অক্সিজেন। পর্ব ১৫। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

“আকাশ ভরা সূর্য তারা”

শিপ্রা মাঝেমাঝে ভাবে, নিজে বিয়ে না করেও সংসারের বাঁধনে বড় বেশি বাঁধা পড়ে আছে।সারাক্ষণ বাড়িশুদ্ধু লোক ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

টুপুকে নিয়ে ভালোরকম চিন্তার কারণ ঘটল একটা।চাকরিটা চলে যাবার পর , কদিন ধরেই নিজের ঘরে শুয়েবসে কাটাচ্ছিল।সেদিন দুপুরে কী মনে হতে শিপ্রা গিয়েছিল ঘরে।দুপুরবেলা বাড়িতে থাকলে বইপত্র পড়ে বা ল্যাপটপটা নিয়ে খুট্‌খাট্‌ করে।সেদিন ঘরে ঢুকে অবাক লাগল ওর।ঘর অন্ধকার করে চোখে হাতচাপা দিয়ে শুয়ে আছে।ঘুমোয়নি যদিও।

নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠল শিপ্রা।গা রীতিমত গরম।জ্বর আছে গায়ে।নাক টানা দেখে কদিন ধরেই সর্দিও টের পেয়েছিল।

ওর স্পর্শ  পেয়ে, “কে? পিতি?”বলে চুপ করে গেল ছেলেটা। যেন পিতিকে ওর কিছুই বলার নেই।সবকথা শেষ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ঘরে ফিরে আসে ও।সেদিন ওর সঙ্গে কোন কথা না বলেই সেন্টারে ফোন করে ব্লাড নিয়ে যেতে বলেছিল।টেস্টে পজিটিভ আসার পর ওই ঘরেই বন্দী আছে টুপু। দুটো ভ্যাক্‌সিন হয়ে যাওয়ায় তেমন মারাত্মক কিছু হয়নি।তবে ডাক্তারের কথামত বাড়ির সবাইকে টেস্ট করিয়ে নিতে হল। বাদবাকি সবাই নেগেটিভ।এখন জ্বর সর্দিকাশির মত করোনার গতিপ্রকৃতি খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কার যে কখন হচ্ছে কখন ছাড়ছে বোঝা মুস্কিল।

নিজের হাতে অনেকদিন বাদে ছেলেটার জন্য স্টু বানিয়েছিল শিপ্রা। ঘরের সামনের ছোট টেবিলে রেখেও এসেছিল।খেয়ে মেসেজ করেছে “খুব খুব ভাল লাগল খেয়ে।”

শিপ্রার যদিও একটুও ভাল লাগেনি। মেসেজ পাবার পর কোনরকম আনন্দই হয়নি ওর ।টুপু হবার পর বউদি অসুস্থ ছিল অনেকদিন। দেখাশোনার ভার পড়েছিল ওর ওপর।সেইথেকে এক অন্যরকমের নৈকট্য। শরীরের তাপের সঙ্গে সঙ্গে টুপুর মনের তাপের খবরও শিপ্রার কাছে সহজেই পৌঁছে যায়।হাজার চেষ্টা করেও কিছুই লুকোতে পারেনা ছেলেটা। দুটো ভ্যাক্‌সিন্‌ নেওয়া আছে।তাই তেমন চিন্তা করতে হচ্ছেনা। শিপ্রা ঠিক করেছে, চোদ্দটা দিন কোনভাবে কেটে গেলেই যেকোন দিন ও বসবে টুপুর সঙ্গে। আরো দেরি না করে কী ভাবছে ও জানা দরকার।

টুপুকে তবু বোঝা যায়।যতীনকে একেবারেই না।ওকে নিয়ে বড় চিন্তা হয়।যেকদিন ও পৃথিবীতে আছে,যতীনের কোন চিন্তা নেই।কিন্তু তারপর।কার ভরসায় থাকবে ও?

সেদিন বলল, “দিদি তুমি মরার আগে যেন আমি মরে যাই।নাহলে কেউ মালা দিয়ে আমাকে সাজাবে না।”কথাটা একেবারেই ভুল বলেনি ও।কিন্তু কথাটা শুনে বুকের  ভেতর ছ্যাঁত করে উঠেছিল ওর।হঠাৎ এসব কী কথা?কেনই বা বলছে যতীন?

“হঠাৎ এসব বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

“না।না।”মাথা নেড়েছিল যতীন।“গুলুর ঠাকুমা মরে গেলনা?কী সুন্দর মালা দিয়ে নিয়ে গেল।তাই বলছিলাম।তুমি ছাড়া আমার জন্য কে মালা কিনবে বলো?”

কথাটা শোনার পর থেকেই চুপচাপ হয়ে আছে ও। মাঝেমাঝে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে।সারাবাড়ির এতগুলো লোকের চাপ নেওয়া তো সোজা কথা নয়।সেই কোন বয়স থেকে ওর ওপর চেপেছে সব।মা বেঁচে থাকতে রান্নাঘরের দিকটা দেখতে হতনা।কিন্তু বৌদি সেটাও পুরোটা সামলাতে পারেনা।ওকে মাথা ঘামাতেই হয়।

শীলাকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরের কাজকর্মের চাপটা অনায়াসেই ভাগাভাগি করে ফেলতে পারত বৌদি। সেটাও বৌদির ছুঁচিবাই মানসিকতায় সম্ভব হচ্ছে না। রান্নাঘরে শীলাকে পারতপক্ষে ঢুকতে দিতে চায়না।একটু চা এর জন্যও বৌ্দিকে বলতে হয়। আজকাল বারান্দার টেবিলে শীলা কুটনো কাটে ছুরি দিয়ে। ব্যবস্থাটা তার করে দেওয়া। বউদির রান্নাঘরের  পবিত্র চৌকাঠ ডিঙোনোর উপায় নেই ওর।

শীলার মেয়েকে নিয়ে আসার কথা জানুয়ারিতে।তখন ঝামেলা আরো বাড়বে।ঝামেলা হলেও বোঝাতে হবে বউদিকে।সংসার বাড়ছে।করোনার হার কমলে তারও ট্যুশানির চাপ বাড়বে।সেসময়  শীলা দেশের বাড়িতে ঘনঘন মেয়েকে দেখতে গেলে তার চলবে না।কাজেই মেয়ে সমেত শীলাকে গ্রহণ করে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ হবে।না বুঝলে জোর ফলাতে হবে, যেটা তার একেবারেই পছন্দ না।

এদিকে সজলবাবুকে নিয়ে বেশ মুস্কিল হয়েছে।ক্লাস ছাড়াও এটা ওটা অজুহাত খাড়া করে বাড়িতে চলে আসছেন।বিজয়ার দুতিন দিন বাদে মিষ্টি হাতে এসে নমস্কার জানিয়ে গেলেন সকলকে।এসব তার পছন্দ হয়না।

সেদিন ক্লাসে শিপ্রা বলেছে একবার, “এরকম হুটহাট করে চলে আসবেন না ।আমি ব্যস্ত থাকি। আমার অসুবিধা হয়।“

উত্তরে উনি বললেন, “বলে এলে তো আপনি বারণ করবেন। চন্দননগরের মিষ্টিটা পেলাম।তাই চলে এলাম।“

উত্তরে কি বলবে ভেবে পায়নি শিপ্রা।তবে এবার একদিন কড়া করেই কিছু বলতে হবে।এত বাড়াবাড়ি তো ভাল নয়।এরপরে কী বলতে কী বলে ফেলবে।তাই মনেমনে কথা সাজাচ্ছে ও।মোক্ষম  ভাবে ঝাড়তে হবে।যাতে বাপ বাপ করে এসব আদিখ্যেতা  পালায়। দু’দুটো ট্যুশানি একসঙ্গে চলে যাবে।কিন্তু উপায় নেই।ওইপথেই হাঁটতে হবে।কারোর জন্যই জগতসুদ্ধু লোকের হাসির খোরাক হতে পারবে না শিপ্রা।

গানের ঘরে চুপচাপ বসেছিল ও ।হারমোনিয়ামের বেলো খুলে রিডে আঙুল রেখে আনমনে ভাবছিল নানাকথা।তাই যতীনের ঘরে ঢোকাটা টের পায়নি ।ছেলেবেলার মত যতীন এসে বেলোর গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিরক্ত করছিল।তারপর ওর কাছে বকুনি খেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমাকে একটা গান শেখাবে তুমি?আমি গান শিখতে পারব না ,না?”

ওর সরল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া হল শিপ্রার।ও হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে বলল, “ কেন পারবি না ? আয়,আমার সঙ্গে গলা মেলা।‘আকাশ ভরা সূর্য তারা..।’”

যতীন দিব্যি গলা মিলিয়ে গাইছিল। শিপ্রা গাইতে গাইতে ফিরে যাচ্ছিল ওর ছোটবেলায়।ওর চোখে ভাসছিল বাবার ঘাম ভেজা মুখ।বাবা ওকে উঠোন থেকে ডেকে বলছিলেন, “শিপ্রারে, তোর জন্য নতুন হারমোনিয়াম এনেছি।”

ছোট্ট শিপ্রার পেছন পেছন কী মজা,কী মজা,বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল  যতীন।তখন ও সম্পূর্ণ সুস্থ। মেনেনজাইটিসে ওর মাথাটা এরকম এলোমেলো  হয়ে যায়নি।পুরনো দিনগুলো কেন যে মনে পড়ে।মনে করে শুধু শুধু কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয়না।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *