সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ৩ । দীনেন্দ্রকুমার রায়

1

(দ্বিতীয় পর্বের পর)

রথতলার কিছু দূরে, নিমাই কুরীর দোকানের পাশে কাঠাখানেক ফাঁকা জমির উপর আজ এক কাপড়ের তাম্বু উঠিয়াছে। এখানে হয়তো কোনোরকম খেলা দেখানো হইতেছে ভাবিয়া অনেক চাষার ভিড় হইয়াছে, ছোটো ছোটো ছেলেরও সংখ্যা নাই ; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার দেখিয়া অনেকেই ক্ষুণ্ণ মনে ফিরিয়া গেল। কারণ তাহারা দেখিল, একজন পাকা দাড়িওয়ালা সাহেবের সঙ্গে সারি দিয়া দাঁড়াইয়া তিনজন শুষ্কমুখ ক্ষীণদেহ বাঙ্গালী ধর্মপ্রচারক এক একখানি কাগজ হাতে করিয়া গান গায়িতেছে–

“বেথলহেমে হইল যিশু-চন্দ্রের উদয়,
গায় সবে ধরাবাসী জয় জয় জয়”

কিন্তু বেথলহেমের চন্দ্রের সহিত আমাদের গোবিন্দপুরের লোকের কোনো সম্বন্ধ না থাকার সে সঙ্গীতে কেহই মুগ্ধ হইল না। কেহ বলিল, “পাদরী সায়েবের গান, ও আর কি শুনবো? আমাদের নদে তাঁতির দেহতত্ত্বের গান ওর চাইতে মিষ্টি!” — শ্রোতার আগ্রহ না দেখিয়া সাহেব অগত্যা গান বন্ধ করিয়া বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন ; এবং তাহার সহকারী রেভারেণ্ড সলোমন বিশ্বাস ও যােহন পরামাণিক “সত্যগুরু কে?”, “যিশুই পরম পথ”, “স্বর্গের সোপান” প্রভৃতি বাইবেল ট্রাক্ট সোসাইটির ছাপাখানা প্রসূত ছোটো ছোটো বহিগুলি দর্শকগণের মধ্যে বিতরণ করিতে লাগিলেন। সাহেবের হয়তো আশা, দৈবক্রমে যদি এরকম পাঁচ হাজার পুস্তকের মধ্যে একখানিরও সদগতি হয়, এবং তাহার সাহায্যে একটিও পতিত আত্মা সদাপ্রভুকে ভজিতে শিখিয়া হিন্দুধর্ম্ম-নরকের অন্ধকার হইতে উদ্ধার লাভ করে, তাহা হইলে অবশিষ্ট চারি হাজার নয় শত নিরানব্বুইখানি পুস্তকের ব্যয়ভার বহন সার্থক হইবে।

— দুরাশা কিনা, কে বলিবে?

রথতলার আর একদিকে পেয়ারা, পাকা কাঁঠাল, কলা, আনারস, কাঁকুড় প্রভৃতি সুপক্ক ফলেক ও পটোল, ঝিঙ্গে, উচ্ছে, কাঁচকলা প্রভৃতি তরিতরকারির দোকান। মেছুনীরা সারি দিয়া বসিয়া ঝুড়ি-বোঝাই পচা ইলিশ মাছ ডালায় সাজাইয়া তিনগুণ লাভে বিক্রয় করিতেছে। মাছগুলি ফুলিয়া পচিয়া উঠিয়াছে, দুর্গন্ধে সেদিকে যাওয়া কঠিন ; কিন্তু ক্রেতার অভাব নাই! ইতর লােকের কথা দূরে থাক, দূরবর্ত্তী পদ্মাতীর হইতে আনীত এই সকল পচা ইলিশ অধিক মূল্যে কিনিতে গ্রামস্থ ভদ্রলোকদিগেরও আপত্তি নাই। পটোল এবং কাঁটালের বিচি-সংযুক্ত পচা ইলিশের ঝুরি পল্লী-বধূগণের রসনাতৃপ্তিকর উপাদেয় ব্যঞ্জন! কিন্তু ডাক্তার কৃতান্তকিঙ্কর বাবু ‘মেট্রিয়া মেডিকা’র দোহাই দিয়া বলেন যে, ইহা পাকযন্ত্রের অনুকূল নহে! আমরা শুনিয়াছি, এই মন্তব্যের জন্য ডাক্তার-দম্পতির মধ্যে এমন প্রেমকোন্দল আরম্ভ হইয়াছিল যে, ধন্বন্তরী মহাশয় চব্বিশ ঘন্টা কাল নিজের পাকযন্ত্রকে অবসরদানে বাধ্য হইয়াছিলেন! পচা ইলিশ ঘরে না আনায় অভিমানিনী ডাক্তার-পত্নী একদিন রন্ধনশালায় প্রবেশ করেন নাই।

দেখা গেল, এই তরকারির বাজারের মধ্যে লাল পাকড়ি-বাঁধা, পাঁচ হাত লম্বা বাঁশের পাকা লাঠি-কাঁধে এক বরকন্দাজ জমিদারের জন্য ‘তোলা’ তুলিতেছে। সে কাহারও কাছে কিছু চাহিতেছে না, কেবল প্রত্যেক দোকানে আসিয়া সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া এক থাবায় যাহা ধরিতেছে, ডালা হইতে টানিয়া তুলিতেছে, ও তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তী একটা চাকরের ঝুড়ির মধ্যে তাহা নিক্ষেপ করিতেছে ; কেহ বলিতেছে, ‘আমি এখনও বউনি করিনি, এক পাক ঘুরে এসে তোলা নিও।’ কিন্তু সে কথা গ্রাহ্য করে কে? জমিদারের বরকন্দাজ মনিবের জমিদারীর মধ্যে পুলিশের কনস্টেবল অপেক্ষাও পরাক্রান্ত! যাহা হউক, বরকন্দাজ সাহেব এইরূপ অপ্রতিহতভাবে তোলা তুলিতে তুলিতে এক কাঁটাল-বিক্রেতার দোকানে আসিয়া উপস্থিত। অভ্যাসমত তিনি একটি কাঁটালের বোঁটা চাপিয়া ধরিলেন। দোকানি বলিল, “বাহ রে মজার লোক বড় জোর দু পয়সার তোলার জন্যে তুমি যে আমার পাঁচ গণ্ডা পয়সার কাঁটাল ধরে টানাটানি কর? রাখ কাঁটাল!” অনন্তর দোকানি দুই হাতে কাঁটালের অগ্রভাগ চাপিয়া ধরিল। কাঁটালটি সুপক্ক ছিল, ‘টগ্ অফ্ ওয়ারে’র জুলুম বরদাস্ত করিতে পারিল না ; কাঁটালের মুষলটা বরকন্দাজ সাহেবের হাতে থাকিল, ভুঁতুড়িখানা দোকানদারের হাতে খসিয়া আসিল, এবং কোষগুলি মাটিতে ছড়াইয়া পড়িল। গোলমাল দেখিয়া বাঁড়ুয্যেদের ছোটোবাবু আসিয়া বিবাদ মিটাইয়া দিলেন বটে কিন্তু দোকানি বেচারার ভাঙ্গা কাঁটালটা আর বিক্রয় হইল না ; বরকন্দাজ সাহেব অপ্রস্তুত ভাবে মুষলটা ফেলিয়া শিকারের সন্ধানে ভিন্ন দিকে প্রস্থান করিলেন।

রথের কাছে যেখানে বড় ভিড়, তাহার কিছু দূরে দাঁড়াইয়া মালীরা শোলার ফুল, পাখি, পুতুল, পালকি বিক্রয় করিতেছে ; শোলার সাপ মাথা তুলিয়া ফণা মেলিয়া খেলিতেছে, মালীর হাতে তাহার লাঙ্গুল ; সুরঞ্জিত পাকাটিনির্ম্মিত কলাগাছের মাথায় একটি শোলার পাকাকলা, শোলার হনুমান গলায় দড়ি লইয়া গাছের মধ্যদেশে অবস্থিতি করিতেছে, এবং মালী ‘চাই শোলার খেলনা’ বলিয়া ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার সময় এক একবার হনুমানজীর কণ্ঠের সেই সুতা ধরিয়া টান দিতেছে, আর সে সজীব হনুমানের মতোই একলম্ফে কদলীমূলে ওষ্ঠ স্পর্শ করিতেছে। অন্যত্র কামারেরা ছোটো ছোটো ছুরি, কাস্তে, কাটারি, বঁটি প্রভৃতি নানারকম অস্ত্র কাঁধে লইয়া বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেছে ; ইস্পাতের সঙ্গে এই সকল অস্ত্রের কোনো সম্বন্ধ নাই, এবং যে মূল্যে তাহা বিক্রয় করিতেছে, তাহাতে গঠনপারিপাট্যের কিংবা ইস্পাতের অস্তিত্ব আশা করা যায় না।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ৩ । দীনেন্দ্রকুমার রায়

  1. গোয়েন্দা গল্পের স্রস্টা বলেই তিনি পরিচিত। সরসতায় সিক্ত তাঁর এই রচনার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *