সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ২। দীনেন্দ্রকুমার রায়

0

(প্রথম পর্বের পর)

ঠাকুর রথে স্থাপিত হইলেন। পুরোহিত চক্রবর্ত্তী মহাশয় রথের সর্ব্বোচ্চ ‘থাকে’ উপবিষ্ট হইয়া গোবিন্দের ক্ষুদ্র সিংহাসন ধরিয়া রহিলেন। যিনি বিশ্বমণ্ডল ধারণ করিয়া আছেন, এই পাপ কলিযুগে তাঁহাকেও আবার হাত দিয়া ধরিয়া রাখিতে হয়! নতুবা যদি তিনি রথ হইতে পড়িয়া যান, তাহা হইলে তাঁহার হাত পা ভাঙ্গিয়া যাইতে পারে! রথের পাঁচটি চূড়া। প্রত্যেক চূড়ার উপর এক একটি শ্বেতচামরের ধ্বজ। চূড়াগুলি লোহিত বস্ত্রে মণ্ডিত। প্রধান চূড়ার নীচে একটা ছোটো তালপাতার ছাতি গুপ্তভাবে অবস্থিত ; পাছে রথচূড়া ভেদ করিয়া বর্ষার জলধারা গোবিন্দের মস্তকে পতিত হয়, এই আশঙ্কায় এইরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছে।

পাড়ার ছেলেরা কামিনীগাছের ডাল, দেবদারুপাতা, প্রস্ফুটিত কদম্ব-পূর্ণ কদম্বশাখা ভাঙ্গিয়া আনিয়া, তদ্দ্বারা রথের আগাগোড়া ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। রথের চতুর্দ্দিকে পুষ্পস্তবক ও পুষ্পমাল্য ঝুলিতেছে। একটু বেলা হইলে রথের কাছে ঠাকুরের বাল্যভোগ আনীত হইল ; কয়েকজন ব্রাহ্মণ লুচি, মোহনভোগ, সন্দেশ ক্ষীর ছানা, আম, কাঁটাল ও অন্যান্য নানাবিধ ফলফুলারী এক একখানি বারকোসে ও পিতলের থালে সাজাইয়া লইয়া রথের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ভোগ আসিতেছে দেখিয়া হঠাৎ চারিদিকে তুমুল কলরব উঠিল : “ভোগ আসচে, বাজে লোক সব তফাৎ!” বলিয়া দুই চারি জন মোড়ল গোছের লোক হুঙ্কার ছাড়িল। মাথায় লাল চাদর-বাঁধা দুই একটা পাইক লাঠি ঘাড়ে লইয়া নিকটেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল ; উপযুক্ত অবসর দেখিয়া তাহাদের হাতের লাঠি কাহারও কাহারও পিঠে পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে সকলে সসম্ভ্রমে সরিয়া গেল।

যে সকল সুবৃহৎ পাত্রে ভোগ আনীত হইল, বাহকগণ দুই হাত উর্দ্ধে তুলিয়া তাহা উঁচু করিয়া ধরিল। পুরোহিত ঠাকুর গোবিন্দদেবের কাছে বসিয়াই ঊর্দ্ধ হইতে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করিয়া দিলেন। নিবেদনকালে পুরোহিতহস্ত নিক্ষিপ্ত দুই চারিটা তুলসীপত্র বারকোসে আসিয়া পড়িল ; দুই একটা ফুল ঘুরিতে ঘুরিতে কোনো বারকোস-ধারীর মাথায় পড়িয়া তাহার দীর্ঘ টিকির পাশ দিয়ে গড়াইয়া গেল! ঢাক ঢোল ও কাঁশি জোরে জোরে বাজিতে লাগিল, এবং সেই সঙ্গে চেলী বা নীলাম্বরীর উপর লাল চাদর বা রুমাল-বাঁধা ছোটো ছোটো ছেলেরা আনন্দভরে নাচিতে আরম্ভ করিল।

দুপুরের সময় রথতলায় বেশি লোক থাকে না, কেবল দুই চারি জন দোকানদার সহচরবর্গের সাহায্যে অস্থায়ী দোকান সাজাইবার আয়োজন করে, এবং পাড়ার দুই একটা দুষ্ট ছেলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দেউড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া মধ্যাহ্ন-নিদ্রাকাতর ঢাকীদিগের ঢাকে সজোরে দুই চারিটা ঘা দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলায় ; আর তাহাদের অপেক্ষাকৃত ভীরু সহচরগণ দূর হইতে তাহাদের এই দুঃসাহসিক অনুষ্ঠান দেখিয়া আনন্দে হাততালি দিয়া হাসিতে হাসিতে পরস্পরের গায়ে ঢলিয়া পড়ে।

কিন্তু বেলা যত শেষ হইয়া আসে, রথতলায় জনকোলাহল ক্রমেই তত বাড়িতে থাকে। বেলা চারিটা বাজিতে না বাজিতে রাজপথের দুই ধারের শ্রেণীবদ্ধ পল্লীবাসীরা,– বালক বালিকা হইতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলেই রথতলার দিকে অগ্রসর হয়। ছোটো ছোটো ছেলেদের ট্যাঁকে ও মেয়েদের আঁচলে দুই চারিটা পয়সা বাঁধা ; মা বাপের কাছে পার্ব্বণী আদায় করিয়া তাহারা রথ দেখিতে যাইতেছে। কাহারও পরিধানে সদ্যোধৌত কাপড়, গায়ে ‘ছক-কাটা’ পিরাণ, তাহার উপর কোঁচান চাদর, কেহ বা নূতন ধুতি চাদরে সজ্জিত হইয়া চলিয়াছে। সাধারণ পল্লীরমণীগণ নদীতীরস্থ বৃক্ষান্তরালবর্তী নিভৃত পথ দিয়া রথ দেখিতে যাইতেছে ; পথিপ্রান্তে ক্কচিৎ কোনো পুরুষ সম্মুখে পড়িলে তাহারা অবগুন্ঠন টানিয়া সলজ্জভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইতেছে, এবং পথিক কিছু দূরে চলিয়া গেলেই অবগুন্ঠন সরাইয়া মুক্তকণ্ঠে আলাপে প্রবৃত্ত হইতেছে ; আর তাহাদের চঞ্চল পদবিক্ষেপে ও তরল কৌতুকহাস্যে সেই সংকীর্ণ বনপথ মুখরিত হইয়া উঠিতেছে।

ক্রমে রথতলা হইতে আরম্ভ করিয়া দূরবর্ত্তী বাজার পর্য্যন্ত লোকে পরিপূর্ণ হইয়া গেল।– পথের দুই পাশে সদ্যোনির্ম্মিত বিপণিশ্রণী ; ময়রার দোকানে পিতলের থালে অগণ্য মক্ষিকাসমাচ্ছন্ন মোণ্ডা, গোল্লা, মেঠাই, তেলেভাজা, ছোটো ছোটো জিলিপি, এবং ধামাতে লাল গুড়ে মুড়কি ও মোটা আউসের ‘গুমো’ চিঁড়া স্তূপাকারে সজ্জিত রহিয়াছে। চাষার ছেলেরা দোকানের সম্মুখে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কেহ বা এক পয়সা দিয়া চারিখানি ছোটো জিলিপি, কেহ আধ পয়সার মুড়কি কিনিয়া কোঁচড়ে পুরিয়া লইয়া যাইতেছে ; কোনো বালক বাড়ি ফিরিয়া যাওয়া পর্য্যন্ত ধৈর্যধারণে অসমর্থ হইয়া চলিতে চলিতেই তাহা ঘন ঘন ‘ফাঁকাইতেছে’। পথের যেখানে-সেখানে বসিয়া কুমোরেরা বড় বড় ঝোড়া বোঝাই ‘চিত্তির’ করা ছোটো ছোটো ঘট, মাটির ছোবা, মাটির জাঁতা, পুতুল ও হাঁড়ি বিক্রয় করিতেছে নানা আকারের নানা রঙ্গের পুতুল, কুকুর, বিড়াল, গরু, হাতি। — কোনো পুতুলের মাথায় জলপূর্ণ কলসী, তাহার বামকক্ষে শিশু, সে মাথা নীচু করিয়া মায়ের স্তন্যপান করিতেছে ; লাড়ুগোপালের ছবির রঙ্গ ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, দক্ষিণ হস্তে একটি সাদা মাটির লাড়ু, গালে ও কপালে খড়ি দিয়া অলকা-তিলকা অঙ্কিত, মাথায় কালো ঝুঁটি, ময়ূরপুচ্ছের অভাবে ঝুঁটিটি নেড়া দেখাইতেছে ! রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্ত্তি গ্রাম্য শিল্পনৈপুণ্যের আদর্শীভূত হইয়া এক পয়সা মূল্যে বিক্রীত হইতেছে ; কৃষ্ণের পরিধানে ধড়াচূড়া, ত্রিভঙ্গ বেশ, হাতে মোহন বাঁশি, বাঁশির মুখটা যদিও হাঙ্গরের মুখের মতোই করিবার চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু এক পয়সায় অধিক কারিগরীর আশা করা যায় না, তাই সেটাকে হাঙ্গরের মুখ বলিলেও চলে, ব্যাঙের মুখ বলিলেও সে কথার প্রতিবাদ করিবার যো নাই ! গণদেব বৃহৎ শুণ্ডসহ শ্বেতবর্ণের হস্তীমুণ্ড ঘাড়ে লইয়া ঘোর লোহিতবর্ণ দেহে বসিয়া আছেন, বর্তুল উদরের উপর শুভ্র উপবীত ঝুলিয়া পড়িয়াছে, হাত চারিখানির ভঙ্গি দেখিলে মনে হয়, তিনি জিমনাস্টিক শিক্ষা করিতেছেন! — এমন সকল চিত্তাকর্ষক পুত্তলিকা দেখিয়া কি আর স্থির থাকা যায় ? ছেলের দল চারিদিকে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে ; কেহ জিজ্ঞেস করিতেছে, ‘ও দোকানি ও লাড়ুগোপালটার কত দাম?’ কেহ বলিতেছে, ‘কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো? আমাকে একটা গণেশ দাও না।’ দোকানীর অবসর নাই ইহার উপর যখন কোনো দুষ্ট ছেলে পুতুল না কিনিয়া কেবল দরই করিতেছে, তখন দোকানীর ধৈর্য্যধারণ করা কঠিন হইয়া উঠিতেছে ; সে তাহার মুখে দুর্জ্জয় ক্রোধ ও বিরক্তি পুঞ্জীভূত করিয়া দক্ষিণ হস্ত সবেগে উৎক্ষেপণপূর্ব্বক বলিতেছে, ‘পালা সব দস্যির দল! এক পয়সার জিনিস কিনবার মুরোদ নেই, আমাকে বকিয়ে মারলে!’ কিন্তু স্ত্রীলোক ক্রেত্রীগণের সে দিকে লক্ষ্য নাই, তাহারা কেহ ছেলেদের জন্য পুতুল কিনিতেছে, কেহ ছোবা পছন্দ করিতেছে, কেহ হাঁড়ি দর করিয়া তাহা ভাঙ্গা কিনা পরীক্ষার জন্য বাজাইয়া দেখিতেছে। একটা বড় বটতলার ছায়ায় তিন চারিখানা মনোহারীর দোকান বসিয়াছে, সেখানেও ক্রেতার সংখ্যা অল্প নহে ; কেহ দেশলাইয়ের বাক্স কিনিতেছে, কোনো বালক এক পয়সার চিনে পটকা কিনিয়া তাহার একটাতে আগুন লাগাইয়া অদূরবর্ত্তী অসতর্ক বন্ধুবর্গের দিকে নিক্ষেপ করিতেছে, এবং হঠাৎ হঠাৎ পায়ের কাছে বজ্রনাদে তাহারা আতঙ্কিত হইয়া উঠিলে, উক্ত পটকাধারী বীরপুরুষ হাসিয়া মাটিতে প্রায় লুটাইয়া পড়িতেছে। একটি ছেলে একটি টিনের বাঁশি কিনিবার জন্য তাহার মায়ের কাছে ভারী আবদার আরম্ভ করিয়াছে ; তাহার মা যুক্তি দেখাইল, ‘বাঁশি কিনিয়া পয়সা নষ্ট করিতে নাই’ ; কিন্তু ছেলে সে যুক্তি না মানিয়া মায়ের অঞ্চল ধরিয়া টানিতে লাগিল, তখন মায়ের যুক্তি নিমিষে চপেটাঘাতে রূপান্তরিত হইয়া পুত্রের পৃষ্ঠ বর্ষিত হইল ; ছেলে মেয়ের অঞ্চল ছাড়িয়া ধূলায় পড়িয়া গড়াইতে লাগিল। একটি বারো তেরো বৎসরের মেয়ে একখানি দোকানে বসিয়া বেলোয়ারী চুড়ি পরিতেছে ; দেশী লালাপেড়ে কোরা শাড়ীতে আপাদমস্তক আবৃত। সে তাহার ক্ষুদ্র হাতখানি বাহির করিয়া দিয়াছে, আর দোকানদার সেই কোমল করপল্লব নিপীড়ন পূর্ব্বক তাহাতে কালো কাঁচের চুড়ি পরাইয়া দিতেছে ; হাতে চুড়ি উঠিতেছে না, তথাপি ক্রমাগত টিপিয়া টিপিয়া ঠেলিতেছে! যন্ত্রণায় বালিকা এক একবার অধীর হইয়া উঠিতেছে ; কিন্তু সেই যন্ত্রণা সে বাক্যে প্রকাশ করিতেছে না, দৈবাৎ তাহার মস্তক কম্পিত হইতেছে, কদাচিৎ বা তাহার অশ্রুসজল চক্ষু দুটি তাহার অজ্ঞাতসারে অবগুণ্ঠনের ভিতর হইতে বাহির হইয়া পড়িতেছে ; কিন্তু তাহার কাতরতায় দোকানীর ভ্রূক্ষেপ নাই ! বালিকার বর্ষীয়সী সঙ্গিনী, বোধ করি শ্বাশুড়ি হইবে, আরও কঠিনহৃদয়া ; সে বলিতেছে, — ‘কী রকম চুড়ি দিচ্ছ বাছা! হাত কেটে চুড়ি উঠবে, তবে তো হাতে মানাবে। অত ঢলকো চুড়ি হাতে দেখে লোকে বলবে কী?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *