কাগজের নৌকো। পর্ব ১২। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

অবিনাশের ডায়ারিঃ

 

২০.০৫.১৯৯৪

 

কার্তিক মাস পড়তে আর ক’দিন বাকি, ওইসময় কিছুতেই ঘরে মন থাকে না আমার,বেরিয়ে পড়ার সাধ হয়, দূরে কোথাও নয়, এই আশেপাশের গ্রামগঞ্জে, পুজোর পর এমনিও চারপাশ বড় শান্ত হয়ে আসে হঠাৎ, মানুষজনের সংসারে উঠানে শীতকাল এসে পিঁড়ি পেতে বসে। ভিড় ঠাসা বাসে চেপে অচেনা কোনও পাড়াগাঁয়ে হয়তো নেমে পড়লাম, পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ানো, চা-দোকানে বসে একটু গলা ভেজালাম, পাঁচজন হরেক কিসিমের মানুষ, খানিক গল্পগুজব, এইসব আর কী, সামান্য বাসনা!

সেবার এইরকম বেরিয়েছি, একটি ছোট্ট জনপদের সঙ্গে আলাপ হল, নাম বইপুর। বেলা বয়ে গেছে তখন, পীতবসনা আলোয় ভরে উঠেছে কেমন চারধার। তেমাথার মোড়ে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে গেল দূর শহরের দিকে। দোকানপাট তেমন নাই, যাও বা আছে দু-চারখান,তাদের ঝাঁপি বন্ধ। বড় রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে কাঁচা ধুলার পথ নেমে গেছে, আনমনা, ভারী পছন্দ হল! ওই পথেই পা বাড়ালাম।

দুপাশে ধূ ধূ জমি, আষাঢ়ের নতুন জলে চাষারা ধান রুইয়েছিল, এখন লকলক করছে সেই ধানের শিষ। কুচি কুচি পঙ্গপালের মত কী এক পাখির দল পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে আকাশে। অনেকদূরে বট না পাকুড় গাছের মাথায় ঝলমল করছে দিনান্তের আলো। ছোট ছোট ঝোপের গায়ে বেগনে রঙা ফুল ধরেছে, একদিকে ফণীমনসার জঙ্গল, সোনার জলে কে যেন ধুয়ে দিয়েছে ভুবনডাঙা। এই রূপবাসনায় মজে যায় মন। জংলা গন্ধে বুঁদ হয়ে আছে বাতাস। হাঁ করে বালকের মতো চেয়ে থাকি আমি।

পথের ওপর ঝাঁকড়া শিউলি গাছ চোখে পড়ে, কতদিনের পুরোনো কে জানে, সচরাচর দেখা যায় না এমন। বাসি শিউলি ফুলে ছেয়ে আছে গাছতলা, ধুলায় মলিন, সাদা রঙ আর তাদের নাই। আবার রাত ভোর হলে নূতন কুসুম সুবাসে ভরে উঠবে চরাচর। দুদণ্ড শিউলিতলায় বসতে ইচ্ছা করল। ধুলার ওপরেই বসলাম।শুঁয়োপোকার দল যাতায়াত করছে গাছ বেয়ে, ওরা একদিন রঙিন পাখাওয়ালা প্রজাপতি হবে!

মাঠের মাঝে একটা শীর্ণ খাল, জল নাই বললেই চলে, একজন বুড়ো মতো লোক হাত মুখ ধুচ্ছে সেখানে, পরনে সাদা মালকোচা মারা ধুতি, কাঁধে একখান গামছা। গলা তুলে শুধোলাম
—এদিকে কোন গাঁ ?
লোকটি ভেজা গায়ে হাত মুছতে মুছতে পথের ওপর উঠে এল। আমার দিকে খানিক চেয়ে বলল
—ইদিককার মনিস্যি তো লয়! তা যাবা কোনঠি ?
একটু হেসে বললাম
—এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, কোন গাঁ পড়বে সামনে ?
—বঅইপুর!
—তা তোমার কি এখানেই ঘর ?
একটু থেমে ফের বললাম
—বিড়ি খাবা একটা ?
—তা দ্যাও বিড়ি একখান!

বিড়ি নিয়ে আমার পাশে এসে বলল। আরাম করে ধোঁয়া ছেড়ে দূরপানে আঙুল তুলে বলে উঠল
—ঘর, ওই যি হাওর, দ্যাখছো ? ওইঠে ঘর।
—এ তোমার জমি ? কাজ করছিলে ?
—জমিন কোথা পাবক, মুনিস খাটি, ভাগীদার।
—পয়সাকড়ি পাও?
—হাঁ গ! যাদের জমিন তারা ভালো মনিস্যি, দেয় থোয়!

একথা সেকথা হয়, সব গাঁ ঘরের অতিসাধারণ গল্প। বুড়োর নাম কেষ্ট, সামনে পাটির দুটো দাঁত নাই, হাসলে শিশুর মতো দেখায়। আমাকে বলে, ঘর চলো, লালী গাইয়ের গরম দুদ খাওয়াবক! আমি কিছুই বলি না, একটু হাসি শুধু। ওদিকে বেলা পড়ে গেছে, মধু মধু বাতাস বইছে। বুড়োর মুখে শুনি, শিউলি গাছটা নাকি অনেকদিনের পুরোনো, তার যৌবনকালের! অতবছর বাঁচে শিউলি ? কী জানি। তখন বইপুর গাঁয়ের চণ্ডীতলায় কোথা থেকে এক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা পেতেছিল, ক’টা দিন ছিল, সে-ই নাকি লাগিয়েছিল এই গাছ।

দূর আকাশে ভেসে ভেসে কতগুলো বক কোথায় যেন চলেছে, সাদা শরীরে তাদের লেগেছে আশ্চর্য রঙ। আমার মন পড়ে আছে ওই সন্ন্যাসীর দিকে। ক’দিনের অতিথি গাঁয়ের পথের ধারে একটি গাছ লাগিয়ে কোথায় আবার হারিয়ে গেছেন। সেই গাছ এখন কুসুম কুসুমে আলো হয়ে থাকে। একজন পরিচিত সন্ন্যাসী, তিনি আমার প্রিয় সখা, আমাকে বলেছিলেন একবার, মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ এইরকম নির্জন অখ্যাত কোনও গেঁয়ো পথের পাশে শিউলিগাছের তলায় যেন সমাধিস্থ করা হয়। কোনও ফলক না, বেদি না, শুধু ধুলামলিন পথ, তার নিচে মানুষটির অচঞ্চল মন শুয়ে থাকবে, শারদপ্রাতে খসে পড়বে কিছু অস্ফূট কুসুম। কেউ জানবে না, চিনবে না, আমারই মতো কোনও পথিক হয়তো এসে বসবে দুদণ্ড। এই গাছ যিনি লাগিয়েছিলেন তাঁরও কি তেমন কোনও বাসনা ছিল ? কী জানি!

কেমন ছিলেন ওই সন্ন্যাসী ? হয়তো অল্প বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন, বাপ মা সংসার পরিজন সব ছেড়ে রমতা সাধুর জীবন, মাধুকরী করে দিন কাটে, কোনওদিন খাওয়া জোটে কোনওদিন জোটে না। শুনেছি এক সম্প্রদায়ের সাধুদের মুখ ফুটে ভিক্ষা চাওয়ার আস্য নাই, গৃহস্থের দুয়ারে দাঁড়াতে হয়, যদি কিছু দেয় তাহলে গ্রহণ করবেন, নচেৎ অন্য কোনও গৃহ আবার। হয়তো ওঁর গ্রামে কোনও এক কিশোরী ভালবাসতো সেই গৃহত্যাগী বৈরাগ্যবান কিশোরকে! বলতে পারেনি কোনওদিন, কিশোর কি টের পেয়েছিল লাজুক কিশোরীর গোপন অশ্রু ? কিছুই জানি না আমি, মনে মনে ভাবি নিত্য ঈশ্বরপ্রেম নিশ্চয় তাঁর হাত ধরেছিল আজীবন। কবেকার কথা, এখন পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেছে নশ্বর দেহপট।

কেষ্ট ঘরের পানে চলেছে, পথের ওপর বৃদ্ধ শরীরটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। জগত সংসারে কে যেন বিছিয়ে দিচ্ছে কুয়াশার আঁচল। দিগন্তরেখার কাছে তুলোর মতো মিহি ধোঁয়া জমছে, নির্মেঘ আকাশে একটি দুটি করে ফুটে উঠছে নক্ষত্র, বেদনাবিধুর সন্ধে নামছে অনিত্য পৃথিবীর দুয়ারে।

উঠে দাঁড়াই, ফিরতে হবে আমাকে। যদিও কোথাও ফেরার নাই তবুও ফিরে আসার অভিনয়টি বজায় রাখতে হয় ষোলোআনা। শিউলিতলায় থইথই আঁধার, ভোর রাতে নতুন কুসুম আসবে গাছে, সন্ন্যাসীর হাতে লাগানো শিউলিগাছ থেকে অপরূপ সুবাস বয়ে আসবে ক্লিন্ন প্রবঞ্চক সংসারের দিকে।

 

 

২৮.০৯.১৯৯৪

 

অস্ত বিকেলে তুমি হাঁটছ

দুপাশে কত বাড়ি দালানকোঠা আর এই শহর

এখন হাওয়া বাতাস অবিকল তোমার মতো

এখন তোমার চোখের নিচে চন্দনবন

 

তুমি হাঁটছ তোমার মতো

শাড়ির আঁচলের পাশে হাঁটছে ফলসা রঙা ভালোবাসা

 

তুমি তার হাত ধরলে যেভাবে আকন্দফুল ফোটে

 

তুমি হাঁটছ আর ঝলমলে অস্ত অপরাহ্ন

তোমাকে সাজিয়ে দিল কনকচাঁপা আলোয়

তুমি হাঁটছ আর কলিকাতা ফিরে যাচ্ছে

পার্কস্ট্রিট পার হয়ে সুতানুটির দিকে

 

তুমি চোখ তুলে কাকে যেন দেখলে

দুটি ভ্রমর অন্ধ হয়ে গেল সেই অপরূপ দৃষ্টিপরশে

 

সেই অন্ধ ভ্রমর আমাকে আজও

পদাবলীর গল্প শুনিয়ে যায়

এমন বৈকালে বলে, তুমি এখনও

দূর চন্দ্রনিশীথিনী প্রেম!

 

 

০৩.১০.১৯৯৪

 

আজ তোমাকে হাতে লিখে কিছুই দিইনি। কী ই বা দাম এসবের বলো!

 

আমি তোমাকে যে লেখা লিখতে চাই তা কোনওদিনও পারব না। কত যে শেকল আমাদের পায়ে, সে তুমিও জানো।

 

তুমিও তো একবার লিখলে না, যে আমি চিঠি চাই।

 

আমার অভিমান হয়েছিল, পুরোনো মেঘের মতো, বৃষ্টির মতো, বেগুনি রঙা জারুল ফুলের মতো।

 

তুমি ছাড়া যে কখনও আমি আর কিছুই লিখতে পারতাম না, সে তুমি জানো।

 

আরও জেনো, হৃদয়পুরের রাণীর সঙ্গে অভিমান করে থাকা যায় না।

 

আমি কেউ না, আমি কিছুই না।

 

শুভ জন্মদিন!

 

ভালো থেকো, কেমন! ও আমার যুথিকা, ও আমার জারুল ফুল, ভালো থেকো।

 

০৭.১১.১৯৯৪

 

০৮.১১.১৯৯৪

 

আনন্দীর সঙ্গে তাদের তিনজনের ছিল ভালবাসার সম্পর্ক। ছিল চোখে চোখ রেখে দিন কাটানোর গল্প।আনন্দীর কোনও মধ্যবিত্ত লুকোছাপা ছিল না জীবনে। সবার কথা বলত সবাইকে। হয়তো তার বুকের মধ্যে ছিল একটা নদী, যার কাছে অনেকদিন কোনও মানুষ এসে বসেনি। হেঁটে যায়নি কোনও ভবঘুরের দল। বুকের মধ্যেই জেগে উঠতো  গ্রীস, আচম্বিতে। তারপর একসময় সব নদী ঘরে ফেরে। সূর্যাস্তের অপরূপ আলোয় দেখা যায় শান্ত মেঘ আর বাতাসের চলাচল। সে বিয়ে করতে চায় অন্য একজনকে। সিনেমার দর্শক কোনওদিনও দেখতে পাবে না কে সে! কেনই বা মেয়েটি বিয়ে করতে চায় তাকে তাও পারবে না জানতে।

 

শাম্ব: গল্পের প্রধান চরিত্র। তার সঙ্গে কোনও অতীত সম্পর্ক আনন্দীর দেখানো হয় না কোথাও। শুধু বোঝা যায় সংলাপে তার প্রতিই বোধহয় ছিল আনন্দীর সমর্পণ। শাম্বরও কি তাই ? সে বিবাহিত তার সংসারে থাকা বসিয়েছে অভাব। আনন্দী তার জন্য পাঠায় নিজের বিয়ের কার্ড। সেটুকু একদম শেষ দৃশ্যে দেখতে পায় দর্শক। চিকচিক করে ওঠে তাদের চোখ অন্য ভালবাসার নীরব উচ্চারণে।

 

অবনী: আনন্দী তাকে ভালবাসে। এখনও হয়তো। তার সঙ্গে আনন্দী বেঁচে নিতে চায় একটু ছেলেমানুষি জীবন। একটা অল্পবয়সী সময়। সে জানে অবনী কোনওদিন তাকে তার মতো ভালবাসবে। অবনীর কাছে সে একটা ট্রফি। তার মেধা তার রূপ তার নিজের স্বেচ্ছায় খরচ করা জীবন যেন একটা পুরস্কার। যা দেখিয়ে সে সবাইকে বলতে পারবে, দ্যাখো আমার প্রেমিকার নাম আনন্দী!

 

সৌম্য: সৌম্যর মেধা তাকে আকর্ষণ করত। এখনও করে। সৌম্যের চেহারা তার স্মার্ট বডি ল্যাঙ্গোয়েজ কোথাও যেন আনন্দীর মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা আদ্যিকালের সেই বীর রাজপুত্তুরের স্বপ্ন দেখাত। কিন্তু তার বোহেমিয়াম ছন্নছাড়া জীবন একটু ভয়ও দেখাত। সেই যে মেয়েদের মুঠো করে রাখা ধুলোবালির সংসারের সংস্কার। (আনন্দী যেন অনেক সাধারণ এখানে)

 

স্ক্রিপ্টে একটা নন লিনিয়ার মোশন ব্যবহার করা হয়েছে। গুমোট সার্কেল একটা। শেষ দৃশ্যে সেই সার্কেল ভেঙে স্পেস পায় স্ক্রিপ্ট।

আনন্দী জাগতিক সব ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত। তবুও মনের ভিতরে কাজ করে দোলাচল। একটা পুরোনো ভেঙে পড়া শহর যেখানে একদা অশ্বারোহী সেনা ছুটে যেত, রাজকীয় আড়ম্বর ছিল কত সম্পর্ক ছিল জীবন্ত, এখন লোকে দেখতে যায় সে প্রত্নরাজি। এমনই আনন্দীর মনের জগত।

এই দোলাচলে বেঁচে থাকে আনন্দী।

 

৩০.১২.১৯৯৪

 

কত জন্ম পার হয়ে অপরাহ্ন আলোয় কত মলিন পথঘাট ঘেঁটু আকন্দ ফুলের জোসনা রুক্ষ চৈত্র বাতাস সন্ধ্যাতারা আর চঞ্চলা প্রজাপতির ডানায় আঁকা কালস্রোত পার হয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা, তবুও কখনও ফিরে এলাম না আর, আমাদের পুনরায় দেখা হবে বলেও এলাম না ফিরে এই জগতে, তোমার মুখখানি বাসনার মতো কখনও টানেনি আমায়, আমার আলতো আঙুলের স্পর্শও কোনওদিন পথরোধ করেনি তোমার, তাই তো এত কটুবাক্য চারপাশে, জগত শুধু ফিরে আসা এবং দেখা করার আখ্যানই বুঝতে পারে!

 

অথচ আমরা জানি, কখনও ফিরে আসব না বলেই তোমার মুখখানি আজোও অপরূপ আমার কাছে, তুমিও আমার কথা ভুলে যাও নাই এখনও।

 

দ্যাখো, সামনে সহস্র কোটি সূর্য আমাদের পথ আলো করে রেখেছে, শত শত নক্ষত্র জন্ম নিচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরে, বিশ্ব তৈজস প্রজ্ঞা সব অতিক্রম করে তুমি চলেছ, আমিও চলেছি, তখন তুমিও নাই আমিও নাই, তুমি আমি কি পৃথক ?

 

শোনো কতদূরে মায়াজগতের বুকে খর চৈত্র অপরাহ্নে এক অপরিচিত ধুনুরি তার যন্ত্রে সুর তুলেছে, সেখানে ‘তুঁহু তুঁহু’ রবে নিরন্তর বেজে চলেছে আমাদের অলীক প্রেমাখ্যান।

 

৩১.১২.১৯৯৪

 

DIAGNOSIS includes-

Site of Disease (Anatomical)

Nature of Disease (Etiological)

Pathophysiology (Complications)

Functional Disturbance (Dysfunction)

 

৩১.১২.১৯৯৪

 

রেলগাড়ির খোলা জানলার ওপারে চাঁদ থইথই মাঠ, তবে কেমন যেন অস্পষ্ট, মানুষের আলোয় নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখে ভালো ঠাহর হয় না। আকাশ আর পৃথিবীর বিভাজন রেখা মুছে গেছে, দুধের মতো কুয়াশায় কে যেন ধুয়ে দিয়েছে ভুবনবাড়ির সংসারের পটচিত্রখানি।

 

মাঠে ধান নাই, গোছা গোছা পাতকাটি বেঁধে শূন্য প্রান্তরে খাড়া করে রেখেছে চাষারা, সেই গত বর্ষায় ওই পাট বুনেছিল, কিন্তু এখন যে কচি আশ্বিনের ধান থাকার কথা, অঘ্রান উঠবে পাকা ফসল, নাই কেন ? চোখ খারাপ হল তবে?

 

এমন রাত্রে দৃষ্টি চলে না বেশিদূর, বিধবার মিহি থানের মতো জোসনা দিয়ে যেন ঢাকা চর্তুদিক। আকাশে নক্ষত্র ফুটেছে, রেলগাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব দিকে হেলে পড়ছে কালপুরুষের কোমরবন্ধনী। চন্দ্রাহত জগতে কুশি কুশি পরীর সন্তানেরা খেলা করতে নেমে এসেছে, ওই ক্রীড়া চেয়ে দেখলে উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ, ঘরে ফেরার চাবিকাঠি তার হারিয়ে যায়।

 

আলো ফুটলে দেখলাম, শীর্ণ নদীর ধারে, শ্যাওলামাখা মাছ চটের ওপর পেতে বসে আছে জেলেবউ। আঙুলপ্রমাণ কচি শিম বিক্রি হচ্ছে ঢেলে, বাজার বসেছে খুব, কেনাবেচায় সরগরম ভবহাট। পথে দু চারখানি ঝিল পড়ে, পানকৌড়ি ভুসভুস করে মাথা নামাচ্ছে আর তুলছে। আর ক’দিন পরেই বালিহাঁস আর চখাচখি আর বগারির ঝাঁক উড়ে বেড়াবে ওইখানে। চন্দ্রহাটার জমিদার শশীভূষণ সত্তর বছর আশি বছর আগে গাদা বন্দুক তাক করে ওদের মেরে নিয়ে যেত পাকশালে। ভারী স্বাদু মাংস, তবে হেঁসেলে ঢুকতে দিত না বউমণি, মোহিনীমালার কোঠায় আগুনে ঝলসানো হতো। আশনাই ছিল কিনা মোহিনীর সঙ্গে।

 

কোঠাবাড়ি এখন আর নাই, কোন মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে ঠুমরি আর তবলার বোল, সারেঙ্গির ছড় টানতো যে লোকটি, কী যেন নাম, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, যামিনীরঞ্জন, আহা, বড় মিঠে হাত ছিল গো। ঝিলপারের আকাশে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে আজকাল ওই পুরাতন জন্মের ছবিই শুধু মনে ভাসে শশীভূষণের। জল খায় নেমে এসে, আবার পাখা মেলে ভেসে ওঠে বাতাসে। গোল চাঁদের রাতে পরীদের পায়ে পায়ে ঘোরে, একজনকে দেখতে অবিকল মোহিনীর মতো, সে-কথা তাকে বলতে কী খিলখিল হাসি! চৈত্র নিশীথে কনকচাঁপার সুবাস মনে পড়ে যায় ওই হাসি শুনলে।

 

এখন দ্বিপ্রহর, মোহিনীর উট্‌ঠানে চিত হয়ে শুয়ে আছে শশী। সমুখে রাঙা আকাশ, পাশে ঝোপের গায়ে কী একটা হলদে মতো ফুল ফুটেছে। দুয়ারের আগল ভেঙে গেছে, একবুক ঘাস, অশ্বত্থের ছোট সন্তান ছাদের আলসের কিনারে খলবল করছে বাতাসে। এই গৃহখানি পরম মমতা ও বাসনায় তৈরি করেছিল মোহিনীমালার জন্য! হায়! সব বিস্মৃত হয়ে কোন্ সুদূর কালদিগন্তে সে মিলিয়ে গেছে, শশীভূষণই শুধু পড়ে আছে রায়বাড়ির বদ্ধ দীঘির জলের মতো!

 

পশ্চিম থেকে ভেসে আসছে আলো, ভগ্ন প্রাচীরের ওপর অপরাজিতা ঝাড়ে কোথা থেকে একটি বুলবুলি এসে বসেছে, কেউ নাই কোথাও। ঘাসের জঙ্গলে বেজিদের আস্তানা, বাস্তুসর্পের বাসাও আছে, কেউ কাউকে কিছু বলে না, মিলেমিশে থাকে। পিক পিক করে কী একটা পাখি ডাকছে, দুটি কৃষ্ণকায় ভ্রমর জোড় বেঁধে উড়ছে বাতাসে। বুড়া বেলগাছে এক ব্রাহ্মণ শরীর বায়ু হয়ে আছে বহুদিন, তারও কোথাও যাওয়ার নাই।

 

শশীর ফেরার সময় হল এবার, বুকে হেঁটে ঘরে ফিরবে, কখনও বুকে কখনও বা ডানায় ভর করে কত বৎসর কত যুগ কত চন্দ্রমাস পার হয়ে তাকে বারবার ফিরতে হয়, পীরিতের বাসনায়!

(ক্রমশ)

 

সায়ন্তন ঠাকুর
লেখক | + posts

জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্বলে। সায়ন্তন মূলত মূলত গদ্য লেখেন। প্রকাশিত বইপত্তর-- নয়নপথগামী(উপন্যাস), শাকম্ভরী(উপন্যাস), বাসাংসি জীর্ণানি(গল্প সংকলন)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *