সেকালের রথযাত্রা। শেষ পর্ব। দীনেন্দ্রকুমার রায়।
প্রতি বৎসরেই রথের দিন বৃষ্টি হয়। আজ এতক্ষণও বৃষ্টি নামে নাই ; ভয়ানক গরম,– যাহাকে গুমট বলে, তাহাই হইয়াছে ; আকাশ ঘনীভূত মেঘে সমাচ্ছন্ন। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে অল্প বাতাস ও মুষলধারে বৃষ্টিপাত আরম্ভ হইল। দর্শকবৃন্দের মধ্যে যাহাদের ছাতা ছিল, তাহারা ছাতা মাথায় দিয়া চলিল ; অনেকে চাদর মুড়ি দিয়া দৌড়াইতে লাগিল। স্ত্রীলোকেরা ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িল ; ছেলে কোলে লইয়া দৌড়াইতেও পারে না, দাড়াঁইয়া ভিজিতেও কষ্ট ; কয়েকপদ দ্রুতবেগে চলিয়াই শ্রমভারে মন্থর হইয়া আসে। গোবিন্দদেবকে যথারীতি ভােগ নিবেদন করিবারও অবসর হইল না ; সকলে ব্যস্তভাবে তাঁহাকে রথ হইতে নামাইয়া ঘরে লইয়া গেল।
দশ মিনিটের মধ্যে রথতলা জনহীন হইয়া পড়িল। চারিদিক অন্ধকার। বায়ুর সনসন, মেঘের ঘন গর্জ্জন ও ঝমঝম বর্ষণের মিশ্র কলতানে বর্ষার গান জমিয়া গেল। একঘন্টা পূর্ব্বে যে রথতলা মহোৎসব-মত্ত অসংখ্য নরনারীর হর্ষকলরবে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল, এখন তাহা নির্জন, নীরব,– বিদ্যুদ্দামস্ফুরিত মেঘমন্দ্রমুখরিত নববর্ষার অবিরল ধারায় অভিষিক্ত ; শুধু দেবপরিত্যক্ত গৌরববিচ্যুত বংশরথ মেঘমণ্ডিত আকাশ-তলে নিঃশব্দে ভিজিতেছে, আর ঢাকির দল দেউড়ির নীচে ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর বসিয়া ঢাক বাজাইতেছে, এবং সানাইওয়ালা গাল ও গলা ফুলাইয়া, দম বন্ধ করিয়া, সানাইয়ে যথাশক্তি ফুৎকার দিয়া করুণ রাগিণীতে গায়িতেছে,–
“ব্রজ ত্যেজে যেও না, যেও না, বঁধু হে!”
বায়ু ও বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিশিয়া এই ঢক্কাধ্বনি ও সানাইয়ের এই স্বরতরঙ্গ যে অব্যক্ত মধুর রহস্যপূর্ণ কুহকময় তানের সৃষ্টি করিতেছে, তাহাতে গ্রাম-প্রান্তবর্ত্তী ম্লান দীপালোকিত ক্ষুদ্র কুটিরে মাতার নিবিড় স্নেহপূর্ণক্রোড়বিন্যস্ত নববস্ত্রপরিহিত উৎসবপ্রত্যাবৃত্ত স্তন্যপানরত শিশুর কজ্জলরঞ্জিত কোমল নয়নপল্লবে নিদ্রা ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে ; কিন্তু তাহার দুষ্টু দিদির চক্ষে ঘুম নাই ! সে তাহার নবক্রীত শোলার ডুলিখানি, টিয়ে পাখিটা ও মাটির রংকরা ছোবাদুটি লইয়া বিষম বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। — সে মিনিটে মিনিটে তাহার বিছানা হইতে উঠিতেছে, তাহার অভিলষিত স্থানে খেলনাগুলি সযত্নে সাজাইয়া রাখিতেছে ; আবার যখনই তাহার আশঙ্কা হইতেছে যে, খোকার ঘুম ভাঙ্গিলেই সে তাহার ক্ষুদ্রহস্ত প্রসারিত করিয়া এত সাধের খেলনাগুলি লইয়া ভাঙ্গিয়া দিবে, তখনই সে উঠিয়া আর একটা নূতন জায়গায় সেগুলি সরাইয়া রাখিয়া আসিতেছে।
(শেষ)