নায়িকার ভূমিকায়। অষ্টম পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য

0

উমাশশীর প্রথম ছবি ‘বঙ্গবালা’(নির্বাক)র ট্রেড শো-এর দিন নাকি নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অথচ সেই শোতেই উপস্থিত থাকা হয়নি উমাশশীর। ছবিতে উমা অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল সুবর্ণ। গরীব বাড়ির বাপ-মা মরা মেয়ে আর নানা রকম বাধা-বিপত্তির সঙ্গে তার লড়াই, এই নিয়েই ‘বঙ্গবালা’। ছবির একটি দৃশ্যে একটি খলচরিত্র সুবর্ণকে চুরি করে নিয়ে পালায় আর তার মোকাবিলা করতে ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সুবর্ণ দা নিয়ে ফুঁসে ওঠে। পর্দায় এই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে নাকি সুভাষচন্দ্র বসু খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন আর সিনেমা হলের বসবার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ওঠেন –

“আপনার মান রাখিতে জননী,
কৃপাণ ধরিল আপনি”।

উমাশশীর আজীবনের আক্ষেপ, নেতাজি যে ঐদিন আসবেন তা তাঁকে জানানো হয়নি! ইশ আগে থেকে জানলে কি আর তিনি ট্রেড শো-এর দিন উপস্থিত থাকতেন না?

‘বঙ্গবালা’র সাফল্যের পর উমাশশীর ডাক পড়ে মনোময়বাবুর পরের প্রযোজনা— নির্বাক ছবি ‘বিগ্রহ’তেও। ওঁর আত্মকথায় বিবরণ পাওয়া যায় সেই সময়ের আউটডোর শুটের! দল বেঁধে যাওয়া হয়েছিল কেষ্টনগর রাজবাড়িতে, আর মহিলা শিল্পীরা উঠেছিলেন নাট্যকার ডি এল রায়ের বাড়িতে। এরপর ‘গ্র্যাফিক আর্টস কোম্পানী’র ব্যানারে আরও একটি ছবি করেন উমাশশী, প্রফুল্ল রায় পরিচালিত ‘অভিষেক’। তার পরেই ডাক আসে ম্যাডানের প্রযোজনায় সবাক ছবিতে কাজ করার। জ্যোতিষ ব্যানার্জী পরিচালিত পৌরাণিক সেই ছবির নাম ‘বিষ্ণুমায়া’। কংস-বধের কাহিনী অবলম্বনে গল্প লিখেছিলেন কৃষ্ণধন দে। এই ছবিতে উমাশশীর ভূমিকা ছিল কংসের স্ত্রীর। ম্যাডানের এই ছবি ক্রাউন থিয়েটারে মুক্তি পায় ১৯৩২ সালের ২৫শে মার্চ। মূল ভূমিকায় অভিনয়ে ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী ও কানন দেবীর মত তারকারা, তার মধ্যেও নজর কাড়েন উমা।

প্রসঙ্গত অভিনেত্রী কানন দেবী ‘বিষ্ণুমায়া’য় পুরুষ চরিত্র কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এবং এটিই প্রথম নয়, এর আগে ১৯৩১এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রহ্লাদে’ও তিনি নারদের ভুমিকায় অভিনয় করেন। সৈয়দ হাসমত জালাল জানাচ্ছেন, সবাক ছবির (টকি) যুগের শুরুতে গান ও অভিনয় দুটোই জানেন এরকম পুরুষ অভিনেতা পাওয়া সহজ ছিল না, আার তখনও তো প্লে ব্যাক পদ্ধতিতে গান রেকর্ড শুরু হয়নি, তাই কানন দেবীর এই প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছিলেন পরিচালক জ্যোতিষ ব্যানার্জী। বস্তুত এই সবাক যুগের শুরুতেই গান ও অভিনয় দুইই জানেন এরকম নায়িকাদের চাহিদা বেড়ে যেতে থাকে উত্তরোত্তর। উমাশশী অভিনীত দ্বিতীয় সবাক ছবি ‘দেনা পাওনা’ প্রযোজনা করেছিল নিউ থিয়েটার্স। নায়ক-নায়িকা ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিভাননী দেবী। কিন্তু ছোট্ট পার্টেও চর্চিত হয় উমাশশীর গান। শিব-পার্বতীর একটি নাচগানের দৃশ্যে উনি পার্বতী সেজে গেয়েছিলেনঃ

“বাবা আপন ভোলা

মোদের পাগল ছেলে

তুই শশ্মানে থাকিস-

কেন মাকে ফেলে”

রাতারাতি সুগায়িকা উমাশশীর চাহিদা তৈরি হয়ে গেল ফিল্ম স্টুডিও গুলোয়। এরপরেই সেই বিখ্যাত ছবি যার জেরে টকি যুগ আরম্ভ হতেই তার একজন অন্যতম তারকা হয়ে গেলেন উমাশশী- নিউ থিয়েটার্সের ‘চণ্ডীদাস’!

 

নিউ থিয়েটার্সের ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩২) চলচ্চিত্রের প্রচারচিত্রে উমাশশী

 ‘চণ্ডীদাস’-এর কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উমাশশী বলেছেন দেবকী বসু যখন এই ছবির কাস্টিংএ ব্যস্ত ছিলেন কিছুতেই নায়িকা পছন্দ হচ্ছিল না ওঁর। এমন সময় একদিন চানী দত্ত এলেন উমার খোঁজে। বললেন দেবকী বাবুর এই ছবির জন্যে সুগায়িকা ও নায়িকার সন্ধানের কথা। খানিক খানিক ভয়ে ভয়েই উমা গেলেন দেবকী বাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তারপরতো দেবকী বাবু যে গানই গাইতে বলেন সেটাই চমৎকার গেয়ে শোনান। এভাবেই গানের পর গান চলতে থাকে। ওঁর গায়কীতে মুগ্ধ দেবকী বাবু নায়িকা নির্বাচনে বেশি সময় নেননি আর। ‘চণ্ডীদাস’এর হাত ধরে নতুন অধ্যায় শুরু হয় উমার জীবনে। কিন্তু চলচ্চিত্রে তারকা হয়ে ওঠার পথে থিয়েটারের অভিনয়ে ছেদ পড়ে। মিনার্ভায় অভিনয় অনিয়মিত হতে হতে বন্ধই হয়ে যায় এক সময়। একটা দুটো ছবিতে অভিনয় শুরু করার সময় রঙ্গমঞ্চও খানিকটা জুড়ে ছিল নায়িকা উমাশশীর জীবনে। কিন্তু যখন নিউ থিয়েটার্সের ‘স্থায়ী’ চুক্তিবদ্ধ পেশাদার অভিনেত্রী হয়ে যান উমা, রঙ্গমঞ্চ একেবারেই সরে যায়। মঞ্চের নায়িকা উমা থেকে শুরু হয় সিনেমার নায়িকা উমাশশীর পথ চলা।

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

“আত্মজীবনী” উমাশশী দেবী, নাচঘর, শারদীয়, ১৩৪২।

“এই আমি উমা থেকে উমাশশী” প্রথম প্রকাশ শারদীয়া আনন্দলোক, ১৯৭৮। পুনঃমুদ্রিত “সোনালি রুপালি তারারা” সম্পাদনা ও অনুলিখন শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, প্রতিভাস, ২০০৭।

“শূন্য থেকে সম্রাজ্ঞী” সৈয়দ হাসমত জালাল, বৈশাখী কানন দেবী সংখ্যা , ২০১৬-২০১৭।

 

স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *