অক্সিজেন। পর্ব ১০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

নতুন টিউশানি

গতকাল জুহু বাড়ি ফিরেছে। প্রায় আটশো টাকা খরচ হল জুহুর পেছনে। হাত একদম ফাঁকা। কুহু ভাবছিল মা কীকরে সবটা বুঝতে পারে? সকালে স্কুল যাওয়ার পথে পাঁচশো টাকা ড্রেসিংটেবিলে রেখে গেল। ও বলেছিল, “এই তো সেদিন সংসারের টাকা দিলে, আবার এ টাকাটা কিসের?”

মা থমকে দাঁড়াল একবার। “সাইকেল সারালি তো।টাকা লাগেনি?”

“সে তো…।”

“আমি জানি। তোর পার্স কাল টেবিলে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলি, ওটা আমার হাত লেগে নীচে পড়ে গেছিল। তুলতে গিয়েই টের পেলাম…।” মা হাসে এবার। “আমার চাকরিটা আছে তো। এভাবে ফাঁকা হাতে ঘুরে বেড়াস কেন? কখন কী দরকার লাগে।”

মা চলে গেল। মায়ের ঘাড়ের কাছে লেপটে থাকা বড় খোঁপাটা দেখে ওর দিদির কথা মনে পড়ছিল। মার মত ওইরকম ঘন কালো লম্বা চুল ওর নেই। দিদির আছে। দিদি একটা লম্বা বিনুনি করে সেটা পিঠে ফেলে রাখে। দিদির শরীরের গঠনও মায়ের মত।ছোটবেলা থেকেই দিদির প্রতি মার বিশেষ টানটা বুঝতেও ওর অসুবিধা হয়নি। তবে? এত শক্ত থাকে কীকরে?

দিদিরও তো হাত ফাঁকা। মা দিদির ব্যাগ ভরে দিতে পারে না?

ছোটবেলা থেকেই মাকে ওরা বেশ সমীহ করে চলে। কিন্তু মা কোনদিন ওদের মারেনি বা বকেনি। দিদি মাকে বলেছিল মিহিরদার কথা। মা পাত্তা দেয়নি। এতবড় সিদ্ধান্ত দিদি নিয়ে নেবে জানলে ও অন্ততঃ মাকে বোঝাত একটু।

মিহিরদার সঙ্গে দিদির আলাপ হয় ট্রেনে। দিদি এমএ-র ক্লাস করতে তখন রোজ ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। প্রাইভেট অফিসে ছোটখাটো কী একটা চাকরি করত মিহিরদা। থাকত উত্তরপাড়ার একটা মেসে। পুর্ববঙ্গের ছেলে। একেবারে সহায়সম্বলহীন হয়ে বাবা মা ছেলেপুলেদের নিয়ে এদেশে আসেন। বাবা, মা কেউ বেঁচে নেই। মিহিরদা ছাড়া অন্য ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তারা কেউ সম্পর্ক রাখতেও চায়না মিহিরদার সঙ্গে।

এহেন মিহিরদা দিদির কী একটা উপকার করায় দিদি তার প্রেমে পাগল হল। কিন্তু বাস্তব বুদ্ধি থাকলে কে মেনে নেবে এমন পাত্রকে? কুহু অন্ততঃ বাবা মার কোন দোষ দেখতে পায়নি।

ভাগ্য এমন, বিয়ে হতে না হতেই করোনার প্রকোপে মিহিরদার চাকরিটা গেল চলে।তারপরের ছবিটা একেবারেই ভাঙা নৌকার পাল। যা আজ ও ওদের বাড়িতে দেখে এসেছে। কুহু এক একবার ভাবছিল নিজের নতুন টিউশানিটা  দিদিকেই দিয়ে দেবে। তারপরেই মনে হল, না। দিদি কিছুতেই নেবেনা। এ ব্যাপারেও ওর মায়ের সঙ্গে মিল আছে।

আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই দ্রুত হাত চালাচ্ছিল ও। বাবার আয়া এসে গিয়েছে। আজ মা বাবাকে না খাইয়েই স্কুলে চলে গিয়েছে। স্কুলে কী জরুরি দরকার আছে বলল। দুধে কনফ্লেক্স্‌ আর কলা মেখে বাবাকে চামচে করে খাইয়ে দিচ্ছিল কুহু। ও নিজের জন্য দুধ গরম করতে রান্নাঘরে ঢুকতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। না আজ আর কর্নফ্লেকস খাওয়া যাবেনা। দুটো বিস্কুট মুখে পুরে গরম দুধে চুমুক দিল শেষ অবধি। এখন আটটা বাজে। সাড়ে আটটার মধ্যে শম্ভুর মোড়ে পৌঁছতেই হবে। বাচ্চু ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। নতুন টিউশানির প্রথমদিন আজ। ও নিয়ে গিয়ে বাড়ি দেখিয়ে দেবে।

বাবলুর দোকানে কদিন থেকেই জুহুর চেহারা ফিরেছে। লাল রঙে জেল্লা এসেছে।কুহু যেতে যেতে জুহুকে  বলছিল, “কীরে কেমন বুঝছিস? টিউশানিটা টিঁকবে তো। মাসে হাজার। ইয়ার্কি নয়। পাহাড়ে চড়তে গেলে অনেক টাকা লাগবে।”

মনেমনে কথাগুলো বলছিল ও। বলতে বলতেই খেয়াল হল ভ্রমণ আড্ডার শক্তিদার সঙ্গে দেখা করতে হবে। রুমাদি বলেছে পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং এর ব্যাপারে শক্তিদার সঙ্গে কথা বলতে। সরকারী ভাবে ফ্রী তে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। ট্রেনিং-এ যেতে গেলেও অনেক কিছুই লাগবে। তার জন্য স্পন্সরশিপ পেলে মন্দ হয়না। রুমাদি পেয়েছিল শক্তিদার থ্রুতেই। এসব সুলুক সন্ধান শক্তিদা জানে। ওর সেজন্য শক্তিদার সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।

মোড়ের ঠিক মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল বাচ্চু। মুখে বিড়ি ছিল। ওকে দেখেই বিড়ি ফেলে তড়বড়িয়ে এগিয়ে এলো। “কীরে এত দেরি করলি কেন? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। তোকে ওখানে দিয়ে আমাকে আবার টিউশানি যেতে হবে।”

কথার উত্তর না দিয়ে ও রিস্ট ওয়াচটা ধরল বাচ্চুর নাকের ডগায়।

ফিচেল একখানা হাসি দিয়ে বাচ্চু বলল, “জানি জানি। সময় ঠিকই আছে। একটু আগে হলে আমার ভালো হত, এই আর কী।”

অনেক খানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় বাড়ি। সামনে একটুকরো ঘাস জমি। টানা গ্যারেজ না থাকলে ঘাস জমি আরেকটু ছড়াত।দরজা খোলার পর ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাচ্চু পালাল। ছাত্রের মা নিয়ে গেলেন বাইরের ঘরে। ওকে বসিয়ে রেখে ছাত্রকে আনতে গেলেন। নাকি প্রথমদিনের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে গেলেন, কে জানে?

একটু পরেই ঢুকল ছাত্র। পেছন পেছন একরাশ খাবার নিয়ে ছাত্রের মা। ছেলেটি ভালোরকম সপ্রতিভ। নিজেই মুচকি হেসে বলল “আমার নাম পিন্টু। আপনাকে কি বলে ডাকব?”

হাসল ও। একবার ভাবল বলে, ডাক যাহোক হলেই চলবে। পড়ায় ফাঁকি চলবে না। কিন্তু কিছু বলল না। যা বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি ভালোরকম বিচ্ছু। প্রথম থেকেই মাথায় চড়তে দিলে আর নামবে না। ও গম্ভীরভাবে বলল, “শোন তোমার রিপোর্ট কার্ডটা নিয়ে এসো। ওটা আমি একবার দেখব।”

ওর মা কাজের লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। “রিপোর্ট কার্ড আমার কাছে। দাঁড়ান পাঠিয়ে দিচ্ছি। পিন্টু আমার সঙ্গে চল।”

রেজাল্ট আনার পর বেশ অবাক হল ও। অঙ্কে একশোয় পঁচাত্তর। অথচ ভূগোল, ইতিহাসে পাস নম্বর নেই।

“কী ব্যাপার, অঙ্কে ভাল নম্বর আর ইতিহাস, ভূগোলে ফেল?”

“ওগুলো পড়তে আমার ভালো লাগে না।”

“এবার লাগবে। আমি তোমায় হেল্প করব তো।”

পড়াতে পড়াতে দু’ঘন্টা কোথা দিয়ে যে কেটে গেল। ভূগোলে হিমালয় পর্বত দিয়ে শুরু করে পাহাড়ে চড়ার গল্প শুনিয়ে দিল ও।পিন্টুর  চোখের পলক পড়ছিল না।

ইতিহাস পড়াতে পড়াতেই খেয়াল হল দু’ঘন্টা শেষ। ততক্ষণে পিন্টুর চোখ মুখের ভাব পালটে গিয়েছে। একটা জিনিস ও বুঝেছে দিদিমনি অনেক নতুন নতুন গল্প জানে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো জানতে পারবে ও। তাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সারাক্ষণ। কুহুর হাসি পাচ্ছিল, ম্যাজিক কাজ করেছে তাহলে।

জুহু দাঁড়িয়েছিল নীচের টানা বারান্দার সামনের খোলা চাতালে। একদম চুপচাপ ছিল, এমন কী ওকে দেখেও কোন কথা বলল না। আসলে ও একটু সুখী। ঠায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলেই রেগে গিয়েছে। জুহুর পিঠে থাপ্পর মেরে ওকে ঠাণ্ডা করতে হল।

এই বাড়িতে যে অনেক লোক থাকে বেশ বোঝা যায়। দোতলার পড়ার ঘরের দরজা ভেজিয়ে দেওয়ার আগে অবধি সারা ঘরে একটা আওয়াজ আসছিল, যা এর আগে শোনার অভিজ্ঞতা হয়নি ওর।

এদের বাড়ির অন্য একটা ব্যাপার বেশ ভালো লেগেছে ওর। এরা খুব গাছপালা ভালবাসেন। বাড়ির বাগানে বেশ বড় আকারের গন্ধরাজ গাছ আছে। সে গাছে ফুল ফুটে আছে অজস্র। এছাড়াও বাড়ির দু’পাশের গেটে ঝাউগাছের ঝোপ। বাড়ির ভেতরেও অনেক জায়গাতেই টব সাজানো। জুঁই এর একটা গাছকে দোতলার ব্যালকনি অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নামতে গিয়ে সিঁড়ির বাঁকে অচেনা বেগুনী ফুলের গাছ দেখে থমকে  গেছিল ও। মন দিয়ে দেখেও চিনতে পারছিল না। মাথা তুলতেই নজরে এলো সাদা হাফ শার্ট পরা প্রায় ওরই বয়সী এক যুবক পথ না পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও ওকে তাড়া লাগায়নি ।

ও ‘স্যরি’ বলে পথ ছেড়ে দিতেই ছেলেটি  হেলতে দুলতে ওপরে চলে গেল। ভঙ্গিটার মধ্যে কেমন একটা না তাড়ার ভাব। কুহুর খুব হাসি পাচ্ছিল। এই জেট যুগে এরকম আলগা মানুষজনও আছে তাহলে? অনুকে বলতে হবে কথাটা, ভেবেছিল ও। কিন্তু অনুর সঙ্গে দেখা হবার পর এসব মনে থাকবে না। আসলে বড্ড ভুলো ও। এখন যেমন আচমকাই মনে পড়ল মীরা কাকীমার বাড়ি সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হবে আজ। কলেজ যাবার আগে মায়ের কথামত মিষ্টি কিনে পুজো দিয়ে দিতে হবে। সময় ভীষণ কম।

ফোনটা বেজে উঠল প্রায় তখনই। বাচ্চু। কথা না বাড়িয়ে কটাং করে ফোনটা কেটে দিল ও। এখন বাচ্চুর সঙ্গে কথা বললে সব গোলমাল হয়ে যাবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *