অক্সিজেন। পর্ব ১১। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

ভাঙনের দিন

মায়ের সঙ্গে অনেকদিন শাড়ির দোকানে আসেনি কুহু। আসলে মা দোকানবাজার করা ছেড়েই দিয়েছে বহুকাল। মায়ের ছোটবেলার বন্ধু সুমনা মাসির ছেলের বিয়ে। সুমনা মাসির ছেলে ডাক্তার। দিদির সঙ্গে ওই অরবিন্দদার বিয়ের কথা হয়েছিল একবার। কুহু জানে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে মা বিয়েতে যাবেনা। ওকেই যেতে হবে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কিন্তু শাড়িটা মা পছন্দ করে নিজের হাতেই কিনবে।

অদ্ভুতভাবে শাড়ির দোকানের সামনেই পিন্টুদের বাড়ির একগাদা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পিন্টু চেঁচাচ্ছে “মা দেখো দিদি। ও মা দেখোনা।”

পিন্টুর সঙ্গে আসলে  সম্পর্কটা বেশ দানা বেঁধে গিয়েছে। এখন পিন্টু হাঁ করে ওর অপেক্ষায় বসে থাকে। পরীক্ষাতেও ভাল করবে যে সেকথা এখনই বলে দেওয়া যায়।

পিন্টুর মা খুব স্বাভাবিক মহিলা। এগিয়ে এসে মার সঙ্গে আলাপ করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে কুহুর এমন প্রশংসা করলেন, মা পর্যন্ত খুশি হয়ে একগাল হেসে ফেলল।

জুহুকে আজ সঙ্গে আনেনি ও, অটোতেই চলে যাবে। মা দোকানের বিল মেটাচ্ছে। ও পিন্টুদের দলটাকে দূর থেকে দেখছিল। আরো দুজন ভদ্র মহিলার সঙ্গে সেদিনের সেই ধীর স্থির ছেলেটাকেও যেতে দেখল। ওদের দলটাকে পেছন থেকে চলে যেতে দেখছিল কুহু। ঠিক তখনই ওই ছেলেটা পেছন ফিরে দেখল একবার। অন্যমনস্ক দৃষ্টি। কিন্তু কুহুর কেন জানিনা মনে হল ও কুহুকেই দেখতে পেছন ফিরেছে। সেই সিনেমায় দেখায় না, “পালট,পালট,” সেরকম আর কী।

ঠিক তখনই অনুর কথা মনে হল ওর। একথাটাও অনুকেই বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লজ্জায় বলা যাবে না। অনু যদি ভুলভাল কিছু ভেবে নেয়? বাচ্চুকেও ফোন করতে হবে। সেই সকাল থেকে অনেকবার বাচ্চুকে ফোন করেছে ও। রাগ করে সাড়া দেয়নি ছেলেটা। রাগ হতেই পারে। কথা ছিল নতুন টিউশানিটার জন্য ওদের দলটাকে চা সিঙারা আর কালোদার দোকানের ঘুঘনি খাওয়াবে। কথা রাখা যায়নি। দুদিন ধরেই ও কলেজ যাচ্ছেনা। ওদের সঙ্গে আড্ডা খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ। কেন যাচ্ছেনা, সেকথা বলারও উপায় রাখেনি ও নিজে।

না। ও কাউকেই কিছু জানাবে না। প্রথম ট্রেনিং শুরু হলে অবশ্য বলতেই হবে। এসব ট্রেনিংগুলো সাধারণতঃ পুজো অথবা শীতের ছুটিতে হয়না। সেক্ষেত্রে না বলার কোন স্কোপ নেই।

আসলে ভ্রমণ ক্লাবের শক্তিদার কাছে দুদিন ওকে যেতে হয়েছে। দুদিনই ওকে বসিয়ে রেখে শেষে ‘দেখছি’ বলে ফেরত পাঠিয়েছে শক্তিদা। ওখানে বসে থাকাকালীন নানা ধরণের ছেলে মেয়েদের আসাযাওয়া লক্ষ করেছে ও। শক্তিদা কাউকেই ফেরান না। পরে আসতে বলেন। ওকে বলেছেন দুদিন বাদে আবার যেতে। হাতে কলমে পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং হবে বাইরে গিয়ে। কিন্তু শেষ অবধি শক্তিদা কিছু করবেন বলে ওর মনে হচ্ছে না।

অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। পোশাক, কাঁটাওলা বিশেষ ধরণের জুতো, নিজস্ব শ্লিপিং ব্যাগ, এসব কেনার জন্য টাকা লাগবে । জুতো কিনে পায়ে গলিয়ে কিছুদিন প্র্যাকটিস করতে হবে। কোথায় পাবে ও এতকিছু? সোমাদি বলেছে ওর ইচ্ছে আর আর্থিক অবস্থার ব্যাপারে শক্তিদাকে কনভিন্স করতে পারলে ব্যাপারটা আটকাবে না। তাই পুরুলিয়ার ট্রেনিংটা আপাততঃ ও বাতিল করে দিয়েছে। ওখানে ও ভেবেছিল সস্তায় হবে। কিন্তু প্রাইভেটে নানারকম মিলিয়ে ভালই টাকা লাগে।

মাকে বললে মা হয়ত যাহোক করে টাকাটা যোগাড় করে দেবে। কিন্তু সেটা ঠিক হবেনা। বাবাকে নিয়ে খরচ তো কম হচ্ছে না।মাঝেমাঝে মাকে ও হিসেবের খাতা নিয়ে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে। তখন বড় মায়া হয়। সামনের দিনগুলো নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা দিনদিন মায়ের কপালের রেখায় ফুটে উঠছে। অথচ মানুষটা এমন, কখনও বলা যায়না, আমি তো আছি। ভয় পাচ্ছ কেন?

দিদির কাছে মাঝে একদিন গিয়েছিল। ওকে দেখে কি একটা লুকোবার চেষ্টা করছিল দিদি। ততক্ষণে যা দেখার দেখে ফেলেছে ও। একটা প্যাকেটে কতকগুলো শাড়ি। সুতো, সূঁচ। দিদি কাপড়ে ফলস্‌ বসাচ্ছে। এম এ পাস মেয়ের ভবিষৎ এই দাঁড়াল তবে! কত টাকা পাবে? বড়জোর কাপড়পিছু পনেরো টাকা।

যে দিদি বোতাম  ছিঁড়ে গেলে অম্লানবদনে ওকে বলত “সেলাই করে দিবি? সেফটিপিন দিয়ে পরছি বলে মা বকেছে।” সেই দিদি অর্ডার  নিয়ে সেলাই করছে অন্যের শাড়ির ফলস্‌।

ও দিদিকে বলেছিল, “টিউশানি করবি? খুঁজে দোব?”

উত্তরে দিদি বলল, “চা খাবি? তোর ফেভারিট নোনতা বিস্কুট আনিয়ে রেখেছি।”

কুহু কিছু জানতে চাওয়ার আগেই তড়বড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল ও। যা ওর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। তোর মিহিরদা একটা দোকানে আপাততঃ খাতা লেখার কাজ পেয়েছে। আমিও দেখছি। একটা কিছু ঠিক যোগাড় করে নেব।”

দিদির কাছ থেকে আসল অবস্থা কিছুতেই বোঝা যাবেনা। জানে ও। তারজন্য মিহিরদাকে দরকার। লোকটা কর্কশভাষায় কথা বললেও কিছু লুকোতে চায়না।

ট্যুশানির পয়সায় দিদির জন্য পেস্ট্রি কিনে নিয়ে গেছিল ও। দিদির পেস্ট্রির ওপর ভয়ংকর দুর্বলতা। কিন্তু ও বার করতে বলল “এইমাত্র অনেক কিছু খেয়েছি।রেখে দিই। পরে খাব কেমন।”

উত্তরে ও হেসে আর একটা প্যাকেট বার করেছিল। এটা রাখ। মিহিরদাকে দিবি। আর একটা প্লেট আন। আমার আর তোরটা একসঙ্গে রাখ। দুজনে একসঙ্গে খাব।

আর কথা না বাড়িয়ে প্লেট নিয়ে এসেছিল দিদি। ওরা দুজনে একসঙ্গে খেয়েছিল অনেকদিন বাদে। তখনই দিদির মুখে এক ধরণের নিরাসক্তি দেখেছিল ও। যেন খেতে হয় তাই খাচ্ছে। ও বুঝতে পারছিল সবকিছুই একে একে হারিয়ে ফেলছে দিদি, কিন্তু জেদ ছাড়বে না। ওটুকুই ধরে রেখেছে আপ্রাণ শক্তিতে।

এসব কথা ও মনেমনে ভাবে আর জুহুর সঙ্গে শেয়ার করে। সেদিন বাচ্চুদের আড্ডায় গিয়েও ওর মন পড়েছিল দিদির কাছে। দিদিকে নিয়ে ইদানিং বড় দুর্ভাবনা হচ্ছে ওর। চুপচাপ থাকতে থাকতে ভয়ংকর কিছু না ঘটিয়ে ফেলে।

অনেকদিন বাদে আবার বাচ্চুদের আড্ডায় গেল ও। বাচ্চু একটু রেগেছিল ওর ওপর। ফোন ধরছিল না। কিন্তু ওকে দেখে রাগ সামলে ভালই ব্যবহার করল। বলছিল, “আমি তো ভাবলাম বড়লোক বাড়িতে পড়াতে গিয়ে তুইও পালটে গেলি।মাইরি বলছি, তোর সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘাবড়ে গেসলাম।”

ও এতটাই অন্যমনস্ক ছিল যে ‘মাইরি’ শব্দটা খেয়াল করেনি। অনু ওকে বারকয়েক ডেকেছে, তারপর হাতের সামনে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করেছে। তখন হুঁস হয়েছে ওর। বলেছে “বাচ্চু কিন্তু আবার মকারান্ত শব্দ বলছে কুহু।

পাপু মুচকি হেসে বলল, “কিরে প্রেমে পড়লি নাকি?”

তাতেও ঘোর কাটেনি ওর। কিন্তু বাচ্চু যখন বিড়ি ধরিয়ে ওকে এগিয়ে দিয়ে বলল ,“নে,এটা তোর পাওনা ছিল।” একঝটকায় ঘোর কেটে গেছিল ওর। বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দূরে। আর বাচ্চু সোল্লাসে বলেছিল, “মহামায়া জেগেছেন।”

তখনই মুখ ভারি করে ক্যান্টিনে ঢুকেছিল অজয়। আর পাপু ওর পেছনে উঁকি মেরে খুঁজছিল কিছু।

অনু ধমকেছিল পাপুকে, “আবার অসভ্যতা করছিস?”

পাপু বলেছিল, “না তো, ওর ল্যাজটা খুঁজছি। গেল কোথায়?”

অজয় অন্য দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বলেছিল, “ঝিন্‌ঝিনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, পরশু দুপুর থেকে। ওর বাড়ি থেকে আমায় ফোন করেছিল।”

ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অজয়ের দিকে। অজয় অন্যমনস্ক ভাবে বলে, “কদিন ধরেই আমায় খুব জ্বালাচ্ছিল। সারাক্ষণ পেছন পেছন ঘুরছে। কাজ করতে দেয়না। ওকে বারণ করেছিলাম আমার সঙ্গে যেতে। পরশু দুপুরে বীরেনদার বাড়িতে মিটিং ছিল। ওকে কীকরে নিয়ে যাই বল?”

অনু বলল “ভাবিস না। ও ঠিক ফিরে আসবে। এধরণের ইনফ্যাচুয়েশান ট্যাকেল করতে খুব অসুবিধা হয়। এ বরং ভালোই হল। কিছুদিন অন্ততঃ তোর কাছে ঘেঁষবে না।”

এসব সময়ে অনুকে ওর বেশ ম্যাচিওর লাগে। কিন্তু কোথাও কবিতা পোস্ট করার পরেই ও যখন বলে, “কবিতাটা কিছুই হয়নি। কেন যে জমা দিলাম।” ওর মনে হয় অনুর মাথায় কিছু নেই। ও আসলে ভীষণ ছেলেমানুষ।

অনুর কথা শেষ হতে না হতেই কালুদার দোকানের বাইরে একটা কিছু আওয়াজ করে পড়ে গেল । আর কুহু ছুটে গিয়ে দেখল জুহুকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে কেউ। জুহু বেঁকে গিয়েও মুখ দিয়ে কোন শব্দ করছে না। নিঃশব্দে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

ও জুহুকে তুলতে তুলতে ভাবছিল এমন করে যদি ও দিদিকে ভাঙাচোরা অবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারত!

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *