সেকালের চড়ক ১। দীনেন্দ্রকুমার রায়

0

চৈত্রমাস বসন্ত ও গ্রীষ্মের সন্ধিস্থল। এই সময়ে পল্লীজীবনে নব আনন্দের হিল্লোল বহে। গম, ছোলা, যব, অড়হড় প্রভৃতি রবিশস্য পাকিয়া ঘরে উঠিয়াছে; সুতরাং দীর্ঘকালের অনাহারে শীর্ণকায়, ক্ষুধাতুর কৃষক পরিবারে যে হর্ষের উচ্ছ্বাস দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা সুদীর্ঘ হিমযামিনীর অবসানে বসন্তের মলয়ানিলের মতোই তৃপ্তিদায়ক।

পল্লীগ্রামে এ সময়ে তরিতরকারিরও অভাব থাকে না; বাগানে বাগানে কচি আম গৃহপ্রাঙ্গণস্থ সজনে গাছে লম্বমান অসংখ্য সজনে খাড়া, পুকুরের পাড়ে বেড়ার ধারে নিবিড়পত্র ডুমুর গাছে থোকা থোকা যগডুমুর ও সংকীর্ণকায়া মন্থরগামিনী তটিনীর উভয় তীরে, যেখানে বালুকারাশি ভেদ করিয়া ছোটো ছোটো ঝরণা উঠিয়াছে, সেই সকল সুশীতল জলপূর্ণ ঝরণার চতুর্দিকে সমুদ্গত সুস্বাদু শুশুনির শাক—প্রভৃতি দ্বারা এ সময় গ্রাম্য গৃহস্থগণের তরকারির অভাব পূর্ণ হয়। প্রায় সকলের ঘরেই ময়দা, খেজুরে গুড়, যবের ছাতু ও ছোলার ডাল সঞ্চিত থাকে। যে সকল কৃষকের অবস্থা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, তাহাদের দুগ্ধবতী গাভীরও অভাব নাই; অনেকেই ঘোল হইতে সঞ্চিত ‘ননী’ জ্বাল দিয়া ঘৃতেরও সংস্থান করিয়া রাখে ; কেহ কেহ সর বাটিয়া তাহাই জ্বাল দিয়া ঘৃত প্রস্তুত করে ; সুতরাং যখন কোনো গোপপত্নী বা কৃষকরমণী তাহার ‘দামাল’ ছেলের কালো নধর শরীর প্রচুর তৈলে ও অম্ল জলে অভিষিক্ত করিয়া, এবং তাহা সযত্নে মুছাইয়া দিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইতে পাড়াইতে বলে, “থোকা যাবে মোষ চরাতে, খেয়ে যাবে কী?/ আমার, শিকের উপর গমের রুটি, তবলা ভরা ঘি !”, তখন এই সুন্দর ছেলেভুলানো ছড়াটির সুরে ও তাহার প্রত্যেক কম্পনে কেবল যে সুকোমল মাতৃহৃদয়ের স্নেহমধুর উচ্ছ্বাসের পরিচয় পাই, তাহাই নহে, তাহাদের পারিবারিক জীবনের নিখুঁত চিত্র ও তৃপ্তিভরা সরল সুন্দর বৈচিত্র্যও নয়ন-সমক্ষে সুস্পষ্টরূপে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে।

আনন্দের এই পূর্ণ উচ্ছ্বাসকালে পল্লীগ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবীগণ কয়েক দিনের জন্য একটি মহোৎসব উপলক্ষে সমবেত হইয়া নানাপ্রকার আমোদে রত হইবে, ইহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুগণ শিবোপাসনার অধিকারী, আবার হিন্দুর অধিকাংশ উৎসবের সহিত ধর্মের অনুষ্ঠান অল্পাধিক পরিমাণে বিজড়িত; সুতরাং চৈত্রমাসের শেষভাগে গাজনের ঢাক সজোরে বাজিয়া উঠে। চড়ক বঙ্গদেশের নিম্নশ্রেণীর সকল সম্প্রদায়স্থ হিন্দুর সর্ব্বপ্রধান পাৰ্ব্বণ।

আমরা বাল্যকালে চৈত্রমাসের মধ্যভাগেই চড়কের ঢক্কাধ্বনি শুনিতে পাইতাম; এবং সেই সময় হইতেই পল্লীর হিন্দু কৃষক ও রাখালের দল, ঘরামি, মজুর প্রভৃতি শ্রমজীবীবর্গ কাজ ছাড়িয়া গাজনের আমোদে মত্ত হইত। আজকাল জীবন-সংগ্রাম কঠোর হইয়া উঠিয়াছে, কাজেই চড়ক সংক্রান্তির এত বেশি আগে আর তাহাদের উৎসবে-মাতিবার অবসর নাই। এখন সংক্রান্তির আট দশ দিন পূর্ব্ব হইতেই চড়কের আয়োজন চলে।

প্রত্যেক গ্রামে গাজনের তিন চারিটি দল থাকে। কোনো কোনো গ্রামে দলের সংখ্যা আরও অধিক হয়। বিভিন্ন পাড়ায় সাধারণত এক একটা দল গঠিত হয় ; প্রত্যেক দলে এক জন দলপতি থাকে, তাহাকে “মূল সন্ন্যাসী” বলে। মূল সন্ন্যাসী হইতে হইলে জাত্যংশে শ্রেষ্ঠ হওয়া যে একান্তই আবশ্যক, এরূপ নহে। কৈবৰ্ত্ত, গোপ, নাপিত, বণিক, গণ্ডকাদি সকল জাতির লোককেই মূল সন্ন্যাসী হইতে দেখা যায়; কিন্তু তাহার পরিণতবয়স্ক হওয়া আবশ্যক। শিবের সিংহাসন-বহন, উৎসবের কয়দিন নিয়মিতরূপে শিবপূজা, দলস্থ সন্ন্যাসীগণকে পরিচালিত করা মূল সন্ন্যাসীর প্রধান কার্য; এতদ্ভিন্ন তাহাকে আরও দুই একটি কঠিন কাজ করিতে হয়, আমরা পরে তাহার উল্লেখ করিব।

চড়ক-সংক্রান্তির দশ দিন পূর্ব্বে মূল সন্ন্যাসী ক্ষৌরকর্ম্ম দ্বারা পবিত্র হইয়া, ক্ষুদ্র কাষ্ঠসিংহাসনে একটি শিবলিঙ্গ স্থান পূর্বক নিজের পাড়ার গাজনতলায় সাড়া জমাইয়া বসে। মহাদেবের এই সকল নৈমিত্তিক সেবক এ সময় তাহাদের বাড়িতে থাকে না; কোনো বৃক্ষতলে বা বনান্তরালে ইহাদের যে আড্ডা নির্দিষ্ট, আছে সেই আড্ডাই ‘গাজনতলা’ নামে প্রসিদ্ধ। প্রত্যেক পাড়ায় এক একটি গানতলা নির্দিষ্ট আছে; যে বৎসর যে লোকই তাহার পাড়ার দলের মূল সন্ন্যাসী হউক, নির্দিষ্ট গাজনতলায় তাহাকে আড্ডা করিতেই হইবে।

গাজনতলার দৃশ্য বড়ই রমণীয়। নিকটে কোনো দিকে কাহারও ঘরবাড়ি নাই। চারিদিকে আশশ্যাওড়া ও ভাঁট-বন, ভাঁট ফুলের সৌরভে জঙ্গলটি আমোদিত ; নিকটে দীর্ঘশীর্ষ নারিকেল-কুঞ্জ, মধ্যে মধ্যে দুই চারিটি সুপারি গাছ, দুই একটি তমাল বা বেলগাছ ও বাঁশের ঝাড়। বৎসরের অন্য সময় সেখানে জনসমাগম দেখিতে পাওয়া যায় না; কেবল এই সময়টিতেই যথানির্দিষ্ট স্থান পরিষ্কার করিয়া সন্ন্যাসীর দল খর্জ্জুরপত্রাচ্ছাদিত ক্ষুদ্র কুটীরে শিবস্থাপনা করে, এবং সন্নিকটবর্তী বট, পাকুড় বা তেঁতুল গাছের প্রচ্ছন্ন ছায়ায় আড্ডা পাতিয়া লয় ।

ক্ষৌরকর্ম্মের পর মূল সন্ন্যাসী পৈতা গলায় দেয়; এ পৈতা ব্রাহ্মণের উপবীতের মতো দীর্ঘ নহে, ইহা তাহারা গলায় ঝুলাইয়া রাখে। পৈতাগুলি হরিদ্রারঞ্জিত, তাহাতে একটি পিত্তলনিৰ্ম্মিত অঙ্গুরী বা আংটা ঝুলিতে দেখা যায়।

মূল সন্ন্যাসীর সঙ্গে সেইদিনই অনেকে দাড়ি গোঁফ কামাইয়া সন্ন্যাসী হয় ; চৈত্রসংক্রান্তির দশ দিন পূর্ব্বে যাহারা কামায়, তাহাদের ক্ষৌরকর্ম্মের নাম ‘দশের কামান।’ এই ভাবে ক্ষৌরকর্ম্মের দিন গণনা করিয়া পাঁচের কামান, তিনের কামান নাম হইয়াছে। ক্ষৌরকর্ম্মের পর ও উৎসব শেষ হইবার পূর্ব্বে এই সন্ন্যাসীদের গৃহকর্ম্মে যোগদানের নিয়ম নাই, দলের সঙ্গে ঘুরিয়া ভিক্ষাসংগ্রহ ও গাজনতলায় রাত্রিযাপনই ব্যবস্থা। সুতরাং যাহাদের অবসর অল্প অথচ একটু সখও আছে, তাহারা অধিক দিন পূৰ্ব্বে না কামাইয়া তিনের কামানের দিন কামাইয়া সন্ন্যাসী হয়। অনেকে আবার মোটেই কামায় না, চড়কের দিন সন্ন্যাসীর দলে মিশিয়া বাণ ফুড়িয়া আমোদে মাতিয়া থাকে।

মূল সন্ন্যাসী ও তাহার অনুচরবর্গের হাতে বেতের এক রকম ছড়ি দেখা যায়; পাঁচ ছয়গাছি সরু বেত একত্র কাঁটার আকারে বাঁধিয়া এই ছড়ি প্রস্তুত হয়; শিবের জটার প্রতিনিধিশ্বরূপ এই ছড়ি হাতে লইয়া সন্ন্যাসীর দলকে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখা যায় ।

সংক্রান্তি ক্রমে যতই নিকটবর্ত্তী হইতে থাকে, ঢাকের বাদ্য ততই উচ্চ হইয়া উঠে। সন্ন্যাসীদল ঘন ঘন “বলো শিবো মহাদেব, দেব !” বলিয়া হুংকার করিতে থাকে। চড়কের ঢাকের বাদ্য শুনিয়া ছোটো ছোটো ছেলেরা দলবদ্ধ হইয়া নাচিতে নাচিতে চিৎকার করে,

“চড়ক চড়ক ড্যাড্যাং-ড্যাং,
পাবদা মাছের দুটো ঠ্যাং!”

সংক্রান্তির দুই তিন দিন পূর্ব্ব হইতেই গাজনতলায় আমোদের ধুম পড়িয়া যায়। অপরাহ্নে বিভিন্ন গাজনতলার ঢাকের বিকট শব্দে কর্ণ বধির হয়, সন্ন্যাসীদলের অবিশ্রান্ত নৃত্যে মাটি কাঁপিতে থাকে ! পাড়ার ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে হইতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা গাজনতলার চারি দিকে সমবেত হইয়া তাহাদের উদ্দাম নৃত্য উপভোগ করে। অনেক কুলবধূ জল আনিবার ছলে কলসী কক্ষে লইয়া গাজনতলার পথে নদীতে যায়, এবং বৃক্ষের আড়ালে দাড়াইয়া, অবগুণ্ঠন ঈষৎ উন্মুক্ত করিয়া কৌতূহল-বিস্ফারিত নেত্রে এই দৃশ্য দেখিতে থাকে; কিন্তু বড় জা, শ্বাশুড়ি, বা ননদের ভয়ে তাহারা সেখানে অধিক বিলম্ব করিতে পারে না।

নাচিতে নাচিতে যে সকল সন্ন্যাসীর অতিরিক্ত ভাবাবেশ হয়, তাহারা মাটিতে উপুড় হইয়া বসিয়া পড়ে, এবং অবনত মুখে ঢাকের তালে তালে মাথা নাড়িতে থাকে; — এই মুদ্রাটির নাম “বয়াল খাটা”। ভাবোন্মত্ত সন্ন্যাসীগণ শুধু ‘বয়াল খাটিয়া’ই ছাড়ে না, বাদ্যের তালে তালে সবেগে মাথা নাড়িতে নাড়িতে ‘হামা টানিয়া’ অনেক দূরে চলিয়া যায়; কখনও বনে প্রবেশ করে, কখনও বা গর্ভে গিয়া পড়ে! শুনা যায়, যখনই তাহাদের উপর মহাদেবের ‘ভর’ হয়, তখনই উহাদের সংজ্ঞালোপ হয়; তখন ঢাক আরও জোরে জোরে বাজিতে থাকে, এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীর কণ্ঠে “বলো শিবো মহাদেব দেব!” ধ্বনি ঘন ঘন উচ্চারিত হয়।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *