অচেনা পিতৃভূমি, অজানা আত্মজন। তপন রায়চৌধুরী। মিহির সেনগুপ্ত-স্মরণে ‘সিদ্ধিগঞ্জের ভাটিকুমার’।

নন্দন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তপন রায়চৌধুরীকৃত ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’-এর আলোচনা– ‘অচেনা পিতৃভূমি, অজানা আত্মজন’। এই লেখাটি তার সংক্ষেপিত অংশ। মূল রচনাটি সুপ্রকাশ প্রকাশিত মিহির ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’-এর শোভন সংস্করণের পরিশিষ্টে মুদ্রিত হয়েছে। 
……………………………………………………………………………………………………….
তিন বছর আগে একটি অ-সাধারণ বই আমার হাতে আসে। বইয়ের নাম সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। লেখক– মিহির সেনগুপ্ত, যাঁর বর্তমান বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু জন্মস্থান পুবে– জেলা বরিশাল। বইটি অ-সাধারণ নানা কারণে, তবে প্রথম এবং সবচেয়ে স্পষ্ট কারণ– তার ভাষা। লেখকের বক্তব্য আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষায় কিন্তু কাহিনীর কুশীলবরা অধিকাংশ বরিশালের। অল্প কয়েকজন মধ্যবঙ্গ তথা খুলনা-যশোরের ভাষায় কথা বলেছেন। তাঁদের বক্তব্যর যথাযথ অনুলিপি বইটির প্রধান উপজীব্য। সে ভাষা শুধু পূর্ববঙ্গের অঞ্চল-বিশেষের ভাষা নয়, সেখানকার বঞ্চিত মানুষের ভাষা– দ্বিধাহীন, স্পষ্ট, শ্লীলতা-অশ্লীলতা জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। দীর্ঘদিনের পরিচয় না থাকলে সে ভাষায় দন্তস্ফুট করা অসম্ভব। তার তীব্রতা, আর্তি, দুনিয়াকে কেয়ার না-করা প্রাণশক্তি তাকে দৈনন্দিনতা থেকে উদ্ধার করে শিল্পের জগতে তুলে দেয়।
রচনাটি উপন্যাস নয়, লেখকের জন্মভূমি এবং পাশেই শ্বশুরালয়ের গ্রাম কীর্তিপাশায় অবকাশ যাপনের কাহিনী। আর সেই প্রসঙ্গে ওখানকার মানুষের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ছবি।
কীর্তিপাশায় আমাদের সাতপুরুষের ভিটা ছিল। সেই গ্রামের বাবুরা অর্থাৎ জমিদারগোষ্ঠী আমার পূর্বপুরুষ। স্থানীয় ভাগ্যহীন মানুষের স্মৃতিতে কীর্তিপাশার বাবুরা বেঁচে আছেন, তবে নায়ক না, খলনায়ক রূপে। কাহিনীর অন্যতম প্রধান চরিত্র– কথক
ছোমেদ বয়াতির বয়ানে সে কথা শুনুনঃ
মোগো গ্যাদা কালে আলহে যত রাজা জমিদার
ভগবতীর পূজা করতেন কাণ্ড অসুমার।…
বাবুরা সব কাণ্ড করত আচলইয়া কুচালে।।…
কাম নাই কায্য নাই খালি ফুর্তি করে।
কারণ অকারণে গরিব গুরবা ধরইয়া মারে।।
হাউস করইয়া বানাইছেন সোয়া হাত জুতা।…
ছোমেদের গ্যাদাকাল অর্থাৎ শৈশব-স্মৃতি আমার শৈশব-স্মৃতি থেকে ভিন্ন নয়। সোয়া হাত জুতার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখা। কিন্তু তার দাগ যে পুরুষানুক্রমে মানুষের মনে যন্ত্রণার ছাপ রাখে, এ কথা জানা ছিল না। জ্যেষ্ঠরা উদার মুহূর্তে বলতেন– চাষী-জেলের পরিশ্রমের অন্নেই আমাদের সাত পুরুষের শরীর পুষ্ট। পুণ্যাহের দিনে সস্তায় ভোজ খাইয়ে, খরার দিনে খাজনা মকুব করে, দুটো পুকুর কেটে, পরগণা সেলিমাবাদের প্রধান বন্দর ঝালকাঠি অবধি রাস্তা বানিয়ে সেই অন্নঋণ শোধ দেওয়ার চেষ্টা হতো। কিন্তু সেই উদারতার চিহ্ন দরিদ্র মানুষের স্মৃতিতে নেই, সেখানে সেই সোয়া হাত জুতাই এখনও সক্রিয়, বাবুরা আপোদ ভিন্ন আর কিছু নয়। যার অন্নে শরীর পুষ্ট সে তো নিতান্ত আত্মজন। কিন্তু বাবুসত্তার খাঁচায় বন্দী থেকে সে আত্মজনকে চেনার সুযোগ পাইনি। গ্রামের চাষা-জেলে, কাহার-মৃধা চারপাশে থেকেও অপরিচিতই ছিল। বাবুত্ব অদৃশ্য অথচ লৌহকঠিন দেয়াল ভেঙে দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছে আপনজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন মিহিরবাবু। তাঁর স্ত্রী কীর্তিপাশার মেয়ে, সেই সুবাদে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান প্রাকৃতজনের কাছে তিনি দুলাভাই, জামাই। এ প্রায় অসাধ্য সাধন।
পরগণা সেলিমাবাদ নদীমাতৃক দেশ। ইতিহাসের কোনো অজানা মুহূর্তে স্থানীয় ভাষায় যাদের হালিয়া দাস, জালিয়া দাস বলে, সেই হেলে চাষী আর নদী-সমুদ্র আশ্রয়ী জেলেরা এসে এখানে বন কেটে বসতি করেছিল। ক্রমে তাদের মাথার উপর শ্রমের অন্নের সিংহভাগের দাবীদার ভূস্বামী শ্রেণীর আবির্ভাব হয়। আর চাষা-জেলের এক অংশ ইসলামে শরিক হন। দেশভাগের আগে যে কীর্তিপাশা গ্রাম আমি চিনতাম, তার প্রধান বাসিন্দা হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণী– ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ। কেউ জমিদারের কাছারির কর্মচারী, কেউ বা ব্রহ্মোত্তর অথবা জমিতে নানা উপস্বত্বের অধিকারী। আর সমাজের নীচু সিঁড়িতে হিন্দু মুসলমান চাষী আর জেলে।
দেশভাগের তিরিশ-চল্লিশ বছর পরে, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল, এই ছ বছর পূজার সময় মিহিরবাবু নিজের গ্রাম এবং কীর্তিপাশায় ছুটি কাটান। সেই অভিজ্ঞতারই ছবি সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম ফকিরের বাসস্থান। পীর-ফকিরদের দরগায় মানুষ যায় গুরুর সন্ধানে, আত্মার শান্তির আশায়। পরগণা সেলিমাবাদের অখ্যাত গ্রামটির জীবনে সেই মোকামের সন্ধান পেয়েছেন মিহিরবাবু।
……………………..
ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত– জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রেই সে কথা জানেন। কিন্তু চন্দ্রদ্বীপের গ্রামাঞ্চলে সে গুহা যে কত গভীর, তার খবর দিয়েছেন মিহির। রাতে ঝড় হয়ে পূজার আঙ্গিনা থেকে ছাউনি উধাও। কীর্তিপাশার বাজারের হরিসভায় সরকারি বরাদ্দের টিন আছে। কিন্তু হরিসভার কত্তারা টিন দিতে নারাজ। কারণ? “ওহানে শ্যাখ, বিন্দু বেয়াকে একলগে খাওনদাওন করে, নাচে কোদে, ওয়া মোরা ভালো ঠেহি না।” বর্ধিষ্ণু কৃষক, কিঞ্চিৎ ‘আভোদা’ অর্থাৎ নির্বোধ জামাই মেম্বর মুশকিল আসানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। টিন শেষ পর্যন্ত আসে মীরহাডির মসজিদ থেকে।
সপ্তমীর রাতে ছোমেদ আলি বয়াতির জারিগানের আসর বসে, বাজনদার বংশীধারী কার্তিক।বয়াতির জ্ঞানে এসব গরিব মাইনসের গান। ‘দুঃকে’র কেচ্ছা। জারি গান তৈরি হয় বয়াতির ভাবের জোরে। বয়াতিরা নিম্নবর্গের মুসলমান, তারা লৌকিক দেবীদের বন্দনা না করে গান শুরু করে না, কারণ এরা কাঁচা খাউগ্যা। তারপর নবী, ভোলা মহেশ্বর, সরস্বতী— কেউ বাদ যান না। শ্রোতাদের ফরমাসে প্রথমে বেহুলার গান, পরে দুর্গা বিষয়ে।তার দেববন্দনায় অসুরও বাদ পড়ে না। তার গান যাদের জন্য তাদের ‘বুহের মইদ্যে বিষাদ বিক্ষের আকুলি বিকুলি’। সেখানে ধর্মাধর্ম জাতিভেদের জায়গা কই?
ছোমেদের শেষ গান এক স্থানীয় ট্র্যাজেডি নিয়ে। ওদেরই জীবিকাসূত্রে স্বজাতি নিকিরি দৌলত আর জালিয়াকন্যা সরস্বতীর রোমান্সের কাহিনী। বাপ-দাদা কর্মসূত্রে এক, এই সুবাদে রূপসী সরস্বতীকে সে দাবি করে ধর্মের বাধা না মেনে। সমাজের বাধা ভেঙে তাদের প্রেম জয়ী হয়। কিন্তু সে জয় ক্ষণস্থায়ী। প্রিয়ার অশ্রু উপেক্ষা করে সাগরে যায় দৌলত। দরিদ্র জালিকের এই বিপদ মাথায় না নিয়ে উপায় নেই। নদীর মোহনায় তার মৃত্যু হয়– ভেদবমি হয়ে। নিরুপায় বিধবা সরস্বতী পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌলতের হিন্দু সখা অষ্টের গৃহিণী হতে স্বীকার করে। দৌলত আর সরস্বতীর সন্তান কানাই আশ্রয় পায় নিঃসন্তান কার্তিকের ঘরে।
দৌলত-সরস্বতীর জীবনকথার অন্যতর পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ। ছোমেদের বয়ানে বুকফাটা আক্ষেপ– আয় আহা নিদারুণ দিন। সেই নিদারুণ দিনে ছোমেদরা বিভ্রান্ত। পাঞ্জাবি গায়ে, ঝোলা কাঁধে ভদ্র সন্তানরা জয় বাংলার বার্তা নিয়ে আসে। কিন্তু যেসব শহুরে মানুষের সঙ্গে তার মতো প্রাকৃতজনের কখনো ওঠাবসা নেই, তারা যদি হঠাৎ এসে বলেন, ‘মোরা তোমরা বেয়াকেই ভাই-ভাই, হে কতা নগদা নগদি বিশ্বাস যাই কেমনে?’ যুদ্ধ লাগলে এক একদল এক এককথা বুঝায়। সকলের হাতেই বন্দুক। তারপর খানসেনার আবির্ভাব। তখন–
লাশের উফার লাশ পড়ে খুনের উফার খুন
আসমানেতে উড়াইয়া বেড়ায় হাভাতইয়া হকুন
ঘর পোড়ে, গরু পোড়ে, পোড়ে মোগো হিয়া
মায়ের কোলে গ্যাদা পোড়ে দগ্ধিয়া দগ্ধিয়া
পানিতে মরিল দুশমন, জঙ্গলে মরিল
মসজিদে মন্দিরে দুশমন বেইজ্জত করিল
ছোমেদ বয়াতি ‘য্যান একদিন পেত্যক্ষ’ দেখলেন স্বয়ং আল্লা শয়তানদের মিনতি করে বলছেন, ‘ওরে তোরা থাম’ ‘হ্যারা হে কতা হোনলে না। গুল্লি দিয়া আল্লারেই মারইয়া ফ্যালাইলে
ছোমেদ মেয়ার কথায় বলি–
‘মানুষই মানুষকে মারে, মানুষই মানুষকে ধরে,
মানুষ ভাসায়, মানুষ ডোবায়, মানুষই সব করে।’
তারপরেও আছে, সব মানুষের শেষ ইচ্ছা–
মোরা য্যাত দুঃখ পাইলাম
মোগো বয়সের কালে
হে দুঃখ না থাকে য্যানো
সোনাগো কপালে
আর,
শোক আছে, দুঃক আছে
মোগো চিরকাল
উপোস কাপাসও আছে
প্যাডে হরতাল
তমো মোরা উচ্ছবের করি আয়োজন
বাচনের জইন্য তাহা অতি পেরোজোন
যে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি অনাহার-অর্ধাহারের মধ্যেও উৎসবে মাততে পারে, মিহিরের বিবরণে তারই জয়গান। এই অসামান্য কাহিনী বাঙালি পাঠকমাত্রেরই চেতনাগোচর হওয়া বাঞ্ছনীয়।
+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *