উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

1

আলবার্তো মোরাভিয়া ‘আমার দেখা ভারত’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘নৌকো পৌঁছোলো ঘাটে, একটি লরি, একটি কি দুটি গো-যান, কয়েকটি পরিবার, কয়েকজন ভবঘুরে উঠলো নৌকার উপর। যেন যা এলো তাই গেল ফিরে, পারাপারের প্রয়োজনটাই যেন ফালতু হয়ে যায়।’ (বঙ্গান্তর : ফাদার দ্যাতিয়েন)

এই নৌকাই তো সেই জীবন-নৌকা, যা ভবঘুরের মতো উড়নচণ্ডী জীবনকে এপার-ওপার করে, ঘাটে ঘাটে ভিড়িয়ে দেয়। আসলে জীবনটাই তো জবন-ছুট। এ জীবন মেলে তো ও জীবন মেলে না। জীবনে জীবনে যোগ করার কত কথাই তো শুনি। কিন্তু সত্যি হয় কি? বোধ হয় না। আর হয় না বলেই চিরকাল উড়নচণ্ডী হয়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ালাম। এই ঘুরে বেড়ানো বা উড়ে বেড়ানোর বয়সও তো কম হল না। সেই সকাল থেকে বিকেলের দিকে গড়াচ্ছিল যখন বয়স, তখনই বাবা বলেছিল, উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে বেড়ালে চলবে? একটা কাজ কামের চেষ্টা করো।

চেষ্টা ছিল না এমন নয়, সকলেরই যেমন চেষ্টা থাকে, সেই জৈবিক চেষ্টা হয়তো ছিল, কিন্তু জীবনটাকে এতোল-বেতোল করে দিতেই আনন্দ ছিল ঢের। কিন্তু সুয্যি মাঝ মাঠ থেকে পেনাল্টির দিকে বল গড়িয়ে দেবার আগেই ঘাটের মাঝি নৌকাটাকে বেঁধে ফেলল খুঁটিতে। পায়ে পরলো ভদ্দর লোকের বেড়ি। কিন্তু মন যেখানে রাখাল রাজা, সেখানে বেঁধে রাখে কার সাধ্যি? ভিতরে সেই উড়নচণ্ডীই রয়ে গেলাম। ওড়াটাই যেন নেশা হয়ে গেল। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যখন হোঁচট খেয়ে দম নেবার ফুরসত মিলল, তখনই ভেসে উঠল ছায়াছায়া মুখের ছবি।

মাঝে মাঝে মনে হয়, সব মানুষই তো ভিতরে ভিতরে উড়নচণ্ডী। সে গৃহীই হোক কি বিবাগী। সংসার সংসার করে এই যে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে, যেন তা উড়তে না পারার হা-হুতাশ। পায়ে শিকল বাঁধা ময়না যেন, উড়তে চায় কিন্তু পারে না। যার সাধ্যি আছে সে না হয় বেরোলো, কিন্তু যার সাধ্যি নেই সে তো মনের মধ্যেই ডানা ঝাপটায়। আর ওই যে, যিনি গৃহদেবতা হয়ে বিরাজ করছেন, তার মনটাও কি উড়ু উড়ু করে না? আত্মপরিজনের ‘মানুষ নয়গো – দেবতা বটে’ স্তুতিও কি তাকে বাঁধতে পারে? এই যে স্তুতির জলবাতাসা দিয়ে তাকে পূজ্য করে তুলল, তারও কি সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না? করে তো। নইলে তিনকালে এসে জীবনের গলুইয়ে বসে কপালের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলে ফেলে – ‘কিছুই পেলাম নারে!’

এই হা-হুতাশ সর্বত্র। জীবনের তৃতীয় সন্ধ্যা বড় বিব্রতময়। ওই বুড়িটাকেও বোধহয় তিনকাল বড় জ্বালাতো। ওই যে বুড়িটা, ঝাঁটা হাতে উঠোন ঝাঁটা দিতে দিতে চিৎকার করত, ‘মর মর তিনকালে গিয়ে এককালে ঠেকেছে। তবু মিনসের হুঁশ হল না! মরবি মরবি, একালে মরবি। তোকে কালসাপে খাবে।’

কার উদ্দেশে বলা, শুধু সেই জানে। যদি তার অস্তিস্ত্ব থাকে ইহপৃথিবীতে। বুড়ির স্বামী গত হয়েছে বহু বছর। পুত্র-কন্যাও নেই। শ্মশান আগলানোর মতো ঘর-সংসার আসলাচ্ছে। লোকে বলে, মাথাটা গেছে। গ্রামের লোক ঘাঁটায় না। ছেলে-ছোকরার মস্করা-বচন, নাট-বল্টু ঢিলে হয়ে গিয়েছে।

এসব তো ওপরের কথা। ভিতরের কথাটা জানে কজন? বুকের ভিতর যে দুঃখ-অভিমান নিয়ে দিনযাপন করছে, তারই বা হদিশ রাখে কে? দিন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারের হাল যে কে ঠেলছে তার তো খবর রাখার কেউ নেই, অথচ চলছে। আপন গতিতেই চলছে। জনমানবের কোনও দায় নেই খবর রাখার। রাখে না তো! আর রাখে না বলেই সেই মাস্টারমশাইয়ের ব্যাথাদীর্ণ বুকটাও কেউ দেখতে পায়নি।

ওই যে সেই মাস্টারমশাই, যারা শরীরে প্রৌঢ়ত্ব, চুলের উপর রুপোলি চিকন সুতো, রোদে চিক চিক করে, রোজ সকালে কাঠের হাতলবিহীন চেয়ারে বউকে বসিয়ে স্থান করাতো। বউটা উঠে পালিয়ে যেতে চাই তো, ধরে বসায়। দু-চার ঘা দেয়। চিৎকার শুরু করে মাষ্টার। বউ গলা ফাটিয়ে কাঁদে। পাড়ার লোকজন জড়ো হয় কচাগাছের বেড়ার ধারে। যেন ফিলিমের শুটিং দেখছে। মাষ্টার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, এখেনে কি যাত্রাপালা হচ্ছে? ভাগ সব। আমি মরছি আমরা জ্বালায়, লোকের আর ফূর্তি ধরে না।

ভিড় পাতলা হয়। বউকে চান করিয়ে আড়ালে নিয়ে যায়। এ কাজ তার নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রাইমারি ইস্কুলের মাষ্টার মশাই একাই সংসারে লগি ঠেলে। বাজার করে, রান্না করে, বউকে খাইয়ে তারপর ইস্কুলে যায়।

এসব যখন ঘটে চলে, ঘরের ভিতর বাবু জোরে জোরে ইতিহাস মুখস্থ করে কিংবা এক মনে অঙ্ক কষে যায়। তার কোনও হুঁশ নেই। এগুলো জীবনের অলঙ্কার হিসেবে মেনে নিয়েছে। বইয়ের জগৎই তাকে উন্মনা করে রাখে। ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় হতো। সেই বাবু প্রথম ডিভিশনে ক্লাস ইলেভেনের উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বি এস সি পড়তে গেল। ততদিনে তার মায়ের প্রয়াণ ঘটেছে।

সেদিনও পাড়ার লোক ভিড় করেছে। কচা বেড়া পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে উঠোনে। মাষ্টার সেদিন খেদিয়ে দেয়নি কাউকে। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে প্যানিং শটের মতো শুধু চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। পাড়ার ছেলেরাই মতিচ্ছিন্ন বৃদ্ধার মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল। বাবু সেদিনও ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসেছিল নির্বিকার। ওর দিদি এসেছিল স্বামী নিয়ে। তাকেই কেবল কাঁদতে দেখেছিল সকলে। বাকিদের শুধু উদাস চাহনি।

এই মৃত্যু নিয়েও কম কানাঘুষো হয়নি। আগের দিনও বুড়িকে স্নান করিয়েছে মাষ্টার। বাবু ঘরে ছাত্র পড়িয়েছে। সে বি এস সি পাশ করে এখন ছাত্র পড়ায়। মাষ্টার অবসর নিয়েছেন। পরদিন সকলে পাড়ার ছেলেদের ডাকাডাকি করল মাষ্টার। সকলে গিয়ে দেখল বুড়ি মরে কাঠ। সৎকার তো হবে, ডাক্তারের সার্টিফিকেট তো লাগবে। ডাক্তার কোথায়? খোঁজ খোঁজ। কে একজন এক বৃদ্ধ ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকল। এল এম এফ। শহরের বেশ নাম আছে। অবিনাশ ডাক্তার। তিনি এসে কল গিয়ে পরীক্ষা টরিক্ষা করে, সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে বিদায় নিলেন। যখন তিনি ফিরতি রিক্সায় উঠলেন, খুব কাছে গিয়ে নিচু স্বরে শুধালাম, কী বুঝলেন? ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন হার্ট অ্যাটাক।

ডাক্তার যা লেখার লিখেছেন, কিন্তু মানুষেরা কানাকানি ঠেকাবে কার সাধ্যি। সন্দেহটা ঝড়ের মতো বইলো কদিন – মাষ্টার নিজেই পরিসমাপ্তি ঘটায় নি তো!

সেই থেকে বাড়িটা কেমন ছমছমে হয়ে গেল। মাষ্টার চুপচাপ। বাবুও। বাড়ি জুড়ে শোকের আবহ। শুধু বাবু যখন সকালে টিউশন পড়ায়, তখনই ছাত্রদের কলকাকলিতে বাড়িটা মুখর হয়ে ওঠে। তাও কতক্ষণের জন্য? দু-এক ঘন্টা। বাকি সময়টা ঘড়ির নিয়মে চলে। মাষ্টার ইস্কুলে চলে যায়। বাবু ঘরে একা। কলেজের পড়া শেষ। পাড়ার কারো সঙ্গে মেশে না। কথা বলে না। মাঝে মাঝে বাজারের থলি হাতে পথ হাঁটে উদাসী মনে। যেন  সে চলেছে কোন নিরুদ্দেশের পথে।

তা সেই বাবু একদিন হারিয়ে গেল। বাজারের থলি হাতে বেরিয়েছিল, আর ফেরেনি। অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল প্রতিবেশীরা। ফেরেনি। মাষ্টার থানা-পুলিশ করেছিল কিনা কেউ জানে না। মাষ্টার একা। নিরাসক্ত, সন্ন্যাসীর মতো ধ্যান গম্ভীর। মাঝে মাঝে মেয়ে-জামাই আসে। দু-চারদিন থাকে। তারপর নিজের সংসারে ফিরে যায়। আর মাষ্টার সকাল-সন্ধে উঠোনে দরজার সামনে কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে থাকে। দূর নীলিমায় ছড়িয়ে দেয় চোখ। বোধহয় খুঁজে বেড়ায় পুরনো সংসার। বাতাসে সাদা ফেঁসোর মতো চুল খুঁজতে থাকে। নিজের সঙ্গে কথা বলে মাষ্টার। কখনও বিড়বিড় করে, কখনো একটু জোরে। নিজেই ঝগড়া করে, হাসে, অভিমান করে। পাড়ার লোকেরা বলে, মাথায় ছিট হয়েছে। কচি ছেলের বল বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকি দেয় পরম কৌতূহলে। হাতছানি দিয়ে ডাকে মাষ্টার। ওরা ভয়ে পালায়। আবার কোনোদিন হয়তো একটা কঞ্চি নিয়ে চিৎকার করে শাসন করে কাউকে। আসবাবপত্রের উপর পড়ে কঞ্চির ঘা।

কোথা থেকে খবর পেয়ে মেয়ে-জামাই এসে বাবাকে নিয়ে চলে গেল তারা। ঘরে তালা। তারপর বহুদিন ঘরে কারো পা পড়েনি। পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বাড়িটা। সন্ধে হলেই মনে হয় গুমড়ে কাঁদছে বাড়ির ইটগুলো। কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, বেজির নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে বাড়িটা। নির্জন বাড়িটায় জ্যোৎস্না যখন খেলে বেড়ায়, তখন সে কাঁদে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে। মুখে মুখে রচিত হয় কল্পকাহিনি। অমাবস্যার রাতে মাষ্টারের বউ আসে, ঘুরে বেড়ায়। একদিন নাকি বাবুও দাঁড়িয়েছিল উঠোনে। নাম ধরে ডাকতেই সব ভোঁ ভোঁ। ভ্যানিশ।

অনেকেই বলে মৃত্যুর পর অতৃপ্ত আত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়। অপঘাতে মৃতরাও নাকি খোঁজ খবর করতে আসে। জানি না। এমন কোনো মৃতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। সুতরাং তাদের সাক্ষাৎকারও নিতে পারিনি। তবে মৃত্যু নিয়ে আত্মা নিয়ে মানুষের দ্বন্দ্ব আছেই। আর আছে বলেই তো এত অলৌকিক কাহিনির ছড়াছড়ি।

 

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

  1. খুব ভালো লাগলো। পরবর্তী পর্বগুলো পড়তে চাই। আশা করি এই ভাবেই ফেসবুকে দেখা যাবে আর পড়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *