অক্সিজেন। পর্ব ২২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

জামলিং গাঁও আর ক্যারাভিনা

কুহু জলের গ্লাসে একটা চুমুক দেয়।তারপর বলতে শুরু করে।

“ইয়াকসাম থেকে বাখিমে যাওয়ার পথটা খুব সহজ নয়।গাছের ওপরে জোঁকগুলো তাদের শুঁড় নিয়ে লগবগ করছে। একে ওরকম বিশ্রী জোঁক,তার ওপর বিচ্ছিরি ওয়েদার ।বৃষ্টি পড়ছে।ওই অবস্থায় হাঁটা খুব শক্ত।জোঁকগুলো গাছ থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে গায়ে, মাথায়।ওখানের পাহাড় ওইভাবে  টপকে বাখিমে যেতে দেখা গেল মাটিতে ঘাসের মধ্যে লাল লাল বুনো স্ট্রবেরি ফলে আছে।টক টক,একদম স্ট্রবেরির মত।বেশ ভাল  খেতে।খুব বেশি প্রোটিন থাকে বলে স্যারেরা বেশি খেতে বারণ করছিলেন।

ইয়াকসামে বড় এলাচ গাছ ছিল।এলাচের চাষ হয় ওখানে। চারপাশে এক অদ্ভুত প্রকৃতি! সবটাই রডোড্রেন্ডন গাছ,পাইন গাছের বন । কিন্তু পথ বড় অসমতল। একবার চড়াই তো পরেই উৎরাই।হাঁটতে রীতিমত কষ্ট হয়।তবু হাঁটতে হচ্ছিল। ওইভাবেই চারটে পাহাড় ডিঙিয়ে  বাখিমে  পৌঁছে গেলাম।

বাখিমেও সরকারি থাকার ব্যবস্থা। কাঠের কুঁড়েঘর।কাঠের খুঁটির ওপর দোতলা থাকার জায়গা। একতলায় ছেলেদের আর  দোতলায় মেয়ে্দের  থাকার ব্যবস্থা। খাওয়ার ব্যবস্থাপনায় ছিল আগে এগিয়ে থাকা শেরপারা।তারাই রান্নাবান্না করে রেডি করে রাখছিল ।পাহাড়ে প্রচুর পরিমাণে জলীয় জিনিস খেতে হয়।তাই স্যুপ,চা এসব বেশি করেই খেতে হচ্ছিল।

পরের দিন যেতে হবে জামলিং গাঁওয়ে।সকাল বেলাই হাঁটা শুরু হল।পথে থাকা কালীন  সব সময়েই সকলকে,  পথে খাবার লাঞ্চ প্যাকেট  দিয়ে দিচ্ছে।পোর্টাররা মাল বয়,রান্না করে। ওই জামলিং গাঁওয়ে  রাতে থাকা হল।ওখানে পাইন গাছ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেলভেটের মত শ্যাওলা মাটি থেকে গাছে উঠে গিয়েছে। একদম সূর্যের আলো পৌঁছয় না। ঠান্ডা ভালোই । সোলার সিস্টেম নেই ।ব্যাটারির আলো জ্বলে।

জামলিং গাঁও থেকে পরের দিন যাওয়া হল বেস ক্যাম্পে। ওখানে চারটে নাগাদ পৌঁছে গেল সবাই । সোলার সিস্টেমে আলো জ্বলে। ওখানে ছেলেদের আলাদা মেয়েদের আলাদা হস্টেল, মানে কাঠের কটেজ করা আছে, সেখানেই থাকার ব্যবস্থা। বেস ক্যাম্প চোদ্দ হাজার ফুট উঁচু জামলিং গাঁও থেকে।জাম্‌লিং গাঁওয়ে কয়েকটা বসতি আছে।ওখান থেকে আর একটা পথ গেছে গোচারা।ওটা ট্রেকিং রুট।

বেস ক্যাম্পে পৌঁছে রোপ তৈ্রি হল।এক একটা রোপে দশজন করে মেম্বার।গ্রুপ লিডার,স্যার, সব নির্দিষ্ট করা হয়েছে ।পাহাড়ে ওঠার সময় ওই এক একটা গ্রুপ একসঙ্গে যাবে। তারপর প্রত্যেককে সব পার্সোনাল ইকুইপমেন্ট যেমন ক্যারাবিনার, হারনেস,জুমার ,ডিসেন্ডার, নিতে বলল ওরা।ওগুলো পোর্টাররা বয়ে এনেছে।সবাই নিজের নিজের জিনিস নিয়ে নিল।পরের দিন থেকেই ফিল্ড প্র্যাকটিস্‌ শুরু।জুতো দিয়েছে ইন্সটিট্যুটে, নাম কোফলাছ্‌।কাঁটা দেওয়া জুতো। বরফে মেরে মেরে হাঁটতে হয়।এক একটা জুতোর ওজন দু’তিন কেজি ।

ওখানে দশজন একসঙ্গে লাইন আপ করবে,একসঙ্গে শিখবে।জুতো পরে হাঁটা শিখতে হবে।সহজ নয়।জুতোতে কাঁটা লাগিয়ে ওই কাঁটা ওলা জুতো পরে বরফে উঠতে হবে ।ওই কাঁটার নাম ক্র্যাম্পন।ওটা জুতোতে লাগিয়ে বরফের পথে চলা বা পাহাড়ে ওঠার সময় পা বরফে গাঁথা,সবই ট্রেনিং এর অঙ্গ।

আইস কুড়ুল থাকে দুহাতে।আইস্যাক্স বলে তাকে। কোমরে হারনেক্স আর ক্যারাভিনা লাগানো আছে ।পাহাড়ে ওঠার পর দড়িটা একজন  ছেড়ে দেয় ক্যারাবিনার থেকে।নদী পার হবার সময় নদীর দুপাশের পাথরে দড়ি বেঁধে রাখা হয়।সেই দড়ি ধরে নদী পার হতে হয় ঝুলে ঝুলে।পা দুটো দড়িতে আটকে হাতে দড়ি টেনে টেনে এগোন।মোটেই সোজা নয় ব্যাপারটা।

আবার পাহাড়ে উঠলে পাহাড়  থেকে মাথা নীচে পা ওপরে করে ছেড়ে দেন স্যারেরা।স্যারেরা এ্যারেস্ট  বললে  পড়তে পড়তে শরীর ঘুরিয়ে পাহাড়ে কুড়ুল গেঁথে দাঁড়াতে হয়।ওভাবেই ট্রেনিং দেওয়া হয়। বেসক্যাম্পে সাতদিন থেকে পাহাড়ে ওঠা শিখতে হয়।তারপর ছোটখাটো একটা পাহাড়ে  সামিট করে ফেরার পালা।ফেরার পর আবার দার্জিলিং এ  গ্রাজুয়েশান সেরিমনি হয়।যে যার স্টেটের কালচারাল প্রোগ্রাম দেখায় সেই অনুষ্ঠানে।”

কুহু থামে এবার।একটানা বলার পরও ওর মুখ থেকে আনন্দের ভাব মুছে যায়নি। বিলুর মনে হয় এই মেয়েটা পারবে।শত অসুবিধা দূর করার মতই শারীরিক, মানসিক  জোর আছে ওর।মুখে কিছু না বলে কুহুর চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সেকথাই বোঝায় ও।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ২২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *