লাল রঙের দেশ মারয়ুল । পর্ব ৪ । তিন পাহাড়ের দেশ, তিনটে বৃক্ষের গল্প । লিখছেন কৌশিক সর্বাধিকারী
তিব্বতি ভাষায় ব্রোক শব্দের অর্থ পাহাড়ি অঞ্চল, পা শব্দের অর্থ বসবাসকারী। লাদাখ রেঞ্জের চোরবাট-লা থেকে নেমে আসা গারকোন নালা যেখানে সিন্ধুনদে এসে মিশেছে, সেখানেই পাহাড়ের ধাপে ধাপে বেড়ে উঠেছে প্রায় একশো পরিবারের গ্রাম গারকোন। এখান থেকে দশ-বারো কিলোমিটার পশ্চিমে বাতালিক, আর তার পরেই সিন্ধুনদ চলে গেছে পাক অধিকৃত ভূখন্ডে। সিন্ধুনদের নিম্ন অববাহিকায় বসবাস করলেও গারকোনের বাসিন্দারা নিজেদের ব্রোকপা বা হাইল্যান্ডার বলতে ভালবাসেন।
ব্রোকপারা আসলে দর্দ জনগোষ্ঠীর মানুষ। এই দর্দ শব্দটি নাকি কোনও সংস্কৃত শব্দের অপভ্রংশ, যার অর্থ পাহাড়ে থাকা মানুষজন। মোটামুটি খ্রিষ্টজন্মের দুশো বছর আগে থেকে পনেরশ শতাব্দী অব্ধি এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পশ্চিমের সরু সব গিরিপথ দিয়ে নিম্ন-লাদাখে নেমে আসেন, সঙ্গে আনেন পুরুষানুক্রমিক জীবনচর্যা। দর্দ গোষ্ঠীর লিখিত ইতিহাস যদিও তেমন পাওয়া যায় না, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন মোরাভিয়ান মিশনারি অগুস্ত হেরম্যান ফ্রাঙ্ক দা-হানু-র দর্দ গ্রামে গিয়েছিলেন, তখনও তিব্বতীয় সংস্কৃতির থেকে নিজেদের মোটামুটি বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা দর্দেরা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল, ইদানীংকালের মতো সব সংস্কৃতিই ভুবনায়নের সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে যায়নি। এ বাবদে হের ফ্র্যাঙ্ক কিছু দর্দ গানের নমুনাও তাঁর বইতে লিখে গেছেন।
তবে দর্দ-দের নিয়ে বহু মিথ এবং গল্প অনেক পুরনো দিন থেকেই প্রচলিত। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লেখায় দর্দ-দের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একধরনের সোনামুখী পিঁপড়ের গল্প রয়েছে। এই পাহাড়ী পিঁপড়ে নাকি আকারে কুকুরের চেয়ে বড়, তারা বালি খুঁড়ে সোনার দানা বের করে আনে আর সেই সোনা লুট করতে উটের পিঠে চামড়ার বস্তা বেঁধে মরুভূমিতে অভিযান চালায় দর্দ জনগোষ্ঠীর মানুষ, যাঁদের হেরোডোটাস বলেছেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। অবশ্য শুধু হেরোডোটাসই নন – মেগাস্থিনিস, প্লিনি, টলেমি, ডায়োনিসাস সকলের লেখাতেই এই প্রকান্ড সোনামুখী পিঁপড়ে আর পিঁপড়ের বাসা থেকে সোনা লুট করার গল্পকথা পাওয়া যায়। নিজস্ব ইতিহাস ও শিরায় প্রবহমান আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন দর্দরা নিজেদের সম্বন্ধে নানা গল্প বলেন। সেই গল্পে আলেকজান্ডারের ভারতজয়ের পরে গিলগিটে রেখে যাওয়া ব্যাকট্রিয়ান সেনাবাহিনীর বংশধর তাঁরা, অথবা পালিয়ে এসেছেন রোম সামাজ্র্যের এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচারের হাত এড়িয়ে, অথবা তাঁদের পূর্বপুরুষরা ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বা পারস্য দেশের অগ্নি উপাসক জনজাতি। তবে সব গল্পেই গিলগিট-স্কার্দু অঞ্চল হয়েই যে শেষমেশ দর্দ-রা আজকের আরিয়ান ভ্যালীতে এসেছিলেন, তার বর্ণনা পাওয়া যায়।
একটা বড় সময়কাল ধরে দর্দদের মধ্যে প্রস্তরচিত্র আঁকার চল ছিল। পাথরে খোদাইএর কাজে দর্দেরা বেশ পারদর্শী ছিলেন, তাই খালৎসী থেকে গারকোন অবধি রাস্তা জুড়ে অজস্র শিলাপট্টের-র ছড়াছড়ি। সেইসব প্রস্তরচিত্রে অদ্ভুত জীবন্ত শিং বাঁকানো আইবেক্সের দল আর তুষারচিতার ছবি রয়েছে। রয়েছে লম্বা চুলের বেণী বাঁধা মেয়েপুরুষ, তীরন্দাজি যুদ্ধ, শিকার, চাষ আর পশুপালনের ছবি। খালৎসীর কাছে কোথাও কোথাও একটা দুটো প্রাচীন ব্রাহ্মী হরফের খোঁজও মেলে। দর্দদের কোনও নিজস্ব লিপি নেই। এই প্রস্তরচিত্র আর দর্দ লোককথার উপর ভিত্তি করেই গত কয়েক দশক ধরে দর্দদের ইতিহাস জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পশ্চিম তিব্বতের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দর্দ আর মঙ্গোলদের সংমিশ্রণে তৈরি। দর্দদের দুটি শাখা ছিল দ্রাস আর দা-হানু অঞ্চলে। দ্রাস অঞ্চলের দর্দরা ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামি বেরদরদের মূলস্রোতে মিশে গেছেন। কিন্তু দা-হানুর দর্দরা বৌদ্ধ হয়েও যেন বৌদ্ধ নন, পালা-পার্বণে, বোনোনা উৎসবে তাদের ভেতর থেকে সেই সুপ্ত প্রবল দর্দের সত্ত্বা প্রকাশিত হয়।
মে মাসের প্রথম দিকে যখন অ্যাপ্রিকট ফুল সব ঝরে গিয়ে একটা দুটো করে পাতা আসা সবে শুরু হয়েছে, তখন কারগিল থেকে সোজা যাওয়া গেলো গারকোনের দিকে। লে মার্কেটে আলাপ হয়েছিল গারকোন গ্রামের টুন্ডুপ শেরিং-এর সঙ্গে, ওর কাছেই গেলাম আগে। ছুটির দিন হওয়ায় স্থানীয় স্কুলের মাস্টারমশাই টুন্ডুপ বাড়িতেই ছিল। গ্রামের মাস্টারমশাইরা যেমন হয়ে থাকেন, টুন্ডুপ অবিকল তেমন চটপটে আর স্থানীয় খবরের ডিপো। তিনদফা নোনতা মাখন চা আর শুকনো খোবানি খেতে খেতে আবহাওয়া আর এইবারের চাষবাস নিয়ে গল্পসল্প করা গেলো খানিক। টুন্ডুপের যৌথ পরিবার। মা, বাবা, ভাই, অবিবাহিত বোন। ভাই-বোন দুজনেই পাশের গ্রামে স্কুলে পড়ায়। এখনও রয়েছেন ঠাকুর্দা মিশকিন শেরিং, লোকায়ত দর্দ সংস্কৃতির শেষতম সাক্ষীদের একজন। নতুন লোক দেখে ভারি খুশি তিনি। পুরনো দিনের কথা জানতে চাইলে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর। সর্বত্রই যেমন বৃদ্ধ মানুষ একাকীত্বের শিকার, এখানেও তাই – সদাব্যস্ত পরিবারে কথা বলার লোক মেলে না। আর যে ভাষায় বাল্যে কথা বলতেন মিশকিন, সেই দর্দ ভাষাও অবিরত হিন্দি-উর্দু-ইংরেজির আগ্রাসনে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মিশকিন শেরিং দন্তহীন মুখে একগাল হেসে বললেন, দর্দদের কথা শুনতে চাও? তাহলে আমার ঠাকুমার গাওয়া গানের কথা বলি তোমায়। আমার ঠাকুমা আমাকে এইসব গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন।
সেই অনেক অনেক আগেকার কথা । একদা গিলগিট অঞ্চলে থাকতো তিন ভাই: গালো, মেলো আর ডুলো। শিকারে শৌখিন। সারা দিন তারা পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটন্ত হরিণ নিশানা করে ফেরে। তাদের চোখে বাজপাখির তেজ , তাদের তীর শিকারী ঈগলের চঞ্চুর মতো ধারালো। সেই সময়ে গিলগিটের যে রাজা, সে ছিল দারুণ পাষণ্ড। তার অত্যাচারে প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সে আদেশ জারি করলো, দর্দদের শিকার করা এখন থেকে বন্ধ। কিন্তু গালো, মেলো, আর ডুলোর ঘরে প্রাণ টেকে না। পাহাড়ে পাহাড়ে বল্লম আর তীর ধনুক হাতে আইবেক্সের পাল তাড়া করে না ফিরলে জীবন কিসের? তাই তিন ভাই একদিন লুকিয়ে গেলো শিকার করতে। রাজার কানে সেই খবর উঠতেই রাজা রেগে আগুন। শেষে কি না তার আদেশ অমান্য করে! এতো সাহস তিন ভাইয়ের! জল্লাদদের বলা হলো গালো, মেলো, ডুলো শিকার থেকে ফিরে সাতদিন আমোদ আহ্লাদ করবে। তার পরে তাদের মুন্ডচ্ছেদ করা হবে।
এইবার ধরো, তুমি জানো না, মৃত্যু কখন আসবে। তবে তো তোমার মনে সাহস থাকবেই। গিলগিটে তখন মেলা চলছে, সেখানে হরেক মজা। গিলগিট আর ব্রুশালের একশ তরুণী মেয়ে আর একশ জোয়ান ছেলে মিলে আগুনের চারদিকে গোল হয়ে নাচছে। আছে নানা রকম প্রতিযোগিতা: ছুটন্ত ষাঁড়ের পিঠে দাঁড়িয়ে তীর ছোঁড়া, বুনো ঘোড়া বশ মানানো, হরিণের ডাক নকল করা, দ্রুতগতিতে পাহাড়ে চড়া । এই নাচ আর প্রতিযোগিতার মধ্যমণি অবশ্য গিলগিটের সেই অত্যাচারী রাজাই। আমাদের তিন ভাই জানেই না তাদের মাথায় ঝুলছে মৃত্যুর খাঁড়া। তারা দিব্যি মেলায় ঘুরছে, নাচছে, গাইছে। মেলার গানের দলে ফুংসোক মানে বাঁশি বাজাচ্ছিল যে লোকটি ,সেই বাজনদারের ভারি মায়া হল দেখে, আহা, এমন সা-জোয়ান ছেলেগুলো, রাত পোহাতেই তাদের মাথা কাটা যাবে! গালো, মেলো, ডুলোকে সাঁটে ফুংসোক বাজিয়ে সাবধান করে দিলো সে। তিন ভাই রাতারাতি পাড়ি দিলো খাড়া পাহাড় পেরিয়ে, পায়ে ঘরে বানানো জুতো, হাতে গাছের ডালের লাঠি।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলতে চলতে সিন্ধুনদের উজানে গিয়ে চোরবাটলা পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছলো দা-ব্রোগে। সেখানে পৌঁছে হাতের লাঠিগুলো মাটিতে পুঁতে দিলো তিন ভাই। দেখতে দেখতে নতুন পাতা ছড়ালো, বেড়ে উঠলো চুলি বা অ্যাপ্রিকট আর মালচাং বা উইলো গাছ। ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে আসার সময় কয়েকটা শস্যদানা জুতোর মধ্যে ঢুকে গেছিলো, সুকতলা খুঁটে কয়েকটা সেই দানা পেলো তারা, মাটিতে ফেলতেই তরতর করে বেড়ে উঠলো যব আর বাকহুইটের চারা। এতো সরস জমি দেখে গালো, মেলো, ডুলো এখানেই থেকে যাবে বলে ঠিক করে তীর ছুঁড়লো দা-ব্রোকের ভাটিতে। তীর যেখানে গিয়ে পড়লো, তৈরি হল দা গ্রাম। গালোর উত্তরপুরুষরা বসতি বানালে গারকোনে, মেলোর সন্ততিদের গ্রাম হলো দাহ, ডুলোর গ্রাম গানোক, সে এখন পাকিস্তানে।
একটু পরেই টুন্ডুপ ওদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে চলল। গ্রামে ঢুকে প্রায় একশো মিটার যাওয়ার পরেই চওড়া রাস্তা শেষ। গাড়ি এখানেই রেখে পায়ে হেঁটে বাকি গ্রামটা ঘুরে দেখতে হবে। বসন্তের শেষে, গারকোন গ্রামের সদ্য চষা জমিতে তখন মাথা তুলেছে যবের চারা। মাঠগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন বিভিন্ন রকম সবুজ রঙের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ। অ্যাপ্রিকট, পীচ, অ্যামন্ড আর পপলার গাছে কুঁড়ি কুঁড়ি পাতা এসেছে। উল্টোদিকের শুষ্করুক্ষ পাহাড়েও সবুজ রঙের ছোঁয়া। খুব বিচক্ষণের মতো নীল ম্যাগপাইরা ওড়াউড়ি করছে, ধুলোর উপর পোকা খুঁটছে সাদা ওয়াগটেইল। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে গারকোন টোকপো, তার থেকেই স্বচ্ছ সুমিষ্ট জল রাস্তার পাশের ছোট নালা দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মহিলারা তারই পাশে ঘরের কাজকর্ম করছেন, একদম ছোট বাচ্চারা মায়েদের কাছে কাছে খেলে বেড়াচ্ছে।
কয়েক পা এগিয়ে একটা খুব পুরনো অ্যাপ্রিকট গাছ, গ্রামের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে প্রকান্ড এক প্রাচীণ আঙুরলতা। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল গাছটার তলায় কিছ বাচ্চা ছেলেমেয়ের জটলা। টুন্ডুপ বলল ওদের জনগোষ্ঠীর প্রাচীন বিদ্যাশিক্ষার পদ্ধতি অনুযায়ী, বারো বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চারা নিজের পরিবার ছাড়া বাইরের অন্য কোনও বড়দের কাছ থেকে কিছু শিখতে যায় না। বারো বছর পর্যন্ত বয়সীদের একটা গ্রুপ, এই সমবয়সী দল থেকেই বাচ্চারা জীবনের প্রাথমিক পাঠ নেয়। এটাও সেরকমই একটা ক্লাস। কাছে গিয়ে দেখলাম এগারো-বারো বছর বয়সি একটা ছেলে, গায়ে লামাদের মত আলখাল্লা, সে আরও ছোট বাচ্চাদের টোল খুলে বসেছে। পোড়োর দল জনা আষ্টেক পাঁচ-ছ বছুরে, গোল হয়ে বসে। টুন্ডুপ জানালো শীতের পরে আজ থেকেই ওদের প্রথম ক্লাস শুরু হল।
আমাদের নবীন লামার নাম নাওয়াং নামগিয়াল। সৌম্য চেহারা, কথাবার্তা খুবই শান্ত এবং পরিণত। একটু কৌতূহল হল, টুন্ডুপের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলাম ছোট্ট মাস্টারমশাইকে, আজ তুমি তোমার ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাচ্ছো? সরাসরি উত্তর না দিয়ে নাওয়াং জিজ্ঞাসা করল, তোমরা স্কুলে গিয়ে প্রথমে কী শেখো? আমি বললাম, আমরা প্রথমে বর্ণমালা আর নম্বর শিখি: এ-বি-সি-ডি, ওয়ান-টু-থ্রী এইরকম। নাওয়াং বলল, আজ আমরা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস শিখছি। খুব অবাক হলাম। টুন্ডুপ বুঝিয়ে দিল, পাহাড়ি রাস্তায় অনেক দূর চলতে হলে শ্বাসসংযম খুবই জরুরি। এছাড়া বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা বলে যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেও শ্বাসসংযম আবশ্যক। তাই ছোট থেকেই সব বাচ্চাদের ব্রিদিং টেকনিক শেখানো হয়, একটু বড় বাচ্চারাই শেখায় বলে ছোট বাচ্চারা খুব চটপট এসব রপ্ত করে ফেলে। আর এত ছোট থেকে শিখে নেয় বলে সারাজীবন ধরে সেটা পালন করতেও ওদের কোন অসুবিধেই হয় না।
টুন্ডুপ বলল এই অ্যাপ্রিকট গাছটাই নাকি ওদের গ্রামের সবথেকে পুরনো এবং বিশেষ একটি গাছ। এর নাম চার-ই-তিলি, বা বিচার-বৃক্ষ। গ্রামে কোন রকম সমস্যা উপস্থিত হলে বিচক্ষণ বয়স্ক মানুষেরা এই গাছের নীচে বসে তার সমাধান এবং ফয়সালা করে থাকেন। সাধারণত এই সভা যা নির্দেশ দেয়, সবাই খুশিমনেই তা মেনে নেন। কিন্তু যদি সেই ফয়সালা একপেশে হয় এবং গ্রামের কেউ তাতে সন্তুষ্ট না হন তবে গ্রামের প্রথা অনুযায়ী তিনি নিজের পাগড়ি উল্টো করে এই গাছ তলায় রেখে দেবেন। পুরো গ্রামের জন্যই সেটা খুবই গুরুতর একটা ব্যাপার। কেউ চার-ই-তিলির নিচে উল্টো করে পাগড়ি রেখে দিয়েছেন মানে তিনি সমাজের সম্মিলিত বিচারের সিদ্ধান্তে খুশি নন। গ্রামের একজন এই যৌথ সিদ্ধান্তে খুশি নন সেটা এতই গুরুতর একটা ব্যাপার যে অন্যপক্ষ নিজে থেকে এগিয়ে এসে ব্যাপারটা আপোষে মিটিয়ে ফেলেন।
দর্দদের কাছে গাছ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দর্দ লোককথা বলে সৃষ্টির শুরু এক হ্রদের জলে। সেই জলের উপরে ভেসে ওঠে এক চারণভূমি আর তারপর সেখানে মাথা তোলে তিন রত্নগিরি। সাদা রত্নগিরি, লাল রত্নগিরি, নীল রত্নগিরি। তিন পাহড়ে বেড়ে ওঠে তিন গাছ, সাদা চন্দন, লাল চন্দন আর নীল চন্দন। তিন গাছে ডানা ঝাপটায় তিন পাখি। সাদা গাছে জেগে উঠলো বুনো ঈগল, লাল গাছে ঝুঁটিদার মোরগ আর নীল গাছে ব্ল্যাক বার্ড । সৃষ্টি হল দেবতা, দর্দ আর মরজগৎ। সমান্তরাল এই তিনটি পাহাড়, তিনটি গাছ আসলে স্বর্গ, দর্দভূমি আর পাতাললোকবাসীদের পৃথিবী। সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পের এই ফারাকই বুঝিয়ে দেয় দর্দরা তিব্বতী ধর্মবিশ্বাস থেকে চিরকাল স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এসেছে।
গ্রামের মধ্যের এই চার-ই-তিলিও দর্দ গ্রামের মানুষের সেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণের কথাই বলে। গারকোন গ্রামের লোকের বিশ্বাস এই গাছটি পিতৃপুরুষ গালোর সময়কার। গাছটি তার ছায়ার মতোই গ্রামে সুখশান্তি বজায় রাখে। সম্প্রতি গারকোন গ্রামে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য সরকারী সাহায্য এসে পৌঁছেছে। রাস্তাটা যাবে গাঁয়ের মাঝ বরাবর একেবারে শেষ বাড়িটা পর্যন্ত। মোটরগাড়ি চললে গাঁয়ের মানুষের অশেষ সুবিধা। পাহাড়ের নীচ থেকে জিনিসপত্র পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। কিন্তু গোল বেঁধেছে যে দুইসার বাড়ির মাঝে, সরু পায়ে চলা রাস্তার ধারের এই চার-ই-তিলি গাছটার পাশ দিয়েই এই রাস্তা, সোজা রাস্তা বানাতে গেলে গাছটাকে কাটতে হয়। আমাদের পরিচিত শহুরে সভ্যতা হলে সেই সোজা পথটিই গ্রহণীয় ছিল। কিন্তু দর্দরা বড্ড একগুঁয়ে, আগেই বলেছি । তারা ভেবে চিন্তে এক জটিল পথ বেছে নিয়েছে। রাস্তা কিছুটা ঘুরিয়ে দিলে গাছটা বেঁচে যায়, তবে তিনটি বাড়ি ভাঙা পড়ে। যে তিনজনের বাড়ি, তাঁরা সানন্দে বাড়িভাঙার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। গ্রামের সকলে মিলে তাঁদের জন্যে একটু তফাতে নতুন বাড়ি বানাচ্ছে এখন। মাসতিনেকের মধ্যে সেই বাড়ি তিনটে তৈরি হবে, এঁরা সরে যাবেন নতুন বাড়িতে, তার পর রাস্তা বানানো শুরু হবে। একটু অসুবিধে হল, ঠাঁইনাড়া হতে হল, রাস্তা বানাতেও দেরি হবে বলে কারও মনে কোনও ক্ষোভ নেই। সকলেই খুশি এমন পুরনো গাছটা বেঁচে গেলো বলে।
টুন্ডুপের এই গল্প শুনে আমি খুব অবাক হই। আমার যে অঞ্চলে জন্ম, সেখানে গাছের শুকনো ডালপাতা প্রতিবেশীর বাড়িতে পড়লেই গাছ কেটে ফেলার হুলিয়া জারি হয়। রাস্তা চওড়া করার জন্যে প্রাচীন বৃক্ষচ্ছেদন এখানে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তা ঠেকাতে বিচারালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। বড় গাছের গুঁড়িতে চোরাগোপ্তা গর্ত করে হিং গুঁজে দেওয়ার ঘটনা দেখেও না দেখার ভান করতে হয়। সংরক্ষণ, পরিবেশ সাম্য – এই সব গালভরা শব্দের সঙ্গে আধুনিক পৃথিবীর মানুষ পরিচিত হলেও মানে টানে না। কিন্তু হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতি এখনও আঁকড়ে রাখতে চাওয়া দর্দরা মনে করেন তিন পাহাড়ের তিন গাছ বেঁচে থাকা দরকার। গাছ না থাকলে পাখি ডাকবে না। পাখি না ডাকলে বাঁচবে না মানুষও। প্রতিটি প্রাচীন জনজাতিই প্রকৃতিকে সুস্থ রাখতে চান, তারা জানেন মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার সুত্র লুকানো আছে প্রকৃতিতে। তাই ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবীতে ভাষার বৈচিত্র্য যত কমছে তত কমে আসছে জীববৈচিত্র্যও। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলির ভাষা ও সংস্কৃতি, হারিয়ে যাচ্ছে অরণ্য নদী পাহাড় সাগর, সভ্যতার লোলুপ থাবায়।
সম্প্রতি খবরে প্রকাশ আমেরিকার বিস্তীর্ণ শীতল আবহাওয়া অঞ্চলে এইবার গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। অসহ্য গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। এ সকলই নাকি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল, কালে কালে আরও বাড়বে। কর্মফল আর কে কবে এড়াতে পেরেছে। তবু সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার মুখেও প্রতিরোধ চালিয়ে যান এইসব ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মানুষ, গাছ লাগিয়ে, নদীকে দূষণমুক্ত রেখে, পাহাড়ে খননকার্যের প্রতিবাদ করে। দর্দরা সে সব রকম লড়াই লড়তে খুব রাজি। তারা যে ভারতভূমির শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা – এ কথা তো আগেই বলেছি।
(ক্রমশ)