কাগজের নৌকো। পর্ব ৯। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

0

আসন্ন সন্ধ্যার দুয়ারে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকায় শৈলরাজির মাথায় মেঘের মুকুটের পানে চেয়ে রামানুজের মনে হল, এই নির্জন ক্ষুদ্র জনপদ, অদূরে নিঃসঙ্গ পাকদণ্ডী, ধুপি গাছ আর পথের দুপাশে ফার্নের ঝোপে ফুটে থাকা পাহাড়ি ফুল-সকলেই যেন বহু সহস্র বৎসর পূর্বের একটি অশ্রুত আখ্যান মৃদুমন্দ স্বরে বলে চলেছে, খেয়াল করলে বোঝা যায় সেই অলীক কাহিনি কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই কুয়াশাবৃতা। এখানকার মানুষ ওই আখ্যান অথবা তুষারাবৃতা অপরূপাকে সোহাগ করে বলেন কানচ্‌ন! আজ তিনদিন হল এই পাহাড়ি গ্রামে এসেছে রামানুজ চক্রবর্তী, পেশায় আর্ট ডিলার তবে তরুণ রামানুজ আলোকচিত্রী হিসাবেও ইতোমধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে, মূলত পাহাড়ের ছবিই সে তোলে, বহুদিন ধরে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের গোপন বাসনাও তার রয়েছে।

 

সামনে উঁচু টিলার উপর আনন্দ মোক্তানের ‘হোপ’ হোম-স্টে, এখানেই এসে উঠেছে রামানুজ। আষাঢ় মাসে পাহাড় প্রায় পর্যটক শূন্য, দুই দিন একটানা বৃষ্টির পর আজ অপরাহ্নে কয়েক মুহূর্তের জন্য জলদান্তর্বর্তিনী শৈলরাজি অস্ত আলোয় স্বর্ণগোধূলির মায়া হরিণের মতো দৃশ্য জগতে ভেসে উঠেছিল কিন্তু পরমুহূর্তেই যুবতির শিথিল কবরীর রূপ ধরে পূর্বগামী বাতাসে মেঘ ভেসে এল, ঝমঝম কুয়াশা বাদ্যে অস্পষ্ট হয়ে উঠল চরাচর। মোক্তানের ক্ষুদ্রকায় কাঠের দোতলা বাড়িটি ভারি সুন্দর, উঠানে একখানি শতাব্দী প্রাচীন ফোয়ারা রয়েছে, বারান্দায় ছোট টবে মরসুমি ফুলগাছ, পেছনে একফালি চাষের জমি, পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর-দূর থেকে দেখলে মনে হয় এই গৃহ শিশুর অপটু হাতে মোমরঙে আঁকা কোনও ছবি।গৃহটির চারপাশে আর কোনও জনবসতি নাই, নিঃসঙ্গ টিলার উপর অভিমানের মতো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বামদিকে পাইন গাছের গহিন জঙ্গল-সারাদিন আবছা স্মৃতিচিত্রের মতো মেঘ আর কুয়াশা পরস্পরের হাত ধরে সেখানে খেলা করে, সন্ধ্যার মলিন আলোয় মাথা দুলিয়ে ধুপি গাছের দল নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আপনমনে কী যেন বলে চলেছে, করুণ অশ্রুপাতের মতো শোনাচ্ছে উত্তরপথগামী অলসচারী বাতাসের শব্দ।

 

মোক্তানের গৃহ পার হয়ে আরও একটু উপরে ছোট্ট একখানি গোম্ফা চোখে পড়ে। কয়েকটি ক্ষয়িষ্ণু পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলে বিরতি চিহ্নের মতো ঘাস জমি পায়ের নিচে যেন আদর বিছিয়ে দেয়, অন্তরমহল হতে ক্ষীণ প্রদীপের আলো ভেসে আসছে, বিচিত্র ধূপের সুবাসে ভারি হয়ে রয়েছে পাহাড়িয়া বাতাস।এই নির্জন গোম্ফাটি রামানুজের ভারি প্রিয়, যেন বহুদিনের কোনও আপনজন। মন্থর পায়ে উপরে উঠে এসে সিংহ দুয়ারের সামনে দাঁড়াল, এখান থেকেই দেখা যায় পাথরের বেদির উপর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ মূর্তি, সারি সারি পুরাতন আলমারির ভেতর রাখা কবেকার সব পুথি, সে কি তিব্বতি ভাষায় লেখা? পুথির দিকে চোখ পড়তেই রামানুজ অবাক হয়ে ভাবল, সুদূর তিব্বতের কোনও সাধারণ মানুষের আখ্যান যদি লেখা হত ওই পুথির পাতায় তাহলে কেমন হত? রুক্ষ হিমশীতল প্রান্তরে হেঁটে যাওয়া একা কোনও মানুষের কথা যদি শুনতেন তথাগত তাহলে কি তাঁর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটত?

অসংলগ্ন চিন্তার মাঝেই হঠাৎ পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল, এমন জনশূন্য নিদ্রিত ভুবনে বড়োই অশ্লীল কটুবাক্যের মতো শোনাল যন্ত্রধ্বনি-সামান্য বিরক্ত হয়ে রামানুজ ফোনটি ধরতেই ওপার থেকে চেতন ডালমিয়ার ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘মি. চকরাবর্তী আর ইউ ইন টাউন?’

গুম্ফার সামনে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে কয়েক-পা নেমে এসে রামানুজ ধীর স্বরে বলল, ‘না, কেন বলুন তো?’

সামান্য ক্ষুন্ন শোনাল চেতনের স্বর, ‘ইটস ভেরি আর্জেন্ট রামানুজ!’

— ওকে, প্লিজ টেল মি হোয়াট হ্যাপেনড!

— ফিউ আওয়ারস ব্যাক সামওয়ান ফ্রম লানডান কলড মি-সি ওয়ান্ট টু বাই টেন পেন্টিংস অব মিস. চ্যাটার্জী! ইটস আ হিউজ ডিল রামানুজ, প্লিজ ডু সামথিং নিডফুল।

— মিস চ্যাটার্জী মিনস ঐন্দ্রী?

— ইয়েস!

এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে রামানুজ বলল, ‘ওকে, প্লিজ গিভ মি সাম টাইম, আই স্যাল গেট ব্যাক টু ইউ। অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো সি ইজ নট ইন কলকাতা, লেট মি চেক ওয়ান্স।’

 

ফোন রেখে অন্যমনস্ক ভাবে কয়েক মুহূর্ত কৃষ্ণকায় শৈলরাজির দিকে চেয়ে রইল রামানুজ-কিশোরী বয়সের মতো মধুর বাতাস বইছে গিরি উপত্যকায়, অদূরে ধূপি গাছের পাতায় নেমে এসেছে আলোর অতীত এক অপরূপ ছায়া আর তারই সখী পাহাড়ি বালিকার মুখের অমলিন হাসি হয়ে সন্ধ্যাদেবী বসে রয়েছেন পাকদণ্ডী পথের বাঁকে, তাঁর আঁচল ছায়ায় আচ্ছাদিত দূরের জনপদে ক্ষুদ্র আলোগুলি টুপটুপ শব্দে ফুটে উঠছে-যেন চৈত্র মাসের কুসুম উপত্যকা, আনন্দের মোক্তানের সাদা লোমওয়ালা ভুটিয়া কুকুরটি রামানুজের পায়ে পায়ে ঘুরছে, ভারি পুতুল পুতুল গড়ন, এই কয়েকদিনেই কুঞ্জবনে চোখে হারাই ভাব, সিম্বাকে কোলে তুলে মৃদু হাসল রামানুজ-ঐন্দ্রী এখন বারাণসী, হোটেলের ফোন নাম্বারে একটি ফোন করবে কি? পরক্ষণেই ভাবল, থাক, যদি আবার রাগ করে? তার থেকে বয়সে ছোট যুবতিকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে রামানুজ, ভয় ঠিক নয়, কী একটি অদৃশ্য বলয় যেন সর্বদা ঐন্দ্রীকে আগলে রাখে, তাকে অতিক্রম করে অন্তরমহলে প্রবেশ বড়ো কঠিন।

তবুও ফোনটি করল, ঐন্দ্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো চিত্রকরের দশটি ছবি বিদেশে বিক্রির কমিশন ভারতীয় মুদ্রায় নেহাত কম নয়!

 

‘গোপাল রেস্টহাউজ, জ্বী কহিয়ে!’, ফোন তুলেই শর্মাজি অভ্যস্ত সুরে কথাগুলি বললেন।

— জ্বী, নমস্কার। ম্যে কলকাত্তা সে বল র‍্যহা হুঁ, ঐন্দ্রী চ্যাটার্জীসে ক্যায়া বাত হো সাকতা হ্যে?

আজকাল বোর্ডারের ফোন কখনও রিসেপসনে আসে না-বিস্মিত কণ্ঠে শর্মাজী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপ কৌন বল র‍্যহা হ্যে? আপকা শুভনাম?’

— জ্বী মেরা নাম রামানুজ চক্রবর্তী, মে কলকাত্তামে ঐন্দ্রী ম্যাডামকে সাথমে কাম করতা হুঁ। উনকা পাস মোবাইল নেহি হ্যে অর মুঝে থোড়া ইমার্জেন্সি পড় গ্যয়া, ইস লিয়ে ইঁহাপে কল করনা পরা!

— লাইন পে বনা রহিয়ে, ম্যে দেখতা হুঁ।

ফোন কানে রামানুজ শুনতে পেল ভদ্রলোক কাকে যেন ডাকাডাকি করছে, অত্যন্ত ক্ষীণ ঘণ্টা আর কাঁসরের শব্দ ভেসে আসছে-বোধহয় পাশে কোনও মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে, চোখ বন্ধ করে একটি দৃশ্য কল্পনা করল রামানুজ-নির্জন সন্ধ্যা নিবিড় কোনও ঘাটের পৈঠায় ঐন্দ্রী বসে রয়েছে, সম্মুখে কলকলনাদিনী সুরধুনী, রক্তবর্ণ মেঘাবৃত পশ্চিমাকাশ সোহাগের মতো টলোমলো, একটি চাঁপা রঙা শাড়ি ঐন্দ্রীর পরনে, আলুলায়িত কেশরাজি যেন সন্ধ্যাকাশের গায়ে বিছিয়ে দেওয়া কোনও অপরূপ মেখলা…ছবিটির কী নাম হবে? লাভ নাকি দ্য রিভার? দ্বিতীয়টিই বেশি ভালো, হঠাৎ চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে টেলিফোনে শর্মাজী বললেন, ‘ম্যাডামজী আভি রুম মে নেহি হ্যে! লৌটনে পে কুছ কহেনা হোগা?’

— বাস একবার মুঝে ফোন করনেকে লিয়ে ক্যহে দিজিয়েগা, ইটস ভেরি আর্জেন্ট!

 

হোম-স্টের বামদিকের ঘরখানি রামানুজের, ছোট্ট ছিমছাম, বাঁশের তৈরি টেবিল আর চেয়ার ছাড়া একখানি মাঝারি আয়তনের খাট রয়েছে, দেয়ালে জাতক কাহিনির পটচিত্র, টেবিলে একখানি বেতের ফুলদানি ভর্তি সতেজ ফুল,প্রতিদিন সকালে একটি মেয়ে এসে বদলে দিয়ে যায়-গৃহখানি ক্ষুদ্র হলেও শ্রী মণ্ডিত, ঊষালগ্নে কুয়াশাবৃত জগতে কর্মমুখরতার ধ্বনি বেজে ওঠার পূর্বেই বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তে উপাসনা কক্ষ থেকে তিব্বতি ধূপ আর মৃদু ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে-পূজা সমাপান্তে বৃদ্ধ আনন্দ জপযন্ত্র নিয়ে পূজার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দীর্ঘক্ষণ অস্ফুট কুসুম আলোক সজ্জায় মগ্ন আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন, মুখে বাতাসি নাওয়ের মতো প্রশান্তি, দূর থেকে কাষায় পরিহিত অকৃতদার মানুষটিকে দেখে তখন মনে হয় তিনি যেন নিজগৃহের সন্ধান পেয়েছেন।

 

উঠান পার হয়ে বারান্দার মুখে রামানুজকে দেখে মৃদু হাসলেন আনন্দ, ‘ইজ এভরিথিং অলরাইট ইয়ং ম্যান?’

আনন্দের পরনে একখানি ঢোলা সোয়েটার আর টেরিকটের পাৎলুন, শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখটি বলিরেখায় জীর্ণ, মুণ্ডিত মস্তক, পাকদণ্ডী পথের পাশে বাতাসে ভাসতে থাকা রঙিন প্রার্থনা-পতাকার মতো উজ্জ্বল চোখ সদাহাস্যময়-প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় শৈলরাজিদ্বারা আবৃত উপত্যকায় আশ্রয়সম প্রবীণ চোখদুটির পানে চেয়ে রামানুজ বলল, ‘একদম! এখানে খারাপ থাকার কোনও উপায়ই আপনি রাখেননি!’

সামনে একটি বেতের চেয়ার আঙুলের ইশারায় রামানুজকে দেখিয়ে বললেন, ‘রাতমে আপকো লিয়ে আজ মাশরুম পাকায়েঙ্গে। আপকা কোই ফুড-অ্যালার্জি নেহি হ্যে না?’

— আহ! মাশরুম আমার খুবই প্রিয় কিন্তু আপনি আবার কষ্ট করে রান্নাঘরে যাবেন কেন?

অনুযোগের কোনও উত্তর না দিয়ে হাসলেন বৃদ্ধ। রামানুজ ক্ষণিকের জন্য ভাবল, অতিথি সেবা কি বৌদ্ধদের রীতি? এখানে অতিথিদের জন্য আমিষ রান্না করা হয় কিন্তু গৃহস্বামী নিরামিশাষী, সম্ভবত তিনি একাহারী-অন্য কোনও অতিথি না থাকায় এবার রামানুজ প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিল সে কয়েকদিন নিরামিষ খাবারই খাবে। খারাপ লাগছে না, রাই শাক, অড়হর ডাল, চাপাটি, স্কোয়াশের তরকারি, বাগান ক্ষেতের টাটকা মুলো-গাজর-টম্যাটো-ভেন্ডির পাঁচমিশালি সবজি, কী একটা পাহাড়ি ফলের টক চাটনি-অনেকদিন পর টানা নিরামিষ আহারে শরীর বরং ঝরঝরে লাগছে বেশ।আনন্দ মোক্তানের কতগুলি পাহাড়ি ছাগল রয়েছে, রাত্রে চাপাটির সঙ্গে তাদের ঘন দুধও উপাদেয়। এলোমেলো চিন্তার মাঝেই গোম্ফা থেকে নিঃসঙ্গ একাকী পুরুষের মতো ডাংচেনের শব্দ ভেসে এল, সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে মঠে, পাঁচজন তরুণ আর দুইজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী রয়েছেন এখানে, মঠাধ্যক্ষ ঝাম-পা অতি বৃদ্ধ-যৌবনে একসময় তিব্বতে লাসার পূর্বে ঝোডেন মঠে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন, চতুর্দশ দলাই লামার প্রিয়পাত্র ঝা-পা সর্বার্থেই একজন উচ্চকোটির সন্ন্যাসী।

 

অপূর্ব সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত একখানি তিব্বতি মিনার-লণ্ঠন টেবিলের উপর নিঃশব্দে রেখে গেল পরিচারিকা রামী, থিরথির বৃষ্টি শুরু হয়েছে, মেঘ ও কুয়াশাবৃত চরাচরে লণ্ঠনের নির্জন আলো মসী উপত্যকায় করুণ কোনও নৌকোর মতোই দুলছে-ডাংচেনের ধ্বনি শুনে চেয়ারের পাশে রাখা ছড়িটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দ মোক্তান মৃদু স্বরে বললেন, ‘প্রেয়ার কা টাইম হো গ্যয়া। আপভি থোড়া রেস্ট কিজিয়ে, ডিনার টেবলমে ফির মুলাকাত হোগা।’

— শিওর।

দুই-এক মুহূর্ত পর আনন্দ পুনরায় বললেন, ‘কাল শুভে বড়ে লামাসে আপকা পরিচয় করা দুঙ্গা। হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড হিজ এনরমাস স্পিরিচুয়াল পাওয়ার।’

রামানুজ উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ওঁর সঙ্গে আলাপ হলে সত্যিই আমার খুব ভালো লাগবে।’

 

নিজের ঘরে খাটে কম্বল চাপিয়ে নিজের চিত্রনাট্যের খাতাটি বের করেছে রামানুজ, এখনও হাতে লেখাই তার পছন্দ, সামনে টেবিলের উপর দুইখানি মোমবাতি গোপন ভালোবাসার মতো আলোয় ক্ষুদ্র কক্ষটি ভরে তুলেছে, দরজা জানলা সব বন্ধ, ঝিমঝিম বৃষ্টি আর পেছনের ধুপি বন থেকে ভেসে আসা বাতাসে কাঠের বন্ধ জানলায় রহস্য আখ্যানের প্রথম অধ্যায়সম শব্দ শোনা যাচ্ছে, ঘণ্টাপোকার একটানা ডাক শুরু হয়েছে-কলম হাতে নিয়ে দামী চামড়া বাঁধাই খাতার প্রথম পৃষ্ঠাটি আরও একবার মনোযোগ সহকারে পড়ছে রামানুজ, গতকাল এই অংশটি লিখেছে…

 

প্রথম দৃশ্যঃ

আলুলায়িত গহিন কেশরাজির মতো চৈত্র নিশীথের তৃতীয় প্রহর, পথঘাট প্রায় জনমানশূন্য, গঙ্গাতীরস্থ ক্ষুদ্র নিদ্রাতুরা পল্লীর মাঝে শুধু বংশী দাসের কুটিরে একখানি ক্ষীণ আলোর রেখা জেগে রয়েছে।  সুরধুনীর চঞ্চলা বাতাসও আজ কোনও অজ্ঞাত কারণে স্তিমিত, খরতপ্ত দিনান্তে দিকবসনা রাত্রিদেবী জগত উঠানের প্রান্তে বিশ্রামরতা, নিথর বৃক্ষরাজি, নদী তীরে এমন অসম্ভব উষ্ণ রাত্রি সচরাচর দেখা যায় না তবে পশ্চিমাকাশ সম্ভবত গর্ভবতী, একখণ্ড কৃষ্ণমেঘ গর্ভে ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠছে, একবার কাজল আঁখির মাঝে কুহকিনীর নয়নতারার মতো ক্ষণপ্রভা দেখা দিয়েই মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল।

 

বংশী দাসের ক্ষুদ্র গৃহে উঠান সংলগ্ন একটি মাত্র কক্ষ, প্রদীপের পীতবসনা আলোয় পুরাতন আখরের মতো ছায়াচ্ছন্ন চারপাশ, মাটির উপর একটি শুভ্র বস্ত্রখণ্ড বিছানো-একজন দীর্ঘকায় পুরুষ তার উপর পদ্মাসনে বসে মগ্নচিত্তে কী যেন লিখে চলেছেন, চাঁচর চিকুর কাঁধের উপর এলায়ে পড়েছে, তপ্তকাঞ্চবর্ণ কপালে চন্দনের রসকলি, কণ্ঠে তুলসী মালার অলঙ্কার, পরনে একখানি শ্বেত পারাবতের মতো ধুতি, দোয়াতে চালপোড়া কালির মধ্যে খাগের কলম স্পর্শ করে একটি তালপাতায় তিনি লিখলেন, বদন-চান্দ কোন্ কুন্দারে কুন্দিলে।

বাইরে দাওয়ায় বসে অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছে বংশীচরণ-পরনে একখানি ধুতি,অনাবৃত দেহ, কয়েক মুহূর্ত পর বিনীত স্বরে বলল,  ‘প্রভু, রাতি হইল, আহার সারি নিঞা বসিলা।’

 

মানুষটি বাহ্যজ্ঞান রহিত-কোন্‌ সুদূর যমুনাতীরে প্রেমনিশিপদ্মে যেন বিভোর হয়ে রয়েছেন, চন্দন-কুমকুম সুবাসে বিরাজ শ্রীমুখখানি হয়তো এই মুহূর্তে তাঁর মনোপটচিত্রে ভেসে উঠেছে, শুধুমাত্র রচনার বিরতিকালে পলাশ কুসুমের মতো দুটি আঁখি বাতায়ন পানে ক্ষণিকের জন্য চেয়ে থাকছে, যদিও সেই উন্মন দৃষ্টি জগতের কোনও কিছুই দেখছে বলে মনে হয় না।

সহসা প্রবল বাতাসি স্রোতে সচকিত হয়ে উঠল দীপশিখা, যমুনাতীরে জলকেলিরতা যুবতির কেশপাশের মতো মেঘাচ্ছন্ন চরাচর অথচ সুদর্শন পুরুষটি জগত সম্পর্কে প্রায় অচেতন, কোনও গভীর কল্পলোক আবৃত করে রেখেছে তাঁকে?

হয়তো ভাবছেন, তাঁর সঙ্গে আর সাক্ষাত হবে না। নবদ্বীপের ঘাট, শূন্য গৃহের উঠান,সেই  ধুলিমাখা পথ-সবই রয়েছে অথচ তিনি ফিরে গেছেন।

 

উত্তর না পেয়ে বংশী পুনরায় ধীর স্বরে সম্বোধন করল, প্রভু!

এইবার যেন সংবিত ফেরে মানুষটির, মুখ ফিরিয়ে কদমকুসুম হাস্যে সুললিত স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘আহার করিয়া লও বংশী! আমাকে লইয়া উতলা হইও না!’

 

কয়েকটি মুহূর্ত কালপ্রবাহে বিসর্জিত হল, সদ্য লিখিত তালপাতার উপর দৃষ্টি ও মন স্থির করে সুপুরুষ মানুষটি অতি ধীর মধুক্ষরা কণ্ঠে নিজেকে অথবা তাঁর আরাধ্যা প্রেমাস্পদকে শোনানোর জন্যই যেন বলললেন, ‘বদন-চান্দ কোন্   কুন্দারে কুন্দিলে গো, কে না কুন্দিলে দুই আঁখি। দেখিতে দেখিতে মোর পরাণ যেমন করে, সেই সে পরাণ তার সাখী।’

 

দ্বিতীয় দৃশ্যঃ

বেলা আন্দাজ আট দণ্ড, পথ ঘাট এর মধ্যেই তপ্ত কড়াইয়ের মতো হয়ে উঠেছে। গতরাত্রির ঝড়ের চিহ্ন স্বরূপ একখানি সুপ্রাচীন বটগাছের একাংশ রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে- কয়েকজন স্থানীয় পল্লীবাসী কুঠার দিয়ে ডালপালা কাটছে, অনেক কয়েকদিন ক্ষুধার উনানের জ্বালানি জোগান দেবে ওই বৃক্ষ শাখা। বেঁচে থাকতে আশ্রয় দিয়েছে কত পাখপাখালিকে, কত ক্লান্ত পথিককে এমন খর চৈত্র দিনে ছায়া দান করেছে, মৃত্যুর পরও অগ্নি স্পর্শে ক্ষুধার অন্ন প্রস্তুতের সহায় হবে অথবা রাতের অন্ধকারে ভয় দূর করবে-স্নানের জন্য একাকী ঘাটে যাওয়ার পথে এসব কথাই ভাবছিলেন সুদর্শন মানুষটি।

আহা, তিনিও যদি হয়ে উঠতে পারতেন ওই বৃক্ষের মতো আশ্রয়দাতা ?

হবেন কী প্রকারে, তাঁর সঙ্গে তো দেখা হল না!

তিনিই ছিলেন সংশয়নাশক, সেই শ্রীক্ষেত্রে পিতা আর মাতা দর্শন পেয়েছিলেন তাঁর, তখন তিনি গম্ভীরায়। আহা! সহস্র জন্মের সৌভাগ্য না হলে কি আর তাঁর দর্শন হয় ?

উজ্জ্বল আকাশের পানে চেয়ে বিরহে ম্লান মানুষটি মৃদুস্বরে আপনমনেই বলে উঠলেন, ‘নীলনলিনাভমপি তন্বি তব লোচনং, ধারয়তি কোকনদরূপং, কুসুমশরবাণভাবেন যদি রঞ্জয়সি, কৃষ্ণমিদমেতদনুরূপং।’

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *