মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৮ । অথঃ শিক্ষা ব্যবস্থা । লিখছেন আদিত্য ঢালী

গত পর্বের পর…

বাচ্চা মেয়েটি নিজের টাকাগুলো হাতে নিয়ে আবার সোজা নারানদার কাছে গেল। নারানদা টাকাটা হাতে নিয়ে গুনে বলল “ঠিক আছে। চলে যা।” মেয়েটি উত্তরে বলল, “আপডেট হবে না?” নারানদা বলল, “মেশিন খারাপ আছে। আগামী সপ্তাহে আসবি। এখন হবে না।” মেয়েটি আর কথা বাড়াল না। ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি নারানদার দিকে তাকাতেই বলল “কী বলেছিলাম তো? ওকে বললেও ও পারবে না।” আমি একটু রেগেই গেলাম। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে সোজা নারানদার কাছে গিয়ে বললাম, “গাঁয়ের মোড়ল হয়েছ অথচ সরকারি টাকায় বাচ্চারা ঠিকমত লেখাপড়াটুকুও শিখতে পারছে না। অন্যের দোষ দেওয়ার আগে নিজেকেও কিছু করতে হয়।” নারনদা ফিক করে হেসে ফেলল। এই হাসির অর্থ আমি জানি। এবারে ও নিশ্চয়ই ওর ভান্ডার থেকে এমন কিছু ঘটনার বিবরণ দেবে যাতে করে জিত ওরই হবে। আমার ধারণা নারানদা কোনোদিনও হারতে পারবে না। যাদের জীবনে চাহিদা কম এবং ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না তারা কোনদিনও হারে না। নারনদাও তাই। ও নিজেকে এবং পরিবারকে চালানোর জন্য নিজেই একটা ক্ষমতার উৎস। তাই ক্ষমতার কাছে ওকে দালালি করতে হবে না বলেই আমার ধারণা।

চেয়ারটা নিয়ে আমার কাছে সরে এসে নারানদা বলল, “শুনুন তবে। সেই পঁচানব্বই সালের ঘটনা। স্বপন সাহা তখন ম্যানেজার। কেউ ফর্ম ফিলাপ করতে না পারলেই আমাকে হাঁক দিত — “নারান ওরটা লিখে দাও তো।” আমিও গটগট করে লিখে দিতাম। একদিন প্যান্ট সার্ট পরা এক ভদ্রলোক এসেছে ব্যাঙ্কে। ক্যাশিয়ার কী কারণে যেন ক্যাশ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এদিকে আমি তখন লোন ডকুমেন্ট ফিলাপ করছি। ম্যানেজারের কাছে ভদ্রলোক যেতেই ম্যনেজার হুঙ্কার দিয়ে আমাকে ডাকল। একরকম ভয়ই পেয়ে গেলাম। কি আবার হল। গুটিগুটি পায়ে ম্যানেজারের কাছে যেতেই ম্যানেজার ভদ্রলোক কে দেখিয়ে বলল, “ওনাকে চেনো?” আমি মাথা নেড়ে না বললাম। “উনি হলেন হাই স্কুলের মাস্টার। চিনে রাখ, এরপর থেকে যেন খুব সাবধানে কাজ করা হয়।” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কারণ আমি তো ওনার কোন কাজই করিনি তাও ম্যানেজার সাবধানে কাজ করতে বলছে কেন? আমি আমতা আমতা করে বললাম, “ম্যানেজারবাবু, কী ভুল হয়েছে?” আমার কথা শুনে ম্যানেজার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এরপর জিজ্ঞেস করছ কী ভুল হয়েছে? কতদিন হল তুমি ব্যাঙ্কে আছ?” আমি ধীর গলায় বললাম, “আজ্ঞে বারো বছর।” ম্যানেজার এবারে চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “বারো বছর ধরে তুমি কাজ করছ আর এই ভুলগুলো কি করে হয়?” আমি তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী ভুল?” ম্যানেজার এবারে টাকা তোলার ফর্মটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখ নিজের চোখে কী ভুল করেছ।” আমি ফর্মটা নিয়ে ফর্মটাকে দেখতেই আমার তাল একেবারে কেটে গেল। আমি সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কত টাকা তুলবেন?” উনি বললেন, “কেন, কুড়ি হাজার।” ওনার উত্তর শুনে আমি আবার ফর্মটার দিকে দেখলাম। কী আর বলব আপনাকে বুঝলেন। কুড়ি হাজার তুলবে তাকে ইংরাজিতে লিখেছে ‘টোয়েন্টি হানড্রেড’। এবারে শুধু তাই নয়। সেই বানান যে কী তা বলে বোঝাতে পারব না। ওরকম বানান আমি নিজেও জানি না। আমি ক্লাস এইট পাশ কিন্তু ওরকম বানান আমি নিজেও লিখতে পারব না। একজন স্কুল মাস্টার মাইনের টাকা তুলতে এসেছে। কুড়ি হাজার টাকা সে বানান করে ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড’ এটা লিখতে পারে না। এরাই তো শেখায় বাচ্চাদের। বুঝে নিন এবারে আপনি এরা কী শেখাবে আর বাচ্চারা কী শিখবে। এদের বাপ ঠাকুর্দা কেউ কোনদিনও স্কুলে যায়নি। পরিবারের প্রথম এরা স্কুলে যাচ্ছে। বাপ-মা তো কিছুই জানে না। কিছুই শেখাতে পারবে না। আর মাস্টাররা তো শুনলেনই কেমন। তো কী শিখবে আর এরা।”

আমি নারানদার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ম্যানেজারকে কিছু বললে না?” নারানদা ওর ঐ একই স্বভাবচিত হাসি হেসে বলল, “আমি আর কী বলব বলুন। আমি মাস্টারকে সাথে নিয়ে এসে নতুন ফর্ম দিয়ে নিজে হাতে লিখে দিলাম। মাস্টার আমার থেকে ফর্ম নিয়ে বলল, “আপনিই তাহলে এবার থেকে লিখে দেবেন। আমি তো অত ব্যাঙ্কে যাই না, নিয়ম কানুন কিছু জানিও না।” আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম ঠিক আছে। পরে বিকেলবেলায় ম্যানেজারকে যখন বললাম যে ওটা আমি লিখিনি তখন ম্যানেজার নিজেই বলল সে নাকি সেটা জানত। কারণ সে তো আমার হাতের লেখা চেনে। কিন্তু মাস্টারকে তো কিছু বলতে পারত না। তাই বাঁকা পথে আসলে মাস্টারকেই কথাগুলো শোনানোর জন্য আমায় বলেছিল। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার সময় নিজে হাতে জিলিপি কিনে দিয়ে গিয়েছিল ম্যানেজার আমায়।”

নারানদার সাথে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি কখন কাউন্টারের বাইরে লাইন পরে গেছে। একজন আবার হাঁকও দিয়ে দিয়েছে আমায়। ওনার আওয়াজ শুনেই তাকিয়ে দেখি চার-পাঁচ জন লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ফিরে কাউন্টারে ফিরে যেতেই একে একে সবাই ফর্ম দিতে শুরু করল। প্রত্যেকেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা তুলল। বুঝতে আর বাকি রইল না যে আবাস যোজনার টাকা ঢুকে গেছে। আজ এই ক’জন এসেছে, কাল থেকে আবার ভিড় বাড়বে। এ তল্লাটে এমনও শোনা যায় কেউ কেউ নাকি দুই সরকারের আমলেই আবাস যোজনার টাকা পেয়েছে এবং শুধু তাই নয় বাড়ি থাকার পরও নাকি দু’বার করে পেয়েছে। এই ঘটনার সত্যতা কতটা আমি তা যাচাই করিনি। তবে এইসব ছোটখাট ঘটনা। দেশ জুড়ে বড় মাছরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের কাছে এরা চুনোপুঁটি। এইসব ঘটনা আমায় আর বিব্রত করেনা। নেতামন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার ছবি দেখার পরও মানুষ যেভাবে সাদরে আবার তাঁদেরকেই নির্বাচন করে সেই থেকে আমার এটাই মনে হয় আমরা সাধারণ মানুষেরা আসলে এইসবেরই যোগ্য। আমাদের সার্বিক উন্নতি না হওয়ার জন্য আমরাই দায়ী। তাই নিজের দোষে তো অন্যকে দুষ্ট করা যায় না।

দুপুরের টিফিন টাইমে খেয়ে দেয়ে এসে দেখি মাস্টারদের লম্বা লাইন পরে গেছে। সবাই হাফবেলায় স্কুল থেকে চলে এসে চেক লিখেটিখে একেবারে রেডি। এদিকে আমি কাউন্টারে ঢুকে দেখি আমার ক্যাশে টাকা খুব একটা নেই। যেটুকু আছে তাতে এদের সকলের হয়ে যাবে। নতুন করে ভল্ট থেকে বের করতে হবে না। মুশকিলটা হল আমার কাছে যা আছে সবই ছোট অঙ্কের নোট। বড় অঙ্কের নোট নেই। তাই দিয়েই ম্যানেজ করে নেব ভেবে আর টাকা বের করলাম না। বেশ লম্বা স্বাস্থ্য ভালো এক ভদ্রমহিলা দু’জনের পর লাইনে এলেন। হাত বাড়িয়ে ফর্মটা দিলেন। এনাকে আমি আগে থেকে চিনি না। এতক্ষণ ভাবছিলাম হয়ত অন্য কাস্টমার মাস্টার নয়। কিন্তু চেকটা হাতে নিয়ে বুঝলাম, না ইনিও মাস্টার থুড়ি দিদিমণি। প্রতিমাসে এনার স্বামী চেক নিয়ে টাকা তুলতে আসেন। এই মাসে উনি আসেননি। ইনি এসেছেন তাই এনাকে চিনতে পারিনি। যথারীতি চেকটা নিয়ে মেশিনে আমার অংশের কাজ করে আমি চেকটা আবার ওনার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে ম্যানেজারকে দেখিয়ে বললাম, “ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যান।” উনি চেকটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমিও ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, উনিও আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিনিট খানেক তাকিয়ে থাকার পর বললাম “কিছু বলবেন?” উনি বললেন “টাকাটা?” আমি একটু জোর গলায় বললাম, “চেকটা নিয়ে ম্যানেজারের কাছে যান।” কী বুঝলেন জানি না। লাইন থেকে সরে গিয়ে অন্য একজন মাস্টারের কাছে গিয়ে কীসব কথা বললেন। তারপর দেখলাম সেই মাস্টারই ওনার চেকটা নিয়ে ম্যানেজারের কাছে গেল ওনাকে নিয়ে। ম্যানেজার সব কিছু দেখে ওনার কাজটুকু করে আবার আমার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা কাউন্টারের কাছে এসেই হাত গলিয়ে চেকটা ঢোকাতে লাগলেন। আমি তখন অন্য একজনকে টাকা দিচ্ছি সেইসময়ই। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “একজনের কাজ করছি তো, ওনারটা হোক আগে তারপর দেবেন!” আমার কথা শুনে হাতটা সরিয়ে নিয়ে টাকাটা দেওয়া হয়ে গেলে আবার হাত ঢুকিয়ে চেকটা দিলেন। আমি চেকটা নিয়ে আরেকবার দেখলাম। পঁচিশ হাজার টাকা তুলবেন উনি। সেইমত আমি আমার কাছে থাকা দুটো একশো টাকার বান্ডিল ও একটা পঞ্চাশ টাকার বান্ডিল ওনাকে দেওয়ার জন্য জানালার দিকে হাত বাড়ালাম। উনি টাকাটা না নিয়ে বললেন “বড় নোট দিন।” আমি টাকাটা পাটাতনের ওপরে রেখে বললাম “আমার কাছে বড় নোট নেই আজ।” উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “না না আমি ছোট নোট নেব না।” পঞ্চাশ টাকার বান্ডিলটা ফেরত নিয়ে একেবারে কুড়িয়ে কাচিয়ে যে কটা বড় নোট ছিল প্রায় সবগুলো দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করে ওনাকে দু’টো একশো টাকার বান্ডিলের সাথে দিলাম। উনি আবার সেই এক কথা বলতে লাগলেন, “ না না, আমি এত ছোটো নোট নেব না।” আমি বললাম “আমার কাছে যেটুকু ছিল সবটাই দিলাম, আর নেই আজ আমার কাছে।” গলার জোর বাড়িয়ে এবারে উনি বললেন— সরকার আমাদের জন্য সব টাকা পাঠাচ্ছে আর আপনারা আমাদের দিচ্ছেন না। আমি এত ছোট নোট নিতে পারব না।

ওনার কথা শুনে আমার মাথা গেল গরম হয়ে। কিন্তু নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বললাম-

— সরকার আপনাদের জন্য নোট পাঠায় না অ্যামাউন্টটা ভরে দেয় অ্যাকাউন্টে।  আপনাকে দেওয়ার জন্য কিছু পাঠায় না। আমার কাছে বাকিরা যেমন জমা দেয় তেমন নোট থাকে, সেই থেকে আপনারা যাঁরা টাকা তোলেন আমি দিই। যেমন নোট পড়ে তেমনই আপনারাও পাবেন। আর এই ব্রাঞ্চে এত টাকা জমা পড়ে যে টাকা নিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে না।

— না আমরা কি ফেলনা নাকি! স্কুল মাস্টার মানে আপনি কী বুঝবেন! আমাদের জন্য নিশ্চয়ই ভালো টাকা পাঠানো হয়, আপনারা দেন না।

— আমাদের রেখে দিয়ে তো লাভ নেই। বাড়ি তো নিয়ে যেতে পারব না বলুন। নিয়ে যেতে পারলে না হয় রেখে দিতাম। আর যা মাইনে পাই প্রতিমাসে এত টাকা একসাথে তোলার সৌভাগ্য কখনও হয় না।

আমার এই কথা শুনে ভদ্রমহিলা আরও রেগে গেলেন। সোজা ম্যানেজারের কাছে চলে গেলেন। আমি কাউন্টারে বসে শুনতে পেলাম ম্যানেজারকে উনি বলছেন, “ম্যানেজার স্যার, আমাদের জন্য কি ছোট নোট আসে বলুন! ক্যাশ থেকে সব ছোট নোট দিচ্ছে। আমি ছোট নোট নিতে পারব না।” ম্যানেজার ওনার দিকে না তাকিয়ে কাজ করতেই জবাব দিলেন “যেমন নোট থাকবে তেমনই তো আপনাকে দেবেন বলুন। নোট তো আর আলাদা পাবে না কোথাও। আপনার বড় নোট লাগলে আপনি কাল আসুন না। কাল একটু বেলার দিকে এলে পেয়ে যাবেন।”

উনি ম্যানেজারকে আর কিছু বললেন না। রাগে গজগজ করতে করতে আমার কাছে এসে বললেন “দিন। যা দেবেন তাই তো নিতে হবে না আমাদের।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। টাকাটা দিয়ে দিলাম। উনি ব্যাগে ভরে চলে গেলেন। কাউন্টার ফাঁকা হয়ে যেতে নারানদা এসে বলল “ সেই যে সকালে ছাত্রী এসেছিল আর দুপুরে দিদিমণি এল, বুঝলেন তো!” আমি নারানদার দিকে হাসলাম। কী আর জবাব দেব আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি। টাকা গুনে গুনে মেলাচ্ছি তখন। ম্যানেজার ভাউচার ফর্ম গুলো ভেরিফাই করছে। হঠাৎ ম্যানেজার আমায় হাঁক দিয়ে বলল, “দিদিমণির সাথে এত ঝগড়া করছিলে যে নিজেও দেখনি আর আমিও খেয়াল না করে ছেড়ে দিয়েছি। দিদিমণি যে থাউজেন্ড বানানে ‘ই’ লিখেছেন! এই নাও আলতো করে ঠিক করে দাও এটা।” আমি চেকটা নিয়ে এসে ‘ই’-টাকে ‘এ’ করে দিলাম।

(ক্রমশ)

আদিত্য ঢালী
লেখক | + posts

আদিত্য চলচ্চিত্র-বিদ্যার ছাত্র। নেশায় পাহাড়। মানুষকে দেখা, বোঝা ও আঁকার স্ব-ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর এই কলামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *