খড়কুটোর জীবন : মাঠে মাঠে চলো বিহরি । পর্ব ৪ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
ভুবনডাঙার মাঠ, গনগনির মাঠ, কচুচুষির মাঠ, জোড়া দিঘির মাঠ বা রূপকথার তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে আমার মনের ঘোড়ার খুড়ে ওড়ে চেনা মাঠের কাঁচা ধুলো। গ্রাম পেরিয়ে মেঠো পথ পিচ রাস্তা ডিঙিয়ে নেমে গেছে কানাডাঙার মাঠ পেরিয়ে বাংলাদেশ সংলগ্ন বিল মাঠের দিকে। লোকে এ পথকে বলে ডহর। বর্ষার সময় সেখানে এক হাঁটু কাদা। গ্রীষ্মে ওড়ে ধুলো। খেজুর গাছে ছড়িয়ে ওঠা বটগাছ কানাডাঙার ল্যাণ্ড মার্ক। মাঠের ইতিউতি ছড়িয়ে কাঁটা বাবলা। গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্রের হাত থেকে বাঁচতে ক্ষণিকের আশ্রয় এই গাছগুলি। লাঙ্গল বইতে গিয়ে বাড়ি থেকে পাঠানো পান্তা বা দুপুরে মুনিশদের মুড়ি বা রুটি-গুড়ের জলখাবার খাওয়ার স্থান এই কাঁটা বাবলার ঝিরঝিরে পাতার শীতলতায়।মাঠে কাজ করতে করতে একটু জিড়িয়ে নেওয়া, গল্পগাছা, বিড়ি টানা, ফসলের পরিকল্পনা সবই হয় এখানে। গোরুর রাখালেরা ফসল শূন্য মাঠে পোষ্যদের ছেড়ে দিয়ে ঘুম লাগায় এই গাছের নীচে। যাদের স্যালো-মেশিন আছে তারা বানিয়ে নেয় অস্থায়ী খড়ের বা চটের ছাউনি। মেশিন চালিয়ে দিয়ে কখনো ধান হাঁটকানো বা সেচের সময় ড্রেন গুলোতে বাঁধ দেওয়া বা কেয়ারিগুলো কেটে জল ছড়িয়ে দেওয়ার ফাঁকে কিছুটা বিশ্রাম অস্থায়ী ছাউনির তলায়। রত্না, ফিফটি, ছত্রিশ, লাল স্বর্ণ, সাদা স্বর্ণ, গোবিন্দ ভোগ নানান কিসিমের ধানের চাষ।
বিল মাঠে গ্রীষ্মের শেষে বোনা হয় সারকেলে, মেগি, দুধকলমা নানান ধান। জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে এরা। মাঠ ভর্তি জলে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকে । তার পর জল কমে। সোনালী ধানের শীষ মাথা নাড়াতে থাকে বাতাসের তালে তালে। বিল মাঠের চাষ খুব কষ্টসাধ্য। তাইতো চাষীর মুখে প্রবাদের মতো উচ্চারিত হয় —
‘বিল মাঠের ঐ চাষে,
হাতির মতো ছেলে আমার
মশা হয়ে আসে।’
আসলে এক একটি মাঠ তার আত্মপ্রকাশ ঘটায় তার কৃষকের মধ্য দিয়ে। তার খেয়াল, আনন্দ, বেদনা, বিরক্তি, অহং, বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে চাষীর জীবন চর্যায়। মাঠ এক সম্ভ্রান্ত ভাড়াটে । সে চাষীকে দেয় আত্মসম্মান। আর সেই সম্মানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে কৃষকের বেঁচে থাকার অধিকার। কৃষক আর মাঠ অর্ধনারীশ্বর। ফসলের গান বাজে কৃষকের প্রাণে —
‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।’
বর্ষার সময় যখন জল থই থই বিল তখন মনে খুশির বান ডাকতো আমার। একদিকে সবুজ ধানক্ষেত গলা ডুবিয়ে মাথা জাগিয়ে অন্যদিকে ঢোলকলমী, শোলা আর ধনচের ঝোঁপ যেন এক একটা সবুজ দ্বীপ। কোথাও কোথাও কলমীলতা বেগুনী ফুল বুকে ভাসমান। কোথাও প্রস্ফুটিত শালুক, কোথাও পদ্মের ঝাড়। জারমানি বা টোপাপানা বংশ বিস্তারে ব্যাপৃত। সাদা বক, শামকুল, বালি হাঁস, কাদাখোঁচা, হাঁড়িচাচা, ডাহুক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা প্রভৃতি পাখির ওড়াওড়ি। মাঠ জুড়ে শামুকের, কাঁকড়ার শ্লথ গতির আনাগোনা। মৃত শামুক, গুগুলি, কাঁকড়া বা মাছেদের দেহাবশেষ ছড়িয়ে কাদামাটিতে। সে যেন রবী ঠাকুরের ‘সহজ পাঠের’ বর্ণিত ‘মোতিবিল’ —
‘নাম তার মোতিবিল,
বহুদূর জল।
হাঁসগুলি ভেসে ভেসে
করে কোলাহল।
পাঁকে চেয়ে থাকে বক,
চিল উড়ে চলে,
মাছরাঙা ঝুপ ক’রে
পড়ে এসে জলে।
হেথা হোথা ডাঙা জাগে।
ঘাস দিয়ে ঢাকা,
মাঝে মাঝে জলধারা
চলে আঁকাবাঁকা।
কোথাও বা ধানখেত
জলে আধো ডোবা,
তারি ’পরে রোদ প’ড়ে
কিবা তার শোভা!’
জেলেরা যখন তাল কাঠের ডিঙি ভাসিয়ে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে বিলের গভীরে যেতো আমিও সঙ্গ নিতাম মাঝে মাঝে তাদের। উঠে পড়তাম ডিঙিতে। দাঁড় বাইতাম। খ্যাপলা জাল, ফাঁস জাল, ফ্যাটা জাল, সুতো বড়শি লাগানো শোলার নল বা দাওন পাতার সুতো বড়শি, বিত্তি, পলো, ঝুপু, কালা — মাছ ধরা বা মারার নানান আয়ুধ বোঝাই থাকতো সেই ডিঙি নৌকা। একদিন অনীল দাদুর সঙ্গী হয়েছি। গভীর নির্জন বিলে পৌঁছে গেছি। মাঝে মাঝে জল পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। দাদু আমাকে একটা ঢোল কলমির ঝোঁপের ওপর বসিয়ে রেখে আরো গভীর বিলে জাল পাততে গেছে। ফেরার পথে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। চারিদিকে জল আর ভয়ঙ্কর নির্জনতায় আমার ভয় ভয় করছে। ভয় কাটানোর জন্য গান ধরেছি —
‘ওরে ট্যাংরা তবু কাটোন যায়
মাগুর মাছে ক্যাতক্যাতায়,
আবার শিঙি মাছটা মারছে কাঁটা
পরান যায় জ্বলিয়া রে।
হায়রে, কি মাছ ধরিছ বড়শি দিয়া ?
ও দরদী কি মাছ ধরিছ বড়শি দিয়া?
ও গুরুজী কি মাছ ধরিছ বড়শি দিয়া
ভ্যাদা মাছে কাদা খায়,
পুঁটি মাছের পরান যায়
আবার বৃষ্টি হলে কই মাছটা
চলে ডাঙা দিয়ারে।
ও গুরুজী কি মাছ ধরিছ বড়শি দিয়া
গুরু বলে মিথ্যা নয়,
চ্যাং ধরেছি গোটা ছয়
আমি ঝোল খাইবো
দুটো বেগুন দিয়ারে।’
দিয়ারে-এ-এ-এ বলে প্লুতস্বরে সে ভয়ার্ত সঙ্গীতে ঝোপঝাড় -জল-আকাশ কম্পিত। সময় আর কাটছে না। বসে বসে মাকড়শাদের জাল বোনা, কাচ পোকার ওড়াওড়ি দেখছি। ঝোপের মধ্যে মেঠো ইঁদুরদের কিচির মিচির চলছে। দাদুর জন্য অপেক্ষা না করে সাঁতার কাটতে কাটতে আর কোনো ডাঙায় বিশ্রাম নিতে নিতে বাড়ি চলে এসেছি। ও দিকে দাদু আমাকে যেখানে রেখে রেখে গিয়েছিলো সেখানে না পেয়ে বিল তোলপাড় করে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে দেখে আমি ভাত খাচ্ছি। আমাকে দেখতে পেয়েই উঠানে ধপাস করে বসে মাকে বলল — ‘বৌমা, একগ্লাস জল দাও তাড়াতাড়ি।’ আমি চুপ করে বসে ভাবছি এবার আমার কুকীর্তি ফাঁস হবে। বাবার কাছে ধোলাই খাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর দাদুর মুখ দেখে মরমে মরছি। ভাবছি দাদুর জন্য অপেক্ষা না করে খুব ভুল হয়েছে। কিন্তু দাদু আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মিচকে হাসি দিয়ে মাকে বললো — ‘আসছি বৌমা।’ মা দুটো খেয়ে যেতে বললে বললো — ‘ঐ শালার জন্ম দিনের দিন খাবো।’ দাদু চলে যেতেই একটা ক্ষমাসুন্দর মূহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলো পথের দিকে চেয়ে ।
(ক্রমশ)