সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

২০০৭-এর বর্ষায় এদিকে সাতাশ মাইল ওদিকে কালিঝোরার তামাম নদীচর দু-মানুষ জলের তলায়, হলুদ লাল দামি সব মেশিন জলের তোড়ে ভেসে গেলো। ভেসে গেলেন দু চারজন শ্রমিকও, কি যায় আসে, অমন হয়, কাজ বন্ধ হলো না। আবার মেশিন, আরো শ্রমিক, আরো পাহাড় কাটা, ফাটানো, খোঁড়া। সেই থেকে ফি বছর প্রায় নিয়ম করে বড় রাস্তার একটা না হয় একটা টুকরো ভেঙে ধসে নদীগত হচ্ছে। বর্ষা আসে, পাহাড়ের মাথায় শুরু হয় জলভর্তি বজ্রগর্ভ নীলকালো ধূসর মেঘের দাপাদাপি। হঠাৎ মেঘভাঙা বৃষ্টিতে কাছের দূরের পাহাড় ভেঙে এসে বাঁধের জলে থমকায়, ধরা জলের তলায় মাটি পাথর জমতে জমতে জলতল উঁচু হতে থাকে, রাস্তা ছুঁয়ে ফেলে একদিন। পথের পাশের, নদীপাড়ের বলবাখানি গেইলখোলা রিয়াং গ্রামের লোকজন জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন, রাস্তায় জল উঠে এলে উপর পাহাড়ের দিকে যান। বাঁধে আটকে রাখা যায় না, লকগেট খুলে নদীকে ছেড়ে দিতে হয়। ছাড়া পাওয়া নদী দুর্দান্ত মহিষের মতো ছুটতে থাকে, পাড় ভাঙে, নিচের সমতলে আবাদবাস্তু ভাসায়, ভাঙে। বর্ষা থামলে যে কে সেই, লকগেট বন্ধ, ধরা জলের মধ্যে সরু সরু মরা গাছের ধূসর কঙ্কাল। 

 

কালিম্পং! কালিম্পং!

রিয়াং রিল্লি তিস্তার একসঙ্গে মিশবার, মহাশোল মাছেদের খেলা করবার, সম্বরের নুন খেতে আসবার পুরোনো চেনা জায়গাটা এখন জলের তলায়। বর্ষা এলে একরকম, লকগেট খুলে দিতে হয়, ফলে হোক না ঘোলা জলের ক্ষ্যাপা ঘূর্ণি, তিস্তাকে অন্তত দেখা যায়। বেশি মেঘজড়িত দিনে, টুকরো পেঁজা মেঘ নেমে আসে গিরিখাতের তলায়, এত মেঘ যে নদীর জল দেখা যায় না। কুয়াশা হয়ে যাওয়া নিচু মেঘ পাহাড়ের ক্ষত, মরা বনের হাড়গোড় ঢেকে নেয়। একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাল পাকানো চারপাশের মাটি থেকে বৃষ্টির, কুয়াশার গন্ধ উঠতে থাকে। রিয়াং গ্রাম, পুরোনো রিয়াং স্টেশনের চাতাল থেকে উত্তর পূবে তাকালে দেখা যায়, চুড়ো থেকে অর্ধেক গা মেঘে ডুবিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাহাড়। বাসে গাড়িতে আসতে যেতে দেখা যায়, সবুজ পাহাড়, ঝাপসা চুড়ো, মেঘ। না-থাকা-মরে-যাওয়া-মেরে-ফেলা নদীতে নামলে আরো ভালো করে দেখা যায়। পাহাড়ের নিচে, মাথায়, গায়ে, হলদে-সবুজ শ্যাওলা ও ছত্রাকের মতো,  মরাবাঁচা থাকা না থাকার অনেক গল্প জমা হয়ে থাকে।  

 

না থাকা নদী থেকে খাড়া উঠেছে যে পাহাড়, তার নাম দুরপিন বা দূরবীন। দুরপিনদাঁড়া। দাঁড়া মানে পাহাড়। নদী থেকে সে পাহাড়ে উঠবার সহজ কোন পথ আছে বলে জানা নেই। তিস্তাবাজারের কাছাকাছি পৌঁছে চিত্রেতে নদী পেরিয়ে কালিম্পং যাবার চড়াই ভাঙতেই হবে। কালিম্পং গিয়ে থানার সামনে থেকে ডানহাতি রিংকিংপং পথ ধরলে আরো চড়াই ভেঙে দূরবীন। প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে প্রথম যখন যাই, সেনাছাউনির মধ্য দিয়ে হুড়মুড় করে উঠে গিয়েছিলাম পাহাড়ের মাথায়। অল্প বা মাঝারি উচ্চতার পাহাড়চুড়ো সচরাচর যেমন হয়, ওপরের দিকটায় খোলা মাঠমতো। বসন্তের বিকেলে সবুজ-বাদামি মাঠের ওপর মিঠে হলুদ রোদ এসে পড়েছে, পশ্চিমে দার্জিলিং-এর পূর্বে রিল্লি উপত্যকার সার সার পাহাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কোথাও রোদ কোথাও ছায়া। মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের একেবারে কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ আটকালো না, প্রশ্ন করলো না কোথায় যাচ্ছি, মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম পাহাড় ঝাঁপ দিচ্ছে অনেক অনেক নিচের নদীতে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাচ্ছে তিস্তা, বাঁয়ে পূব থেকে আসছে রিল্লি, দক্ষিণ থেকে রিয়াং। গিরিখাতের সবকটা পাহাড়ের গা সবুজে ঢাকা, খাদের একেবারে নিচে, পশ্চিম পাহাড় জুড়ে ছায়া নামছে ঘন হয়ে। রোদ-লাগা উজ্জ্বল সবুজ, ছায়া-ঢাকা অন্ধকার সবুজ, সাদা-রুপোলি নদী। জোরে জোরে হাওয়া দিচ্ছিলো, সেই হাওয়ার শনশন, মাঝেমাঝে দু একটা পাখির ডাক। মাঠে বসে থেকে থেকে দেখলাম, রোদ মরে এলো, ছায়া বাড়তে বাড়তে পুবের পাহাড়বন ঢেকে নিলো, খাদের নিচের জমাট অন্ধকার উঠে এলো পাহাড়ের গা বেয়ে, পিছনের শহরে চিকচিক ঝলমল করতে থাকলো সন্ধ্যার আলো। কতদিন কেটে গেলো, চোখ বুঁজলেই প্রথম দেখাশোনা সে দূরবীনকে স্পষ্ট মনে করতে পারি। 

 

পাহাড়ের মাথায় যেখানে মাঠের পর মাঠ ধাপে ধাপে খাদের মুখ অবধি ছড়িয়ে থাকতো, তার অর্ধেক জুড়ে বেশ কিছুকাল হয় বড়সড় বৌদ্ধ গুম্ফা হয়েছে। বারান্দা থেকে দেখা যায় বাকি মাঠ কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা, ঘেরার ভিতরে সেনা ব্যারাক, একগাদা লরি-টরি। গুম্ফার সামনে অতিকায় ইস্পাতের টাওয়ার, সম্ভবত মোবাইল ফোনের। সকাল থেকে বিকেল লোক ভিড় করে তাই দেখতে আসে, আসবেই, দূরবীন পাহাড় ভ্রমনার্থীর অবশ্য দ্রষ্টব্য। 

 

এক যদি সবে-আলো-ফোটা খুব খুব সকালে আসা যায়, বেশ ভালো লাগে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা কাঁপুনি ধরায়, সামলেসুমলে উত্তরের পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকালে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মধ্যে রেখে  ডানদিক বাঁদিকের বরফপাহাড়ের সারি গোলাপি-লাল থেকে আস্তে আস্তে উজ্জ্বল সাদা হয়ে উঠছে, গুম্ফায় প্রভাতি পূজাপাঠ ওই শুরু হলো, গম্ভীর গং-এর আওয়াজে মিশে যাচ্ছে বহু কণ্ঠের সুরেলা স্তোত্রপাঠ, মাখনে চুবোনো সলতেয় আগুন দিয়ে জ্বালানো হচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক ছোট প্রদীপ, দূর পাহাড়ের মাথা থেকে রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে নিচের পাহাড়, পাহাড়তলিতে। এক-আধবার দূরবীন থেকে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। অবশ্য তখনো পাহাড়চূড়োয় বাড়ি বলতে গুম্ফা, ইতস্তত দু একটা সরকারি ঘর। বাকিটা দিব্যি খালি, মাঠে বেড়া পড়েনি, কেউ না দেখলে মাঠশেষের খাদ অবধি চলে যাওয়া যেতো, কুয়াশা না থাকলে দেখা যেতো নিচের নদীও। দূরবীন পাহাড়ের কোনো বিন্দু থেকে নদী দেখবার সুযোগ আর নেই। 

 

দেখবার মতো নদীও অবশিষ্ট নেই আর। রিংকিংপং পথ ধরে দূরবীন পাহাড়ের শেষ চড়াই উঠবার অব্যবহিত আগে যে পাঁচ মাথার মোড়, যেখানে এখন অস্ত্রধারী টহলদারেরা ঘুরে বেড়ায়, মিলিটারি সায়েবদের ইচ্ছামতো রাস্তায় বেড়া নেমে আসে, সেখান থেকে একটা পথ সেনাছাউনির ভিতর দিয়ে চিবো গ্রামের দিকে যায়। গ্রাম আসবার অনেকটা আগে পথ যাচ্ছে খাদ ঘেঁষে। পথের ধারে এক ফালি ঘাসজমি,  সে জমিতে নামলে নিচ অবধি দেখা যায়। কালিম্পং-য়ে, দূরবীন-এ গেলে অভ্যাসবশত সেখানে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি। কখনো নিচের খাদ থেকে পাহাড় বেয়ে মেঘ উঠে আসতে থাকে, কখনো ঝড়ের মতো হাওয়া দেয়। পরিষ্কার মেঘমুক্ত দিনেও নিচে নদীর পাড় ভালো দেখা যায় না। খুবলে খাওয়া পাহাড়ের গা, বাঁধ, বদ্ধ হলদেটে জলা, কংক্রিটের ধূসরসাদা স্তূপ। যতদূর চোখ যায়, ঝাপসা ঘোলাটে নোংরা, কেউ যেন দীর্ঘ লোল পিশাচজিভ বার করে নদী পাহাড় বনের সমস্ত রঙ রস রুপ টেনে শুষে নিয়েছে। 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *