নায়িকার ভূমিকায়। নবম পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য

0

বাংলা সহ সারা দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে টকি (সবাক ছবি) যুগের শুরুতে গান ও অভিনয় দুটোই জানেন এরকম অভিনেতা-অভিনেত্রীর কদর বাড়তে থাকে দ্রুত। ‘চণ্ডীদাস’ বা এরকম কয়েকটি নৃত্য-গীত মুখর ছায়াছবির হাত ধরে তাই শুধু উমাশশী বা কানন বালাদের মত নায়িকাদের জীবনেই নতুন অধ্যায় শুরু হয়নি। টকি যুগের গোড়াতে এই পরিবর্তন ছাপ ফেলে পরিচালনার রীতি নীতি থেকে ছবির প্রচার সর্বক্ষেত্রেই। একদিকে বাংলার চলচ্চিত্রে শব্দ এসে যাওয়ার পর জনপ্রিয় হতে থাকে ভদ্রলোক বাঙালি পরিচালিত চলচ্চিত্র সংস্থাগুলো। অন্যদিকে লোকমুখে প্রচলিত হতে থাকা ‘বই’ (সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র)-এ নতুন রূপে নির্মাণ ঘটে নায়ক–নায়িকাদের। গান জানা নায়িকারা নাচে-গানে-অভিনয়ে ফিল্ম বিনোদনে নিয়ে আসেন নতুন মাত্রা। অবশ্য তার  উল্টো পিঠেই থাকে প্রচুর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অকাল অবসরের করুণ বাস্তব! গানে পারদর্শী না হওয়ায় কাজ হারান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। শুধু গানই নয় শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, ‘সুমধুর’ কণ্ঠস্বর এসবেরও চাহিদা তৈরি হতে থাকে। বাংলার ছবির পর্দায় পেসেন্স কুপার-সীতা দেবীদের নির্বাক ব্যঞ্জনা সরে গিয়ে নায়িকার আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় উমাশশী-কাননবালাদের সুর-শব্দ-ছন্দের মুর্ছনা। চলচ্চিত্রের পর্দা ও চলচ্চিত্রের পর্দার বাইরে চলচ্চিত্র নিয়ে যে জন পরিসর তাতে বদলে যেতে থাকে নায়িকার ভূমিকা।

এই প্রসঙ্গে একথা মনে রাখা ভালো যে, সারা পৃথিবীতেই এই সময় নায়িকাদের কল্পনা বদলে যেতে থাকে দ্রুত। জনপ্রিয় কল্পনায় নটী–নায়িকাদের নিত্য-নতুন ভূমিকার পাশাপাশি বেশ কিছু নব্য-নির্মাণের সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকে আধুনিক শহুরে জনসমাজ। ‘মর্ডান গার্ল’, ‘পিন আপ গার্ল’, ইট গার্লের’ মত যৌন-সংবেদী নির্মাণের সঙ্গে গোটা বিশ্বের মেট্রোপলিটান শহুরে সমাজ পরিচিত হয়। কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কারা এই মর্ডান গার্ল? কীরকম ভাবেই বা তাঁদের দৃশ্যমানতা তোলপাড় ফেলে দেয় শহুরে সংস্কৃতিতে? একদিকে হাই হিল জুতো, লিপস্টিক শোভিত ঠোঁট ও অন্যান্য কসমেটিকস যদি তাঁদের বাইরের পরিচিতির অভিজ্ঞান হয়, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-নির্দিষ্ট নারীত্বের সংজ্ঞার বাইরে বেরতে পারায় রয়েছে তাঁদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। জেন্ডার স্টাডিসের গবেষকরা দেখিয়েছেন কিভাবে ‘মর্ডান গার্ল’দের উত্থান এই  সময় সারা বিশ্বেই ফেনোমেনাল হয়ে ওঠে। বেজিং থেকে বোম্বে, টোকিও থেকে বার্লিন, জোহানেসবার্গ থেকে নিউ ইয়র্ক- এই আধুনিকারা সাড়া ফেলেন ফিল্মের পোস্টার থেকে নানা দ্রব্য পণ্যের বিজ্ঞাপনে, পত্র-পত্রিকার পাতা থেকে কাফেতে, সিনেমা হলে ও জন-পরিসরে। বলাই বাহুল্য এই  নির্মাণের অনেকটাই পুরুষের চোখ (মেল গেজ) নির্ধারিত দেখা। কিন্তু তানি ই বার্লো, প্রীতি  রামামূর্তী, লিন ই থমাস এবং আরো কিছু এর বিশিষ্ট গবেষকদের দল জানাচ্ছেন কিভাবে এই আধুনিকা নারীরা মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট নিয়মনিষ্ঠ  মা-জায়া-দুহিতা স্টিরিওটাইপ ভেঙ্গে স্ত্রী স্বাধীনতার নতুন ধারণা নিয়ে এসেছিলেন — যা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হতে পারে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা হতে পারে, আবার যৌন স্বাধীনতাও হতে পারে। সমাজের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির বাইরে নানাভাবেই সাড়া ফেলেছিলেন এই ‘মর্ডান গার্ল’এরা।

যেটা গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র এবং ফ্যাশন এই আধুনিকাদের ছকভাঙ্গা নির্মাণের অন্যতম দোসর হয়ে ওঠে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আমেরিকা কিংবা ভারতে। সারা বেরি বা লরেন্ট গুইডোর মত গবেষকরা বলছেন, এই সময়ের আধুনিকাদের এই নব্য নির্মাণ বুঝতে হলে আমাদের চোখ রাখতেই হবে ছবির পর্দায় আর বিশেষত নায়িকাদের নৃত্য-গীত মুখর দৃশ্যগুলোয়। এই এক একটি পারফর্ম্যান্স যেন সমকালের বাস্তবতায় এইসব আধুনিকাদের এক একটি ঐতিহাসিক  উচ্চারণ! বাংলায় ফিরে এলে আমরা উমাশশীর তারকা ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে এই আধুনিকা-গায়িকা-নায়িকাদের যুগকে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারব। আর অতি অবশ্যই তিরিশের দশকের সবচেয়ে আলোচিত তারকা কানন বালার মধ্য দিয়েও চিনে নেওয়া যায় পর্দায় ও পর্দার বাইরে আধুনিকা নায়িকার নির্মাণ। যেভাবে ক্লোজ আপ ও মিড ক্লোজ আপে সফট ফোকাসের ক্যামেরা এই নতুন যুগের নায়িকা-গায়িকাদের সংবেদী রূপ নিয়ে আসতে শুরু করে, তা জানান দেয় দৃশ্যগত ভাবেও বাংলা ছবিতে এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে।

পোস্ট কার্ডে কানন বালা, সৌজন্যে ব্লগ ঃ Vintage Indian Clothing
     পোস্ট কার্ডে কানন বালা, সৌজন্যে ব্লগ : Vintage Indian Clothing  

বাংলার সবাক ছবির যুগের শুরুতে গান ও সঙ্গীত প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণারত সুমিত দে জানাচ্ছেন, এই গায়িকা-নায়িকাদের যুগে শ্রম, শ্রেণী, রুচি সব কিছুরই নতুন বিন্যাস ঘটে। আর উনি এটাও মনে রাখতে বলছেন যে এই গান ও অভিনয় দুইই জানেন এইরকম নায়িকারা বাংলা চলচ্চিত্রের এই বিশেষ কালপর্বে এক স্টুডিও ইকনমির প্রয়োজনেও এসেছিলেন। নইলে ১৯৩৫  সালেই তো নীতিন বোসের সেই ঐতিহাসিক ছবি ‘ভাগ্যচক্র’ যার হাত ধরে ভারতীয় ছবিতে প্লেব্যাক সঙ্গীতের সূচনা হয়। তারপরেও কেন প্রযোজকরা চাইছেন অভিনেত্রী হবেন সঙ্গীতেও পারদর্শী? তবে কী পুঁজির ছক নিজের স্বার্থেই প্লেব্যাক সঙ্গীত বহুল ভাবে ব্যবহার করতে চাইছিলেন না? এসব একদিকে যেমন ফিল্ম ইকনমির খুব জরুরি প্রশ্ন। অন্যদিকে স্টুডিও যুগের এই সবাক ‘বই’ এর বাজারে গায়িকা-নায়িকারা নির্মাণ করেন বাঙালির রুচিশীল সিনেমার এক আদর্শ। সাহিত্যনির্ভর গল্প, শব্দ-প্রযুক্তির চমৎকার প্রয়োগ আর উপন্যাসের নায়িকার আদলে গড়ে ওঠা সিনেমার নায়িকারা নিয়ে আসেন বাংলা ছায়াছবির নতুন এক ভাষা। আর ফিল্ম-মেলোড্রামার চেনা গতি বদলে বদলে যেতে থাকে গায়িকা-নায়িকার অপেক্ষা, প্রেম, বিরহ ও আত্মত্যাগের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে।

(চলবে)

তথ্যসুত্রঃ

“দ্য মর্ডার্ন গার্ল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ডঃ আ রিসার্চ অ্যাজেন্ডা অ্যান্ড প্রিলিমানিরি ফাইন্ডিংস”, তানি ই বার্লো, প্রীতি রামামূর্তী, লিন ই থমাস এবং অন্যান্যরা, জেন্ডার অ্যান্ড হিস্টরি, ভলিউম ৭, সংখ্যা ২, অগস্ট ২০০৫।

“রিদমিক বডিস/মুভিসঃ ডান্স অ্যাস অ্যাট্রাকশন ইন আর্লি ফিল্ম কালচার”, লরেন্ট গুইডো,  মূলগ্রন্থ দ্য সিনেমা অফ অ্যাট্রাকশনস রিলোডেড, ২০০৬।

স্ক্রীন স্টাইলঃ ফ্যাশন অ্যান্ড ফেমিনিনিটি ইন নাইনটিনথার্টিস হলিউড, সারা বেরি, ২০০০।

সাক্ষাৎকারঃ সুমিত দে, স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড এস্থেটিকস, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে (নিউ দিল্লী) সিনেমা স্টাডিস বিভাগে গবেষণারত।

 

স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *