সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

তিস্তা থেকে রিয়াং: কালিম্পং-এর পথে

তিস্তা ভ্যালি রোড ধরে উত্তরের দিকে এগোচ্ছি। শিলিগুড়ি থেকে কিছু দূর গেলে ডাইনে লালটং বাঁদিকে ঘোড়ামারা-হিলেখোলার গভীর বন। গভীর মানে বাইরে থেকে দেখলে ওইরকমটাই লাগে, বিশেষত বর্ষা নামার পর। শালজঙ্গলে নতুন পাতার লালচে-সবুজে তখন গাঢ় সবুজের ছোপ, বড় গাছের গায়ে লতিয়ে ওঠা অন্য কত গাছ, খানিক নিচে জলে ধোয়া দুর্ভেদ্য সবুজের ব্যূহ। অসংখ্য লতাগুল্ম-ঝোপঝাড়, বনের মেঝেয় বসন্তের পোড়া দাগ মিলিয়ে গিয়ে ছোট বড় ঘাসের জটলা। ডালপালা লতাগুল্ম ঘাসবনের আড়ালে কি আছে কি নেই ঠাউর হয় না। ডাইনে লালটং-য়ের বনের পর চুমুকডাঙ্গি-র বন, তার পর দশ মাইল। বর্ষার বনে চোখ চলে না, মাত্র মাইলটাক দূরে তিস্তার বিপুল জলরাশি সগর্জনে প্রবাহিত, দেখা যায় না।

বলছি বটে বিপুল জলরাশি, জলকল্লোল গর্জন ইত্যাদি, তবে সে পুরাকথা। একুশ শতকের শুরুতে, মাত্র বছর পনেরো-কুড়ি আগেও বনপথ ধরে সাহস করে লালটং বা চুমুকডাঙ্গি গ্রামে পৌঁছে গেলে দেখা যেতো বন শেষ হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ, ডাঙাজমি সোজা নেমে যাচ্ছে নিচের নদীতে। জল বাড়লে ডুবে যাচ্ছে চাষজমি, কখনো বা ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল হাঁস মুরগি শুয়োর ইত্যাদির থাকার জায়গা। জল বলতে তিস্তার সবুজ নিলচে চেনা জল নয়, ভরা বর্ষার উদ্দাম ঘোলা জল, তাতে পলির সঙ্গে কাদা বালি পাথর সব মিশে আছে। ফি বর্ষায়, ক্ষ্যাপা জল ক্রমশ গ্রামের ঘরবাড়ি ছাপিয়ে ওপরের বন ছুঁয়ে ফেলতো, শেষে একদিন জলের ধাক্কা সামলাতে না পেরে গাছপালা পশুপাখি কীটপতঙ্গ সমেত পুরো বনটাই ভেঙে পড়ে নদীতে চলে যেতো। ধসে যাওয়া পাড়ের গা বেয়ে পথ বার করে নিচে নামতে হতো তখন। কত বন, কত গ্রাম তিস্তা যে এভাবে খেয়েছে, এখনো খাচ্ছে, খায়, ইয়ত্তা নেই। নদী, জল বাড়তো, এগুতো, বন, মানুষ, গ্রাম পিছোতো। কথা হচ্ছে, বনের গভীরে, অমন বিপদের জায়গায় গ্রাম, মানুষ ইত্যাদি থাকতো কেন? সকলি সায়েবের, মানে সায়েবদের ইচ্ছা। বন কাটতে কাটতে, কেটে কাঠ বানিয়ে দূরদেশে চালান দিতে দিতে সায়েবরা এই বন থেকে ওই বনে, এই পাহাড় থেকে ওই নদীতে পৌঁছতেন, সঙ্গে যেতো কুলিদের গ্রাম। কুলিরা বন কাটতো, কাটা বনে নতুন চারা লাগাতো, সেই চারার দেখভাল করে বড় করতো। পুরোনো সায়েবলোগ গেলেন, নতুন সায়েববর্গ এলেন, বনের কুলিদের জীবনে বিশেষ হেরফের হলো না। বন কাটা বন্ধ হয়ে ওই একরকমের বন বাঁচানো শুরু হলো, বনে লোকজনের থাকা, ঢোকা বারণ। হলে কি হয়, নদীর পাড়ে, পাহাড়ের মাথায়, এমনকি তিস্তা ভ্যালি রোডের ধারে ধারে পুরোনো গ্রামগুলো থেকেই গেলো। বনে কাজ নেই, বালি ও কাদামাটির পুরু আস্তরণে ঢাকা নদীচর, ফসল কায়ক্লেশে যদি বা কিছু হয়, হাতীতে খায়, বুনো শুয়োর,  হরিণের দল তছনছ করে। তবু গ্রাম আছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে কোথায় যায় মানুষ?

বন, বনের ভিতরের গ্রাম, গ্রামের মানুষের গল্প আগে বলা হয়েছে, আবার বলা যাবে। নদী, মানে তিস্তা নদীর কথায় ফিরি।  আমাদের এদিককার পাহাড়বন ক্ষেতখামার চা-বাগিচার যত গল্পই করা যাক, তিস্তায় আসতে নামতে ভাসতে এমনকি ডুবতেও হয়। সে তিস্তা আর নেই, নদীর দুধারের ওপর নিচের পাহাড়ে সার সার বাঁধ। পুরোনো বড় নদীকে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট আলাদা আলাদা নদী বানিয়ে ফেলা হয়েছে, ক্ষীণতনু শীর্ণকায়া দুঃখী সেসব জলধারা দেখে পুরোনো তিস্তাকে মনে করা যায় না। তবু। তাও।

ছোট হোক, সরু হোক, নদী তো। সিকিম-তিব্বত সীমান্তের বরফের পাহাড় থেকে শুরু করে জেলা কুচবিহারের প্রান্তে বাংলাদেশে ঢোকা অবধি, বহু পাহাড়বন জনপদ ছুঁয়ে তিস্তার নাতিদীর্ঘ যাত্রাপথ। সে পথের বেশির ভাগটায় ছোট, সরু, কোনরকমের নদীই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

লালটং চুমুকডাঙি দশ মাইল ছাড়িয়ে সেভক বাজার। পাহাড়শেষ, সমতলের শুরু। বছরের অধিকাংশ সময় সেখানে নদী বলতে বালিপাথরের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসা একফালি দুর্বল স্রোত। বাজার থেকে পাহাড়ে উঠে, করোনেশান ব্রীজ ছাড়িয়ে কালিঝোরা নদীর সরু গভীর গিরিখাত। অনেকটা ভিতরে না ঢুকলে সে নদী দেখতে পাওয়া যায় না। রেলপথ তৈরি, বাঁধ বানানো, রাস্তা চওড়া করা ইত্যাকার তীব্র দেশপ্রেমিক প্রয়োজনে সেভক থেকে কালিঝোরা পাঁচ মাইল পথের যাবতীয় পাহাড়বন লন্ডভন্ড, পর্বতগাত্র বৃক্ষহীন, ক্ষতবিক্ষত, যেখানে সেখানে যখন তখন ধ্বস নামছে।

কালিঝোরা বাজারের নিচে, ফিকে সবুজ রঙ করা সায়েবি আমলের পুরোনো পি ডব্লিউ ডি বাংলোর গা ঘেঁষে যেখানে ঝকঝকে সাদা-রুপোলি বালির রাজত্ব, যেখান দিয়ে এসে কালিখোলা বা কালিঝোরার মিশকালো জল তিস্তার পান্নাসবুজে পড়তো, ঠিক সেইখানে নদীতে বাঁধ পড়েছে। পুরোনো একতলা বাংলো জ্বলে খাক হয়ে গিয়েছিলো প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময়। বিস্তীর্ণ চর, চর জুড়ে মানুষ-ডোবা শরতের কাশবন, চরশেষের সবুজ নীল জল, জলের ভিতরের সাদা বাদামি হলদে পাথর। সব গুঁড়িয়ে ভাসিয়ে ডুবিয়ে বাঁধ উঠেছে। ধসে পড়া, পড়তেই থাকা সব উলঙ্গ পাহাড়ের গা ছুঁয়ে স্থির নিশ্চল জমে আছে মরে যাওয়া, মরে ভুত হয়ে যাওয়া তিস্তা নদী, পাহাড়ের রং মানে লেপচা মানুষেরা যাকে ডাকেন রঙ ন্যিয়ো  বলে।

বাঁধের জমা জলে তলিয়ে গিয়েছে  কালিঝোরার চর, তিস্তা ও কালিঝোরার মোহনা। তিস্তার ভাঁটিতে পূর্বিখোলা নদীর সুন্দর চোখজুড়োনো চর আছে না গেছে কে জানে। সেভকের করোনেসান ব্রীজ পেরিয়ে পাহাড়বন ডিঙিয়ে যে সুঁড়িপথ উঠে যেত পোনবু পাহাড়চুড়োয়, সেখান থেকে আরো নানান পাহাড়বনে, সে পথের কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে গেলেই পূর্বিখোলা নদীর অপরূপ বন্য গিরিখাত দেখতে পাওয়া যেতো। বনের সবুজে মিশে যেতো  নদীর সবুজ, স্রোত ধরে একটু এগোলেই দেখা যেতো তিস্তাকে। পনবুর পুরোনো পথে বিশেষ কেউ এখন পাকদন্ডী ভাঙে না। পথটাও সম্ভবত নেই।

কালিঝোরা থেকে বিরিক লোহাপুল, সেখান থেকে রম্বি, রিয়াং, সাতাশ মাইল। সাতাশ মাইলে আর একটা বাঁধ। তারপর ধুলো-ওড়া ঘিঞ্জি তিস্তাবাজার, কিঞ্চিৎ উজানে রঙ

ন্যিয়োয় এসে মিশেছে রঙ ন্যিত অর্থাৎ রঙ্গিত। শোনা যাচ্ছে, সেখানেও বাঁধ পড়বে। তা পড়ুক। মন নামে বন, সারান্দা পাহাড়ের গল্প বলতে গিয়ে সেই কবে বলেছিলেন কালকূট।   মনের বনে, স্মৃতির নদী বেয়ে আমাদের সময়ভ্রমণ, সেখানে বাঁধ ওঠায় কার সাধ্য?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *