সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ৫। দীনেন্দ্রকুমার রায়

(চতুর্থ পর্বের পর)

রথ টানিবার সময় হইয়াছে বুঝিয়া ঢাকে ও ঢোলে কাঠি পড়িবা মাত্র দর্শকগণ চারিদিক হইতে রথের কাছে দৌড়াইয়া আসিল। দুই গাছি খুব মোটা ‘কাছি’ রথের কাছে পড়িয়াছিল ; ষাট-সত্তরজন লোক তাহা ধরিয়া সজোরে টানিতে লাগিল। কেহ বা টানিতে টানিতে দড়ি ছাড়িয়া একেবারে রথের উপর অশ্বদ্বয়ের সম্মুখস্থ উদ্যত পদদ্বয়ের কাছে উঠিয়া দাঁড়াইল। রথ হেলিয়া-দুলিয়া রাজপথের দিকে অগ্রসর হইল।  রাজপথে উঠিলে সকলে তাহা বাজারের দিকে টানিয়া লইয়া চলিল ; মুহুর্মুহু হরিবোল শব্দে চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঢাকীরা রথের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া মহা উৎসাহে নাচিয়া নাচিয়া পাখাওয়ালা বড় বড় ঢাকগুলা বাজাইতে লাগিল।

রথ চলিতে চলিতে একটু থামিলেই চারিদিক হইতে পানের বিড়া, সুপারি, বাতাসা, পাকাকলা, পয়সা, কড়ি গোবিন্দদেবের উদ্দেশে রথের উপর বর্ষিত হইতে লাগিল ; দুই-একটি সুপারি গোবিন্দদেবের পুরোহিত(যিনি কপিধ্বজ হইয়া গোবিন্দদেবের সিংহাসনখানি ধরিয়া বসিয়া ছিলেন) মহাশয়ের কেশশূন্য মস্তকের উপর ঠকাস করিয়া পড়িল ; তিনি চক্ষু মুদিত করিয়া একটু কাতরভাবে মস্তক অবনত করিলেন। দর্শকগণের হস্তনিক্ষিপ্ত যে সকল সামগ্রী মাধ্যাকর্ষণ-প্রভাবে পুনর্ব্বার মাটিতে আসিয়া পড়িল, চাষার ছেলে মেয়েরা জনসংকুল রাজপথের ভিড় ঠেলিয়া সেগুলা কুড়াইয়া অঞ্চলে বাঁধিতে লাগিল।

ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা রথের নিম্নতম ‘থাকে’ বসিয়া সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আমোদ উপভোগ করিতেছে। যতই জোরে ঢাক বাজিতেছে, রথ দ্রুতবেগে চলিতে চলিতে যতই দুলিতেছে, তাহারা উভয় পার্শ্বস্থ কামিনী ও দেবদারু-পত্রাচ্ছাদিত, কদম্বকুসুমভূষিত বাঁশের খুঁটা দুই হাতে ততই দৃঢ়ভাবে চাপিয়া ধরিয়া হর্ষোচ্ছ্বাসে পরস্পরের গায়ে ঢলিয়া পড়িতেছে। প্রতি মুহূর্তে নীচে পড়িয়া নিষ্পেষিত হইবার আশঙ্কা, তাহার উপর এমন উদ্দাপনার লোভ– এই সকল চপলচিত্ত বালক-বালিকা কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারে না ; তাই অনেকে মাকে না বলিয়া, এবং বাপ দাদাকে লুকাইয়া পলাইয়া আসিয়া, কোনো প্রতিবেশীর সাহায্যে রথে চড়িয়া বসিয়াছে ; উন্মাদনাপূর্ণ উদ্দাম উদ্দীপনায় তাহাদের কোমল বক্ষ স্পন্দিত হইতেছে, এবং যুগপৎ আনন্দে ও আতঙ্কে তাহাদের কচি মুখ ও ফুলের মতো কোমল গাল দুখানি লাল হইয়া উঠিতেছে।

রাজপথ দিয়া প্রায় অর্দ্ধমাইল পথ ঘুরিয়া রথ রথতলায় ফিরিয়া আসিল। তখন সন্ধ্যা সমাগতপ্রায় ; ময়রার দোকান কতক কতক উঠিয়া গিয়াছে, দর্শকগণ ধীরে ধীরে গৃহে ফিরিতেছে, এবং জনতা ক্রমেই হ্রাস হইয়া আসিতেছে ; কিন্তু এখনও পানের দোকানে ক্রেতার অভাব নাই। খিলিবিক্রেতা সাদা বোতলে লাল, নীল, সবুজ নানারঙ্গের জল পুরিয়া, ছোটো ছোটো শিশি, কাঁচের ডিশ, কাঁসার রেকাবি প্রভৃতিতে মশলা রাখিয়া দোকানখানি সুন্দররূপে সাজাইয়াছে। উৎসব প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, তথাপি তাহারা ঘন ঘন হাঁকিতেছে, “চার চার খিলি এক পয়সায়, বড় সস্তা, চাই মশলাদার গোলাপী খিলি!” চাষার দল পয়সা ফেলিয়া মুঠা মুঠা খিলি কিনিতেছে, কেহ কেহ বা শুধু পানে সন্তুষ্ট নয়, কোমর হইতে সূত্র নির্ম্মিত গেঁজে বাহির করিয়া পয়সা খুলিতে খুলিতে বলিতেছে, “দোকানি দাদা! এক পয়সার বিলাতী বিড়ি দাও, খুব তলব হবে তো?” — বিলাতী সভ্যতার প্রভাবে অনেকদিন আগেই গোবিন্দপুরে সিগারেটের আবির্ভাব হইয়াছে ; তাই রথের দিন দেখা গেল, চাষারাও খর্সান ছাড়িয়া পয়সা-জোড়া সিগারেট কিনিয়া কঠোর শ্রমলব্ধ অর্থের সদ্ব্যবহার করিতেছে!

যাহা হউক, চাষার দল পান চিবোইতে চিবোইতে পানের পিকে শুভ্র দন্তপাতি ও কৃষ্ণ অধরোষ্ঠ রঞ্জিত করিয়া অদূরবর্ত্তী নাগরদোলায় চড়িয়া বসিল। এক পয়সায় কুড়ি পাক ; কিন্তু অনেকে এক পয়সার পাক খাইয়া তৃপ্ত হইল না, বনবন করিয়া কুড়ি পাক ঘুরিয়া আসিলে নাগরদোলার বেগ কেমন মন্দীভূত হইল, অমনই তাহারা চিৎকার করিয়া বলিল, “আর এক পয়সা!” নাগরদোলা আবার সবেগে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ নাগরদোলায় উঠিয়াই গান ধরিয়াছিল–

“ঐ যায় যৈবনের তরী অকূল তুফানে।”

কুড়ি পাকের শেষে গানটা মধ্যপথে হঠাৎ থামিয়া গিয়াছিল নূতন করিয়া পাক আরম্ভ হইলে আবার তাহারা নবোৎসাহে সপ্তমে গলা চড়াইয়া সমস্বরে গায়িতে লাগিল,–

“মদনের ঢেউ নেগেছে রাখতে পারি নে!”

রথ রথতলায় আসিলে সন্ধ্যার পূর্ব্বে ঠাকুরের বৈকালিক ভোগের ব্যবস্থা আছে। সকালের ন্যায় সন্ধ্যাকালেও ব্রাহ্মণগণ ভোগ লইয়া রথের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল ; পুরোহিত ঠাকুর পূর্ব্ববৎ তাহা ঊর্দ্ধদেশ হইতে নিবেদন করিতে লাগিলেন ।

(ক্রমশ)

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *