কাগজের নৌকো। পর্ব ১৭। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

0

পৌষ মাস, গঙ্গামুখচুম্বী এই প্রাচীন জনপদটি ভারি নির্জন, লোকবসতি পার হয়ে উত্তরে অল্প কিছুটা পথ হাঁটলেই দিগন্তপ্রসারী শস্যক্ষেতের মাথায় অনন্ত-আহ্বায়ী শূন্য আকাশ, তাল-খেজুর গাছের জটলা, পুরাতন ঝুড়ি নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াবট, বুড়া তেঁতুলতলা আর তার বামদিকে অতীত স্মৃতিকথার মতো বয়ে গেছে হিজল বিল–বৈকালে প্রায়দিন এখানেই এসে বিলের ধারে বসে থাকে সাম্য, সাম্যব্রত পাল, কলিকাতার ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে এই চৌরিগাছার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে রয়েছে, তাও আজ দুই বছর হয়ে গেল, উদ্যমী তরুণ সাম্যকে গ্রামের লোকজন ভারি ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, তবে শুধু ভক্তি দিয়ে তো আর সুচিকিৎসা হয় না, রক্তাল্পতায় জীর্ণ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র বড়োই অভাবী, ঠিক যেন দিন-আনি-দিন-খাই গেরস্ত ঘরের নিরুপায় গৃহিণী, তাই বলে কি তাদের উপবাসে দিন কাটে? না, ওই গৃহিকর্ত্রীর মতোই সাম্য ও তার একমাত্র সহকর্মি কম্পাউডার গিরিশবাবু দুজনে একসঙ্গে প্রাণপনে লড়ে যায়, যেটুকু উপকার হয় মানুষের, খুব খারাপ ফল হয় না, ইদানিং পোয়াতি মেয়েদের বাচ্চা হওয়া, শিশুর টীকা, ছোটখাটো অপারেশন, সাধারণ জ্বরজারি, টাইফয়েড, যক্ষা, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা, পুরুষ ও মহিলার বন্ধ্যাত্বকরণ–সবই হচ্ছে, শুধু সাপে কাটা রোগী নিয়েই যত সমস্যা, তাদের আট মাইল পশ্চিমে কান্দি মহকুমা হাসপাতাল বা সদর শহর বহরমপুরে পাঠাতে হয়, যাওয়ার পথেই অধিকাংশ রোগীর নাভিশ্বাস উঠে যায়, ভাগ্যবান দু-একজন হাসিমুখে ফিরে সাম্যকে নমস্কার করে বলে, ‘ডাকদার বাবু গোঁ, আপনে ছ্যালেন বলি পরাণডা বাঁচিলো!’, তবে অধিকাংশ মানুষই আর ফেরে না, ঠাঁই হয় সুরধুনীর শ্মশানে, হব্যবাহ চিতাধুমের রথে তাদের প্রাণপাখি নিয়ে কোন দূর মহাশূন্যে মিলিয়ে যান!

 

এখন ভরা পৌষ, নতুন ধান ওঠার পর চাষার সর্ষে ফলিয়েছে খুব, দিনান্তের আলোয় ঝিমঝিম উত্তরগামী বাতাসে পশ্চিমাকাশে রূপবতীর অলঙ্কারের কৌটো খোলার ক্ষণ আসন্ন, হিজল বিলের জলে একখানি অচঞ্চল পানসি পটচিত্রের মতো পূর্বদিকে ভেসে যাচ্ছে, বিলের একপাশে বিগতযৌবনা কাশের দল কিছু রয়ে গেছে, তবে তারা বড়োই বিবর্ণা, কতগুলি বক বিলের জলের দিকে তাকিয়ে পাকুড় গাছের মাথায় বসে রয়েছে, অল্পখানি পথ পার হয়ে হিজল বিল ডানহাতে একখানি প্রকাণ্ড বাঁক নিয়ে দৃষ্টিসীমার আড়লে চলে গেছে, ওইদিকেই সুরধুনী, ফেরিঘাট, বিলের পারে তৃণাবৃত জমির উপর বসে সাম্য একদৃষ্টে এই রূপজগতের পানে চেয়ে রয়েছে, কী আশ্চর্য এই জগত, এমন সুন্দর নাম কে দিল জলাশয়ের? হিজল বিল! আনমনে একটি সিগারেট ধরিয়ে ভাবল, বহুকাল পূর্বে, গঙ্গার ওপারের বাগড়ি অঞ্চল নাকি সমুদ্রতলে ছিল, ওদিকের এক গ্রাম থেকে ক’মাস আগে একটি জলহস্তীর মাথার খুলি প্রত্নতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেছেন, সেই কথা খবরের কাগজে ছাপাও হয়েছে, ওঁদের মতে সেটি নাকি কুড়ি হাজার বছরের পুরনো, তখন নিশ্চয় এসব অঞ্চলে বয়ে যেত নোনা বাতাস! তারপর কী বিচিত্র খেয়ালে সমুদ্র ক্রমশ সরে যেতে থাকল দক্ষিণে, ধীরে ধীরে বালুচর জেগে ওঠায় উঁচু হয়ে উঠল জমি, গাছপালা হল, মাটি উর্বর হয়ে উঠল, তারও বহু বৎসর পর লোকবসতি হল…কতদিন আগের কথা, তাই কি এই অঞ্চলে এত বিল, খাল, নদী, বাঁওড়? হয়তো এই জলাশয়গুলি এখনও সমুদ্রস্মৃতি ভুলে যেতে পারে নাই!

আনমনে একবার বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ভাসিয়ে সাম্য ভাবল, কোনওদিন কি আবার এখানে সমুদ্র ফিরে আসবে? কে জানে! হয়তো আসবে, হয়তো সাগর ভুলেই গেছে এদিককার কথা!

অবিনাশ থাকলে ভালো বলতে পারত! অবিনাশ! সে এখন আছে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে, চালসায়, কতকাল দেখা হয়নি! একটা চিঠি লিখতে হবে! একবার ওর কাছে ঘুরে এলে হয়, তার মতো সার্জারির হাত সচরাচর দেখা যায় না, ওটিরুমে স্ক্যালপেল হাতে যেন জাদুকর হয়ে উঠত! সেই কলেজবেলার ঝিলমিল দিনগুলি কেমন বাতাসে মিলিয়ে গেল, প্রফেসর বাসুর ক্লাস ফেলে মেট্রো সিনেমা, শ-পানশালায় বারো টাকা রামের গেলাস, আর শ্রাবণী? স্কটিশের শ্যামাঙ্গী মেয়েটি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছে দিনগুলি, চিবুকের ডৌলটি ছিল অপরূপ…তেমনই তো নিয়ম, চোখ আর কথার আড়াল হলেই মন ধীরে ধীরে শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে!পুরাতন স্মৃতি মুছে না-গেলে হয়তো মানুষ সেই পাহাড় মাথায় নিয়ে বাঁচতেও পারত না!

 

বেলা আর নাই, পশ্চিমে ছিন্নমেঘদলের পরনে রাঢ়দেশের রক্তমৃত্তিকার বসন, অস্তগামী আলো সুদূর অন্তরীক্ষ হতে ভুবনডাঙায় এক আশ্চর্য আখ্যান যেন বিছিয়ে দিয়েছে, হিজল বিলের নিস্তরঙ্গ জল, দিকচক্রবাল রেখা আর আকাশ অদ্বৈততত্ত্বের মতোই অভিন্ন–সেদিকে চেয়ে রইলে মনে হয়, বিচিত্রবর্ণা আকাশই হয়তো নদী আবার হিজল বিলকে কখনও মহাশূন্য বলে ভ্রম হয়, ঘাসঝোপ, তেঁতুলতলা, বটের ঝুড়ির আড়ালে আলোর সুর বাজিয়ে চলেছেন সেই অদৃশ্য জাদুকর, এমন দৃশ্য কতবার দেখেছে সাম্য, তবুও আজ তার মনে হল, কী অদৃষ্টপূর্ব এই রূপ, আনন্দভুবনে বেদনার ঠাঁই নাই, তাই হয়তো প্রতিক্ষণে সে নূতন হয়ে ওঠে।

উঠে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ির দিকে চাইল সাম্য, পৌষ মাসে বেলা সামান্য বড়ো হলেও সন্ধ্যার নূপুরধ্বনি শোনা যাচ্ছে, আজ সন্ধ্যায় চকহরিপুরের মাঠে মেলায় যাওয়ার কথা, এসব অনাড়ম্বর গ্রাম্য মেলা ভারি সুন্দর, ধীর পায়ে ঘাসজমির উপর রাখা সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেল সাম্য, হাসপাতাল লাগোয়া কোয়ার্টার এখান থেকে প্রায় মাইল দুয়েক হবে, যাওয়ার পথেই জোনাক-জ্বলা আঁধার জগত-উঠানে অভিমানী কাজলের রূপ ধরে নেমে আসবে।

 

হাসপাতালে প্রতিদিনের কাজকর্ম করে দেয় যে ছেলেটি তার বয়স বেশি নয়, সতেরো আঠারো হবে, জল তোলা, ঝাড়ু দেওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাই তার কাজ, জাতে বাগদি, নাম দীনবন্ধু, সবাই দীনু বলেই ডাকে, একমাথা কোঁকড়া চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, চোখ দুটি যেন কাজলে আঁকা, সরকারি পিওনের চাকরি, আয় তেমন মন্দ নয় তার উপর ভারি শৌখিন, বিকেলে সাইকেল নিয়ে যখন বাসগুমটির মোড়ে হাওয়া খেতে বেরোয় তখন একটু পুরনো দিনের বেলবটম প্যান্ট আর সাদা ডগ-কলার জামা থাকে পরনে, সাইকেলটির রূপও দেখার মতো, দীনবন্ধু বলে পক্ষীরাজ–হাতলের দুপাশে অডিও ক্যাসেটের রিল অশ্বপুচ্ছের মতো দোলা খায়, সামনের মাডগার্ডে মাধুরী আর পেছনে অমিতাভ বচ্চনের ছবি, সিটে মোটা গদি, দু’দিকে দুইখানি বেল, আবার সামনে একটি টর্চবাতি লাগানো, সে এক হইচই কাণ্ড, গঙ্গা থেকে ভেসে আসা আনমনা বাতাসের মাঝে প্যাডেলে চাপ দিয়ে মুখে শিস বাজিয়ে গান ধরে, চুম্মা চুম্মা দে দে চুম্মা!

এমনিও অমিতাভ বচ্চনের নাম শুনলে অজ্ঞান, একবার সাম্য মজা করে বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে, খুদা গ্বওয়া তো তেমন হিট হল না, এখন আর বচ্চন চলে না, বুঝলি! শাখরুক দেখবি বাজার কাঁপাবে!’

গোখরো সাপের মতো ফোঁস করে উঠেছিল দীনবন্ধু, ‘ওসব দুদিনের বরিগি, আসবেক, যাবেক, আর বচ্চন, বুজলেন সার, বচ্চন, ওর কতাই আলাদ! আরেক বারটো ফিরা “দিবার” দ্যাকেন তো, ও জিনিস আর হবেক লাই!’

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিজের ঘরে স্টেথো গলায় বসে সাম্য হাসির মাঝেই ক্ষণিকের জন্য ভেবেছিল, কী সেই রহস্য, যে কারণে বিগত প্রায় তিরিশ বছর ধরে রুপালী পর্দার এই প্রৌঢ় অভিনেতা নিজের আসনটি অগণিত মানুষের হৃদয়ে পেতে রেখেছেন! সামান্য হেসে বলেছিল, ‘তা বটে! কুলিও ভালো বল?’

–ও নাম আর লিলাম না সার, ওসব বই একবারই আসে!

টেবিলের উপর একটা ব্লাড রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে সাম্য জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তা তুই এত বই দেখিস কোথায়?’

চৈত্র বাতাসের মতো উন্মনা হাসি ফুটে উঠেছিল দীনবন্ধুর মুখে, ‘ক্যানে, সাঁটুইএ ভিডিও হল আচেক না, আর বড়ো বই লাগলি কান্দির ছায়াপথে যাই, সাইকেল লিয়ে পগার পার!’

–কান্দি তো অনেক দূর!

–তা দূর খানিক আচে, ও সাইকেল লিয়ে চলি যাই!

সহসা কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় সাম্য শুধিয়েছিল, ‘হ্যাঁ রে, হিজোল ঠাকুরাণি চক এখান থেকে কতদূর?’

প্রশ্নটি শুনে সামান্য অবাক হয়েছিল দীনবন্ধু, ‘সে ম্যালা দূর লয়, কিন্তুক উ গঞ্জ পার হলিই তো সাধু বাবার ডেরা, তারপর নিকষ জঙ্গল! আপনে যাবেন?’

–ওই চকের জঙ্গলের একপাশেই ইন্দ্রজিৎ, কুমার ইন্দ্রজিতের বাড়ি, বুঝলি! ওর কাছে একবার যেতে হবে!

–সে কে বটেক সার?

সরল জিজ্ঞাসায় হেসে ফেলেছিল সাম্য, ‘এক জাদুকর, বুঝলি, খুব বড়ো এক জাদুকর!’

 

চৌরিগাছার পুরাতন জমিদারবাড়ি পার হয়ে দত্তদের শরিকি দীঘির বাম হাতে হাটপাড়ার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গ্রাম্য বধূর মতো পথখানি ধরে আধ মাইল হেঁটে এলেই বুড়াশিবের মন্দির, তার পাশেই চড়কতলার মাঠ, ওখানেই ঝুমঝুম মেলা বসেছে। এই পৌষ মাসে গ্রামের লোকজনের হাতে ধানবিক্রির কাঁচা পয়সা থাকে, আর এবছর ভালো ধান হওয়ায় মেলাখেলাও বেশ জমে উঠেছে! হু হু বনবন নাগরদোলা, সারিবন্দী তেলেভাজা মিঠাই,মেয়েলি কাচের চুড়ি-ঝুটো গয়নার দোকান, খেলনার পশরা, হরেক মাল সাড়ে-ছ-টাকার দোকানে ভিড় উপচে পড়ছে, ভটভটি চালানো সাদা আলোয় থিরিথির আঁধার গাঁয়ের দুই চোখে যেন ঝিলিমিলি, ঘোমটা টানা শান্ত তন্দ্রাচ্ছন্ন সেই চিরকালের সন্ধ্যা জোনাক পোকাদের নিয়ে সামান্য দূরে সরে গেছে, হয়তো সুরধুনীর ঘাটে অথবা শীতার্ত হিজল বিলের পাশে মুখ নিচু করে সে বসে রয়েছে! তবে চড়কতলার মাঠ আজ সরগরম, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকের স্বর–নটরাজ সার্কাসের নাইট শো শুরু হতি চলিছে, আসেন, আসেন, সামনে টিকিট দশটাকা, প্যাছনে পাঁচ পাঁচ! একদিকে ভিডিও হলের তাঁবু, তার সামনে মৌমাছির মতো মানুষের ভিড় আর একেবারে মেলার শেষে মাঠের কিনারায় পাতা মিশিকালো মাঝারি আয়তনের তাঁবুটি দেখলেই বুকের ভেতর ছমছম করে ওঠে, সামনে হ্যাজাকের আলোয় একজন সিড়িঙ্গে চেহারার লোক টিকিট বাক্স নিয়ে বসে আছে, ভিড় যে খুব বেশি তা নয় আবার একেবারে জনশূন্যও বলা চলে না, তাঁবুর উপরে হাতে আঁকা একখানি পোস্টারের উপর হ্যাজাকের আলো এসে পড়েছে, কালোর উপর লাল হরফে লেখা একটি মাত্র বাক্য–কুমার ইন্দ্রজিতের বিচিত্র ভোজবাজি; অন্যান্য জাদুখেলার তাঁবুর মতো জাদুকরের ছবি, নারীমুখ, জনপ্রিয় খেলার নাম কিছুই নাই! এদিকে ভটভটির আলো এসে পড়েনি, ফলে হ্যাজাকের আলো আর তার পেছনে গহিন আঁধারে জায়গাটি থমথমে ও ঈষৎ রহস্যময় হয়ে উঠেছে।

 

মেলার মাঠে পা দিয়েই সাম্য দীনবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই তো এখন সিনেমা দেখবি, নাকি?’

দীনুর পরনে আজ একখানি সাদা জামা আর সাদা প্যান্ট, মাথার চুলগুলি জলে ভিজিয়ে টান করে পাতা, সস্তার আতরের গন্ধে সারা শরীর ভরপুর, সাইকেল একহাতে ধরে হেসে বলল, ‘চলেন সার, আগে এক পাক লাগাই নে, তাপ্পর বই দ্যাকতে যাব আর শ্যাষ রাতে যাত্রা!’

মেলা ভিড় থইথই, উজাড় করে গাঁ-গঞ্জের মানুষ এসেছে, তারপর আজ রাত দশটা থেকে সরকার বাবুর যাত্রাপার্টির অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘বরিশালের বর আর বর্ধমানের কনে’ পালা রয়েছে, প্রখ্যাত অভিনেতা চিন্ময় আর জুঁই রায়ের শো, চলচ্চিত্রের অভিনেতাকে চোখের সামনে দেখার জন্য এইদিকের মানুষের উৎসাহের অন্ত নাই, বারংবার মাইকে অভিনেতার আসার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে।

একপাশে অস্থায়ী আটচালায় সাইকেল দুটি জমা রেখে দীনুর সঙ্গে পায়ে পায়ে গ্রাম্য মেলা অবাক হয়ে দেখল সাম্য, সে আজন্ম দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে বড়ো হওয়া মানুষ, এসব গাঁয়ের মেলাখেলা কখনও চোখেও দেখেনি, শালপাতায় আলুর চপ আর গরম রসে ফেলা গজা খেল, বেশ খেতে, চারপাশে তরুণী যুবতির দল কাচপোকার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের নিরন্তর কলকলে কান পাতা দায়, সাম্যর সঙ্গে দু-একজনের চোখাচোখি হতেই ঘোমটা টানা হাসি মুখে এনে চোখ নামিয়ে নিল, ভারি লজ্জা তাদের! অবশ্য সাম্যকে আশেপাশের গাঁয়ের লোকজন চেনে, ডাক্তার হিসাবে তার খ্যাতি এই অঞ্চলে মন্দ নয়।

 

দীনু ভিডিও হলের দিকে চলে যাওয়ার পর একা একাই এদিক-ওদিকে ঘুরছে সাম্য, আজ ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ, মেলার ভেতরে আলো ও ভিড়ে তেমন বোঝা না গেলেও মাঝে মাঝেই শিমশিম উত্তুরে বাতাসে টাল খেয়ে উঠছে শরীর, গলায় মাফলারটি ভালো করে জড়িয়ে নিল সাম্য, মাথার উপর দিকবসনা কোনও অপরূপা যেন তার সহস্র চুমকি বসানো ঝিকিমিকি শাড়িখানি বিছিয়ে দিয়েছে, আজ চন্দ্রদেব নাই ফলে নির্মেঘ পৌষ মাসের আকাশে অলীক সুরধুনী স্পষ্ট, এই জগতের মানুষ ওই উজ্জ্বল শ্বেতকায়া নদীর নাম দিয়েছে আকাশগঙ্গা! ছেলেবেলায় কলকাতার আকাশেও একেকদিন দেখা যেত ছায়াপথ, ভারি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত সাম্য, কলেজে পড়ার সময় একবার অবিনাশের সঙ্গে পুরুলিয়ার আনাড়ায় টিলা পাহাড়ের দেশে গিয়েছিল, রাত্রে গহিন আঁধারে বসে আকাশগঙ্গার পানে চেয়ে অবিনাশ বিস্মিত গলায় বলেছিল, ‘কী আশ্চর্য দেখ সাম্য, কত নক্ষত্র, ওদের কেউ হয়তো আর এখন জীবিত নাই, শ্বেত বামন অথবা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়েছে, রূপ নাই আলো নাই শুধু এক অমোঘ অন্ধটান, প্রাণস্পন্দী আলোও সেখানে বন্দী…আকাশে আমরা দেখছি অতীত, আলো আসতেই হয়তো সময় লাগে কয়েক হাজার বছর, শেষ আলো এখনও এসে পৌঁছায়নি, তুই-আমি এই বর্তমান কালে বসে রইছি আর আলো আসছে অতীত থেকে! কী বিচিত্র এই জগত, বল!’

বিস্ময়াভূত সাম্য কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা বলতে পারেনি, তারপর মৃদু গলায় অতি প্রিয় একটি গান শুরু করেছিল, ‘তারকা রবি শশী খেলনা তব হে উদাসী, পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে, রাশি রাশি, নিত্য তুমি হে উদার, সুখে-দুখে অবিকার!’

সেই তলতলে কৃষ্ণ নিশীথে আদিম মালভূমির সানুদেশে দিগন্তপ্রসারী ঝিমঝিম শাল-জঙ্গলের মাঝে ক্ষুদ্র তাঁবুর মধ্যে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা আজও ভুলতে পারে নাই সাম্য, মাঝে মাঝে ভেসে আসছে শিয়াল কি কোনও রাতচরা পাখির আর্তনাদ, তাঁবুর বাইরে অভিমানিনীর অন্তঃসলিলা বেদনার মতো জ্বলছে অগ্নিশিখা, লেলিহান শিখা থেকে বাতাসে লাফ দিয়ে সহস্র অগ্নিকণা প্রতি মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণকায় আঁধারে, এমনই পৌষ মাস ছিল সেদিন, রাত্রি আরও ঘন হলে অবিনাশ তাকে শুনিয়েছিল এক আশ্চর্য আখ্যান, জাদুকর গণপতির কথা, ক্ষীণ নিরাসক্ত কণ্ঠে হব্যবাহর পানে একদৃষ্টে চেয়ে বলেছিল, ‘জানিস সাম্য, আমার জন্মের সঙ্গে ওই অদ্ভুত জাদুকরের কোনও সম্পর্ক রয়েছে!’

বিস্মিত সাম্য প্রশ্ন করেছিল, ‘মানে? তুই জানলি কী করে? কাকু-কাকিমার মুখে শুনেছিস?’

কোনও উত্তর না-দিয়ে চুপ করে গেছিল অবিনাশ, তারপর কয়েক মুহূর্ত পর স্বগতোক্তির ঢঙে বেজে উঠেছিল, ‘আমি জানি! আমি জানি!’

তারপর থেকেই কোন বিচিত্র উপায়ে জাদুর প্রতি খুব আগ্রহ জন্মায় সাম্যর, নিজে দেশি বিদেশি বইপত্র কিনে প্রচুর পড়াশোনাও করেছে, দু-চারটি সহজ হাতসাফাইয়ের খেলাও দেখাতে পারে, সন্ধ্যার মুখে এই গ্রাম্য মেলায় আসার কারণও তাই, জাদুকর ইন্দ্রজিৎ, চৌরিগাছায় এসে অবধি তার সন্ধান করছে সাম্য, আজ বোধহয় মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে। পায়ে পায়ে মেলার শেষ প্রান্তে জেগে থাকা সেই রহস্যময় ভোজবাজির তাঁবুর পানে একাকী এগিয়ে গেল সাম্য।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *