পুনর্ভবাপুত্র। ত্রয়োদশ পর্ব। আরেক প্রস্থ ইশকুল। লিখছেন আহমেদ খান হীরক

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।

আমরা ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এবি হাইস্কুলের মাঠে।

আজ এসএসসির রেজাল্ট। রেজাল্ট হবে বিকাল সাড়ে চারটায়। আমরা স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়েছি দুপুর একটা থেকে। আমাদের মুখ শুকনা। আকাশের মতোই ঘনঘোর আমাদের মনের অবস্থা। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় আকাশ তবু কিছুটা নির্ভার হতে পেরেছেআমাদের সেই অবস্থাও নেই। একটু পর পর খুব অদ্ভুত অদ্ভুত খবর আসছেকেউ বলছেএবার ঝেড়ে ফেল করেছে সবাই। এবি স্কুলের ইতিহাসে নাকি এত খারাপ রেজাল্ট আগে হয়নি। আমাদের মুখ করুণ থেকে করুণতর হয়ে যাচ্ছেফেল করলে আমাদের ভবিষ্যত কী হবে ইত্যাদি কিন্তু আমরা ভাবছি না। আমাদের ভাবনা সবটাই পরিবার আর সমাজকেন্দ্রিক। ফেল করলে বাড়ির লোকজন কী বলবেপাড়াপ্রতিবেশীরাই বা কী বলবেএক বছরের জুনিয়র সোমারা নিশ্চয় খুব হাসাহাসি করবেপ্রাইমারি লেভেলের বান্ধবী ছন্দাশাহিদারাও নিশ্চয় মুখ টিপে হাসবে। ছন্দাশাহিদাদের স্ট্যান্ড করা লেখাই আছে ধরতে গেলে। কিন্তু আমাদের… আমাদের কী হবে?

এই যে এতক্ষণ ‘আমাদের’ ‘আমাদের’ বলে চিৎকার করছি এই ‘আমরা’ আসলে কারা?

এবি হাইস্কুল এলাকার বিখ্যাত সরকারি স্কুল।

এই স্কুলের সরকারি হওয়া নিয়েও বেশ জোরালো একটা গল্প চালু আছে। আর গল্পের কেন্দ্রে আছেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ।

১৯৮৮ সাল।

বন্যায় ভেসে গেছে সারা দেশ। রহনপুরও তার ব্যতিক্রম না। রহনপুর উঁচু বরেন্দ্র এলাকা বলে আমাদের ঘরে ঘরে পানি ঢোকেনি হয়তকিন্তু চারপাশ আমাদের পানি নাগপাশের মতোই ঘিরে রেখেছে। এর মধ্যে একদিন শুনতে পেলাম এরশাদ আসবেন!

আমি তখন ছোট। বোধহয় হাফপ্যান্টও ছাড়িনি। রাজনীতির কিছু বুঝিটুঝি না। (অবশ্য এখন ফুলপ্যান্ট হওয়ার পরও বুঝি না।এরশাদ আসবেনপ্রেসিডেন্ট আসবেন এ খবর তবু আমাকে স্পর্শ করে গেল। কী জানি এক অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল আমার মধ্যে। তবে এখন মনে হয় এরশাদ আসায় যত না খুশি হয়েছিলাম তারচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম এই শুনে যে তিনি আসবেন হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টার তখনও চর্মচোখে দেখিনিকোনওদিন যে সত্যি দেখতে পাব এই বিশ্বাসও রাখিনিকিন্তু প্রেসিডেন্ট আসার খবরে হেলিকপ্টারের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে ফেললাম— গটগট করে একটা হেলিকপ্টার যেটার মুখ টিয়া পাখির মতো ছুঁচালো সেটা এসে আমাদের নারকেল গাছকে চক্কর মেরে আমাদের ছাদের ওপর বসে পড়ল। আর হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল থান্ডার ক্যাটস। আমি স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলামথান্ডার ক্যাটস থান্ডার ক্যাটস!

আর সেদিন চিৎকার হচ্ছিল এরশাদ এরশাদ নাম নিয়ে। এবি স্কুলের মাঠ। মাঠে জনতা সয়লাব। আমি আব্বার আঙুল ধরে গিয়েছি মাঠে। এত মানুষ আর কোনওদিন দেখিনি। আমার দারুণ ভয় করছিলবারবার জাপটে ধরছিলাম আব্বাকে। এরকম সময় মাথার ওপর গটগট আওয়াজ। একটা বিরাট ফড়িং যেন উড়ছেচক্কর কাটছে মাঠটা। এরশাদএরশাদ!! আবার চিৎকার… কিন্তু নাএই হেলিকপ্টারটা নামল না মাঠে। উড়ে চলে গেল দূরে। মাঠময় গুঞ্জন— নামবে নাএরশাদ নামবে না এখানে… কোনও ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়!

কী ঝামেলা?

কত কিছুরই তো ঝামেলা হতে পারে?

হেলিকপ্টারটা হয়ত মাঠে নামতে পারে নাহয়ত পানিতে নামবেম্যাকগাইভারে এরকম একটা হেলিকপ্টার দেখা গিয়েছিল অবশ্য। হেলিকপ্টার জঙ্গলের ভেতর পানিতে নামে।

কিছু মানুষ সাথে সাথে হইহই করে মাঠ ছেড়ে পুনর্ভবার দিকে দৌড় দিল। পানি থইথই পুনর্ভবা। এই পানির ওপর হেলিকপ্টার নামলে ডুবে যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকল। কিন্তু হেলিকপ্টার আসার নাম নেই। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার একটা চিলকে হেলিকপ্টার মনে করে নিল সবাই। তাতে হইহই বাড়ল কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু এরশাদের হেলিকপ্টার আর আসে না!

অনন্ত সময় কেটে গেল যেন। কেউ কেউ খুবই বিরক্তিকেউ কেউ হতাশ— নাহএরশাদ বোধহয় আসবেন না এখানে!

কিন্তু কেউ নড়ল না একচুল। আমরাও নড়লাম না। এরপরএরশাদএলেন। গটগট গটগট গটগট শব্দ তুলে এরশাদের হেলিকপ্টার মুহূর্তে নেমে এল মাঠের ওপর যেখানে গোল করে চুন দিয়ে দাগ দেয়া আছে।

মুহূর্তেই চারিদিকে সতর্ক অবস্থা। পুলিশের হুইসেল। মানুষজনের উন্মাদনা। এসব ঠেলে এরশাদ তার জন্য তৈরি মঞ্চে উঠলেন। ভাষণ দিলেন।

এখানে একটা ঘটনা ঘটল। আর সেটা হল এরশাদের মঞ্চে ওঠার পরপরই তাকে বরণ করে নেয় এবি স্কুলের ছাত্ররা। কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও ছিলকিন্তু কোনও কারণে এগিয়ে থাকল এবি স্কুলই। আর তারপর— কূটনৈতিক কারণে এগিয়ে থাকার কারণেই— ঘোষণা এল এবি স্কুলের।

কিসের ঘোষণাসরকারিকরণের ঘোষণা।

এই ঘোষণার আগে এলাকার সবাই জানত সরকারি হতে চলেছে কলেজ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদের মুখের কথাই আইন। ফলে এবি স্কুলই সরকারি হয়ে গেল। আমাকে আব্বা ঘাড়ের ওপর তুলে দেখালেন এরশাদকে। আমি অনেকগুলো কালো কালো কালো মাথার মধ্যে একটা লোককে দেখলাম। বুঝতে পারলাম না সে জনই এরশাদ কিনা!

এরশাদকে চিনতে না পারলেও এরশাদের এক মুখের কথায় করে দেয়া সরকারি স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে আর আমাদের সবার বুক ঢিপঢিপ করছে। আজ রেজাল্ট। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এবি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কুখ্যাত ছাত্ররা। আমাদের কুখ্যাতি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পাড়ায় পাড়ায়বাড়িতে বাড়িতে। –বাড়ির অভিভাবকেরা আমাদের দেখিয়ে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন— বলতেনআর যাই করো ওদের মতো হইয়ো নাওরা বদমাইশের বদমাইশ… শয়তানের শয়তান!

আর স্কুলের শিক্ষকেরাও আমাদের কঠিন শাসনের মধ্যে রাখতেন। কঠিন শাসনতবে একটু যেন বাড়তি ভালোও বাসতেন আমাদের। বাবামা যেমন তার দুষ্ট সন্তানটিকে বকাঝকার ওপর তো রাখেনই কিন্তু একটু বাড়তি স্নেহও করেনতেমন।

আমাদের জোট তৈরি হয়েছিল ক্লাস সিক্সেই। আমরা ক’জন— হিমেলমনিশফিকুলআমি প্রাইমারি লেভেল থেকেই বন্ধুইয়ার তো ছিলামই। আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল ডালিমরিটুসোহেলসহ আরও কয়েকজন। আমরা ছিলাম একাধারে বাথরুম চিত্রশিল্পীখেলার মাঠের অ্যারেঞ্জারহোস্টেলের বহিরাগতকোণায় দাঁড়ানো সিগারেট ফুঁকানো বাজে ছেলে ও ওই কাচা বয়সেই মাসুদ রানার মতো দুর্ষর্ষ নোংরা (!) বইয়ের পাঠক। আমরা দারুণ মিথ্যা বলতে পারতামচোখকান লাল না করেই। আমরা ভয় দেখাতে পারতাম অন্য ছাত্রদেরহুমকি দিতে পারতাম জোরালোভাবে… ফলে আমরা কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলাম। আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে তাস পেটাতেমআম চুরি করতে যেতামখানের ভিডিও দোকানে গিয়ে থ্রিএক্স দেখতাম… ফলে আমরা অন্যদের থেকে অল্পতেই বয়স্ক হয়ে গিয়েছিলাম। দিনদুনিয়ার তাবৎ খবর আমরা আমাদের মতো করে অন্য ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করতে পারতাম।

সবই করতাম আমরাশুধু পড়ালেখাটা বাদ দিয়েছিলাম।

আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক মঞ্জুর স্যার যখন বলতেন– টেন্স মানেই লাঠি আর লাঠি মানেই টেন্স তখনও আমাদের দৃষ্টি থাকত জানালা দিয়ে বাইরে।

যখন বাংলা শিক্ষক বলতেনসমাস লাগবে ছ’মাস… আমরা তখনও গুরুত্ব দিতাম না। ফলে পড়ালেখায় খুব খারাপ হিসেবে আমাদের কুখ্যাতি অন্যান্য খ্যাতির (!) মতোই বিস্ফোরিত হয়ে পড়েছিল স্কুলের আনাচেকানাচে।

ফলে রেজাল্টের দিন যে আমাদের বুক ঢিপঢিপ করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই পরীক্ষা দিতে পাওয়াটাও ছিল আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করেছিলাম এসএসসির আগে– সেই টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টের পরেই।

কী হয়েছিল সেদিন?

সেদিন এই গাছতলাতে বসেই আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। আমরা মানে আমরা সেই কুখ্যাত দল। যাদের নিয়ে টিচাররা নানা রকমের টেনশনে থাকতেন।

সেদিন টেনশনটা ছিল হেডস্যারের।

হেডস্যারের রুম থেকে গাছতলাটা একেবারে ফকফকা দেখা যায়। আমাদের দীর্ঘক্ষণ একইভাবে বসে থাকতে দেখে হেডস্যার পিয়নকে ডেকে পাঠালেন–

কী হয়েছে ওদের?

আন্দোলনে নামছে সার!

আন্দোলনকীসের আন্দোলন?

ওদের একজন তো টেস্টে ফেল করছেওরা বলছে ফেল করা ছাত্ররে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দিতে হবে!

ফাইজলামি নাকিকে ফেল করছে?

আপনি তো চিনেন সার। ওই গ্রুপেরই হিমেল।

ও। ডাকো ওদের।

আমরা হেডস্যারের রুমে ঢুকলাম সদলবলে। নাভাববেন না বুক ফুলিয়ে ঢুকেছি। ভঙ্গিটা কাচুমাচু্ই ছিল। হিমেলআমাদের প্রাণের বন্ধুএসএসসি দিতে পারবে না এটা কোনও কথা না। তাছাড়া সে ফেলও করেনি টেস্ট পরীক্ষায়। চিকেন পক্স হওয়ার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি সে। আমরা সেটাই হেডস্যারকে বললাম। হেডস্যার অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেনযে ছেলে টেস্ট পরীক্ষা প্রিপারেশন নিতে পারে নাই তাকে আমি ম্যাট্রিক কীভাবে দিতে বলবতারচেয়ে ভালো সে আরও ভালো মতো প্রিপারেশন নিয়ে পরের বছর পরীক্ষা দিক!

আমরা ঝুলে গেলাম। স্যার প্লিজ স্যারপ্লিজ!

পাথর হলে নিশ্চয় গলত আমাদের ভেজা কথায়। কিন্তু হেডস্যারের পাথরের অধিকসম্ভবত পর্বত। তাকে টলানো গেল না। আমাদের ধমকধামক দিয়েই ঘর থেকে বের করে দিলেন। আর বললেনখবরদার ঘোঁট পাকাবে নাঘোঁট পাকানো আমি একদম পছন্দ করি নাতোমাকে তোমার বন্ধু পাশ করিয়ে দেবে নানিজের নিজের পড়ালেখা দেখো… বাড়ি গিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে পড়তে বসোযাওনিজের পরীক্ষার কথা ভাবো!

তখন কী যে হল আমাদের… আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজাতেই। ঘুরে হেডস্যারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললামস্যারহিমেল যদি পরীক্ষা দিতে না পায় তাহলে আমরাও পরীক্ষা দিব না!

হেডস্যার বললেনচ্যালেঞ্জ করো আমাকে তোমরাঅ্যাঁচ্যালেঞ্জ করো?

আমরা বললামআর স্যারযতক্ষণ হিমেলকে পরীক্ষা দিতে দেয়ার অনুমতি না দেন ততক্ষণ আমরা আপনার জানালার সামনে ওই গাছতলাতেই বসে থাকব!

হেডস্যার মুখে খুবই একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন। অক্ষর দিয়ে লিখে সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। তবে সেই শব্দের মানে আমরা যা বুঝলাম তাতে এ রকম বোঝায়— তোরা আমার যা পারিস তা কইরা নিস!

আমাদের বেশি কিছু করার ছিল না। ফিরে গিয়ে গাছতলাতেই বসলাম।

স্কুল চলছিল। অথচ কেউ তাকাচ্ছিল না আমাদের দিকে। যেন আমরা নেই। আমরা নেই। আমরা বলে কিছু নেই। মনি বললআচ্ছা আমাদের যদি টিসি দিয়ে দেয়!

আমরা ধমকে উঠলাম মনিকেদিলে দিবে!

হিমেল বললচ বন্ধু লাভ নাই… আমার জন্য খামাখা তোরা ক্যান বিপদে পড়বি?

আমরা বললামতোকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছি… হয় জিতব না হয় হারবহয় সবাই মিলে পরীক্ষা দিবনা হয় কেউ পরীক্ষা দিব না!

আমরা বসেই থাকলাম।

দুপুর পেরিয়ে বিকেল… বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেল। হেডস্যার চলে গেলেন। পিয়ন হেডস্যারের ঘরের তালা মেরে দিলেন। অন্যান্য শিক্ষকেরাও সব যে যার মতো চলে যেতে লাগলেন। গাজী স্যার তাঁর প্রাইভেটের ছাত্রদের নিয়ে বসলেন। বারান্দায় বারান্দায় লাইট জ্বলে উঠল। পিয়ন এগিয়ে এসে বললতোরা যাইসনি ক্যানএখানে বইসা থাইকা কি কিছু হবে?

আমরা চুপ করে বসে আছি। ততক্ষণে আমাদের বুকে বাষ্প জমতে জমতে গাঢ় মেঘের মতো হয়ে গেছে। একটু কেউ সহানুভূতির কথা বললেই হয়ত কেঁদে ফেলব। কিন্তু কেউ সহানুভূতির কথা বলল না। পিয়ন চলে গেল। গাজী স্যার সিগারেট খেতে এসে আমাদের দেখলেন। সিগারেট টেনে নীরবে চলে গেলেন। আমরা বসেই রইলাম।

বৃষ্টি এল আটটার দিকে। আর হেডস্যার এলেন সাড়ে আটটায়। মাথায় একটা ছাতাআর হাতে ধরা আছেন আরও তিনটা ছাতা। এসেই জিজ্ঞেস করলেনঅ্যাইতোরা কয়জন?

আমরা তাকিয়ে আছি স্যারের দিকে। স্যার আমাদের দিকে ছাতা বাড়িয়ে বললেনবাড়িতে দুইটার বেশি ছাতা নাই। এই দুইটা ছাতা মিজানুরের দোকান থেকে নিয়ে আসলামসব ছাতার ভিতরে আয়… খবরদার ভিজবি নাভিজে নিউমোনিয়া বানিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবি না তা হবে নাঢোকছাতার ভেতর ঢোক!

হিমেলকে হেডস্যার নিজের ছাতার ভেতর নিয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেনভালো করে প্রিপারেশন নেজীবনের পরীক্ষায় এসএসসিটাই আসলএখান থেকে মানুষের গাড়ির গিয়ার পায়!

আবার বৃষ্টি শুরু হয়।

আমরা রেজাল্ট নেয়ার জন্য এসে দাঁড়িয়েছি বারান্দায়। ছাত্রে ভরপুর বারান্দা। রেজাল্ট শিট আমাদের গাজী স্যারের হাতে। স্যারের মুখ গম্ভীর। আমাদের প্রত্যেকের মুখ গম্ভীর। স্যার বললেনগত দশ বছরে যা হয়নি এ বছর তাই হয়েছে!

আমাদের বুকের ঢিপঢিপি আরও বাড়ল।

স্যার বললেনএবি স্কুলে দশ বছর পর প্রথম কেউ ফেল করেছে!

আমাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশাপরক্ষণেই কেমন একটা নির্ভার ব্যাপার ছড়িয়ে গেল আমাদের মধ্যে। ধরেই নিলাম আসলে আমরাই ফেল করেছি। হাহতাহলে আমাদের গাড়ির গিয়ার আটকে গেল!

আর সেই দিন যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম হিমেলকে নিয়ে সেটাও আর পূরণ করা হল না!

রেজাল্ট জানানো হল। রেজাল্ট হয়ে গেল সবার। এবার ফেল করেছে বেশ কয়েকজন– এ নিয়ে হেডস্যারসহ সব কজন শিক্ষকের মন খারাপ। এবার স্টার প্রাপ্তিও কম– এটা নিয়েও শিক্ষকদের মন কম খারাপ নাকিন্তু শিক্ষকদের রুমে এসব ছাপিয়ে একটা গুঞ্জন…

গুঞ্জনটা হল স্কুলের সবচেয়ে কুখ্যাত দলটা পাশ করে গেছে ভালোমতো। মনি ফার্স্ট ডিভিশনডালিম ফার্স্ট ডিভিশনসোহেল ফার্স্ট ডিভিশন শুধু শফিকুল সেকেন্ড ডিভিশন!

আর হিমেল?

হিমেল লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন।

আনন্দে আমাদের চোখে পানি চলে এল।

গাজী স্যার আমাকে ডাকলেন— হীরকরেজাল্ট জানো?

-–না স্যার।

–-কী মনে হয় তোমার?

–-বোধহয় ফেল করেছি। ইংরেজি ফার্স্ট পেপার খুব খারাপ দিয়েছিলাম। জীব বিজ্ঞানেও ফেল করতে পারি!

–-তোমার কানের পাশ দিয়ে গুলি গেছে!

–-তার মানে পাশ করেছি স্যার?

–-৭৫১।

–-জ্বি স্যার?

–-তোমার মার্কসএকটুর জন্য স্টার পাইছতোমার কাছ থেকে অবশ্য এরচেয়ে বেশি আশা করছিলামলেটার মাত্রই দুইটাতেস্যাড!

আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার কথা ছিল এরকম অপ্রত্যাশিত রেজাল্টে। কিন্তু তার আগেই শুনলাম হেডস্যার নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। হিমেল কানের কাছে ফিসফিস করে বললস্যার নিশ্চয় আমাদের রেজাল্ট জানতে পেরেছেন!

(ক্রমশ)

আহমেদ খান হীরক
+ posts

জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৮১। দশ বছরের লেখালেখির জীবনে লিখছেন মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। কর্মরত আছেন একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে। কথাসাহিত্যের সাথে লিখছেন টিভি নাটক ও সিনেমা।

প্রকাশিত বই-পত্তরঃ
কবিতা - আত্মহননের পূর্বপাঠ (২০১০)
রম্য সংকলন - যে কারণে আমি সাকিব আল হাসান হতে পারি নি (২০১৭)
গল্প সংকলন - য পলায়তি স জীবতি (২০২০), সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা (২০২১)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *