পুনর্ভবাপুত্র। দশম পর্ব। রূপের ছায়া। লিখছেন আহমেদ খান হীরক
এখন যারা পকেটে মোবাইল নিয়ে ঘোরে, ফুটুর–ফাটুর সেলফি তোলে, নদী দেখলে নদী, আকাশ দেখলে আকাশ, পাখি দেখলে পাখির ছবি তোলে, গ্রাম থেকে ইন্সটাগ্রাম পর্যন্ত যাদের ক্যামেরার প্রস্থ, তারা কোনোদিনই বুঝবেন না আমাদের শৈশবের ছবি তুলতে চাওয়ার এবং যাওয়ার মহিমা। সে এক অন্য রকম অনুভূতির বিষয়! আশঙ্কা আর আশা মিলিয়ে সবকিছু গুলিয়ে দেয়ার একদিন।
যেদিন ছবি তুলতে যাওয়া হবে সেদিন কিন্তু নদীতে দাপাদাপি কম—চোখ যেন লাল হয়ে না যায়! তারপর বেশ গুছিয়ে সাবান–টাবান মাখা। পা ছবিতে আসবে না বলে পা–কে কম গুরুত্ব দেয়া সাবান মাখানোই। চুলে খুব করে ফেনা ঘষা। সাবানেরই ফেনা—শ্যাম্পু টিভির বিজ্ঞাপন। সুন্দরী মেয়েরা চুল উড়িয়ে নাচানাচি করে আর জেলাসদরের দোকানে সেগুলোর বোতল দেখা যায়। কেউ কেনে না হেতু বিবর্ণ প্রায়। ওসব তখনও একেবারেই নাগালের বাইরের জিনিস।
বিকেলে চুল পাট করে আঁচড়িয়ে, সবচেয়ে নতুন শার্টটা পরে, গলায় ভালো করে পাওডার ঘষে ছবি তুলতে যাওয়া হতো। এটাই নিয়ম ছিল। পাসপোর্ট সাইজ সাদাকালো। ইস্কুলে লাগবে দুই কপি। দুই কপি এক্সট্রা—আর একটা নেগেটিভ। নেগেটিভটা খুব যত্ন করে রাখতে হতো। এ্যালবামে অন্য ছবির ভিতরে নেগেটিভগুলো সাধারণত চিপকাচিপকি হয়ে থাকতো। এখনো আমাদের সবার এলবাম ঘাঁটলে রঙজ্বলা পুরনো নেগেটিভ পাওয়া যায়।
ছবি তুলতে শৈশবের মথুরা ছিলো—স্টুডিও রূপছায়া।
ঝা চকচকে স্টুডিও। কাচের দরজা। ভিতরে একপাশে রিশেপশন, অন্যপাশে সোফা। সোফার পেছনে এ্যাকুইরিয়াম। এ্যাকুইরিয়ামে রঙিন মাছ। অবশ্য এ্যাকুইরিয়ামের আমদানি আরো পড়ে। কিন্তু অবস্থা এরকম ছিলো। ফলে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকতে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসতো। এতো জেল্লা সহ্য করার মতো অবস্থা তখন ছিলো না আমাদের। আমরা বারবার ঢোক গিলতাম। বিবিধ সংকোচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকতাম বাইরে। যাবো কি যাবো না এই টানাপোড়েনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত রূপের জয় হতো; আমরা কাচের দরজায় চাপ দিতাম কাঁপা কাঁপা হাতে।
রূপছায়ার কর্ণধার টুলু ভাই।
টুটুল ভাই যেন নিজেই ছবির বিজ্ঞাপন। নায়কসুলভ চুল, ক্লিনশেভ, জিনস–ফুলহাতা চটকদার শার্ট… তাকে দেখলেই ঢাকাই ফিল্ম থেকে মন একলাফে বোম্বে চলে যেতো। ও হ্যাঁ, মুম্বাই তখন বোম্বে ছিল। ওখানে তখন সেরা নায়ক গোবিন্দ। সপ্তাহে সপ্তাহে তার সিনেমা আসে। কখনো রবিনা কখনো কারিশমার সাথে নাচানাচি করে। বিয়েতে সে–সব বাজে। আইসক্রিমওয়ালারাও সেই সব টেপ বাজায়—আমরা ইশক হে দিওয়ানা শুনতে শুনতে কাঠিবরফ কিনি। চুষি। খাই। গোবিন্দ আমাদের মাথার ভেতর খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত ক্লান্ত করে…
টুলু ভাই তেমন গোবিন্দ হয়েই বসে থাকতেন স্টুডিও রূপছায়ায়। হাসি হাসি মুখ। কখনো চা খাচ্ছেন তো কখনো তুলি দিয়ে ছবিতে আঁচড় দিচ্ছেন। আমাদের দেখলেই চোখ তুলে বলতেন, এসো…! বসো…! একটু অপেক্ষা করো!
মানে তার চামড়ার মতোই টকটকে বাংলা। আমরা তার বসো শুনলে না বসে পারতাম না। গদিওয়ালা সোফা। বসলে ডুবে যেতাম প্রায়। চারপাশে নানা ছবি টাঙানো। আমরা সেগুলোতে নজর বোলাতে বোলাতে ভেতরে ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে কখনো কখনো ঢুলতেও শুরু করতাম।
আজকে অবশ্য টুলু ভাই সামনে নেই। সহকারী যে ছিলেন, জানালেন, টুলু ভাই ভিতরে আছেন!
ভিতরে আছেন মানে ছবি তুলছেন। ফলে আমাদের কাজ হলো রিসেপশনের কাচের টেবিলে অন্যদের তুলে রাখা ছবি দেখা। বুঝতাম সৌভাগ্যবানদের ছবি এখানে স্থান পায়। আমাদের খুব ঈর্ষা হতো ওইসব ছবিওয়ালাদের।
তারপর, যেন অনন্ত সময় পেরিয়ে গেলে, আমাদের ডাক আসে একসময়।
ভেতরে।
মানে যেখানে ছবি তুলতে হবে, সেখানে!
চারদিক থেকে চারটা তীব্র লাইট এসে পড়েছে বেঞ্চের যে–জায়গায়, সেখানে গিয়ে বসি আগের অভিজ্ঞতা থেকে। টুলু ভাইয়ের ক্যামেরা স্ট্যানগানের মতো উদ্যত আমার দিকে। একবার শুধু বলতাম, মানে কোনো রকমে বলতে পারতাম, পা..পাসপোর্ট…
ঘাম হয় খুব। যেন ভিজে এসেছি পুনর্ভবা থেকে।
টুলু ভাই টিস্যু দেখিয়ে দেন। আমি ঘাম মুছি। কিন্তু টিস্যুতে এত ঘাম মোছা যায় না। আমি কি আরেকটা টিস্যু নেবো? অস্বস্তি হয়। টুলু ভাই বলে ওঠেন, ভালো করে ঘাম মোছো ভাই। নাহলে ছবি ভালো আসবে না!
ছবি ভালো আসার জন্য ঘাম মোছা তো দূরের কথা, আমরা জানও দিতে পারি। অতএব এক সাথে দুটো টিস্যু উঠিয়ে নিই। মুছি। তাকায় টুলু ভাইয়ের দিকে। উনি মাথা নাড়ান ঈশ্বরের মতো। যেন সম্মতি দেন আমি আমার জীবনে সফল হতে পেরেছি কিনা। এসে আবার হটসিটে বসি। আলো আছে, ক্যামেরা আছে; ভরসা একটাই টুলু ভাই আছেন। তবু, বুকের ভেতরটায় যেন কেউ প্রচণ্ডভাবে হাতুরি পেটায়। মনে হচ্ছে হার্টফেল হয়ে যাবে। শরীর শক্ত হয়ে আসে। অবস্থা হয় রবোকপের মতো। যান্ত্রিকভাবে এদিক–ওদিক তাকিয়ে মনে মনে বলি, কোথাও কি অপরাধ ঘটতে চলেছে?
কিন্তু রোবট হয়ে থাকা চলবে না।
টুলু ভাই এগিয়ে এসে ঘাড়টা ঠিক করে দেন। তবে ক্যামেরার কাছে উনি ফিরে যেতে না যেতেই আমার ঘাড় আবার স্থানচ্যূত হয়ে যায়। আবার সেই কোথাও কি কোনো অপরাধ ঘটতে চলেছে! মনে মনে নিজেকে খুব করে গালি দিয়ে উঠি। করছো কি ব্যাটা? ইজ্জত কি রাখবে না!
ইজ্জত থাকে না। শরীরের মাংসপেশীগুলো কোনোভাবেই আর ঢিলে হয় না।
টুলু ভাই আবার এরই মধ্যে বলেন, একটু হাসো তো…
এটাকেই বলে বিষফোঁড়ার ওপর ক্যানসার!
হাসতে গিয়ে মনে হলো জীবন দিয়ে দিচ্ছি। ঠোঁট নড়ছে না। এতটুকু ফাঁক হচ্ছে না। বিশ মণ লবণের বস্তা ঠোঁটের ওপর নিয়ে মানুষ হাসবেই বা কীভাবে? তবু চেষ্টা করে যাই। কিন্তু কোনোমতেই হাসিটা নিয়মমতো খেলাতে পারি না ঠোঁটে। ঠোঁটটা অদ্ভুতভাবে ফুলে ওঠে বরং।
টুলু ভাই এগিয়ে আসেন। ঘাড়টা ধরে আবার সোজা করে দেন। বলেন, একটু সহজ হও।
শুলে চড়া মানুষ সহজ হয় কীভাবে?
ফলে অ–সহজ মানুষ হয়েই ট্যারা চোখে তাকিয়ে থাকি ক্যামেরার দিকে।
‘রেডি…একটু হাসি‘ বলেই টুলু ভাই শাটার টেপেন। চোখ ঝলসে যায় ফ্ল্যাশের আলোয়। পরপর কয়েকবার। তারপর… অবশেষে… ছবি তোলার যুদ্ধ শেষ!
কিন্তু যুদ্ধ এমন এক ব্যাপার যা শেষ হয়েও কখনো শেষ হয় না।
ছবি তোলার যুদ্ধ শেষ হতেই শুরু হতো অন্যরকম একটা যুদ্ধ।
যুদ্ধটা অপেক্ষার। চারদিন পরে ছবি পাবো। কিন্তু ছবিটা কেমন হবে? গতবার যেমন বান্দর বান্দর লাগছিলো নিজেকে তেমনই কি লাগবে? বিবিধ ভাবনায় চারটা দিন ঠিক করে ঘুমাতে পারি না। তৃতীয় দিন থেকে পেট পর্যন্ত নেমে যায়!
চতুর্থ দিন আবার বুক ঢিবঢিব।
আবার সে কাচঘেরা দরজা। আবার টুলু ভাই। শীতল হাওয়া। ইশক হে দিওয়ানা…!
রশিদ দেখিয়ে ছবি নিই। প্রথমে একবার দেখে নেয়ার পর আবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। বোঝার চেষ্টা করি ছবিটা নিজেরই কিনা! কান দুটো আরো লম্বা দেখাচ্ছে কিনা! সদ্য গজানো লোম লোম গোঁফগুলো খুব বাজে লাগছে কিনা!
তখন টুলু ভাইয়ের আবার সেই সাহসযোগানো কণ্ঠ—ছবি সুন্দর হয়েছে। তবে আরেকটু হাসতে পারলে আরো সুন্দর হতো!
আরেকটু হাসি যে কবে হাসতে পারব তা কেইবা জানে!
(ক্রমশ)