। গ্রহের প্রথম দেশ হিসেবে পার্লামেন্ট থেকে মেটাল মাইনিং-এর ওপর পাকাপাকি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় গুয়াতেমালায়। দৃষ্টান্ত, সন্দেহ নেই। অবশ্য এই দৃষ্টান্তের ওপর সাম্প্রতিক ভয়ের লেগ্যাসি। বিটকয়েন অর্থনীতির ভরাডুবির পর রাজস্ব আদায়ে দেশের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতির একাধিক বেলাগাম প্রো-কর্পোরেট নীতি। ২০২১-এ তৈরি সরকারি এজেন্সি জেনারেল ডিরেক্টরেট অফ এনার্জির একাধিক মাইনিং সংক্রান্ত নজরদারি ও ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার শুরু। তার সঙ্গে দোসর ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল ফোরাম অন মাইনিং, মিনারেলস অ্যান্ড সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট’-এর মতো গালভরা প্রোজেক্টে এল সালভাদোর সরকারের সংযুক্তি অথবা ২০২৩-এর নভেম্বরে চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সমঝোতা – এই সবকিছুর ওপর শেষ পেরেক হিসেবে ২০২৩-এর ১১ জানুয়ারি পরিবেশ সংস্থা এ.ডি.ই.এস.-এর পাঁচ সক্রিয় সদস্য এবং বামপন্থী এফ.এম.এল.এন. রেসিস্টেন্স দলের কর্মী আন্তোনিও পোচেকো, মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল গোমেজ, আলেজান্দ্রো লাইনেজ গার্সিয়া, পেদ্রো আন্তোনিও রিভাস লাইনেজ ও সল অগাস্টিন রিভাস ওর্তেগাকে তিরিশ বছর আগের গৃহযুদ্ধের একটি হত্যামামলার দায়ে কোনওরকম প্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা। অথচ ১৯৯২-এর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন আইনে পরবর্তী কোনওরকম রাজনৈতিক বন্দিত্ব থেকে এফ.এম.এল.এন.-কে সরিয়ে রাখার কথা সুস্পষ্ট বলা হয়েছিল। কর্মীরা পিটিশন করলেও দেশের আদালত সেই আইন ভুলে এখনও অমানবিক অন্ধ জেলে ঢুকিয়ে রেখেছে সেই পাঁচ কর্মীকে। শুধুই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা? নাকি দেশের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার পানীয় জলের জোগান দেওয়া লেম্পা রিভার বেসিনে মাইনিং নিয়ে সোচ্চার এবং দেশের মাইনিং নিষেধাজ্ঞার অন্যতম কাণ্ডারি সান্টা মার্টা কমিউনিটির ওই পাঁচ সক্রিয় কর্মীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া, কী উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের? আশঙ্কা আসলে একটা দিকেই যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম মেটাল মাইনিং নিষেধাজ্ঞার যুগান্তকারী পদক্ষেপ কি উঠিয়ে দিচ্ছে এল সালভাদোর?

এ.ডি.ই.এস.-এর প্রেসিডেন্ট ভিদালিনা মোরালেস এখনও পরিবেশ-আন্দোলনে নির্ভীক, পেছনে গ্রেপ্তার পাঁচ সহযোদ্ধার ছবি (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

গুয়াতেমালা। গ্লোবাল উইটনেসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭-র অন্তত ৩ জন পরিবেশকর্মী হত্যা বেড়ে ২০১৮তে দাঁড়ায় ১৬-য়, যা কমে ২০২১-এ হয়েছে ৪। তবে ২০১২ থেকে ২০২১-এর হিসেবে মোট ৮০ জন পরিবেশকর্মী হত্যার নিরিখে গ্রহের ষষ্ট বিপজ্জনক দেশ গুয়াতেমালা। ছয় থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত চলা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ, ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স, আদিবাসী উচ্ছেদের লেগ্যাসি একবিংশ পেরিয়েও পোশাক বদলে চোরাগোপ্তা চলছেই। জলবিদ্যুৎ-স্বর্ণনিকেল খনি-পাম অয়েলের ত্রিভুজ ‘প্রগতি’ আক্রমণে শ্বাসরুদ্ধ আদিবাসী গুয়াতেমালা।

খনিজ রাজনৈতিক ইতিহাস। কানাডার ইনকো কোম্পানির ফেনিক্স (শুরুতে নাম ‘এক্সিমবাল মাইন’) নিকেল মাইন-কে ১৯৬৫ সালে ৪০ বছরের মাইনিং লিজ দেয় গুয়াতেমালা। সাতের দশকের সামরিক শাসন, গৃহযুদ্ধ, ’৭৮-এর কুখ্যাত পানজো গণহত্যায় অন্তত ৫৩টি আদিবাসী শরীর শেষ – বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবেশ-রক্ষা। নথিবদ্ধ হত্যার সঙ্গে ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স। ২০০৪-এ ইনকো কোম্পানি কানাডায় স্কাই রিসোর্সেস তৈরি করে, ৪০ বছরের লিজ শেষ হওয়ার আগের বছরই গুয়াতেমালায় সাবসিডিয়ারি কোম্পানি সিজিএন তৈরি হয়। স্কাই রিসোর্সেস ২০০৮-এ হুডবে মিনারেলস ইনকর্পোরেশনকে ফেনিক্সের শেয়ার বেচে দেয়। হুডবে থেকে ২০১১-য় ফেনিক্সের মালিকানা আসে রাশিয়ান-সুইস কোম্পানি সলওয়ে ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের কাছে। ২০১৭-য় রাষ্ট্র থেকে পঁচিশ বছরের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সলওয়েকে। ক্ষমতায় এসে সিজিএন-এর সঙ্গে প্রুনিকো কোম্পানিকেও সাবসিডিয়ারি করে নিয়েছে সলওয়ে। যদিও এইসমস্ত হাতবদল, নামবদলে পরিবেশ আইন থেকে পালানো, আর্থিক ক্ষেত্রে সুবিধে ইত্যাদিতে যথেষ্ট এসে গেলেও আদিবাসী অধিকারে যায় আসেনি কিছুই। তাঁদের লড়াই, কষ্ট থেকে গেছে একইরকম, যার অন্যতম প্রেক্ষিত এল অ্যাস্টর অঞ্চল। ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯ – বাধ্যতামূলক উচ্ছেদ, ঘর জ্বালানো দেখে এসেছে মায়ান কোয়েকচি আদিবাসীরা। ২০০৭-এ রোজা এলভিরা কক সহ ১০জন প্রতিবাদী মহিলাকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ এসেছে শাসক ও কোম্পানির ভাড়াটে নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর। ২০০৯-এর ২৭ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত উচ্ছেদকান্ডে স্থানীয় প্রতিবাদী আন্দোলনকর্মী, শিক্ষক, লা ইউনিয়ন কমিউনিটির নেতা অ্যাডোলফো ইচ চামানকে প্রাক্তন মিলিটারি অফিসার প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন। পরিণতি হিসেবে সিজিএন থেকে পরবর্তী আট বছর পুরো মাইনে পেয়ে এসেছিলেন সেই অফিসার। ওই একই উচ্ছেদে বছর কুড়ির জার্মান চাব কোক গুলি খেয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে এখনও হুলচেয়ারে করে মাছের জাল ঠিক করেন, বয়স তিরিশের ঘর পেরিয়েছে জার্মানের। অ্যাডোলফোর ঘাতক হিসেবে সরাসরি হুডবে মিনারেলসের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবাদে কোর্টে গেছিলেন তরুণী স্ত্রী অ্যাঞ্জেলিকা চোক। ২০১৬-র ১৭ সেপ্টেম্বর অ্যাঞ্জেলিকার দুই শিশুপুত্র সহ ঘুমের সময় গানশট, কোনওক্রমে বেঁচে ফেরেন প্রত্যেকেই। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে বিনা বিচারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য গ্রেপ্তার হন আদিবাসী কর্মী অ্যাবেলিনা চাব কাল। ২০১৭-র গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্ট প্রাইজ-জয়ী আদিবাসী পরিবেশকর্মী নেতা-আইনজীবী রডরিগো টট ২০১১-য় সরাসরি গুয়াতেমালা সরকারের বিরুদ্ধে জমি অধিকারে সরকারের অংশ কতটা বা কতটা আদিবাসীদের অধিকার – প্রমাণ চাইতে কোর্টে যান, পাশে দাঁড়ায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। জমি অধিকার, উচ্ছেদের ত্রাস ছাড়াও পরিবেশ দূষণ সরাসরি জড়িয়ে ফেনিক্স কাণ্ড। ২০১৭ থেকেই ফেনিক্স মাইন থেকে তিন মাইল দূরের লেক ইসাবেলের জল অস্বাভাবিক কমলা-হলুদ হয়ে যেতে থাকে। কোম্পানির নিজস্ব রিপোর্টে টক্সিক লিচেটের কথা থাকলেও সেসব বাইরে না এনে দায়ী করা হল বোট্রিওকক্কাস নামের এক অণু-শৈবালকে। শ্যাওলার ওপর সাময়িক দায়িত্ব দিয়েও চাপা থাকেনি অপরাধ। মাইনিং ওয়েস্ট, প্রুনিকো কোম্পানির একাধিক বাঙ্কার লিকের ঘটনায় ফেনিক্স মাইনের দিকে ক্রমশ আঙুল উঠে যায়। নিকেল, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম-মাখা হলুদ লেক ইসাবেলের কতটা গভীরে যাবেন মাছচাষিরা? ২০১৭-র ২৭ মে দুপুরে এল অ্যাস্টরে লোকাল ফিশার গিল্ডের পক্ষে বিশাল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জমায়েত ও রাস্তা রোকো আন্দোলনে পুলিশি গুলি – বছর সাতাশের মৎস্যচাষি, আন্দোলনকর্মী কার্লোস মাজ ককের গায়ে ফেটাল গানশট, এবং এই হত্যাকাণ্ড ক্যামেরায় ধরে রেখে আজ অবধি অজস্র গ্রেপ্তারি, মৃত্যুপরোয়ানা শুনে নিজের দেশেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাংবাদিক-চিত্রগ্রাহক কার্লোস চোক এবং তাঁর সহযোগী জারসন জিটামুল।

এল অ্যাস্টরের ফেনিক্স মাইন ও লেক ইসাবেল (ছবিসূত্র – দ্য ইন্টারসেপ্ট)

২০০৭-এর ৯ জানুয়ারি এল অ্যাস্টরের লা রেভল্যুশন অঞ্চলের উচ্ছেদ অভিযানে অগ্নিদগ্ধ আদিবাসী ঘর (ছবিসূত্র – সেজ জার্নালস)

এইসমস্ত রক্তক্ষরণের মাঝে যখনই আদালত আশ্বাস দিয়েছে, ঠিক পরপরই রাষ্ট্র-কোম্পানি-এলিটিস্ট সমাজের আঁতাতে জমি হারিয়েছে আদিবাসীরা। ১৯৮৯ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কনভেনশন ১৬৯’ বা ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পিপল কনভেনশন’-অনুযায়ী যেকোনও প্রোজেক্টে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী অংশের সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই মর্মে একের পর এক মামলায় ২০১৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ফেনিক্সের কাজে সাময়িক নিষেধাজ্ঞার রায় দেয়। ২০২১-এ কোম্পানি হাস্যকর এক আদিবাসী-সম্মতিপত্র পেশ করে, যেখানে ঘুষ, আর্থিক টোপে আদিবাসী কাউন্সিলের এক অংশকে হাতে রেখে নব্বই শতাংশ জনসংখ্যাকেই অন্ধকারে রাখা হয়। তবু পাল্টা লড়াই চালিয়ে গেছেন মায়ান কোয়েকচিরা। ২০১৭-তে পাওয়া পঁচিশ বছরের লিজ ২০২২-এর ৬ জানুয়ারি আবার ফিরে পেয়েছে কোম্পানি। বড় মাছ ক্রমশ খেয়ে ফেলছে ছোট মাছকে। তাতে জল নষ্ট হয়ে বসবাস-অযোগ্য পৃথিবী তৈরি হলে হবে, কার কী? কোম্পানির কী? রাষ্ট্রের কী?

২০০৯-এর জুনে হত্যার তিন মাস আগে অন্যান্য আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে মাঝখানে অ্যাডোলফো ইচ চামান (ছবিসূত্র – সেজ জার্নালস)  

২০০৯-এর পুলিশি ফায়ারিংয়ে আহত হয়ে আজীবন প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মৎস্যজীবী তরুণ জার্মান চাব চোক (ছবিসূত্র – সেজ জার্নালস)

খনি থেকে জলবিদ্যুৎ। শিকার সেই আদিবাসী অংশ। উত্তর গুয়াতেমালার ইক্সিকুইসিস অঞ্চলের মায়া-চুজ আদিবাসী জনজাতি বনাম বহুজাতিক, এবারে ঘাতক এনার্জিয়া ওয়াই রেনোভেসিওন কোম্পানি। রিও পোজোম নদীর ওপর দুটি বাঁধ তৈরির কাজ চলছিল। ২০১৩ থেকে ব্রিটেন সহ ৪৮টি দেশের আর্থিক অনুদান পাওয়া আইডিবি ইনভেস্ট স্পনসর কাজ করছিল এই প্রোজেক্টে। ২০১৭ পর্যন্ত ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হলে মালিকানা থেকে হঠাৎ সিদ্ধান্ত – রিও পোজোমের পাশাপাশি আরও চারটি নদী – নেগ্রো, পালমাইরা, ভারসোভিরা ও প্রাইমাভেরায় প্রকল্পের এক্সটেনশনের কাজ চলবে। মায়া-চুজ থেকে তীব্র আন্দোলন চলল। পবিত্র ইয়াল-উইজ পাহাড়ে ডিনামাইট, টানেল, নদীতে যন্ত্র – আদিবাসীদের আর কে আছে পাহাড়, নদী ছাড়া! ২০১৭-র ১৭ জানুয়ারি ইক্সিকুইসিসের ইউলচা ফ্রন্টেরা গ্রামে হাজারের কাছাকাছি আদিবাসী বিক্ষোভ, পুলিশ-কোম্পানি নিরাপত্তা রক্ষী আঁতাত এবং ফায়ারিং। ৬৮ বছরের সেবাস্টিয়ান অ্যালোঞ্জোর মাথায়, বুকে দু’দুটো ফেটাল বুলেট। চার ঘন্টা সংজ্ঞাহীন পড়ে থাকা, তিনঘণ্টা হাসপাতালের রাস্তা – সত্তরের কাছাকাছি শরীর এতটা নেয়! ২০১৮-র অক্টোবরে ইক্সিকুইসিসে আরেকটি বিক্ষোভে ছ’জন মারাত্মক আহত হলেন। সেবছর ডিসেম্বরে আন্দোলনকর্মী দুই ভাই নেরি ও ডমিঙ্গো এস্তেবান পেদ্রোর ক্ষতবিক্ষত নিঃস্পন্দ শরীর পাওয়া যায় স্থানীয় একটি নদীর কাছে। ক্রমাগত ডেথ থ্রেট এবং ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন অন্যতম প্রতিবাদী পরিবেশকর্মী তরুণী আরসিলা পেরেজ। এবং এসমস্ত অসম্ভব ত্যাগের প্রাপ্তি বলতে ২০২২-এ প্রোজেক্ট থেকে হাত সরিয়ে নেওয়া আইডিবি ইনভেস্ট। এলাকার সামান্য কিছু আদিবাসী উপস্থিতির কথা বলে স্পনসরশিপ এনে আসলে যে অঞ্চলের ৮৬ শতাংশ অংশই আদিবাসী, এ তথ্যই নাকি কোম্পানি থেকে বেমালুম চেপে যাওয়ায় হয়েছিল আইডিবি-র কাছে। সবকিছু মিলিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ আপাতত স্থগিত।

সেবাস্টিয়ান অ্যালেঞ্জোর সমাধির কাছে চোখের জল মুছছেন পুত্র পরিবেশকর্মী জোয়ান অ্যালেঞ্জো (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

দুএকটি আরও অন্যান্য হত্যার দিক। মায়া বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্যতম কোর অঞ্চল সিয়েরা ডেল লাকানডন ন্যাশনাল পার্কের ভেতর চলে যেতেন স্থানীয় লা লুচা কোঅপারেটিভের প্রেসিডেন্ট নির্ভীক পরিবেশকর্মী ওয়াল্টার ম্যানফ্রেডো মেন্ডিজ ব্যারিওজ। অরণ্যের সাস্টেনেবল টিম্বার হারভেস্টিং-এর পাশাপাশি ‘পিটেন ফ্রন্ট এগেইন্সট ড্যাম’ সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন ওয়াল্টার। ২০১৬-র ১৬ মার্চ বছর ছত্রিশের ওয়াল্টারের গুলিবিদ্ধ শরীর হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার সময় দেয়নি। ঘরে ছয় সন্তান। অথবা গ্রহ জুড়ে চিরাচরিত পাম-অয়েল ভ্রুকুটি। লা প্যাশন নদীতে দেশের বৃহত্তম পাম-অয়েল প্রোডাকশন ইউনিট গ্রুপো ওলমেকা-র সাবসিডিয়ারি রেপসা ফ্যাক্টরির কুখ্যাত পাম অয়েল স্পিলেজ হয় ২০১৫-র জুনে। অন্তত ২৩টি প্রজাতির মাছের লাশে ভয়ঙ্কর লা প্যাশনের ১০০ মাইল, মাথায় হাত প্রায় ১২,০০০ চাষির। অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত সায়াক্সচে মিউনিসিপালিটির স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, কর্মী রিগোবার্তা লিমা চোকের নেতৃত্বে রেপসা-র বিরুদ্ধে মামলা ঋজু হয়। কোর্ট থেকে রেপসা-কে সাসপেনশন ধরানোর পরের দিন ২০১৫-র ১৮ সেপ্টেম্বর বছর আটাশের রিগোবার্তা ফেটাল গানশট পান। একইদিনে অপহৃত হয়ে অত্যাচার ও শাসানির পর কোনওক্রমে ছাড়া পান আরও তিন আন্দোলনকর্মী। এবং শেষে নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গল ঘেঁষা ছোট্ট দেশ বেলিজের পরিবেশকর্মী জোন রেমনারেসের কথা। বেলিজ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের বেলমোপানের বছর আটত্রিশের তরুণ রেমনারেস আধুনিকতম জিপিএস বোট টেকনোলজি, গ্লোবাল পার্ক ডিফেন্স, স্মার্ট পেট্রোল দিয়ে বেলিজের কোস্টাল ইকোসিস্টেমের ওপর নজরদারি চালাতেন। নিজে ছিলেন পরিবেশ সংস্থা টার্নফ অ্যাটল সাস্টেনেবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা-কর্মী। কোরাল রিফ, ম্যানগ্রোভ বাঁচাতে ছুটতেন পাগলের মতো। ২০২৩-এর ৩১ ডিসেম্বর নিউ ইয়ার্স ইভ পালনের সময় ভাই ডেভিডের সঙ্গে ফেটাল বুলেট পান। দুই ভাই একসঙ্গে শহিদ। তাঁদের স্ত্রীরা বুলেটের দাগ থেকে বেঁচে ফিরে ২০২৪-এর অসহ্য স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবেন বাকি জীবন।

মায়া বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ভেতর পরিবেশকর্মী ওয়াল্টার ব্যারিওজ (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গলের অন্ধকারের গল্পে পর্দা পড়ে না। খনির গরম রক্তে ক্রমশ লাল থেকে টকটকে লাল হয় সান সেবাস্টিয়ান নদী, ইসাবেল লেক। সাময়িক স্থিতাবস্থা পেরিয়েও কতদূর নিরাপদ রিও পোজোম? পিতার হত্যার পর থেকে কথা বলতে গেলে আটকে যায় ছেলে পরিবেশকর্মী জুয়ান অ্যালেঞ্জোর। তবুও এখনও রক্ত গরম ইক্সিকুইসিসের বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তরুণী মারিয়া বাতিস্তার। ফেনিক্স বিরোধী আন্দোলনে এখনও ভাঁজ পড়া চামড়া নিয়ে লড়ছেন আন্দোলনকর্মী ক্রিস্টোবেল পপ। রিও পোজোম থেকে বহুজাতিক কোম্পানিকে সাময়িক আটকে দিয়ে বেলা লিন্ডা গ্রামের তরুণী ক্যাটালিনা বলছেন – ‘জলসম্পদকে রক্ষা করাই আমাদের সন্তানদের উপহার হিসেবে দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ’। উঠে আসছে, ভীষণভাবে উঠে আসছে ১৯৬৭ সালের নোবেলজয়ী গুয়াতেমালান কবি, ঔপন্যাসিক মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল অস্টারিয়াস রোজালেসের সেইসমস্ত কথা – ‘রাইজ অ্যান্ড ডিম্যান্ড, ইউ আর আ বার্নিং ফ্লেম, ইউ আর সিওর টু কনকোয়্যার দেয়ার হোয়্যার দ্য ফাইনাল হোরাইজোন বিকামস আ ড্রপ অফ ব্লাড, আ ড্রপ অফ লাইফ …’

এখনও ফেনিক্স মাইন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পরিবেশকর্মী ক্রিস্টোবেল পপ (ছবিসূত্র – দ্য ইন্টারসেপ্ট)

এখনও কাজ করে যাচ্ছেন এনার্জিয়া রেনোভাসিওনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা প্রথম মহিলা পরিবেশকর্মী মারিয়া বাতিস্তা (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

 

ঋণস্বীকার

১. Cavanagh, John, Perez-Rocha, Manuel & Alperstein, Olivia. Institute for Policy Studies calls on Salvadoran government to release from prison leading Water Defenders arrested on January 11. January 13, 2023. Institute for Policy Studies.

২. Cuffe, Sandra. Guatemalan activists murdered after court suspends palm oil company operations. September 30, 2015. Monagbay.

৩. Cuffe, Sandra. Killing of Guatemalan activist in the Maya Biosphere Reserve raises alarm. March 18, 2016. Mongabay.

৪. Cuffe, Sandra. Land, environmental activist killings surge in Guatemala: report. July 30, 2019. Aljazeera.

৫. Cuffe, Sandra. The hidden story of a notorious Guatemalan nickel mine. March 27, 2022. The Intercept.

৬. Dinechin, Paloma de. ‘He had a machete in his cheek’; How Guatemala’s hydropower dream turned deadly. January 22, 2024. The Guardian.

৭. Environmentlaists threatened, murdred in El Salvador. February 2, 2012. Friends of the Earth.

৮. Funes, Yessenia & Gerace, Anthony. How El Salvador’s iron-first regime is quashing environmental resistance. January 24, 2024. Atmos.

৯. Garside, Julitte. How witnessing a police shooting put a Guatemalan journalist in danger. January 19. 2019. The Guardian.

১০. Gold fever: Big mining companies circle as El Salvador prepares to reverse ban. February 3, 2024. The Guardian.

১১. Hines, Ali. Decade of Defiance. September 29, 2022. Global Witness.

১২. Karunananthan, Meera. El Salvador mining ban could establish a vital water security precedent. January 10, 2013. The Guardian.

১৩. Lakhani, Nina. El Salvador makes history as first nation to impose blanket ban on metal mining. March 30, 2017. The Guardian.

১৪. Lakhani, Nina. Salvadoran environmental defenders detained for decades-old crimes. March 14, 2023. The Guardian.

১৫. Provost, Claire. El Salvador’s communities battle to keep their gold in the ground. April 11, 2014. The Guardian.

১৬. Radwin, Maxwell. International community calls for release of El Salvador antimining activists. August 2, 2023. Mongabay.

১৭. Radwin, Maxwell. Is El Salvador preparing to reverse its landmark mining ban? February 7, 2023. Mongabay.

১৮. Radwin, Maxwell. Murdered Belize environmentalist helped boost marine conservation through technology. January 10, 2023. Mongabay.

১৯. Rodriguez, James. Where impunity reigns: Nickel mining in El Astor, Guatemala. January 20, 2021. Sage Journals.

২০. Schalk, Owen. National and international groups call for governments to take actions against OceanaGold. March 17, 2023. Canadian Dimension.

২১. Stoumbelis, Alexis. Anti-mining activists killed in El Salvador. December 29, 2009. Democracy Now.

২২.https://www.frontlinedefenders.org/en/case/carlos-maaz-coc-killed-while-participating-peaceful-demonstration

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *