মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ১২ । দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস । লিখছেন আদিত্য ঢালী
দূরপাল্লার ট্রেনে স্লিপার ক্লাসে যাওয়ার সময় বিশেষতঃ যখন উত্তর ভারতের উপর দিয়ে ট্রেন যায়, গ্রীষ্মকালে যেমন প্রবল তাপপ্রবাহ চলে দিনের বেলা, তেমনি রাতের বেলাতে ভয় থাকে চুরির। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার আর সেই আলো চিরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে ট্রেন। সিগন্যাল না পেয়ে যখন অজানা যায়গায় বা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন রাতের ঘুম ভাঙলে বুক যেমন ভয়ে দুরুদুরু করে তেমনি দিনের বেলায় গরমে হাসফাঁস করে গোটা ট্রেন। ভোট নিতে যেখানে যেতে হল এবারে, সেখানে গিয়েও আমার অবস্থা খানিকটা এইরকমই হয়েছিল। টিমের সবাই যখন এল তখন প্রায় বেলা দু’টো। আমি পেট ভরে ভাত মাছ খেয়ে এসেছি। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। বড় একটা স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে বসলাম। যা যা দিয়েছে কাউন্টার থেকে সব কিছু মিলিয়ে নিতে হবে। কিছু নিতে ভুলে গেলে মহা মুশকিল। সব দেখে নেওয়ার পর এবারে পুলিশ নিতে হবে। পুলিশ ট্যাগ করাতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বুথের নাম ধরে ডাকা হল। প্রিসাইডিং অফিসার আর আমি গেলাম। একজন অল্প বয়স্ক ছেলে হাতে একটা লাঠি নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলল — “২৫৯ নং বুথ?” প্রিসাইডিং অফিসার বলল — “হ্যাঁ।” ছেলেটি বলল — “আমি আপনাদের সাথে আছি।” আমরা দু’জনের দু’জনের মুখের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ একটা গভীর দোটানার মধ্যে থাকার পর বুঝলাম আমাদের সাথে আমাদের সুরক্ষার জন্য যাকে দেওয়া হয়েছে সে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। সিভিক ভলান্টিয়ার কী তা আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি তারা খুব ভালো করে জানি। আর যাঁরা জানেন না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি — সিভিক ভলান্টিয়ার হল স্কুলের প্যারাটিচার বা কলেজের গেস্ট লেকচারার এর মতই। যাদের র্যান্ডামলি বাছা হয় কাজে নেওয়ার জন্য। এবং খুব স্বল্প বেতনে সমগ্র কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একটা বুথে ভোট করাতে এসে আমাদের সুরক্ষার জন্য মোতায়েন আছে মাত্র একজন, যার অস্ত্র বলতে শুধু একটা লাঠি।
বেলা গড়িয়ে তিনটে বাজার পর বাসের নম্বর দেওয়া হল। যে এলাকায় আমাদের পাঠানো হচ্ছে সেটা কেশিয়ারি থেকে আরও প্রায় কিলোমিটার পাঁচেক। আমাদের বাসে আমাদের সাথে আরও চারটে বুথের লোক। তারাও এই একই বাসে যাচ্ছে আবার ফেরার সময় এই একই বাসে ফিরবে। প্রতিটা বুথে লোক নামাতে নামাতে বাস চলল। গ্রামের মাটির পথ। কোনোরকমে হেলেদুলে ধীরে সুস্থে বাস এগিয়ে চলেছে দুলকি চালে। আমাদের বুথ সবার শেষে। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল তখন। বিশাল বড় হাই স্কুল৷ সেখানেই দু’টো বুথ। তার মধ্যে একটা আমাদের টিমের আর একটা অন্যদের। বাস থেকে নেমে নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে একটা উটকো বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এসে লাগল। এতটাই তীব্র সেই গন্ধ যে সারা শরীর যেন দুলে উঠল। প্রিসাইডিং অফিসার নাক কুঁচকে বলল- “নির্ঘাত কিছু একটা মরেছে৷” আমারও তাই মনে হল। আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই অবসরে বলে রাখি আমাদের মধ্যে প্রিসাইডিং অফিসার, সিভিক ভলেন্টিয়ার এবং আমি ছাড়াও আরো দুজন অফিসার এসেছে আমাদের সাথে। তারা যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পোলিং অফিসার। আমি প্রথম। আমাদের বুথে ভোটার প্রায় ১২৫০। প্রত্যেকের তিনটে করে ভোট।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর লোকাল যে ওয়াটার ক্যারিয়ার মানে আমাদের জল ও অনান্য কিছু প্রয়োজন হলে এনে দেবে সেই ছেলেটি এল। এসেই নাক কুঁচকে বলল- “ইসস! এতো ইঁদুর মরেছে সিওর।” প্রিসাইডিং অফিসার বলল — “আরে সে তো জানি, কিন্তু করব কী এখন?”
— দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি দেখছি। এই ঘরে তো বসা যাবে না। পাশের ঘরে বসতে হবে। চাবি নিয়ে আসি।” ছেলেটি বলল।
— ধুর পাশের ঘর বললেই হল নাকি! এই ঘরে সব কাগজ টাগজ লাগানো হয়ে গেছে।” প্রিসাইডিং অফিসার বলল।
সবাই এবারে মাথায় হাত দিলাম। কেউ কেউ তো হতাশায় বুক চাপড়াতে শুরু করল। কী হবে এবারে! এই সময় ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এল আমাদের সিভিক ভলিন্টিয়ার ছেলেটি। কোথাও থেকে সে লম্বা লম্বা গাছের ডাল জোগাড় করে এনেছে। সেটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করেছে একটা ঝাঁটা। মেঝেতে এত ধুলো পড়ে আছে যে ওই ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করতে এক ঘন্টা লেগে গেল। আমরাও হাতে হাতে পরিষ্কার করতে লেগে গেলাম। একদম লাস্ট বেঞ্চের কোণা থাকে মৃত ইঁদুরটিকে উদ্ধার করা গেল। বাইরে ফেলতেই চারটে কাক ঘিরে ধরল। এবারে আমাদের পরিষ্কার হওয়ার পালা। বারান্দা দিয়ে প্রায় ১৫০ মিটার হেঁটে গিয়ে বাথরুম। স্কুলের বাথরুম যেমন হয় ঠিক তেমনি। অপরিষ্কার, নোংরা, দুর্গন্ধময়। দেওয়ালে দেওয়ালে চক দিয়ে কোথাও ভালোবাসার বাক্য কোথাও স্যারেদের নিক-নেম। একদম মফস্বলের সরকারি স্কুলগুলো হয় ঠিক তেমনি। তবে এটা ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই স্কুল হওয়াতে প্রেম জানানোর কথাও লেখা আছে৷ আমাদের শুধু বয়েজ স্কুল হওয়াতে এসব থাকত না। নতুন নতুন গালাগালি শিখে সেসব লেখা হত আগে। কোনো স্যার যদি উদুম মার দিত তাহলে সেই স্যারের নামে বদনাম। দেওয়ালগুলো একটা আস্ত সময়ের দলিল বহন করত। সেসব সময় কবে পার করে এসেছি। এখন দেওয়ালে দেওয়ালে শুধু রাজনৈতিক শ্লোগান। আর কিছু নেই।
বাথরুমের দরজার ছিটকিনি নেই। যে মগটা রাখা আছে সেটা যে বহুবছর ধরে চলছে তা তার ভাঙা হ্যান্ডেল ও গায়ে পড়া শ্যাওলার বহর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। জলের গতি এত কম যে মগ ভর্তি হতে হতে বাথরুমের সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যাবে। প্রায় আধ ঘন্টা পর বাথরুমের কাজ শেষ করে যখন বাইরে এলাম তখন কলের জল শেষ হয়ে গেছে। বাথরুমের কাজ ঠিকঠাক হলেও মুখ হাত পা ধোয়া হয়নি। রুমে ফিরে এসে বলতে প্রিসাইডিং অফিসার ছেলেটিকে ফোন করল। পাম্প চালাতে হবে। এদিকে বিকেল গড়িয়ে এসেছে। সূর্যের তাপমাত্রা কমতে কমতে হঠাৎ করে অনেকটা কমে গেছে। মেঘ করে এসেছে। মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঈশান কোণ কালো হয়ে আসছে। বৃষ্টি শুরু হবে বলেই মনে হচ্ছে। যাক এতক্ষণে নিশ্চিন্তি। বৃষ্টি হলে একটু শান্তি পাবো। তাপমাত্রা অনেকটা কমে যাবে। সারাদিন গরমে যা হাসফাঁস করেছি তার থেকে নিস্তার মিলবে। রাতে একটু ভালো ঘুম হবে৷ এই ঘরে তিনটে ফ্যান। সেই ফ্যানগুলো ঘুরছে কেন আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। একদম ফ্যানের তলাতে দাঁড়ালেও যেটুকু সামান্য হাওয়া পাচ্ছে তাতে আমার একটা চুলও মাথার ওপর থেকে নড়ছে না। বৃষ্টি হলে গরম কমবে।
বলতে না বলতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে গেল। বাইরের আকাশ প্রায় অন্ধকার। ভোট নিতে আসার জন্য সবার ব্যবহারের জন্য যে ব্যাগটা দেওয়া হয় তাতে সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে মশা মারার কয়েল, কার্বলিক অ্যাসিড, মোমবাতি, দেশলাই সব থাকে। ওরা বোধহয় আগে থেকেই বুঝতে পারে কী কী অসুবিধেয় পরে ভোটকর্মীরা। তাই সব আগে থেকেই দিয়ে দেয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বোধহয় একেই বলে। বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই লোডশেডিং। মোমবাতি জ্বালিয়ে আমরা কাজে বসলাম। সিভিক ভলেন্টিয়ার ছেলেটি দেখলাম এক কোণায় মাদুর পেতে মশারি টানিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর আমরা প্রায় পাঁচ হাজার ফর্মে স্ট্যাম্প মারতে বসলাম আর প্রিসাইডিং লম্বা লম্বা কাগজ বের করে তাতে সব কিছু পূরণ করতে বসল। বাইরে তখন তুমুল হাওয়া দিচ্ছে। ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে দিয়েও মোমবাতির আগুনকে হাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের বেশ কসরতই করতে হচ্ছে। টিমটিম করে মোমবাতির আলোয় চোখ টানটান রেখে আমরা কাজ করে চলেছি অনবরত৷ এই স্ট্যাম্প মারা কখন শেষ হবে জানি না। এরপর আবার সমস্ত স্ট্যাম্পে সই করতে হবে। ঝামেলার যেন শেষ নেই! আর শেষ হবেই বা কীভাবে! গণতন্ত্রের প্রহসনে দাঁড়িয়েছে যে ব্যবস্থা তাতে ঝামেলা তো লেগে থাকবেই।
(ক্রমশ)