অক্সিজেন। পর্ব ১২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

চেনা ও অচেনা

বিলু ক্লাবের মাঠ থেকে ফিরছিল। সঙ্গে ছিল পিন্টু। পিন্টু বিলুর ‘ছোটে’, মানে ছোট মাসির ছেলে। ছোটের সঙ্গে বিলুর সম্পর্কটা একটু অন্যধরণের। এই শহরে ছোটের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন বিলুর মা। খুব ছোট থেকেই এই মাসির কাছে বড় বেশি যাতায়াত  বিলুর। বিলুর মার পুজো আর্চা নিয়ে মাতামাতি শুরু হবার পর থেকেই বিলুর যাবতীয় আদর আবদার ছোটে নিঃশব্দে মিটিয়ে এসেছে।

পিন্টুকে ওদের ক্লাবের ভলিবলের ট্রেনিং-এ ছোটে ভর্তি করেছিল ওরই বুদ্ধিতে। এখন মুস্কিল হয়েছে ওর। ফাঁকা বিকেলে ক্লাবে এলে পিন্টু ওকে টেনে বাড়িতে নিয়ে যায়। ছোটেরও রীতিমত সায় থাকে তাতে।

আজ যেমন ফোন করে বলল, “‘আফগানি চিকেন’ বানাচ্ছি। দিদিকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি, খেয়ে একেবারে বাড়ি যাবি।”

যাবার ইচ্ছে ছিলনা বিলুর। আজ টুপুর সঙ্গে বসার কথা ছিল। টুপু ওর একেবারে প্রাণের বন্ধু। কিছুদিন ধরেই টুপুর মনমেজাজ ভালো নেই। ওর চাকরি আর প্রেমিকা একইসঙ্গে হাওয়া হয়েছে। বাংলায় ভালো রেজাল্ট করে পাস করার পর সংবাদপত্রের অফিসে চাকরি পেল ও। তার পরে পরেই রিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব। সবটাই বিলুর সঙ্গে শেয়ার করেছিল টুপু। নিয়মিত যোগাযোগ রাখে বিলুর সঙ্গে। বেশ কয়েকদিন ফোনে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর বাড়িতেই হাজির হয়েছিল বিলু। তখনই সবটা জানতে পারে।

বিপদ হল ফেরার সময়। টুপুর পিসিমনি মিষ্টি খাওয়াতে নিজের ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে আসল খবর জানতে চাইলেন। বিলু বলেনি কিছুই। খালি আভাস দিয়েছে।

টুপুর বোকামী তুলনারহিত। ও নাকি রিনিকে পিসিমনির কাছে নিয়ে এসেছিল। আর সরাসরি বলেছে, ওই পিসিমনি মানে পিতির নজরে  রিনিকে পাসমার্ক পেতে হবে। তবেই ও রিনিকে বিয়ে করতে পারবে। ছেলেটা এত বোকা, কথাটা বলার আগে দুবার ভাবেনি। ও একা তো আর রিনিকে বিয়ে করবে না, রিনিরও ওকে বিয়ে করা দরকার তো।

এসব পুরনো বাড়ির চিন্তাভাবনার ফল। বিলুও তো একটা পুরনো ধ্যানধারণার বাড়িতে বড় হয়েছে। এসব কথা ওর জানা আছে।

তাছাড়া দুজনের পরিবারের আকার আয়তন একেবারেই বিপরীত। রিনি এক মেয়ে। বাবা মা দুজনেই চাকুরে। ওদের ফ্যামেলি মেম্বার  তিনজন। নিজেদের পয়সায় কেনা ছিমছাম ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। টুপুদের পুরনো থামওলা বাড়ি, পরিবারের অতজন সদস্যকে দেখে এমনিতেই ও ভয় পেয়েছে হয়ত, তার ওপর ওই ধরণের কথাবার্তা বললে যা ঘটার তাই ঘটেছে।

এখন টুপুকে ও কীকরে যে বোঝাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা।

কথাটা শুনে থেকে অবধি বিলুর নিজেরই খুব খারাপ লেগেছে! টুপু ওর বন্ধু , অথচ টুপুর মানসিকতার কোন হদিশ রাখেনা ও। এরকম কথা শুনলে একটা মেয়ে যে সটান বেঁকে বসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। রিনি সেদিন থেকেই ওর ফোন ধরছে না। একদম ব্লক করে দিয়েছে  ওকে।

চাকরি গিয়েছে তারপরে। টুপুর চাকরি যাওয়া নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না ও। চাকরি আবার হয়ে যাবে ওর। কিন্তু রিনি কি ফিরবে?

যদিও টুপুকে ও বলেছে এই খারাপ সময়টা গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজে কথাটা মানতে পারছে কই?

এসব ভাবতে ভাবতেই ছোটের বাড়িতে ঢুকছিল। পিন্টু হঠাৎ “দিদি এসে গিয়েছে” বলে ছুট দেওয়াতে ও চমকে গেল। তাকিয়ে দেখল একটা আকাশি শালোয়ার কামিজ পরে লাল সাইকেলটায় স্ট্যান্ড দিয়ে দাঁড় করাচ্ছে সেই মেয়েটা। ছোটে বলছিল, কদিনেই পিন্টু দিদিমনির ভারি ভক্ত হয়ে পড়েছে। হতে পারে। কিন্তু মেয়েটা বেশ অহঙ্কারী। সাইকেল রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। একবারও তাকাল না ওদের দিকে।

টুপুদের বাড়ি যাওয়াটা সহজ হলনা। ছোটাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও রওয়ানা হতে পারল।  আকাশে বেশ ভালোই মেঘ ছিল। সেটা ও টের পেল বাড়ি ফেরার পথে। খুব জোর নামল বৃষ্টি।

ওখানে গিয়ে যা বোঝা গেলো টুপুর পরিস্থিতি একেবারেই সুবিধার নয়।নিজের পড়ার ঘরের ছোট বিছানায় লেপটে পড়েছিল। ও যখন বলল “এত কথা তুই রিনিকে বলতে গেলি কেন?”

টুপু ম্লান হাসল। “আমি না বুঝে কিছুই বলিনি। রিনিকে যেদিন বিয়ের প্রস্তাব দিই, সেদিনই বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে গেলে আমার বাড়ির এলোমেলো মানুষ গুলোকেও বুঝতে হবে। ওদের ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারিনা। আর পিতি! কি না করেছে আমাদের জন্য । রিনি যদি না ফেরে, তাহলে বুঝব ওটা হওয়ারই ছিল। বরং আস্তে আস্তে সইয়ে নেওয়া যাবে।

আমি চাকরির কথাই ভাবছি। এই বাজারে চাকরি পাওয়াই মুস্কিল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে দিয়েছিল। সেই সঙ্গেই ছাঁটাই শুরু হল। এখন কিছু একটা জোটাতে না পারলে একেবারে গুড ফর নাথিং হয়ে যাব।”

টুপু পৌঁছে দিয়ে গেলো দরজা অবধি। বাইরে পা রেখেই চমকে উঠল বিলু। টিপ্ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। খানিকটা এগোতেই তেড়ে এলো বৃষ্টি। একটা ঝাঁপ ফেলা দোকানের শেডে বাইকটা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই চোখে পড়ল আরো কিছু মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই পিন্টুর দিদিমনি মেয়েটা। আর অবাক কাণ্ড ওকে ঢুকতে দেখে হেসে বেশ চেঁচিয়ে বলল, “আপনি আমাদের পাড়ায় কেন? বৃষ্টিতে ফিরবেন কীকরে?”

বিলু হেসেই বলল, “তেমন হলে ফিরব না। এখানে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দেব।”

কথাটা বলে ফেলার পর অবাক হল ও। একদম অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ও তো এভাবে কথা বলেনা। পিন্টুর দিদিমনি তখনও অচেনা দৃষ্টি নিয়ে হাসিমুখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। বৃষ্টি কি অহঙ্কার ধুয়ে দেয়?

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ১২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *