সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ১। দীনেন্দ্রকুমার রায়

1

গোবিন্দপুরের বাঁড়ুয্যেরা বনিয়াদী বড়মানুষ, কিন্তু এখন তাহাদের ভগ্নদশা। শুনিয়াছি, পূর্ব্বকালে তাঁহাদের প্রতাপে ‘বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খাইত’! তাঁহাদের দেউড়ির সম্মুখ দিয়া কেহ পালকি হাঁকাইয়া যাইতে সাহস করিত না। কোনো অশ্বারোহী এই দেউড়ির সম্মুখস্থ রাজপথে আসিয়া পড়িলে, তাহাকে ঘোড়া হইতে নামিয়া দূরে গিয়া অশ্বে আরোহণ করিতে হইত, এবং তাহাদের লাঠিয়ালের ভয়ে নীলকর সাহেবরা গোবিন্দপুরের চতুঃসীমার মধ্যে পদার্পণ করিত না, পাছে লাঠিয়ালেরা কোনো ছলে তাহাদের অপমান করে।

বাঁড়ুয্যে বাবুদের পুরাতন ভৃত্যগণ সন্ধ্যার পর গ্রামের মধ্যে দুই একটা স্থানে আড্ডা করিয়া এই সকল পুরাতন কথার আলোচনা পূর্ব্বক সেকালের জন্য হা-হুতাশ করে, এবং অনেকখানি তামাক পোড়ায়। পূর্ব্বকালের সেই সকল প্রতাপশালী বাঁড়ুয্যে বাবুদের হীনপ্রভ, পূর্ব্ব-সম্পদ-গৌরব-চ্যুত বংশধরগণ এখনও পুরাতন চাল একেবারে ছাড়িতে পারেন নাই, গ্রামের মধ্যে দলাদলি বাধিলে তাঁহারা এক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, এবং অপর দল অপদস্থ হইলে জীবন সার্থক মনে করিয়া থাকেন। কোনো উপায়ে গ্রামস্থ লোকের ভয় ও ভক্তি আকর্ষণ করিতে পারিলে ইহাদের অনেকেই আপনাদিগকে প্রাতঃস্মরণীয় পূর্ব্বপুরুষগণের অপেক্ষা ভাগ্যবান মনে করেন, কেবল যাঁহারা ইঁহাদের মধ্যে শিক্ষিত হইয়া প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করিয়াছেন, তাঁহারাই স্ব-বংশের শোচনীয় অধঃপতনে আন্তরিক কষ্ট অনুভব করেন।

শুনিয়াছি পূর্ব্বকালে বাঁড়ুয্যে বাড়িতে ‘বারো মাসে তেরো পার্ব্বণ’ হইত। একে জমিদারির আয় অধিক ছিল, বংশধরগণ মা ষষ্ঠীর কৃপায় রক্তবীজের ন্যায় ব্যাপকতা লাভ করিয়া প্রত্যেকে দু’ কড়া দু’ ক্রান্তির মালিকে পরিণত হয় নাই, এক এক কন্যাবিদায়ে তখন পাঁচ সাতা সহস্র রজনমুদ্রা দান করিতে হইত না, এবং খোলাভাঁটীর সভ্যতা তখনও পল্লী অঞ্চলে অজ্ঞাত ছিল। তাহার উপর প্রজার অবস্থা ভালো ছিল, নির্বিঘ্নে রাজস্ব আদায় হইত, টাকায় ষোলো সের তেল, আট সের ঘি পাওয়া যাইত, বারো আনায় একমণ উত্তম মিহি চাউল মিলিত, একটাকা ব্যয় করিলে ঘরে বসিয়া তিন মণ গম পাওয়া যাইত, কাজেই বাবুদের বাড়ি পূজাপার্ব্বণ হইলে গ্রামের লোককে উনুন জ্বালিতে হইত না, বাঁড়ুয্যে বাড়িতেই সকলে মহাসমারোহে লুচি-মণ্ডায় উদর পরিতৃপ্ত করিত। ধুমধামেরও অন্ত ছিল না। দুর্গোৎসবের সময় বাড়িতে যে জাঁক হইত, তাহা দেখিয়া কবির দলের এক জন ওস্তাদ একবার নবমীপূজার দিন এই গান গায়িয়া একজোড়া শাল শিরোপা পাইয়াছিল–

সত্য যুগে সুরথ রাজা
করেছিলেন দেবীর পূজা,
ত্রেতা যুগে রাম;
কলিযুগে বিশ্বনাথে
সদয় হলে ভবানী
মরি, কি পুজোর ঘটা
গোবিন্দপুরে মহিষমর্দ্দিনী।

এখন সে সকল ধুমধাম আর নাই। পালোয়ানেরা দেউড়ির সম্মুখে সকালবেলা গায়ে মাটি মাখিয়া আর কুস্তি করে না; পাঁড়ে, চৌবে, দোবে, মিশির প্রভৃতি টিকিওয়ালা দারোয়ানেরা সন্ধ্যাকালে দলবদ্ধ হইয়া সিদ্ধি ঘোঁটে না; অপরাহ্নে বাঁড়ুয্যে বাড়ির বিস্তীর্ণ চত্বরে আর গৃহবাজ, লোটন, মুক্ষি প্রভৃতি নানা জাতীয় বিভিন্ন বর্ণের পারাবতের সলীল গতিভঙ্গী ও শস্যভক্ষণের দৃশ্য দেখা যায় না। মা কমলার অন্তর্দ্ধানের সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দপুরের বাঁড়ুয্যে-বাড়ি হইতে সকল রকম ধুমধাম অন্তর্হিত হইয়াছে ; কিন্তু দোল ও রথযাত্রায় আজও কিছু কিছু ঘটা আছে। এই উৎসব একমাত্র বাঁড়ুয্যে পরিবারের নিজস্ব নহে, ইহা গ্রামবাসীগণের সাধারণ সম্পত্তি। বালকবালিকা হইতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা পর্যন্ত গ্রামস্থ সকলেই এই উৎসব উপলক্ষে আমোদে মত্ত হয়।

অনেকদিন আগে বাঁড়ুয্যে বাবুদের কাঠের রথ ছিল। একবার গ্রামে আগুন লাগিয়া বহুসংখ্যক গ্রামবাসীর গৃহাদি দগ্ধ হইয়া যায় ; সঙ্গে সঙ্গে ভগবানের দারুময় রথখানিও ব্রহ্মার কুক্ষিগত হয়, দেবতার সামগ্রী বলিয়া তিনি পক্ষপাত প্রদর্শন করেন নাই। তাহার পর অর্থ ও উৎসাহ– বোধ করি এ উভয়েরই অভাববশত আর কাঠের রথ নির্ম্মিত হয় নাই। তদবধি প্রতি বৎসর বাঁশের রথ নির্ম্মাণ করিয়া গৃহবিগ্রহ গোবিন্দদেবের রথযাত্রা চলিতেছে ; কিন্তু প্রতি বৎসর রথের আকার ক্ষুদ্র হইতে যেরূপ ক্ষুদ্রতর হইতেছে, তাহাতে দীর্ঘকাল পরে ইহার সাকার অস্তিত্বের কতখানি অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা এখন কে বলিতে পারে!

যাহা হউক, দগ্ধাবশিষ্ট কাঠের রথের চক্রগুলি, দুইটি কাষ্ঠনির্ম্মিত অশ্ব, একটি সারথি ও কয়েকটি কাষ্ঠপুত্তলিকা অগ্নিমুখ হইতে অব্যাহতি পাইয়াছিল। সারা বৎসর তাহারা বাঁড়ুয্যে বাবুদের চণ্ডীমণ্ডপের প্রান্তবর্ত্তী একটি অন্ধকারময় গুদামে বিশ্রাম করে ; রথের দুই দিন পূর্ব্বে সেগুলিকে গুদাম হইতে বাহির করা হয়। চক্রগুলি নবনির্ম্মিত বংশরথে সংযুক্ত হইয়া থাকে, ঝুল ও ধুলায় সমাচ্ছন্ন অশ্বদ্বয়ের দেহও রঞ্জিত হয় এবং বর্ষাব্যাপী তত্ত্বাবধানের অভাবে, কিংবা ছোটো ছোটো ছেলেদের উৎপাতে সারথির অথবা কোনো পুত্তলিকার হস্ত পদ স্বস্থান-চ্যুত হইলে, সেই ‘ডিসলোকেশান’গুলির উপর ‘ব্যাণ্ডেজ’ জড়াইয়া এবং তাহাদের দাড়ি, গোঁফ ও মাথার চুল ভুষোর কালি দিয়া আঁকিয়া, তাহাদিগকে রথে তুলিয়া বংশদণ্ডের সহিত দড়ি দিয়া বাঁধিয়া দেওয়া হয়।

রথের দিন খুব সকাল হইতেই বাঁড়ুয্যে বাবুদের চর্ম্মচটিকা-সমাচ্ছন্ন দেউড়ির নীচে গোটাকতক ঢাক ঢোল ও কয়েকখানা কাঁশি অতি উচ্চরবে আপনাদিগের আগমনবার্ত্তা ও রথের উৎসবকাহিনী সমস্ত পল্লীর মধ্যে ঘোষণা করিতে থাকে।

বাঁড়ুয্যেদের ফাটা দেওয়াল-সংলগ্ন প্রকাণ্ড জীর্ণ দেউড়িটার সম্মুখে আজ কী সমারোহ! বহুদিনের রৌদ্রদগ্ধ, প্রাচীন জীর্ণসংস্কারবর্জ্জিত ধূসর প্রাচীর আষাঢ়ের নবজলধারা-সম্পাতে শৈবাল-সমাবৃত হইয়াছে ; সম্মুখে একটি প্রকাণ্ড আঙিনা। সকাল হইতেই সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেদের হাট বসিয়াছে ; কেহ নাচিতেছে, কেহ খেলিতেছে, কেহ কাহাকেও মারিতেছে, কেহ কাঁদিতেছে, কেহ বা ভালোমানুষের মতো রথের লাল চূড়ার  দিকে চাহিয়া আছে। আজ স্কুল পাঠশালা বন্ধ ; মা সরস্বতীর নিকট বিদায় লইয়া আজ সকল ছেলেই নিশ্চিন্ত!

বেলা আটটার মধ্যেই গোবিন্দদেব রথে উঠিবেন ; চারি জন ব্রাহ্মণ তাঁহাকে ঠাকুরদালান হইতে রথতলায় সিংহাসনসহ বহিয়া আনিল ; বাহক চারিজনের বয়সের যে পার্থক্য়, তাহাদের আকারপ্রকার ও পরিচ্ছদের বিভিন্নতা তাহা অপেক্ষা অল্প নহে।গোবিন্দদেবের সিংহাসন তাহারা কাঁধে তুলিয়া বহিয়া আনিতেছে পশ্চাতে একদল লোক, অধিকাংশই বাঁড়ুয্যে পরিবারের সম্পর্কীয় লোক, — জামাই, জামাই-এর ভাই, মামাতো ভাইয়ের সম্বন্ধী, পিসতুতো ভগিনীর দেবর প্রভৃতি মাতব্বর কুটুম্ব ও সরস্বতীর বরপুত্রগণ, কপালে তিলক কাটিয়া, বাহু-মূলে ছাপা লাগাইয়া, ময়ূরকণ্ঠী, পীতাম্বরী কিংবা চেলীখানি কোঁচাইয়া পরিয়া, এবং উত্তরীয়খানি কেহ দেহের উপর ঊর্দ্ধাধোভাবে উপবীতের মতন ঝুলাইয়া, কেহ তাহা তো করিয়া কটিদেশে জড়াইয়া, কেহ বা সুশুভ্র উপবীতগুচ্ছ কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া, খােল করতাল বাজাইয়া,

“জয় গোবিন্দ গোপীনাথ মদনমোহন দয়া কর হে!”

সংকীর্ত্তন করিতে করিতে চলিয়াছে। ঠাকুরদালান হইতে বাহির হইয়া দেউড়িতে আসিতে দুই পাশে সারি সারি ঘর । পূর্ব্বে এখানে ক্রিয়াকর্মে ব্রাহ্মণভোজন হইত ; এখন কার্ণিশের উপর কপোত ও মেঝের নীচে সরীসৃপের বাসা হইয়াছে। এই সকল প্রকোষ্ঠের বারান্দায় দাঁড়াইয়া পাড়ার সধবা, বিধবা, কুমারী, যুবতী, বৃদ্ধারা গোবিন্দদেবকে রথে যাত্রা করিতে দেখিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতেছে! সমাগত রমণীগণের নিকটবর্ত্তী হইয়া সংকীর্ত্তণকারীদের উৎসাহ ও হরিভক্তি সহসা বাড়িয়া উঠিল ; তাহারা গলার শির ফুলাইয়া উভয় হস্ত উর্দ্ধে তুলিয়া মাথা নাড়িয়া উর্দ্ধমুখে নাচিয়া নাচিয়া কেবলই গায়িতেছে, — “দয়া কর, কর হে” — ছেলেদের মধ্য হইতে ঘন ঘন হরিবোল শব্দ উঠিতেছে। ঠাকুর ও সংকীর্ত্তনের দল দেখিয়া দলবদ্ধ রমণীগণের কেহ উভয় হস্তে ললাট স্পর্শ করিয়া, কেহ নতজানু হইয়া মৃত্তিকায় ললাট স্পর্শ করিয়া, কেহ বা গললগ্নীকৃত-অঞ্চলে সাষ্টাঙ্গে মাটিতে লুটাইয়া প্রণাম করিতেছে ; দক্ষিণ হস্তে সংকীর্ত্তণকারিগণের পদরজ তুলিয়া লইয়া ভক্তিভরে তাহা জিহ্বায় ও মস্তকে স্পর্শ করিতেছে। হায় অন্ধভক্তি! ইহারা জানে না– এই পদরজের সঙ্গে এমন পাষণ্ডেরও পদধুলি মিশ্রিত আছে, যাহারা বক্ষে ধারণ করিয়া ভগবতী বসুমতী অহরহ অসহ্যভার অনুভব করিতেছেন ; কিন্তু সরলা, সুশীলা ভক্তিবিহ্বলা পল্লীরমণীগণ কোনো পাপিষ্ঠের পরিচয় জানিবার জন্য উৎসুক নহে। তাহারা বিশ্বাস করিতেছে, যাহার মনে যতই পাপ থাক, যে পবিত্র নাম তাহারা উচ্চারণ করিতেছে, তাহার অধমতারণ মহিমা-প্রবাহে তাহাদের সকল কলুষ বিধৌত হইয়া গিয়াছে, যেমন শতবর্ষের সঞ্চিত পাপএকবার মাত্র ভাগীরথী-তরঙ্গে অবগাহন করিলে বিলুপ্ত হইয়া যায়।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ১। দীনেন্দ্রকুমার রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *