লাল রঙের দেশ মারয়ুল । পর্ব ৭। বনের গান। লিখছেন কৌশিক সর্বাধিকারী

0
“লোক হলে পাবনার, নেই কোন ভাবনার” — পাবনার লোকেরা কর্মঠ হয়, বোধ করি সেই কথা মনে করেই এই ছড়াটির উৎপত্তি। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল তৎকালীন পাবনা জেলার লাহিড়ীমোহনপুরের কাছে আগমোহনপুর গ্রামে। সেখানে আমি কোনদিন যাইনি। বাবার কাছে শুনেছি প্রচুর গাছে ঘেরা ছিল আমাদের ভদ্রাসনটি। ছোটবেলায় বাবা রোজ গাছে চড়ে পাখির বাসার ডিম গুণে আসতো, ডিম ফুটলে সাপ তাড়িয়ে পাখির বাচ্চা বাঁচাতো। বোধহয় সেই ছোটবেলার স্মৃতির ঘোরেই বাবা গাছ লাগাতে, বাগান করতে ভালবাসতো খুব। টবের গাছ নয়, জমিতে, মাটিতে লাগানো গাছ। যেখানেই যেতো নিজের হাতে গাছ লাগাতো। আমি খুব ছোট থেকেই দেখতাম অফিস থেকে এসে খুরপি, ছোট কোদাল নিয়ে সোজা চলে যেতো বাগানে। বয়স হয়ে যাওয়ার পরে গ্রীষ্মকালে গাছ মাটি ঘাঁটার জন্য বহুবার হাতে, গায়ে ভাল রকম অ্যালার্জি হয়েছে, তার উপরে ডায়াবেটিস – কিন্তু বাবাকে কিছুতেই নিরস্ত যেতো না। বাজার থেকে পাকা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়ো, উচ্ছে এসব এলে বীজগুলো শুকিয়ে রাখতো বাবা। আমের আঁটি, তালের আঁটি ভিজে জায়গায় ফেলতো। বাবার হাতে গাছ হতোও খুব ভাল। আম্বালায় তিনবছর পোস্টেড ছিলাম, সে সময় বাংলোর হাতায় খুব ঝকমকে দুটো কাঁঠাল গাছ করেছিল, বলত পরে যে আসবে সে খুব ইঁচড় কাঁঠাল খাবে। এমন কী হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েও বাবার বালিশের পাশে নিমফলের বীজের পুঁটুলি পেয়েছিলাম। ভাবতো সুস্থ হয়ে উঠে আবার গাছ লাগিয়ে বেড়াবে।
এখন সিঁথিমোড়ের কাছে যে আবাসনটায় সরকারি দস্তাবেজ অনুযায়ী আমার স্থায়ী ঠিকানা, সেখানে আমরা এসেছিলাম কুড়ি বছর আগে। আঠেরো বছর ধরে আবাসনের সামনে, রাস্তার ধারে, বিল্ডিংগুলোর মাঝে, আনাচে কানাচে বাবার লাগানো কত গাছ যে এখনও টিঁকে আছে, তা সব ঠিক করে জানিও না। তবে আমাদের ফ্ল্যাটের দক্ষিণের চারটে কদম গাছ, পশ্চিম দিকের তিনটে নিম গাছ আর উত্তরদিকের দুটো শিউলি গাছ, যখনই বাড়ি যাই, সবগুলো ডাল বাড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করে। বাবা-ই যেন হাত বাড়িয়ে ডাকে। চলে আসার সময় পিছন থেকে শুভেচ্ছা জানায়, আশীর্বাদ করে।
দু’বছর আগে লেহ-তে আসার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে এখানে কিছু স্থানীয় গাছ লাগাবো। রুক্ষ প্রকৃতি এবং শীতকালে চরম ঠান্ডার জন্য লাদাখে সব গাছ হয় না। বড় গাছের মধ্যে কয়েকরকম উইলো – মালচাং, সেলচাং, সোলচাং, ডোকচাং ইত্যাদি, দু’রকম পপলার – য়ুলাত আর য়্যারপা, অ্যাপ্রিকট বা চুলি আর আপেল বা কুশু। বড় ফুলের গাছ হিসেবে লাইল্যাক । লাদাখে সত্তরের দশক থেকে যেসব পশ্চিমী অভিযাত্রীরা আসতেন, তাঁদের অনেকেই লাদাখে অনেকরকম শীতকালে বেঁচে থাকবার মতো গাছ লাগিয়েছেন। সেসব গাছ কিছু বেঁচেও আছে। লেহ শহরের রাস্তায় পুষ্পাঞ্জলি বিছিয়ে দেওয়া লাইল্যাক আর আইরিস গাছ এমনই হালের আমদানি।
লাদাখে গাছ লাগানোর সময়কাল খুব সীমিত – মার্চ থেকে এপ্রিল মাস। এর বাইরে গেলে সে গাছ বাঁচানো খুব শক্ত। মার্চ মাসে দু আড়াই ফুট গর্ত খুঁড়ে তারমধ্যে অনেকটা সার দেওয়া মাটি দিয়ে কয়েক দিন রেখে, জল দিয়ে ভিজিয়ে তারপর এক একটা গর্তে তিন-চারটে করে উইলো বা পপলারের ডাল পুঁতে গর্তে ভালো করে গার্ডেন সয়েল ভরে দেওয়া হয়। এরপর প্রথম তিন মাস সকাল-বিকেল দুবেলা জল দিতে হয়, তারপর দিনে এক বেলা জল দিলেই চলে। শক্ত পাথুরে মাটিতে গর্ত খুঁড়তে এবং গাছ পোঁতার পর রোজ জল দিতে প্রচুর পরিশ্রম হয়। এই পরিশ্রম যাতে বিফল না হয় সেই জন্যই প্রতিটি গর্তে তিন-চারটে করে ডাল লাগানো হয় – অন্তত একটা তো বাঁচবে।
গতবছর প্রায় তিনশোটা গাছের ডাল লাগানো হলেও অভিজ্ঞতার অভাবে এবং করোনা পরিস্থিতিতে লোকাভাবে তার মধ্যে প্রায় একশোটা ডাল শুকিয়ে যায়। এবছর নতুন ডাল লাগানোর সময় সেজন্য আমরা খুব সতর্ক ছিলাম। গর্ত গুলো একটু বেশি বড় করে করা হয়েছিল, নিচে সার মাটি দিয়ে রোজ জল দেওয়া হতো, দিন দশেক পরে টাটকা ডাল লাগিয়ে সিন্ধু নদের ধার থেকে সরস মাটি এনে গর্ত ভরাট করা হয়েছিল। জল দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত লোককে কাজে লাগানো হয়েছিল। সবাই মিলে মনে মনে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম যে এ বছর আমরা একটা গাছকেও মরতে দেবো না। সবার চেষ্টায় সেই চ্যালেঞ্জ প্রায় সফল হয়েছে, সোয়া চারশোটার মধ্যে চারশোটার বেশি গাছ নতুন ডাল-পাতা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে রোজ। পাঁচমাসে প্রায় তিনফুট লম্বা হয়েছে গাছগুলো। সামনের মাসে মালচিং করে গ্যাপ প্লান্টেশন করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার জন্য তিনশো গর্ত খোঁড়ার কাজ অলরেডি সারা, এই মাসে আরও শ-দুয়েক গর্ত খুঁড়ে রেডি করা হবে। বাবার কথা মনে করে লাদাখে অন্তত হাজার গাছের বন তৈরীর সঙ্কল্প কিছুটা হলেও সফল করা হবে।
আমার বাসস্থান শহর থেকে একটু দূরে রুক্ষ জমিতে। চারপাশ উঁচু উঁচু শুষ্ক পাথুরে পাহাড়ঘেরা। লেহ শহরের জলের মূল উৎস খারদুং হিমবাহ থেকে আসা গ্যাংলাস টোকপো। শহরের মাঝবরাবর যেখান দিয়ে নালা বয়ে গেছে তার দুপাশ সজলশ্যামল – কিন্তু আমার বাসস্থানটি টোকপো থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এবং অনেকটা উঁচুতে বলে এখানে মাটির নীচের জলস্তর অনেক অনেক নীচে। দু-চারটে কষ্টসহিষ্ণু কাঁটাগাছ ছাড়া এখানে ঘাস অবধি জন্মায় না, বড় গাছ তো অনেক দূরের কথা।
এই পাথুরে জমিতে গাছ লাগানোর আগে কর্তব্য জমিটি একটু সরস করে তোলা। তাই শীতকালে নিজস্ব জলের খরচ কমিয়ে আরো কিছু অতিরিক্ত জলের ব্যবস্থা করে বিঘে খানেক জমির চারিদিকে আল দিইয়ে জলসেচ করবার ব্যবস্থা করলাম। প্রচন্ড শীতে সেই জল মাটির নীচে পালিয়ে যেতে পারতো না, বরফের শক্ত স্তর হয়ে জমে থাকতো। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা তিনমাস জল জমে বরফ হয়ে থাকলো। তারপর মার্চমাসে বরফ গলবার সময় সেই বরফ একটু একটু করে উপরের মাটিকে সরস করে তুললো।
এরপর পালা জমি তৈরির। মার্চের শেষে স্বেচ্ছাসেবীরা প্রথমে গাঁইতি দিয়ে কুপিয়ে জমি থেকে সমস্ত বড় পাথর তুলে ফেললো। ঢালু জমিটাকে তিনটি সমতল ধাপে ভাগ করা হলো। তার পর পাঞ্জী দিয়ে আঁচড়ে মাঝারি পাথরের টুকরো বেছে তুলে ফেলা হল। এইবার কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি ঝুরো করবার কাজ। এই কাজটি কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ, কারণ এই কোপানো ঝুরোমাটিকে এবার তারজালিতে ছেঁকে নিতে হবে যেন কোনও নুড়িপাথর না থাকে। ছেঁকে নেবার পরে যা পড়ে থাকলো তা কাঁকুরে মাটি আর বালির মিশ্রণ। এর সঙ্গে মেশানো হল প্রচুর জৈব সার আর স্থানীয় নার্সারি থেকে আনা গার্ডেন সয়েল। জমির চতুর্দিকে আল দিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থাও হল। এবার পরপর কয়েকদিন আবার এই জমিতে জল দিয়ে জলের ঢালান দেখে আবার জমিকে সমতল করার কাজ হল। আবহমান কাল ধরে এভাবেই লাদাখের মানুষেরা পাথুরে পাহাড়ি জমিকে চাষযোগ্য করে তোলেন। এখনও প্রতি বসন্তে এভাবেই কর্মঠ পরিবারগুলি এক-দুবিঘা করে ভূ-সম্পদ বৃদ্ধি করেন।
এই জমি তৈরির সময়ে একটা পুরোন অব্যবহৃত হাজার লিটারের সিনটেক্সের ট্যাঙ্কের নীচের তিন চতুর্থাংশ কেটে আমার বেডরুমের সামনে বাগানের মাঝে বসানো হয়েছিল, যাতে জল ভরে পশুপাখির জলপানের ব্যবস্থা করা যায়। জমির পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে লাগানো হল মালচাং গাছের সারি। চারকোণে চারটি স্ত্রী গোল্ডেন ডিলিশিয়াস আপেলগাছ, আর জমির ঠিক মাঝখানে তাদের সঙ্গে সমদূরত্বে একটি পুরুষ আপেলগাছ, যেন বায়ুবাহিত পরাগ সবকটি স্ত্রীগাছ সমান ভাবে পায়। একটি মালবেরিও লাগানো হল। গাছের ডালগুলো লাগাবার আগে জলের ট্যাঙ্কে এক সপ্তাহ ডুবিয়ে রাখা হলো। নদীর পার থেকে মাটিসুদ্ধ ঘাসের চাঙড় তুলে এনে বসানো হলো তৈরি জমির উপরে। আল বরাবর লাগানো হল দুইসার আইরিস বা তেসমা আর কয়েকটা কোৎসে।
এখন পাড়ার কুকুরদল তো বটেই, মাঝে মাঝে পাহাড় ডিঙিয়ে চরতে আসা জো-এর দলও বাগানে জল খেতে আসে। সন্ধ্যেবেলা জানলার পাশে বসে পড়াশুনো করতে করতে তৃষ্ণার্ত কুকুরের দলের চকচক শব্দে জল খাওয়ার আওয়াজ পেয়ে মন খুশি হয়ে ওঠে। দুর্দান্ত এবং ভীষণদর্শন টিবেটান ম্যাস্টিফ গোত্রের কুকুরগুলো জল খেয়ে চলে যাওয়ার সময় যে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, তা দেখে সব পরিশ্রম সার্থক মনে হয়।
জো-র দল অবশ্য শুধু জল খেয়েই ফেরে না, গুটিকতক পাতা আর ঘাসও খায়। বেশি খেতে পারে না, পিছন পিছন কুকুরের দল তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ঘাসজমিতে কিছু চাল ডাল ছড়িয়ে দেই, তাই খেতে পায়রার ঝাঁক এখনও পুরো বাগান না হয়ে ওঠা জমিতে চরে। ইউরেশিয়ান ম্যাগপাই আর হিমালয়ান লাল ঠোঁট কো এখন এখানে নিত্য অতিথি।
এইসব ছাড়াও ছেলেরা অফিসের সামনে একটা কুড়িফুট বাই পঁচিশফুট ঘাসের লন বানিয়ে দিয়েছে। একেবারে রুক্ষ কাঁকুরে জমি আগে পাথর বেছে কুপিয়ে চেলে সমান করেছে, তারপর নদীর ধার থেকে দেড়ফুট বাই দেড়ফুট, ছ’ইঞ্চি পুরু ঘাসের চাপড়া তুলে এনে পাশাপাশি সমান করে বসিয়ে রোজ জল দিয়ে, বালি ছড়িয়ে চারমাসে চৌরস লন বানিয়ে দিয়েছে। অফিসের সামনের বাকী জায়গায় পাঁচশো সূর্যমুখী গাছে প্রায় আড়াই হাজার ফুল হয়েছে। সূর্যমুখী গাছগুলোর তলায় ভিজে মাটিতে পোকা খেতে আসছে দলে দলে গিরগিটি। অসংখ্য বাম্বল-বী প্রাণপণে পরাগ খেয়ে চলে – একেবারে কাছে গিয়ে ছবি তুললেও ভ্রুক্ষেপ করে না। তেলে টইটুম্বুর ফুলের বীজ খেতে আসছে চড়াই, রেডস্টার্ট আর ব্লুথ্রোটের দল। লনের কোণে কোণে দুটো চারটে ম্যাগপাই ঘুরে বেড়ায় আজকাল, মাঝে মাঝে আসে রেড বিলড কো। সবমিলিয়ে একটা ছোটখাটো বাস্তুতন্ত্র যে চোখের সামনে গড়ে উঠতে দেখলাম, এটাই জীবনের একটা বড় সাফল্য এবং প্রাপ্তি বলে মনে হয়।
এই অঞ্চলে সূর্যালোক প্রচন্ড। যদি এই গাছগুলো বড় হয় তবে বৃক্ষাবরণ তৈরি হয়ে ভূমিজ জলের বাষ্পীভবন কমবে, মাটি সরস থাকবে। এই সরস মাটির উপরে ঝরা পাতা পড়ে সার তৈরি হবে। পাথুরে মাটি উর্বর মাটিতে পরিণত হবে। গাছে গাছে পাখি আর পোকামাকড়ের আনাগোণা বাড়বে। তাদেরই  প্রযত্নে এই মাটিতে অন্যান্য স্থানীয় প্রজাতির গাছ জন্মাবে, বড় হবে।
এত গাছ আমি নিজের হাতে লাগাতে পারিনি অবশ্যই, কিন্তু প্ল্যান করা, লোক লাগানো, সঠিক সময়ে গর্ত করানো, গর্তে গার্ডেন সয়েল দেওয়া, গাছের ডাল এবং কলম এনে তা ভিজিয়ে রাখা, সঠিক ভাবে সেগুলো লাগানো, রোজ নিয়ম করে জল দেওয়ানো… এইসবই আমার ভাবনা এবং রোজকার তত্ত্বাবধানে হয়েছে বলে এই গাছগুলোর প্রতি আমার একটা গভীর ভালবাসা তৈরি হয়ে গেছে। জানি কদিন পরেই লাদাখ থেকে চলে যাবো, তবু আশা আছে নিয়মিত জল দেওয়া এবং যত্নে ঘাটতি হবে না। চেষ্টা করব প্রতি বছরই একবার এসে দেখে যাওয়ার। পাঁচ বছর পরে জায়গাটার চেহারাই বদলে যাবে এমন আশা করাটা মনেহয় অবাস্তব কিছু নয়।
(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *