উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৮। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
একদিন দুপুরে সত্যেন সেনের সামনে চেয়ারে বসে আছি, কথা বলছি, দেখি চিত্তদা ঢুকলেন। বোধহয় অন্য কোনও ঘর থেকে বেরোলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কখন এসেছো?
বললাম, কিছুক্ষণ আগে।
জিজ্ঞাসা করলেন, অফিসে যাবে তো?
-হ্যাঁ।
-আমার সঙ্গে চলো।
সত্যেনদার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বেরিয়ে এলেন। আমিও এলাম। দেখি অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িতে সত্যেনদার সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে দু’একটা প্রশ্ন করলেন। তারপর থেকেই আমার সঙ্গে তার ব্যবহার বদলে গেল। হয়তো ভেবেছিলেন আমিও রাশিয়ান লবির। একারণেই হয়তো একটু প্রশ্রয়ই দিতেন। সময়ে-অসময়ে নানা কাজে ডেকে পাঠাতেন।
নবম-দশম বছর দুয়েক প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে গেল। হলো নতুন পত্রিকা ‘কিশোর মন’। নীরদ হাজরাই সম্পাদক রয়ে গেলেন। কিছুদিন পর তাকে চলে যেতে হলো। এলেন অদ্রীশ বর্ধন। রহস্য-রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা কাহিনী আর অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর তখন বেশ নাম। তিনি নতুন ছাঁচে পত্রিকাকে ঢেলে সাজালেন। প্রকাশনীর প্রধান সম্পাদক এবং মালিক অশোক চৌধুরী পত্রিকায় নতুন ভাবনা এনে দিলেন। শুরু হল প্রচ্ছদ কাহিনি, শুরু হল বিভিন্ন বিভাগ। অনেকটাই দায়িত্ব পড়ল এই উড়নচণ্ডীর উপর। সঙ্গে ছিল পত্রিকার অঙ্গসজ্জা এবং পত্রিকা প্রকাশ তারিখ ঠিক রেখে ছাপতে পাঠানোর কাজ। কাগজের পত্রিকাভাষায় ‘অপসমন’। ফলে অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে যেমন হৃদ্যতা গড়ে উঠল, তেমনই চিত্তদার সঙ্গেও তৈরি হল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একদিন দুপুরে ডেকে পাঠালেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, সত্যেনদা মারা গেছেন। পিজিতে আছেন। আমি ওর বাড়ি যাবো। তুমি যেতে পারো।
গিয়েছিলাম শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। অবশ্য শ্রাদ্ধে যাওয়া হয়নি। চিত্তদাকে খবরটা দিয়েছিলাম। আমার যাওয়া হয়নি। কী কারণে যাইনি, আজ আর মনে নেই। না থাকারই কথা। তবে এটুকু মনে আছে, এরপরেও কারো সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়নি। নৌকা যেমন চলছিল, তেমনই চলছিল নদীর স্রোতের টানে। ইত্যাদি প্রকাশনী যতদিন বেঁচে ছিল নব্বই দশকের ঠিক আগে পর্যন্ত, চিত্তদার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা চলত। তারপরেও কিন্তু সম্পর্ক একই থেকে গেল। তিনি তখন এ কাগজ থেকে ও কাগজে। আমিও নানা সময়ে সদ্য গজিয়ে ওঠা কাগজগুলোতে মাথা সেঁধিয়ে দিচ্ছি। সেই সময়গুলোতেও চিত্তদার সঙ্গে দেখা হলেই দু-দণ্ড কথা হতো। কুশল বিনিময় হতো। এখনও হয়। তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র হচ্ছে। সেটাও জানালেন একদিন। মাঝে মাঝেই দূরালাপে কথা হয়। এখন আর নতুন কথা কি হতে পারে অতীত ঘাঁটা ছাড়া!
কিন্তু অদ্রীশদার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে গেল। কখনও কোথায় দেখা হয়ে গেলে সামান্য কথা হতো। যতদিন ‘কিশোর মন’ ছিল এবং তিনি সম্পাদক ছিলেন, সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কখনো কখনো তাঁর খুপরিতে ডেকে ব্যক্তিগত আলাপনও করেছেন। তার স্ত্রী দীর্ঘদিন বিগত হয়েছিলেন। একমাত্র সন্তানকে মানুষ করার জন্য বেঙ্গল কেমিক্যালের উঁচুপদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুধু লিখে জীবিকা নির্বাহ করতেন। থাকতেন বেলেঘাটায় এক সরকারি আবাসনের দুকামরার কুঠুরিতে। মাতৃস্নেহে সন্তানকে মানুষ করেছেন। শিয়ালদহের কাছে লেবুতলা পার্কের কাছে তার একটা মুদ্রণী ছিল। সেখান থেকে বের হতো ‘ফ্যানটাসটিক’ পত্রিকা। কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকা, যার শিরোনাম অঙ্কন করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে লিখতেন। পরে নানা কাজের চাপে পত্রিকা আর নিয়মিত বের হতো না। তবে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের ধারা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। বেশ মনে আছে রেডিওতে বিজ্ঞানের আসরে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায় এবং অদ্রীশ বর্ধন ‘সবুজ মানুষ’ নামে একটা গল্প লিখেছিলেন। সেই গল্প পড়াও হয়েছিল। এটা বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে একটা ইতিহাস।
‘কিশোর মন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অদ্রীশদা আবার নিজের ঠেকে এসে বসলেন। মানে, সেই প্রেসে। প্রকাশনীর কাজ শুরু করলেন। বের হতে লাগল একের পর এক বই। ছোটোদের জন্য একটা ভূতের গল্প সংকলন বের করেন। সেখানে আমারও একটা গল্প রাখলেন। বইয়ের নামকরণও আমার করে দেওয়া। তারপর যা হয় আর কি! ধারাবাহিক অদর্শনে তিনি ধূসর হতে লাগলেন। একমাত্র বইমেলায় তার সঙ্গে দেখা হতো ‘ফ্যানটাসটিক’ স্টলে। কথা হতো, কিন্তু সে আর কতক্ষণ। বই দর্শনার্থীর ভিড়ে তিনি প্রায় হারিয়ে যেতেন। এভাবেই চলতে চলতে একদিন সংবাদ এলো, তিনি নেই রাজ্যে চলে গেছেন। ব্যাস, এখানেই সম্পর্কের ইতি।
আবার স্মৃতির শহরে
অনেকদিন তো হল, চলুন একবার দেবদাসদের সঙ্গে দেখা করে আসি। দেবদাস আচার্য। ষাটের দশক থেকে তার লেখালেখি শুরু। পাশাপাশি লিখেছেন নাটক, উপন্যাস, আত্মজীবনী। সেসব ছাপাও হয়েছে। সত্তর দশকের প্রথম দিকে প্রকাশিত হল ‘মানুষের মূর্তি’। তিনি বের করতে লাগলেন, ‘ভাইরাস’ কবিতার কাগজ। সেই কাগজকে ঘিরে শুধু শহর নয়, বাংলা বাজারে তরুণ কবিতের সে কী উত্তেজনা। সেই সময়ের তরুণ কবিদের কার পা পড়েনি তার রাধানগরের বাড়িতে।
তবে কবি মজনু মোস্তাফা, মানে নির্মাল্য ভট্টাচার্য্যকে ঘিরে যে উন্মাদনা শহরে ছিল, দেবদাসদাকে নিয়ে তা ছিল না। তবে দুজনের মধ্যে সখ্যতার অভাবও ছিল না। দেবদাস আচার্যর প্রথম কবিতা বোধহয় পড়ি ‘সমুদ্র’ নামে একটা ছোটো পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন সমুদ্র সেন। তিনি কে জানি না। তবে পত্রিকাটি স্থায়ী হয়নি। সত্তরের দ্বিতীয় কি তৃতীয় পর্বেই পরিচয়। কীভাবে হলো, জানি না হয়ে গেল। তখন তিনি নানা রকম পত্রিকার পরিকল্পনা করতেন। কোনওটা আলোর মুখ দেখতো, কোনওটা ভ্রণেই নষ্ট হতো। একবার একটা গদ্যের কাগজের পরিকল্পনা করলেন। বেশ মনে আছে, জর্জ কোর্টের মোড়ে, লেখরাজদার দোকানে দেবদাসদা, গল্পকার শচীন বিশ্বাস, নীহার ব্যানার্জির সঙ্গে বসে পরিকল্পনা হয়। মূলত কুসংস্কার বিরোধই সমাজ-সংস্কৃতির পত্রিকা। কী নাম দেওয়া হয়েছিল, মনে নেই। তবে এই উড়নচণ্ডীও একখণ্ড গদ্য লিখেছিল লিখেছিল ভূতে ধরা নিয়ে। সে কাগজ স্বাভাবিক নিয়মেই অবলুপ্ত হয়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শচীন বিশ্বাস। এরপর বের করলেন ‘কৃষ্ণনগর’। ট্যাবলয়েড মাপের কবিতার কাগজ। ততদিনে শোভন মুদ্রণীর প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে পাত্রবাজারে রবিদাদের বাড়িতে। ‘কৃষ্ণনগর’ কবিতার কাগজ। এই কাগজেই জয় গোস্বামীকে প্রায় পাওয়া যায়। সেই পত্রিকাও বন্ধ হল। তারপর ‘ভাইরাস’। এই পত্রিকার বের করার সময়েই দেবদাস আচার্য বাংলোর তরুণ কবিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন, ফলে তার পরিচিতিও বাড়তে থাকে।
তার সমকালীন গল্পকার শচীন বিশ্বাস ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক। মৃদুভাষী। ধুতি-পাঞ্জাবী শোভিত এই মানুষটির ঠোঁট থেকে বাংলাদেশের কোনও এক অঞ্চলের কথ্যভাষায় টান মুছে যায়নি। নিরীহ এই মানুষটির ভিতর ছিল আগুন। তার ছোটোগল্পে সে সবই ফুটে ওঠে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ, বোধ হয় নাম ছিল ‘জীবনযাপন’, থেকেই তিনি বাংলা ছোটগল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী হিসাবে নিজেকে জানান দিয়েছিলেন। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের গতি রুদ্ধ হয়ে গেলে এবং সিপি আই (এম এল) বহুধাবিভক্ত হয়ে, যখন দিশাহীন হয়ে পড়েছিল, সেই সময় এই শহরেও প্রায় আঁচ এসে পড়ে। কে যে কোন সিপিআই (এম এল)-র ভাগে, বুঝে ওঠা দুষ্কর হয়ে ওঠে। সকলেই হিসেব করে পা ফেলতে চায়। এই সময়ে পার্টির কোনও কোনও অংশ গণসংগঠনের উপর জোর দিল। কলকাতায় তৈরি হল বিপ্লবী লেখক সংঘ। তার নেতা ছিলেন দেবব্রত পান্ডা। তিনি কোনও এক কলেজে পড়াতেন। শচীন বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তিনি কৃষ্ণনগরেও শাখা খুলতে এলেন। ছিলেন কৃষ্ণনগরের পলিকেটনিক কলেজের মাস্টারমশাই সত্য বাগচী। তিনি ছিলেন গোপন নকশালপন্থী। গঠিত হল কমিটি। কারা যে সেই কমিটিতে ছিলেন সেসব মনে নেই। তবে সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের হল। নাম ‘বাসভূমি’। সম্পাদক শচীন বিশ্বাস। বিপ্লবী সাহিত্যের যাত্রীভূমি। শহরের গল্প-কবিতা লিখেছেন সেই পত্রিকায়। কত দিন বেরিয়েছিল পত্রিকা স্মরণে নেই। বিপ্লবী লেখক সংঘের অস্তিত্ব কখন কিভাবে বিলুপ্ত হল, সে সব অন্ধকারেই রয়ে গেছে। কিন্তু শচীন বিশ্বাস তেমনই রয়ে গেলেন। মূলত বামপন্থী পত্রিকাগুলোতেই তিনি বেশি লিখতেন। চতুরঙ্গ, পরিচয় ইত্যাদি কাগজে। নিজের মধ্যে নিজের জগতে থাকতেন তিনি। বিপ্লবের আগুন স্তিমিত হয়ে গেলে এবং সত্তর দশক মুক্তি এনে দিতে না পারায় হয়তো একটু হতাশও ছিলেন। উড়নচণ্ডীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও ক্রমশ তা ম্রিয়মান হয়ে যায়। বাসভূমিতে বোধ হয় আর বের হয়নি। পরে শুনেছি বহরমপুর থেকে একই নামে একটি পত্রিকা বের হয়, জানি না সেটা একই পত্রিকা কিনা। শহরের উপকণ্ঠে ‘অঙ্গনা’ নামে একটা আবাসন, এলাকায় তিনি বাসা বেঁধেছিলেন। প্রায় নির্জনে থাকতেন। কখনো হঠাৎ গেলে বিব্রত হতেন না। আন্তরিক আহ্বানে দু’দণ্ড বসে কথা বলা যেতো। একদিন কোনও এক সুহৃদ মারফৎ জানা গেল শচীনদা আর নেই। ক্রমশ তিনি বোধ হয় শহরের স্মৃতি থেকেও নেই হয়ে গেছেন।
কিন্তু নীহারদা আছেন। শহরের সাংস্কৃতিকভূমিতে প্রবীণ নীহারদা এখনও উজ্জীবিত কারণ তরুণ প্রজন্মকে। কৃষ্ণনগর শহরের সংস্কৃতির কথা নীহারদাকে উপেক্ষা করে বলা যায় না। এর আগে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নীহারদা, মানে নীহার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা এসেছে, কিন্তু যা আসেনি, তা হল এই মানুষটার দৃঢ়চেতা মানসিকতার কথা। দেবদাস আচার্যর সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই নীহারদার সঙ্গে পরিচয়। তিনি হোম গার্ডে বেশ উঁচু পদে ছিলেন। সম্ভবত সংস্কৃতি সংসদের সভ্য ছিলেন। তিনি মঞ্চে ওঠেননি, মঞ্চের বাইরে থাকতে ভালোবাসতেন। নিজে লিখতেন না, লেখকদের পৃষ্ঠপোষণা করতেন। দেবদাসদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করবেন শোভন মুদ্রণী। ব্যবসায়িক ছাপার কাজের তাঁর পৃষ্ঠপোষণায় ও শতঞ্জীবের সম্পাদনায় ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ হওয়ার ইতিবৃত্ত তো আগেই বলেছি। তিনিই ছিলেন প্রকাশক ও মুদ্রক। দেবদাসদার পরামর্শ ও পরিকল্পনায় তৈরি হল ‘লোকপ্রকাশনী’। ঠিক হল স্বল্প খরচে বেরোবে ছোটো ছোটো বই। প্রথম বই বেরোলো গল্পকার সমর ভট্টাচার্যের প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘সৌদামিনীর দিনকাল’। লেখক প্রকাশনী থেকে আর কার কার বই বেরিয়েছিল বা আদৌ বেরিয়েছিল কিনা, জানি না, তবে সে প্রকাশনী আর টেঁকেনি। পরে নীহারদা একাই এই প্রেসের মালিক হয়ে যান।
সে কোনও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নীহারদা জড়িয়ে থাকতেন। মাঝে মাজে বড়সড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করতেন। তখন তার একমাত্র শ্লোগান ছিল ‘মাঠ ঘিরে ফেলব’। মানে? মানে, কৃষ্ণনগর টাউন হলের মাঠ টিন দিয়ে ঘিরে নাটোৎসব বা সাংস্কৃতিক উৎসব করা হবে। সাতের দশকের দেখা এই স্বপ্ন তিনি সফল করেছিলেন আটের দশকের মাঝামাঝি। সময় যত এগিয়েছে, বয়সও তাকে কড়া ধমকানি দিতে শুরু করে। পাত্রবাজার থেকে প্রেস তুলে নিয়ে গেছেন কাঁঠালপোতায় নিজের বাড়িতে। ‘গ্রাম গ্রামান্তর’ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে এক সময় দেহ রাখে। অকৃতদার এই মানুষটি এখন নিজের মধ্যেই থাকেন, শুনেছি। শহরের পথে সাইকেল পরিভ্রমণে তাকে খুব কমই দেখা যায়। তবে যে কোনও অনুষ্ঠানে তার হাজিরা এখনও টের পান সাংস্কৃতিক-জনেরা।
(ক্রমশ)