অক্সিজেন। পর্ব ১৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

দুয়ারপথে

কুহুর ঘুম ভেঙেছে বেশ খানিকক্ষণ।মুখেচোখে জল দিয়ে রেডি হয়েছে ও।কুহু এখনো ভাবতে পারছে না কিভাবে ও এখানে এলো।আসলে এই ট্রেনিংটায় ও কিছুতেই নিজের চেষ্টায় যোগ দিতে পারত না।এর পেছনে আছে শক্তিদার নিঃস্বার্থ সাহায্য।

ঠাকুমা একটা কথা বলত, “ভগবানের তৈ্রি পৃথিবীতে সবমানুষ কিছুতেই খারাপ হতে পারেনা।কেউ কেউ ভাল আছে বলেই এখনো চন্দ্র সূর্য উঠছে।”কথাটার জলজ্যান্ত প্রমাণ শক্তিদা।মানুষটার একটাই বদ স্বভাব,কাউকেই ফেরাতে পারেন না।

সেদিন ক্লাবঘর ফাঁকা হলে শক্তিদা সরাসরি ওর কাছে কিছু কথা জানতে চান। “তোমার কী সমস্যা বল তো?পাহাড়ে উঠতে চাও তো পুরুলিয়ার ট্রেনিংটায় গেলেনা কেন?”

ও সোজাসুজি বলেছিল, “টাকার জন্য।আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি  কতটা টাকা লাগবে।পরে বুঝতে পেরে পেছিয়ে এলাম।”

“আমার কাছে কি কারণে এলে?”

“রুমাদি পাঠাল।বলল,পারলে আপনিই একমাত্র কোন সুযোগ করে দিতে পারবেন।”

“মহা মুস্কিল তো।রুমা  এইকথা বলল?”

উত্তরে ও হেসেছিল।

উনি কী যেন ভাবলেন।তারপর বললেন, “তুমি খেলাধূলা কর তো?”

জবাবে ও কোনমতে বলতে পেরেছিল ,“দৌড়তে পারি।”

“ঠিক আছে। তোমার ফোন নাম্বারটা এই ডায়েরিতে নোট করে যাও।”বলে ঝুলঝুলি একটা পুরনো ডায়েরি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।ওই ডায়েরির শেষের দিকের একটা পাতায় নিজের নাম্বার টুকে দিতে দিতে ও ভেবেছিল ,যতসব ফালতু ব্যাপার।শুধুশুধু বেশ খানিকটা সময় গেল।

সময়ের অপব্যবহার হয়নি যে তার প্রমাণ ও নিজে। এখানে এসে  এমন একটা দিন যায়না, যেদিন ওর শক্তিদার কথা মনে পড়েনা।শক্তিদার সাহায্য ছাড়া দার্জিলিং এর এই ‘এইচ এম আই’ তে ওর আসার তো কোন  কথা ছিলনা।

‘এইচ এম আই’ কথাটার অর্থ হিমালয়ান মাউন্টেয়ারিং ইন্সটিউট। কোনরকম অসম্ভব স্বপ্নেও ও এখানে আসার কথা ভাবতে পারেনি। ওর পাশেও কেউ ছিলনা তো। সেদিন বিকেলে ও মনখারাপ করে বাড়ি ফিরেছিল।এমনকি রোজকার মত জুহুর সঙ্গেও মনখারাপটা শেয়ার করেনি।তার পরেরদিন ঠিক রাত  সাতটা নাগাদ শক্তিদার ফোন এলো।

কলেজ থেকে এসে টিউশানি নেই বলে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।মা ফোনটা হাতে ধরিয়ে দেয়।গলাটা প্রথমে বুঝতে পারছিল না কুহু ।

“আমি শক্তিদা বলছি,কাল সকাল আটটার মধ্যে সল্ট লেকে যুব কল্যাণ দপ্তরের অফিসে পৌঁছতে পারবে?”

“কাল?”

“হ্যাঁ । দৌড়তে হবে।দৌড়ের জুতো, পোশাক আছে তো?সঙ্গে নিয়ে যাবে।  তোমার জন্য একটা চিঠি আমি তৈরি করে রাখছি।নিয়ে যেও।আমি থাকব না।তুমি দীপক গড়াইএর সঙ্গে দেখা করবে।”

ফোন পেয়ে মাকে সবটা বলেছিল ও।মা বলেছিল, “চলে যা।সুযোগ বারবার আসেনা।”

তখন ওর মনে পড়েছিল, শক্তিদা ফোন নাম্বারের সঙ্গে একটা ফর্ম ফিল আপ করিয়েছিল ওকে।এমনি ফর্ম।তাতে নিজের যাবতীয় তথ্য লিখতে হয়েছিল ওকে।

এই সেন্টারে আসার পর বারবার শক্তিদার কথা মনে পড়ছে ওর। বাড়ির নানা অসুবিধা টপকে ওর এখানে আসা।আর একটা অন্য অসুবিধাও আছে। টিউশানি গুলোর ব্যবস্থা করে আসতে হয়েছে। পুজোর কটা দিন এমনিতেই ছুটি ।কিন্তু তারপরে তো ওর যাওয়ারই কথা। যদিও ও বলে এসেছে, সবগুলো দিনই ও ম্যানেজ করে দেবে।

পিন্টুর মা জানতে চেয়েছিলেন, “খরচ খরচা আছে।আগামী মাসের কিছু টাকা নিয়ে রাখবে নাকি?তুমি ছেলেমানুষ, কোথা থেকে আর যোগাড় করবে?”

“না না সে আমার মা দেবেন।” বলে ও থামিয়ে দিয়েছে ওনাকে। কদিন ঘনঘন পড়িয়ে সবার সিলেবাস ও কিছুটা শেষ করে দিতে পেরেছে।

টিফিন ব্রেকে খেতে খেতে বাড়ির কথা ভাবছিল ও।দুর্গা পুজোর অঞ্জলি না দিয়ে সবার সঙ্গে বসে বসে ডিম পাঁউরুটি খাচ্ছে। আসলে এই সেন্টারে ভোর হতে না হতেই এত ধরণের ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যায়, না খেলে টিঁকে থাকাই মুস্কিল।

ভোর পাঁচটায় বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে হাজিরা দিতে হয় ।তার আগেই ওদের বেডটি আর বিস্কুট দিয়ে দেয়।তারপর রেডি হয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়া। ও তিনপর্যায়ের ট্রেনিং এর জন্যই তৈরি হয়েছে।তবে এখন ও বেসিক এর ট্রেনিংটাই নেবে।বেসিকের পরেই এ্যাডভান্স আর তারপরে এম ও আই ।তিনস্তরের ট্রেনিং, মোট কুড়িহাজার টাকা । মজা এই যে যুব কল্যাণ দপ্তরের মাধ্যমে ট্রেনিং। সবটাই দেবে সরকার। একবছর অন্তর ট্রেনিং।বেসিক্ ট্রেনিং এ জয়েন করলেও অন্য ট্রেনিংগুলো ও নিতে পারবে কিনা জানেনা।

দার্জিলিং এ আপাতত সাতদিন ওদের রাখা হবে।বাড়ি থেকে বাড়ি সাতাশ দিন লাগবে ট্রেনিং নিতে।এই বেসিক ট্রেনিং নিলেই হিমালয়ে অভিযানে যেতে পারা যায়।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট দুশো জন ছেলে্মেয়ে এসেছে।ভোর পাঁচটা থেকে সাতটা অবধি সাধারণ ফিজিকাল এক্সারসাইজ।দার্জিলিং এর ম্যালে নিয়ে যান ট্রেনাররা ।তারপর তাদের নির্দেশ মত ট্রেনিং নিয়ে হস্টেলে ব্রেকফাস্টের জন্য ফিরে আসা। ছেলেরা আছে ছেলেদের হস্টেলে।মেয়েদের আলাদা হস্টেল।হিন্দী আর ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে ট্রেনিং।কাজেই  দুটো ভাষার একটা জানা খুব জরুরি।পড়াশুনার যোগ্যতা সেভাবে কিছু না থাকলেও সবাই মোটামুটি মাধ্যমিক পাস।কেননা নাহলে থিওরিটিক্যাল ট্রেনিং নেবে কিভাবে?

কুহুর আটকাচ্ছে না কিছুতেই।কাজ চালানোর মত হিন্দী, ইংরাজী ওর জানা আছে। মাধ্যমিকের জায়গায় ও হায়ার সেকেণ্ডারী পাস।এখানে বেশীরভাগেরই ডিগ্রী ওর থেকে কম।তাই সবার  আলাদা একটা সমীহ ভাব থাকে ওর জন্য।

ওর বারবার মনে হয়, এসবের কিছুই হতনা, যদিনা সেদিনের সল্ট লেকের সাই এর টেস্টে পাস করত ও।ওখানে দুশো মিটারের একটা দৌড় হয়।তাতে ও প্রথম হয়েছিল।ফলে সহজেই ট্রেনিং এর জন্য ওকে সিলেক্ট করা হয়।

সিলেক্ট হবার পর ওর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা হয়েছিল বাবাকে নিয়ে।ট্রেনিং এর সময় বাবার শরীর খারাপ হলে কী হবে ভেবে খুব চিন্তা করছিল ও।মীরা কাকীমা মার কাছে সেটা শুনে জোর ধমক লাগায় ওকে।

কাকীমা বলেছিল , “নিশ্চিন্তে যা।তোর মা বাবার দায়িত্ব আমাদের।তোর কাকু এখন অনেক সুস্থ।দরকার হলে দোকান বাজারও করে দিতে পারবে।”

ও অবশ্য বলেছিল, “সেসব ব্যবস্থা আমার করাই আছে।তোমরা খালি একটু নজর রেখো।আর তেমন হলে আমায় খবর দিও।”

এখানে আসার আগে দিদির কাছেও একবার ঘুরে এসেছিল ও।দিদির মুখচোখ থমথমে।কিন্তু কিছু ভাঙল না।শুধু ওকে  বলেছিল, “সাবধানে থাকিস।আমি তো কোন কাজেই লাগিনা।বাবা মার দায়িত্ব এখন পুরোটাই তোর তো।তোকে ভাল থাকতেই হবে।”

এই ট্রেনিং ক্যাম্পেও তাই ওর মন বড় চঞ্চল হয়ে আছে।মার সঙ্গে ছাড়াও মাঝেমাঝেই মীরা কাকীমার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছে।তবে একটা কথা ও ভাবে।যা হবার তাই হয়।

এই যেমন কেউ টানতে টানতে ওকে দার্জিলিং এ ক্যাম্পে পৌঁছে দিল,ঠিক তেমনই একদিন ওর স্বপ্নের পাহাড়চূড়োয় পৌঁছে দেবে।এখন সবটাই প্রস্তুতি।পথে নেমে পেছনে তাকালে এগোন যাবেনা।

দার্জিলিংএ একসপ্তাহ কাটানোর পর ওদের ইয়াকসামে যেতে হবে।সেখান থেকেই শুরু হবে ট্রেকিং।দার্জিলিংএ সব ট্রেনিংটাই খুব রুটিনে চালানো হয় ।একদম সকালে বেডটি খেয়েই শুরু হয়ে যায় সকালের এক্সারসাইজ।ম্যালে নিয়ে গিয়ে দৌড় ব্যায়ামের পর সাতটা থেকে আটটার ব্রেক।ওই ব্রেকেই ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট। ব্রেকফাস্টের বহর বেশ ভাল।টেবিলে সাজানো থাকে, পাঁউরুটি, কলা, সেদ্ধ আর স্ক্যাম্বেলড্‌ ডিম । তাছাড়াও দুধ কর্নফ্লেকস্‌।খিদের চোটে ভালই লাগে খেতে। অনেকসময় ডালিয়ার খিচুড়ি বা ওটস্‌ ও সাজানো থাকে টেবিলে।ওর মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা।

বাড়িতে নিজের ব্রেকফাস্ট ওকে নিজেকেই বানাতে হত।বাবার আয়া না আসা অবধি মা বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত।ওর ট্যুশানিতে যেতে হলে আয়ার অপেক্ষা। নিজের খাবার নিজে বানিয়ে আয়া এলে তার হাতে বাবাকে রেখে ওকে বেরোতে হত। রান্নার দিদি এসে বানাত দুপুরের খাবার।তাকেও সব বুঝিয়ে দিয়ে তবে ও বাজার দোকান,ট্যুশানি সারত।এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে নিজেকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরত মা।ছুটির দিন ছাড়া ওই এক নিয়মে চলত ওদের বাড়ির ঘড়ি।এখানে এসে ফেলে আসা সেই ছবিটা  বারবার মনে পড়ছে ওর।

মার স্কুলে এখন ছুটি চলছে।ছুটি ফুরোতে ফুরোতেই ও পৌঁছে যাবে বাড়ি। এখানের সবটাই ভাল শুধু খাবার ছাড়া। বড় একঘেয়ে দুপুর আর রাতের খাওয়া।মাঝেমাঝে মন খারাপ হয়ে যায়।

সেদিন বেশ মজার একটা ঘটনা ঘটেছে।গুরগাঁও থেকে আসা কুলদীপের সঙ্গে উড়িষ্যার সীমার রিলেশানশিপের ব্যাপারটা সবাই অল্পবিস্তর আন্দাজ করেছে।কুলদীপ ফাঁক পেলেই মেয়েদের হস্টেলের সামনে এসে দাঁড়ায় আর সীমা বেরিয়ে গিয়ে  ওর সঙ্গে চক্কর মেরে আসে।

কিন্তু সেদিন ইন্সট্রাক্টারের মন্তব্য শুনে ওরা সবাই এলার্ট হল।সকাল আটটার পরে কিছু ক্লাস চলে।।কুলদীপ ক্লাসে দেরি করে ঢুকতেই উনি ইংরাজিতে বললেন , “কুলদীপ আমার ক্লাসে দড়ির নট বাঁধা শেখানো হয়।পাহাড়ে উঠতে চাইলে আর নিজেকে বাঁচাতে চাইলে এটা ভাল করে শিখতেই হবে।নট তুমি নিজে যা বাঁধছ বাঁধো,সেটা পাহাড়ে ওঠার কাজে লাগবে না।”

কথাটা বলার পর সারা ক্লাস হইহই করে হাসল। কুহু হাসেনি। ও দেখছিল কুলদীপ লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।সীমাকে সবাই দেখছে উঁকি মেরে। যেন ওরা কোন বিরাট অপরাধ করেছে।এসব ক্ষেত্রে ওর প্রতিবাদের ইচ্ছে হয়।কিন্তু লাভ কিছুই হবেনা ভেবে চুপচাপ থাকে।

সকালে খাওয়া দাওয়ার পর রোজ খুব সিরিয়াসলি কিছু কিছু থিওরি শেখানোর ইন্ডোর ক্লাস চলে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন পাহাড় চেনানো হয়।তাদের রেঞ্জ বোঝানো হয়।তখন ওইসব পাহাড়ের বিস্তৃতি দেখতে দেখতে ওর রোমাঞ্চ হয়।ওখানে ও একদিন উঠবে তো।

দড়ি ধরে পাহাড় ওঠা ছবিতে দেখেছে ও।দড়িতে নানারকমের নট বাঁধা শিখতেই হয়।ওই দড়িই পাহাড়ে রক্ষাকর্তা ।দড়ির ফাঁসে নিজেকে কিভাবে বাঁচানো যায়।সেসব শেখার ক্লাস থাকে।কিছ কিছু জিনিস স্যারেরা বলেন।কিছু কিছু নিজেকে বুঝে নিতে হয়।

এসবের পরে লাঞ্চ।ভারতের সব প্রদেশের খাবার মিশিয়ে লাঞ্চের মেনু হওয়ার জন্য কোন জায়গার ছেলেমেয়েরাই  ভালো করে খেতে পারেনা।বাড়ি থেকে অনেকেই আচার ঘী এসব নিয়ে এসেছে।ভাতের সঙ্গে কালো কালো স্বাস্থ্যকর ডাল,কাঁচা সবজির স্যালাড আর ডিম বা মাংসের টলটলে ঝোল।  প্রতিদিন ওই খাবার সহ্য করা মুস্কিল।তবু রাতের রুটি অনেকটাই সহনীয়।

এসবের মধ্যেই টুকটাক ফোন করছে ও।মার কাছে খবর নিচ্ছে বাবার।মীরা কাকীমাকেও ফোন করল একদিন।

আসার আগে বাচ্চুদের সঙ্গেও দেখা করেছিল।করোনার বাড়াবাড়ি যাতে না হয় পুজোকমিটিগুলো এবারে খুব সংক্ষেপে  পুজো সেরেছে।

বাচ্চু ফোনেও বলছিল, “মাইরি বলছি,তোকে আমরা খুব মিস করছি।”

এবারে  আর ওকে বকেনি ও।বরঞ্চ কেমন একটা স্বস্তি পেয়েছিল, কলেজের হাওয়া টের পেয়ে।অনুটা কেমন আছে কে জানে ?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *