অক্সিজেন। পর্ব ১৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

রাধারানী

মীরার শরীর এখন অনেক ভালো।তবে ভেতরে ভেতরে একটা দুর্বলতা আছে,ও টের পায় সেটা।সকালে একটা মজার কান্ড হয়েছে।ও খাঁচার কাছে আসতেই রাধা  বলেছে, “কেমন আছো?কিছু খেয়েছ?”

আসলে এই কথাটা সেদিন কুহু জানতে চেয়েছিল রাস্তা থেকেই, চিৎকার করে, কিকরে জানি রাধা হুবহু তুলে ফেলেছে।

আসলে ও সবারই সুর নকল করে।সেদিন ব্যালকনিতে ওর খাঁচাটা ঝোলানো ছিল।ঘরে ঢোকাতেই আচমকা চেঁচাল, “পুরা্না বাসন বিক্রি ,পুরানা বাসন।” বিক্রি কথাটা বিদঘুটে ভাবে বলছিল।কানে লাগছিল।অনেকসময় ধমকাতে হয় চুপ করানোর জন্য।‘পুরানা বাসন’ বলে বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল।চুপ করানোর জন্য  ছোলা ঘুষ দিতে হল।কিছু খেতে দিলে মুখ বন্ধ করে,আর পুরনো কথা ভুলে যায়।

করোনা হবার পর থেকেই রঞ্জিত ভারী দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডাক্তারের দেওয়া ভিটামিন ট্যাবলেটগুলো, যা মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন খাওয়াতে হবে।তার নিজেরও ভীষণ ঘুম পায়,গা গুলোয়।যদিও ছেলের কাছে বেমালুম ব্যাপারটা চেপে যেতে হয়েছে । বিভুকে বলেই বা কী লাভ?চাকরি ছেড়ে ওর পক্ষে ওরকম হুটহাট করে আসা তো সম্ভব নয়।

বিভুকে নিয়ে আরো নানারকমের সমস্যা আছে।একাএকা বিদেশে আছে।বয়স বাড়ছে।অথচ বিয়ের কথা বললেই এড়িয়ে যায়। মাঝেমাঝে মনেমনে একটা স্বপ্ন  দেখে মীরা।কথাটা আজ অবধি কাউকেই বলতে পারেনি।কুহুর সঙ্গে যদি বিভুর বিয়ে দেওয়া যায়,কেমন হয়?

প্রথম বাধা বয়সের।কুহুর বয়স বছর কুড়ি হবে আর বিভু ত্রিশে পড়বে ডিসেম্বরে।দ্বিতীয়তঃ তারা কায়স্থ।কুহুরা ব্রাহ্মণ।ওরা আপত্তি করতেই পারে।আর একটা বাধাও আছে।পাশাপাশি বাড়ির ছেলে মেয়ে , অথচ কেউ কাউকে সেভাবে চেনেনা।কুহুর বাবা মা বাড়ি করে এখানে আসাকালীন বিভু পুরুলিয়ার মিশনের হস্টেলে পড়তে চলে গিয়েছে।তারপরে আর বাড়িতে থাকল কোথায়? দিল্লীতে  বিএসসি,এমএসসি করার পর তো বিদেশেই চলে গেল। তারপরের পড়াশুনা তো বিদেশে।কুহুর সঙ্গে সেভাবে ওর আলাপই হয়নি।

এবারে বিভু এলে কথাটা কুহুর মা কে একবার বলে দেখলে হয়। তারপর বিভুকে বলা যাবে।কোন কিছু ঠিক করে না থাকলে ও তাদের মতের বিরুদ্ধে যাবে না।

তবে কুহুকে নিয়ে মুস্কিলও আছে।ওর যত আজগুবী চিন্তা ভাবনা।ওকি বিভুর সঙ্গে বিদেশে যেতে রাজি হবে? সেদিন বলছিল, “জানো কাকীমা, আমার একটা বড়সড় ইচ্ছে আছে।মা জানে।আমি তোমাকে বলতে পারি ।কিন্তু আর কাউকে তুমি বলো না।“

মীরা সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, “কী ইচ্ছেরে?”

ও লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল , “পাহাড়ে ওঠা মানে পাহাড় জয় করার ,মানে একেবারে চূড়োয় ওঠার ইচ্ছে।”

“খুব ভালো ইচ্ছে।আমি একবার দেওঘরে পাহাড়ে উঠেছিলাম জানিস।তবে এখন আর পারব না।বয়স হয়েছে তো।তবে আমার তো ছিল পাহাড়ে চড়া।তুই তো পাহাড় জয় করতে চাস। কিন্তু ট্রেনিং এ যেতে হবে তো।”

“সেটাই তো ভাবনার।বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে ট্রেনিং এ  যাব কী করে?”

“আরে ওটা নিয়ে ভাবিসনি।আমি আর তোর কাকু আছি তো। ঠিক সামলে নেব।” কথাটা বলার পর ভেবেছিল মীরা ,“পাগলকে সাঁকো নাড়া” না দিলেই হত।তারপরেই মনে হয়েছিল, ছিঃ! নিজের স্বার্থের জন্য এমন ভাবনা তাকে মানায় না।

এমনিতে কুহু সাধারণ।তবে চেহারার মধ্যে একটা আলগা চটক আছে।চুলের,শরীরের বাঁধুনিতে মেয়েলী লাবণ্যের পাশাপাশি ঋজু ভাব আছে একটা।সেটাই টানে। কুহু লাল সাইকেলে চড়ে যখন কলেজে যায়,কতসময় হাঁ করে ওকে দেখে মীরা। বেশ লাগে দেখতে!

ওইটুকু একটা মেয়ে, তার শরীর খারাপের সময় নিজের হাতে যত্ন করে খাবার বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে।এত নিজের লোক থাকতে ওর হাতেই দিনের পর দিন চা খাবার খেয়েছে মীরা।

তাই ছবিটা আসে।মনেমনে নিজের ঘরে দোরে,আল্পনা আঁকা ঠাকুর ঘরে, বাগানের গাছগাছালির ফাঁকে কুহুকে বসিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছে ওর। ঘুরছে, ফিরছে, আপনমনে কথা বলছে।এসব কথা রঞ্জিতকে বলেনা ও। রঞ্জিতের সব ভালো। কিন্তু ও কোনরকম স্বপ্ন দেখেনা।

সেদিন যেমন ময়নাটার কথা ভাবছিল মীরা।ছোট্ট একটা পাখি, তার খোঁজখবর নিল।অথচ বাড়ির কেউ একবার দেখা করতে পর্যন্ত এলোনা।ডাক্তারের কাছে শুনেছে করোনা হবার পর দশ দিন বাদে, আর কারোকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা করোনা রুগীর থাকেনা।অথচ বাড়ির লোকেরা তাদের ধারেকাছে ঘেঁসছে না।এই মানুষগুলোই রঞ্জিতের একেবারে আপনজন আর তার  বত্রিশ বছরের সঙ্গী।একসময় সে কী না করেছে এদের জন্য।

মাঝেমাঝে মনে হয় এই বাড়ি ঘর সব বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলে হয়। আবার মনে হয় সেটুকু গুরুত্বই বা ওদের দেবে কেন? ওইটুকু অভিমানেরও যোগ্য নয় ওরা।

রাধা তাকে অবাক করেছে।কথাগুলো হয়ত ওর নয়।কিন্তু ঠিক জায়গায় লাগাচ্ছে তো। তার শরীর কেমন আছে জানতে চাইল।সেদিন ও খেয়েছে কিনা রাধা  জানতে চাইল।এসব রাধা  বলে কীকরে? রাধার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ও বেশ চালাকচতুর।

মীরা মনেমনে ভাবল, রাধাকেই বলবে।রাধার কাছেই জানতে চাইবে,বিভুর সঙ্গে কুহুর ম্যাচিং কেমন হবে?তার ভাবনাটা কী ঠিক পথে যাচ্ছে?

পরক্ষণেই নিজের ওপর করুণা হল তার।রাধার কাছে মতামত নেবে?এতটাই নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছে নাকি?এতো একধরণের পাগলামী।

বড় রাস্তার ওপর বাড়ি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চলমান মানুষের স্রোত দেখতে দেখতে মীরা ভাবছিল চারপাশে এত লোক তবু দিন দিন ও নিজে বড় একা হয়ে যাচ্ছে তো।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ১৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *