পুনর্ভবাপুত্র। নবম পর্ব। লিখছেন আহমেদ খান হীরক

0

আমাদের ডন

এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছি। ভেবেছিলাম ফেল করব। ঘটনা ঘটল উল্টো–ভালো নম্বর নিয়ে পাশ। নম্বরটা এতই ভালো যে বিশ্বাস হয় না। বাড়িতে এসে যখন বললাম, দেখা গেল তাদের মধ্যে তেমন কোনো কৌতুহল তৈরি হয় নি। যেন, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। আমাকে মিষ্টি কিনতে পাঠিয়ে দিলো। আমি মিষ্টি নিয়ে ফিরছি যখন, তখন ডনের সাথে দেখা।
ডন।
ডন আমার দিকে তাকিয়েই বলল, স্টার করছিস নাকি?
আমি বললাম, হুম। মিষ্টি খাবি?
ডন হাসল। বলল, মিষ্টি রাইখা আয় বাড়িতে। তোকে নতুন একটা জিনিস খাওয়াবো!
সেদিক ডন কী খাইয়েছিল তা আর বিতং করে বলছি না; কিন্তু রহনপুরের একটা সময় পর্যন্ত ডন আমার জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল। থাকার কথা না, তবু থাকত–কীভাবে কীভাবে যেন সে ঠিকই পৌঁছে যেত!

এই নাম অবশ্য তার বাবা-মা রাখেননি। এই নাম আমরা রেখেছিলাম। নাম তার ছিল শহিদুল ইসলাম। আমরা বলতাম শহিদুল ইসলাম ডন। কী বিচিত্র জীবন তার আর কী গভীর মৃত্যু! পুনর্ভবার দিকে তাকালে, সন্ধ্যায় তার পাড়ে দাঁড়ালে, এখনও ডনের মৃত্যু অথবা তার বেঁচে থাকা অথবা তার থাকা-না-থাকা আমাকে স্পর্শ করতে চায়। আমি শহুরে নিরাবেগী আধুনিক মানুষ হওয়ার প্রবল ইচ্ছায় এইসব আবেগী বাতাসে কোনওই হাওয়া দিই না। বরং মন ফেলে রাখে সিগারেটের মতো তুচ্ছতায়। অথচ সিগারেটের তুচ্ছতাতেও যে ডন থেকে গেছে, ভুলে যাই!

ডন বয়সে আমাদের চেয়ে বড় ছিল এবং তার চেয়ে বড়দের সাথে ছিল তার ওঠাবসা। ওঠাবসা মানে অনেকটা ফুটফরমাশ খাটার মতোই তো ছিল। সিগারেট এনে দিত, চাও… আবার একই সিগারেটে টান দিয়ে বন্ধুতাও ছিল তার। আমাদের সাথে, আমার সাথে, সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল ওই সিগারেট নিয়েই বোধহয়। কেবল সিগারেট খেতে শিখেছি বলে ভয় ও লজ্জায় দোকান থেকে না কিনতে পারা আমাকে সিগারেট কিনে দিত ডন। আমরা নদী পেরিয়ে চলে যেতাম সেটা খেতে। ডন তখন আমাকে অদ্ভুত গল্প শোনাত। যে গল্প আমি কোনওদিন শুনিনি, যেগুলো রূপকথা না, কিন্তু রূপকথার চেয়ে কম আকর্ষণীয় না। আমাদের সাদা জগতের মধ্যেই যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে আরেকটা কালো… অন্ধকার জগত… তার সাথে প্রথম পরিচয় ডনের গল্পে। ভারতীয় বর্ডার পেরিয়ে তখন কোথা থেকে আসে মদের বোতল, কোথা থেকে আসে ফেন্সিডিল, আসে পিস্তল সব যেন ডন জানে। আমার অদ্ভুত লাগে শুনতে। সেই কাটা রাইফেল আর পিস্তল আর বুলেটের গল্প শুনতে শুনতে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। ডন গাঁজা খায়। আমার গাঁজার ঘ্রাণ অদ্ভুত ভালো লাগে। ডনের দিকে তাকিয়ে মনে হয় আমি অন্য গ্রহের প্রাণী দেখছি। আমার ভেতর ঈর্ষা, আমার ভেতর ভয়! যে মানুষটা আমি কোনওদিন হতে পারব না, হয়তো হতে চাইও না, সেই মানুষটা আমাকে দুর্নিবার আকর্ষিত করে চলে। ডনকে আমার মহাশক্তিধর মনে হয়। সে হুট কথাতে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যায় ইন্ডিয়া। এক মাস ঘুরে এসে শোনায় সেখানকার সিনেমাহলের কথা, বারের কথা, মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার কথা। শোনায় চায়না গেট সিনেমা দেখতে দেখতে মাতোয়ারা হওয়ার কথা! ডন আমার অপরূপকথা খুলে দিতে থাকে পৃথিবীর।

ডন খুব বেশি পড়াশোনা করেনি। কিন্তু ডনের সাথে ঘুলেমিলে যেতে আমার সময় লাগেনি। পড়াশোনা বেশি না করলে কী হবে ডন ছিল আমাদের সবার চেয়ে বেশি রাজনীতি সচেতন। আমরা পত্রিকার শব্দ-জব্দ আর খেলার পাতায় আটকে থাকতাম। ডনকে দেখতাম সে উপসম্পাদকীয় পড়ছে নিয়মিত। রাজনীতি নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তা ছিল, সেগুলো সে সুযোগ পেলেই বলত। আমরা কখনও মনে মনে, কখনও তার মুখের ওপর হাসতাম। আমরা হাসলে সে ব্যথিত হত, কিন্তু আমাদের ওপর রাগ করার মতো স্বভাব বা যোগ্যতা তার ছিল না।

ডনের কাছে আমরা ব্রিজ খেলতে শিখেছিলাম। তাসের ফোটা কীভাবে গুণতে হয়, কীভাবে হাত ফেলে খেলতে হয়, কীভাবে ট্রিক্স নিতে হয়, কীভাবে রিস্ক নিতে হয়… সব! আমরা যখন নিয়মিত হয়ে উঠছি তাসে, ডনই ছিল আমাদের শিক্ষাগুরু। কিন্তু আমরা তা স্বীকার করতাম না। কারণ সামাজিকভাবে ডন আমাদের নিচে ছিল। নিচের মানুষকে আমরা সমকক্ষই ভাবতে পারতাম না, শিক্ষাগুরু ভাবা তো দূরের কথা!

ডন ছিল আমাদের অন্ধকার জগতের সূত্রধর। আমাদের সব খারাপের সাক্ষী। আলোর জগতে তার পরিচয় আমরা লুকিয়ে রাখতাম। ভাবটা এমন করতাম যেন আমরা তাকে চিনি না। ডনের অনেক খারাপের সাক্ষীও আমরা। কিন্তু সে সব খারাপকে ইদানিং আমার খারাপ মনে হয় না। মনে হয় ডন ভালো হতে চেয়েছিল… আমরা যখন আরেকটু বড় হয়ে উঠেছিলাম, যখন ডনের সঙ্গ আমাদের খুব একটা কাঙ্খিত ছিল না, এরকম সময়ে ডনের সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিল। পাওয়ার ট্রলারে চড়ে মাথায় গামছা বেঁধে সে তখন জমির দিকে যাচ্ছে চাষাবাদের উদ্দেশ্যে। আমাকে দেখে হেসে সে বলেছিল, ভালো হয়া গেছি বন্ধু! হালাবাদ করা শুরু করছি এখন!

ডন ভালো হয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ভালো সে হতে পারেনি। পাশের একটা গ্রামে তাকে লেঠেল হয়ে যেতে হয়েছিল। যে গ্রামের আক্রমণে ডনকে লাফিয়ে পড়তে হয়েছিল পুনর্ভবায়। পুনর্ভবায় কোনও কালেই ডনের স্বস্তি ছিল না। একটা পা একটু ছোট হওয়ায় ডন ভালো সাঁতার কাটতে পারত না। স্রোতের টানে অনেকটা যেতে যেতে ডন তার পাশের জনকে বলেছিল, হামি আর পারনু না জি ভাই… এরপর ডনের হাত ডুবে গিয়েছিল…

দুই দিন পর ডন ভেসে উঠেছিল পুনর্ভবাতেই। তার লুঙ্গি তার ফুলে ওঠা শরীরে কেটে নাকি বসে গিয়েছিল… অন্যদের মুখে শুনেছি। আমি দেখতে যাইনি। আধুনিক মানুষদের এসব আবেগ দেখানোর মতো সময় নেই।

স্বর্গছেঁড়ার পুনর্ভবা শুধু হীরকদের ঠাঁই দিয়েছে তা না, পুনর্ভবা ডনদেরও ঠাঁই দিয়েছে তার গভীরে। পুনর্ভবা ততটা আধুনিক হতে পারেনি।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *