কাগজের নৌকো। পর্ব ১৩। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

বাংরিপোসি পার হয়ে বাস চলেছে যোশিপুরের দিকে, পড়ন্ত বেলায় দুপাশে গাছ-গাছালি সাজানো পথ এখন ছায়াচ্ছন্ন, দূরে অস্পষ্ট শৈলশ্রেণী, চৈত্রের অস্তগামী রৌদ্রে চরাচর যেন রূপবতী কনকচাঁপার পাপড়ি-রক্তাল্পতায় ভোগা গর্ভবতী তরুণীর মতো বিবর্ণা দ্বিপ্রহরের রূপ আর নাই, মাঝে মাঝে বিড়ি ডালের ক্ষেত, মহুয়া গাছ, দু-একটি ক্ষীণতনু দীঘি চোখে পড়ে, খোড়ো চালের মাটির ঘর, নিঝুম ক্ষুদ্র জনপথ পার হয়ে কখনও বাস উঠছে ঘাটির পথে কখনও আবার ঢাল বেয়ে নেমে আসছে সমতলভূমির কাছে, বাসে অসম্ভব ভিড়, বেগুন ঠাসা দশা সবার, লোকালয়ে বাস থামলেই অল্পবয়সী খালাসি দরজা খুলে তারস্বরে চিৎকার করছে, ‘যশিপুরঅ, যশিপুরঅ, এক্সপেসো বাস অছি!’

 

ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে কাউকে কিছু না জানিয়েই আজ সকালে হাওড়া থেকে বালাসোরের রেলগাড়ির কামরায় উঠে বসেছিল অবিনাশ, পকেটে সম্বল বলতে মাত্র পাঁচশোটি টাকা-নব্বই সালের প্রথমদিকে তা নেহাত কম না হলেও খুব বেশিও নয়, ওই নিয়েই সিমলিপাল অরণ্য ভ্রমণের ইচ্ছে মনে উঠেছিল, দু-চারখানি বইপত্র পড়ে বুঝেছিল বারিপদা থেকেই বনবাংলোর বুকিং পাওয়া যাবে, যদিও অবিনাশের জানা ছিল না সিমলিপাল প্রবেশের জন্য একটি গাড়ি আবশ্যক-চার চাকার যান বিনা কাউকেও অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না! ভুল বুঝতে পারল বারিপদায় পৌঁছে, বালাসোর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ, বাস গুমটির কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারল বুকিং-এর জন্য বনদপ্তরের আপিসে যেতে হবে, আপিস সামনেই, হাঁটা পথে মিনিট দশেক, দুপুর হয়ে এসেছে, ভরা চৈত্রে লু বইছে তখন উড়িষ্যায়, সরকারি আপিসে সিমলিপালের কথা বলতেই আপিসার গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপকা বুকিং হ্যে?’

অবিনাশ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘নেহি, আপকা পাস বুকিং কে লিয়ে আয়া হ্যুঁ!’

একটি আদ্যিকালের মোটা খাতায় কী সব লিখতে লিখতে ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দিলেন, ‘প্যহলে ইঁহা হোতি থি বুকিং, লেকিন অব বুকিংকে লিয়ে আপকো যশিপুর যানা হোগা!’

–যোশিপুর?

মুখ তুলে অবিনাশের মুখের দিকে একপলক চেয়ে আপিসার বললেন, ‘হাঁ, যশিপুর!’

বেলা প্রায় বারোটা, কী করবে বুঝতে না-পেরে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে জানলার বাইরে চেয়ে রইল অবিনাশ- ঝিমঝিম দ্বিপ্রহরে বনদপ্তরের পাশে একটি আমলকি গাছের পাতাগুলি জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁপছে, দূরে প্রায় জনশূন্য পথঘাট, দোকান বাজার যেন ঈষৎ কম্পিত ছায়াচিত্র, চারপাশ রাগী দৈত্যের রক্তচক্ষু, পথের ধকলে পরনের জামাকাপড় আলুথালু, মুখখানি শুকনো বালুচর, মাথার চুলও এলোঝেলো-কিশোরের মতো মুখখানি দেখে সম্ভবত মায়া হল আপিসারের, সামান্য নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক্যয়া আপ স্টুডেন্ট হ্যে?’

ম্লান হেসে পকেট থেকে নিজের কলেজ আইকার্ড বের করে আপিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে অবিনাশ বলল, ‘হাঁ, থার্ড ইয়ার, ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজ, ক্যালকাটা!’

আইকার্ড ভালো করে দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘ম্যয় বীরভদ্র দাস, ইঁহাকা চেকিং অফিসার। আপ সিমলিপালমে কাঁহা যায়েঙ্গে?’

বীরভদ্রবাবুর কথায় বিস্মিত অবিনাশ বলল, ‘সিমলিপাল হি যায়েঙ্গে!’

অবিনাশের কথাস শুনে বীরভদ্র দাসের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল, ‘ও তো ঠিক হ্যে, লেকিন আপ কিস্‌  বাংলোমে যানা চাহাতে হ্যে?’

কিছুদিন আগে কোনও বইয়ে পড়া একটি নাম সহসা অবিনাশের মাথায় ভেসে উঠল, আগুপিছু চিন্তা না করেই বলল, ‘চাহলা!’

–চাহ্বলা? চিতল ভিলা?

মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল অবিনাশ, দু-এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে বীরভদ্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক্যেয়া আপকে পাস গাড়ি হ্যে?’

‘গাড়ি?’, গাড়ির কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল অবিনাশ!

–হাঁ, বিনা গাড়িকে আপ যশিপুর সে জঙ্গল ক্যয়সে যায়েঙ্গে?

কী উত্তর দেবে বুঝতে না-পেরে অবিনাশ ইতস্তত সুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোই বাস রুট নেহি হ্যে?’

বীরভদ্র স্পষ্ট বুঝতে পারলেন কোনও খোঁজখবর না নিয়েই ছেলেটি সুদূর কলকাতা থেকে জঙ্গলে বেড়াতে চলে এসেছে, মুখখানির পানে তাকিয়ে সম্ভবত মায়া হল ভদ্রলোকের, নরম গলায় সামনে একটি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘আপ বেঠিয়্যে!’

সামনের খাতাটি বন্ধ করে বীরভদ্র অবিনাশের মুখের দিকে তাকালেন, ‘শুনিয়ে, চহ্বালা যানে কে লিয়ে প্যহলে যশিপুর সে বুকিং করনা হোগা, ফির আপকো এক গাড়ি ভি চাহিয়ে!’

 

ডাক্তারির ছাত্র হওয়ার সুবাদেই সম্ভবত বীরভদ্র দাস সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন-বাসের জানলা দিয়ে বাইরে একটি ছোট গ্রাম্য আদিবাসী হাটের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ ভাবল, কী বিচিত্র এই দেশ, বীরভদ্র দাসের মতো সহৃদয় মানুষ না থাকলে আজ তার কোনওভাবেই চাহ্বলা যাওয়া হত না! শুধু তাই নয়, যশিপুর দপ্তরে ফোন করে একটি গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বীরভদ্র, এখন একটিই চিন্তা, সাকুল্যে পাঁচশো টাকায় আদৌ গাড়িভাড়া-বাংলোর বুকিং সব হবে কিনা! হয়তো হবে না, সেক্ষেত্রে কী করা যায়? নিজের মনেই হাসল অবিনাশ, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে, প্রতিবারের মতো এবারেও চিন্তামণিই চিনির জোগান দেবেন!

 

যোশিপুরে বাস পৌঁছাল বেলা পাঁচটা নাগাদ, ঝিলিমিলি অপরাহ্নে ক্ষুদ্র জনপদটি যেন কারোর প্রতীক্ষায় বসে রয়েছে, দূরে ঢেউ দোলানো পাহাড় দিনান্তের আলোয় একখানি বিছেহারের মতো ক্ষীণকটি নগরীর অঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, হাতে গোনা কতগুলি দোকান বাজার পার হয়ে নির্জন রাস্তা বয়ে গেছে অরণ্যের দিকে, দগ্ধ চৈত্র দিনের শেষে গাছপালা জগত-উঠানে দু-দণ্ড জিরিয়ে নিতে বসেছে, মন্দ মন্দ মধুবাতাসে প্রথম দর্শনেই যোশিপুর ভারি পছন্দ হল অবিনাশের, ছোট ব্যাগটি হাতে নিয়ে বনদপ্তরের কার্যালয়ের দিকে হাঁটার সময় চোখে পড়ল দু-একটি সাইনবোর্ড-বড়ো বড়ো হরফে সিমলিপাল অভয়ারণ্য সম্পর্কে কিছু তথ্য লেখা রয়েছে; একটি ছোট সাঁকো পার হতেই পথটিকে আলতো সোহাগে ঘিরে ধরল গাছপালার সারি, দূরে শৈলশ্রেণী এখন সুস্পষ্ট, এদিকে লোকালয় আর নাই, চৈত্র অপরাহ্নে বাতাসে বন্য কষায় সুবাস ভেসে আসছে- খর দিনান্তে যেন বনদেবী নিভৃত অরণ্যমাঝে টলোমলো দীঘির জলে স্নান শেষে অজানা কুসুমে সাজানো বসনপ্রান্তটি ভুবনডাঙায় নিঃশব্দে বিছিয়ে দিয়েছেন! আহ! প্রাণভরে শ্বাস নিল অবিনাশ, এমন অরণ্য পথের কথা কত বইয়ে পড়েছে কিন্তু কখনও দেখা হয়নি, রিনিঝিনি আলোয় মনে হল, বহুজন্মের পরিচিত কোনও রূপমায়া যেন গোপন ইশারায় তাকে ডেকে চলেছে!

 

পথের বামদিকে বনদপ্তরের আপিস বন্ধ হয়ে গেছে, পেছনের কোয়ার্টারে একটি দুটি আলো জ্বলছে শুধু-সন্ধ্যা হয় নাই এখনও তবুও জায়গাটি ভারি নির্জন, বীরভদ্রবাবু বারিপদা থেকে ফোনে এখানকার রেঞ্জার সাহেব কামাল মুস্তাফাকে অবিনাশের কথা বলে রেখেছেন কিন্তু আপিস বন্ধ থাকায় কী করবে বুঝতে না-পেরে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অবিনাশ, সবুজ রঙা বোর্ডে সাদা কালির হরফে উড়িয়া ও ইংরাজি ভাষায় সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লেখা রয়েছে-সাতাশশো পঞ্চাশ বর্গ কিলোমিটারের এই অভয়ারণ্য পূর্বে ময়ূরভঞ্জের রাজাদের মৃগয়াভূমি হিসাবেই পরিচিত ছিল, এখন অবশ্য অভয়ারণ্য-পরপর লেখা রয়েছে জীবজন্তু ও নানাবিধ পাখির নাম, কতগুলি ছবির মধ্যে বরেহিপানি ও জোরান্ডার ঝর্নার ছবিদুটি ভারি সুন্দর, একবার দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়, অবিনাশের মনে হঠাৎ ভেসে উঠল চাহলার কথা-শুনেছে এই বাংলো নাকি কোর এরিয়ায়, অদেখা গহিন অরণ্যে যেন দ্রিমিদ্রিমি মাদল বাজতে শুরু করেছে, সন্ধ্যার অস্পষ্ট ছায়ায় হয়তো কোথাও ফেউ ডেকে উঠল আর সেই অরণ্যের রাজা? এই যাত্রায় তার কি দেখা মিলবে?

 

‘আপকো ক্যেয়া বারিপদা সে বলভদ্র সাহাব নে ভেজা?’, অচেনা কণ্ঠস্বরে পেছন ফিরে তাকিয়ে অবিনাশ দেখল সবুজ জামা আর পাৎলুন পরা একজন বয়স্ক বনকর্মী ডানহাতে পিচ রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মানুষটিকে দেখে সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অবিনাশ, যাক, একটা ব্যবস্থা হবে এবার নিশ্চয়, মুখে হাসি টেনে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাঁ, ক্যেয়া ম্যে কামাল সাহাব সে মিল সাকতা হ্যুঁ?’

–জরুর, আইয়ে, সাহাব আপকা ইন্তেজার কর রহ্যে হ্যে।

আলাপ পরিচয়ের পর অল্পক্ষণ কথা বলে অবিনাশ বুঝতে পারল, কামাল মুস্তাফা মানুষটি ভারি সজ্জন, বয়সও খুব বেশি হলে বছর চল্লিশ হবে, চাপ দাড়ি আর গোঁফে সাজানো মুখে চোখদুটি সর্বদা ঝকমক করে। অবিনাশকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে হাতের কাজ সাঙ্গ করে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপকে লিয়ে চহ্বালাকা চিতল ভিলা ম্যয়নে বুক কিয়্যা হ্যে!দো রাতকা বুকিং হ্যে, আপ আরামসে দো দিন বিঁতায়ে!দিনমে থোড়া বহুত গরমি হোগা, লেকিন সামকে বাদ ওয়েদার ইজ ভেরি সুদিং, ঔর লাক রহেনেসে টাইগার স্পটিং ভি হো সাকতা হ্যে!’

বাঘের কথা শুনে অবিনাশ উত্তেজনার বশে বাঙলাতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘টাইগার স্পটিং হয় ওখানে?’

গলা তুলে কাউকে চা-নাস্তা আনতে বলে হাসলেন কামাল, ‘দেখিয়ে, ইট ডিপেন্ডস অন লাক, টাইগার লাক! আপকা লাক আচ্ছে হো তো জরুর মিলেগা, তিন দিন প্যহলে চহ্বালা বাংলোকা নজদিক স্পটিং হুয়া থা! প্রোবাবলি রকি আভি উঁহা পর হ্যে!’

বিস্মিত কণ্ঠে অবিনাশ শুধোল, ‘রকি কৌন?’

–ইঁহাকা মহশুর শের! গাইডোনে উসকা নাম রকি রাখা!

 

রাত্রে আপিস সংলগ্ন স্টাফ গেস্ট হাউসেই অবিনাশের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন কামাল সাহেব, ঘরখানি ছোট হলেও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, আসবাবপত্রের তেমন বাহুল্য নাই, একখানি চৌকির উপর পাতলা বিছানায় দুটি বালিশ আর মাথার পাশে টেবিলে জলের কুঁজো রাখা, একটি কাঠের চেয়ারও রয়েছে ঘরে-সারাদিনের ধকলের পর নিরিবিলি বিছানাটি দেখেই অবিনাশের দুচোখের পাতায় নিদ্রাদেবীর বীণা আপনমনেই বেজে উঠল! বাইরে কলঘর থেকে ভালো করে স্নান শেষে ঘরে পা দিতেই চারদিকে গহিন সন্ধ্যা নেমে এল, সামনে রাস্তাটি জনমানবশূন্য, আলো নাই কোথাও, শুধু আপিসের গেটের সামনে একটি নিভু নিভু বাল্ব অন্ধকারকে যেন আরও গাঢ় করে তুলেছে, পেছনে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে মাঝে মাঝে মানুষের গলার অস্পষ্ট স্বর ভেসে এলেও অল্পক্ষণ একা বসে থাকার পর মনে হয়, জায়গাটি সত্যিই নির্জন অরণ্য মহালের দুয়ার!

থাকার ব্যবস্থা হলেও কামাল বলে দিয়েছিলেন, রাত্রে খাওয়ার জন্য অল্প দূরে বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে, সন্ধ্যা গড়িয়ে সাতটা বাজতেই একটি পাজামা আর সুতির পাঞ্জাবি পরে টর্চ হাতে অবিনাশ বাস গুমটির চৌমাথার দিকে রওনা হল, আঁধার থইথই পথের দুপাশে গাছ-গাছালি পরস্পরের হাত ধরে যেন অন্ধকারের বূহ্য রচনা করেছে, শুক্লপক্ষ হলেও আজ চাঁদ উঠবে বেশি রাতে, মন্থর পায়ে বাতাস বইছে চরাচরে, মধুমাসের রাত্রি অরণ্যে বড়ো মনোরম-সমস্ত দিনের উষ্ণতা মুছে এখন জগত দীঘির জলের মতো শীতল, অবিনাশের টর্চবাতির আলোর সামনে কতগুলি পোকা আপন খেয়ালে উড়ে বেড়াচ্ছে, আলো জ্বাললে তাদের দেখা যায় আবার বোতাম টিপে নিভিয়ে দিলে চারদিক নিমেষে আঁধার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে, কী একটি রাতচরা পাখি ডেকে উঠল অদূরে- এখানে অরণ্য তেমন গভীর নয় তবুও অবিনাশের মনে হল, এমন রাত্রি শুধুমাত্র নিশাচর শ্বাপদদের জন্য যথাযথ, মানুষের পদশব্দে নির্জনতার পবিত্র সুবাস নষ্ট হয়ে যায়।

 

চৌমাথায় লোকজন তেমন নাই, দু-চারটি চা-পানের দোকান, ভাতের হোটেলে টিমটিম আলো জ্বলছে, মাথার উপর সহস্র নক্ষত্রে সাজানো আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, কোনও অনাম্নী যুবতি তার হীরের মালাটি ছিন্ন করে আপন খেয়ালে একমুঠি হীরে যেন দিগন্তপ্রসারী চরাচরে ছড়িয়ে দিয়েছে, সামনে একটি ভাতের হোটেলে ঢুকে কাঠের লম্বা টেবিলে বসতেই মাঝবয়সী দোকানি উঠে এসে নমস্কার জানিয়ে ভারি নম্র সুরে বলল, ‘কঅন খাইবে কহন্তু!’

এসব দিকের মানুষ বাঙলা বলতে না পারলেও যথেষ্ট ভালো বোঝে, অবিনাশ স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী আছে?’

–আইজ্ঞা, ভাত, ডাল, সারু-আলু তরকারি, আন্ডা ভজা আউ বিরিবড়া!

–তাই দিন!

অল্পক্ষণ পরে দোকানি যত্ন করে শালপাতায় গরম ভাত, পাশে স্টিলের বাটিতে কলাইয়ের ডাল, আলু-কচুর তরকারি, ডিমভাজা, বিরিবড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা, একফালি পাতি লেবু সাজিয়ে অবিনাশের সামনে রেখে ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুমনে আয়া?’

সারাদিন প্রায় অভুক্ত থাকার পর গরম ভাতের গন্ধে অবিনাশের খিদে চনমন করে উঠেছে, ডাল আর লেবু ভাতে মেখে সামান্য হেসে বলল, ‘হাঁ, জঙ্গল দেখকে কে লিয়ে আয়া হ্যুঁ!’

–কঁহা যায়েঙ্গে?

বিরিবড়া ভেঙে ভাতের সঙ্গে মুখে দিয়ে কোনওক্রমে অবিনাশ জবাব দিল, ‘চাহালা!’

চাহালার কথা শুনে বিস্মিত কণ্ঠে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপকা বুকিং মিল গ্যয়া?’

ভারি সুন্দর খাবারের স্বাদ, মোটা চালের ভাতে কলাইয়ের ডালের সুবাস নির্জন বনকুসুমের মতো ফুটে উঠেছে, খিদের মুখে লোকটির কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে আরেক গরাস ভাত মুখে তুলে অবিনাশ বলল, ‘হাঁ, মিল গ্যয়া!’

দোকানে অন্য খরিদ্দার নাই বললেই হয়, দূরে একটি বেঞ্চে একজন মানুষ শুধু মাথা নিচু করে মন দিয়ে থালায় ভাত মাখছে, গোধূলি লগ্নের মতো একখানি ম্রিয়মান আলো টিনের চাল থেকে ঝোলানো, পুরাতন কালের পাখাটি অলস ভঙ্গিমায় ঘুরে চলেছে, দোকানের এককোণে রাখা রেডিও থেকে মৃদু সুরে কী একটা উড়িয়া গান ভেসে আসছে-সুরটি ভারি মিষ্টি, যেন ঝিমঝিম নেশা, অবিনাশের উত্তর শুনে দোকানি আপনমনে অস্ফুটে কী যেন একটা বলল, কথাটি স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে অবিনাশ ভাতের থালা থেকে মুখ জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যয়া আপ কুছ কহে রহে হ্যে?’

দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর লোকটি কোনও গোপন কথা এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিমায় বলল, ‘নেহি! কুছ নেহি!’

–তব?

–তব কুছ নেহি বাবু, বহুত দিন সে চহ্বালাকে বাড়ে মে বহুত কুছ শুনা, ও এরিয়া আচ্ছা নেহি হ্যে!

বিস্মিত কণ্ঠে অবিনাশ শুধোল, ‘অচ্ছা নেহি, কিঁউ?’

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল দোকানি, চারপাশ সাবধানী চোখে একবার দেখে নিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘কোর এরিয়া হ্যে সাহাব, বহ্বা কিতনে লোগো কি মত হুয়ি হ্যে!’

ভাতের দু-একটি দানা আনমনে আঙুলে নড়াচড়া করে অবিনাশ অবাক স্বরে শুধোল, ‘মত হুয়ি হ্যে?’

–হাঁ সাহাব! এক আদমখোর শের থা উঁহা পর, বিশ পচ্চিশ সাল প্যেহলে কা বাত!

–আদমখোর শের?

নিচু হয়ে অবিনাশের কাছে মুখ এনে ফিসফিস স্বরে লোকটি বলল, ‘হাঁ! আদমখোর শেরকা হাত মারে হুয়ে  ইনসানকো মুক্তি নহি মিলতা! ও আব ভি বহ্বি হ্যে!’

(ক্রমশ)

সায়ন্তন ঠাকুর
লেখক | + posts

জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্বলে। সায়ন্তন মূলত মূলত গদ্য লেখেন। প্রকাশিত বইপত্তর-- নয়নপথগামী(উপন্যাস), শাকম্ভরী(উপন্যাস), বাসাংসি জীর্ণানি(গল্প সংকলন)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *