খড়কুটোর জীবন : খোঁয়াড়। পর্ব ২১। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

গত পর্বের পর

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে খোঁয়াড় শব্দটির অর্থ – ‘ গৃহপালিত পশু গো-ছাগ প্রভৃতি আটক করিয়া রাখার স্থান (পাউন্ড)। ‘ আসলে খোঁয়াড় হলো জমির ফসল অথবা বাগানের গাছপালা নষ্টকারী গবাদিপশু আটক রাখার জেলখানা। এই ব্যবস্থায় গবাদিপশু কর্তৃক ফসল হানিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সংশ্লিষ্ট গবাদিপশু ধরে খোঁয়াড়ে দিতেন। গবাদিপশুর মালিককে খোঁয়াড় মালিক অ়র্থাৎ পাউন্ডকিপারকে ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদান করে পশুগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হতো। তা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও পাউন্ড কিপার উভয়েই অর্থ পেতেন।

এর একটি সুন্দর বর্ণনা আছে দীনেন্দ্রকুমার রায় -এর ‘ রাতচোরা গরু ‘ নামক গল্পে। গল্পকার লিখেছেন- ‘সেকালে আমাদের পল্লী অঞ্চলে কাহারও গাইগরু যদি কোন গৃহস্থের বেড়া-বাতাড়া ভাঙিয়া ফসলের খেতে প্রবেশ করিত, তাহা হইলে সেই গাভীটিকে ধরিয়া আপাদমস্তক ধনঞ্জয় দান করিয়া পাউণ্ডে (খোঁয়াড়) পাঠাইয়া দেওয়া হইত। গরুর মালিক… লোকাল-বোর্ডের পাউন্ড-কীপারকে বোর্ড নির্দিষ্ট রেটে মায় খোরাকি জরিমানা দিয়া গরু খালাস করিয়া আনিত। ‘

১৯৩০ সালে প্রকাশিত ‘ সাসেক্স কাউন্টি ‘ ম্যাগাজিনের তথ্যানুসারে জানা যায় মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ড ও তার উত্তর আমেরিকার উপনিবেশ গুলি এছাড়াও আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে প্রতি গ্রামে ছিল ‘ ভিলেজ পাউন্ড ‘। পাথর বা ইটের উঁচু দেওয়ালের এই পাউন্ডগুলি ছিল নানান আকৃতির। আমাদের দেশের খোঁয়াড়গুলি অধিকাংশ বাঁশের বা কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি। ইউরোপীয় পাউন্ডগুলি মধ্যে ছোটোগুলির আয়তন ছিল প্রায় ২২৫ বর্গফুট এবং বড়ো গুলি প্রায় হাফ একরের। সেযুগেও ফসল নষ্টকারী গবাদিপশু গুলিকে আটক রেখে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হতো। আবার পশুগুলির মালিক যদি তিন দিনের মধ্যে সেগুলিকে মুক্ত করে না নিয়ে যেতেন তাহলে সেগুলো নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হতো।

আমাদের দেশে মোগল আমলে খোঁয়াড় ছিলো এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কেননা তখন সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিলো কৃষি। তাই কৃষিজ ফসল রক্ষার জন্য খোঁয়াড় ব্যবস্থা বেশ সহায়ক ছিলো। পরবর্তীতে সরকার বা জমিদারদের অনুমতি নিয়ে প্রায় প্রতিটি গ্রামেই খোঁয়াড় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলত গবাদিপশুর কবল থেকে জমির ফসল ও বসত বাড়ির বাগান প্রভৃতি রক্ষা পেতো। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকেও প্রায় প্রতিটি গ্রামে পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত খোঁয়াড় দেখা যেত।

প্রতিটি খোঁয়াড়ে আটক পশুগুলির মুক্তির জন্য পশু মালিকদের নির্ধারিত অর্থ জরিমানা দিতে হতো। স্থানীয় সরকার, জমিদার পরবর্তীতে পঞ্চায়েত জরিমানার অর্থ পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতেন। শরৎচন্দ্রের ‘ মহেশ ‘ গল্পে আমরা দেখি গফুর বংশীর দোকানে এক টাকায় পিতলের থালাটি বন্ধক দিয়ে জরিমানা স্বরূপ সেই টাকার বিনিময়ে মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড় থেকে ছাড়িয়ে এনেছে।

গ্রামাঞ্চলে গবাদিপশুর ফসল নষ্ট করা নিয়ে নিত্য বিবাদ লেগেই থাকে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি হত্যা থেকে প্রতিবেশির হাতে প্রতিবেশির খুনের ঘটনাও ঘটে।মামলা দায়ের হয়। সে ক্ষেত্রে খোঁয়াড় ব্যবস্থা একটি সুন্দর সমাধান।
আমাদের গ্রামে বাবর আলীর বাড়িতে ছিলো খোঁয়ার বা পাণ্ডব। গ্রামের কাছাকাছি যাদের ফসলের ক্ষেত ছিলো ছেড়ে রাখা গবাদী পশুর কারণে তা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ছাগল , গরুর পেটে চলে যেতো সবুজ ধান, পাট, গম, ছোলা, সর্ষে ইত্যাদি। বীজ বোনার পর বা ফসল পাকার সময় পাখপাখালীর হাত থেকে  ক্ষেত বাঁচানোর জন্য চাষীরা ক্ষেতের মধ্যে কালি মাখা মাটির হাঁড়িতে চুন দিয়ে চোখ-মুখ এঁকে লাঠির মাথায় টাঙিয়ে রাখতো। অনেকে খড়ের উপর ছেঁড়া জামা-প্যাণ্ট পড়িয়ে কাকতাড়ুয়া বানাতো। অনেকে কানেস্তারা পেটাতো । কাকতাড়ুয়ার ভয়ে পাখিরা উড়ে গেলেও গরু, ছাগল তাড়ানোর কোনো সহজ উপায় ছিলোনা। অনেকে পাটকাঠি বা বাবলার কাঁটা দিয়ে বেড়া দিতো। সেসব ছিলো সাময়িক। বেড়া ভেঙে গরু ক্ষেতে ঢুকে যেত ফসল খেতে। গরু বা ছাগল ফসল খাচ্ছে এমন সময় ক্ষেতের মালিক পৌঁছে দেখলো সে দৃশ্য। রক্তে বোনা ধানের শোকে  রক্ত তখন মাস্তিষ্কগামী। লাঠি হাতে তেড়ে গিয়ে তাড়িয়ে ধরে তাড়নপূর্বক ছাগল বা গরুর পাণ্ডব যাত্রা সমাধা করে ক্ষান্ত হতেন তিনি।

অনেককে দেখতাম দড়ির অভাবে ছাগলের কান চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে পাণ্ডবের দিকে। মুখে তার ছাগল আর ছাগল মালিকের প্রতি অপ শব্দের ছড়াছড়ি। বাবর আলীর পাণ্ডবে ছাগল বা গরু জমা দিয়ে ঠিক ফসলের ক্ষতি পূরণ হতো না। ছাগল পিছু দু টাকা আর গরু পিছু পাঁচ টাকাতে আর কী পূরণ হয়। কিন্তু ছাগলের মালিককে ছাগল ছাড়াতে গেলে দিতে হতো কুড়ি টাকা আর গরু ছাড়াতে গেলে দিতে হতো পঞ্চাশ টাকা। গ্রামের ভাষায় বলে – খাট পোড়ে পুড়ুক ছারপোকা তো মরবে। এতেই ফসলের মালিকের প্রাণ জুড়াতো । অনেক দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেরা রাস্তা থেকে যার তার ছাগল ধরে পাণ্ডবে দিয়ে এসে প্রাপ্ত টাকায় লজেন্স বা বিস্কুট খেতো। বাবা পয়সা না দেওয়াতে ছেলে নিজেদের ছাগল নিয়ে গিয়ে বাবর আলীর কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আসতো। বাবা ছেলেকে পেটাতে পেটাতে বলতেন – ‘ তোর মতো ছেলেকেই পাণ্ডবে দেওয়া উচিত। ‘ সে ছেলে পিতৃ বাক্য সত্য প্রমাণ করেছিলো পরবর্তীতে জেলখানায় গিয়ে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *