খড়কুটোর জীবন : পাড়ার সেই নাটকে ভাই । পর্ব ১০ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
‘পথের পাঁচালী’র হরিহরের মতো কথকঠাকুরেরা গ্রাম জীবন থেকে কবেই বিদায় নিয়েছেন। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে। তাই গল্পদাদুর আসর আর বসে না। ক্ষেন্তবুড়িরা হাঁড়িগুলি আলনায় রেখে আর শাড়ীগুলি উনানে বিছিয়ে পা ছড়িয়ে উকুন দেখতে দেখতে নাতি-নাতনীদের সঙ্গে আর সীতার বনবাসের কাহিনী বলেন না সেই কবে থেকে। চারণের দল আজ ইতিহাস। ‘ভাট বকিসনা’ আজ কথার কথা। কবির গান, আখড়াই গান, হাফ-আখরাই গান, খেউর গান, তরজা গান, মানিক পীরের গান আর কোথাও শুনি না। গম্ভীরা, অষ্টক, রাসবেঁশে, চটকা, জারি, আলকাপ,সারি এখন লোকসংস্কৃতির গবেষণার বিষয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকেও কোথাও কোথাও এসব দেখতাম। যা এখনো কিছুটা বহমান। তবে গ্রামে বসতো বাউল গানের আসর। ফকিরেরা মত্ত হতেন মুর্শিদা বা মরফিরাতি গানে। চৈত্র মাস জুড়ে চলতো বোলান গান। মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে হতো ঝাপান গান। আর এসবের পাশাপাশি হতো গ্রামের শখের দলের যাত্রা বা নাট্যাভিনয়। তবে সিনেমা আর টেলিভিশনের দাপটে সেসব ছিলো ম্রিয়মান। সিনেমা বা ব্যান্ডের গান থাবা বসাচ্ছিলো গ্রাম জীবনের উপর।
ছোটো বেলায় বাড়িতে সকালবেলা চা খেতে আসতেন পাড়ার অনেকে। বংশী দাদু আমাকে রবিঠাকুরের বা নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতে বলতেন। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রণাম ঠুকে বলতে শুরু করতাম – নমস্কার, তালগাছ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে … ইত্যাদি। মাঝে মাঝে নিজেও এক পায়ে দাঁড়িয়ে যেতাম মজা করে। এই শিক্ষা কাজে লাগতো স্কুলের রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর সময়।
আমাদের আলফা নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখ অনুষ্ঠিত হতো রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। মাসখানেক আগে থেকেই দেবু মাস্টারের ( দেবব্রত দে) তত্ত্বাবধানে শুরু হয়ে যেতো মহড়া। কে কোন কবিতা আবৃত্তি করবে, নাটকে কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করবে তার জন্য প্রথমে চলতো নির্বাচনী পর্ব। তার পর চূড়ান্ত পর্বে যারা জায়গা পেতো তাদের নিয়ে চলতো জমজমাট রিহার্সাল। রেণুকা দিদিমণি আবৃত্তি নিয়ে বসতেন। মনে আছে এক দিদি আবৃত্তি করছে – ‘রথযাত্রা নোকারণ্য মহা ধূমধাম।’ দিদিমণি যত বারই বলে দিচ্ছেন — ‘নোকারণ্য নয়, লোকারণ্য’; দিদি ততবারই বলে চলেছে ‘নোকারণ্য’। দিদিমণির ধমক উপেক্ষা করে আমাদের সে কী হাসি। পরে দিদিকে অনেকে ‘নোকারণ্য’ বলে ক্ষ্যাপাতো। আমি আবৃত্তির দলে। নাটকের দলে জায়গা হয়নি। আর আমি পাগলা দাশুর মতোও করিনি। কিন্তু নাটকের রিহার্সাল দেখার সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত করেনি। সেবার হচ্ছিলো রবিঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয়। পিসি মশাই পিসিমা, দই ওয়ালা, অমল, ছেলের দল, সেপাই, মোড়ল, সুধা, ঠাকুরদা, কবিরাজ প্রহরী নানান চরিত্র। ঘোষ পাড়ার রসময় দা দই ওয়ালা। ‘দই, ভালো দই’ বলে সে অভ্যস্ত হাঁক পাড়তো। কেননা সকাল বেলা সে প্রতিদিন সত্যি করেই দই বিক্রি করতে যেতো। রুগ্ন অমলকে দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। পাঁচমুড়ো পাহাড়, শ্যামলী নদী, ডুরে শাড়ী, ক্রৌঞ্চ দ্বীপ আমাকেও কল্পনাতুর করে তুলতো অমলের মতো। মনের মধ্যে জন্ম নিতো অসংখ্য চিত্রকল্প। ঠাকুরদার সেই সংলাপটা খুব ভালো লাগতো। — ‘ঝরনা না থাকলে কি চলে! একেবারে হীরে গলিয়ে ঢেলে দিচ্ছে। আর, তার কী নৃত্য! নুড়ি গুলোকে ঠুং-ঠাং ঠুং-ঠাং করে বাজতে বাজতে কেবলই কল্ কল্ ঝর্ ঝর্ করতে করতে ঝরনাটি সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। কোনো কবিরাজের বাবার সাধ্য নেই এক দণ্ড কোথাও আটকে রাখে।’ আমার কল্পনাচারী মনেও কারোর আটকানোর সাধ্য ছিলো না। সুধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো যে দিদি নাটক শেষ হলে অমলের নাম করে তাকে ক্ষেপানো হতো। আর অমলরূপী দাদাকে সবাই বলতো — ‘সুধা তোমাকে ভোলেনি’।
দেবু স্যারের নির্দেশে আমরা দু’দিন আগে থেকেই গ্রাম থেকে বাঁশ, কাঠের চৌকি বাড়ি বাড়ি থেকে জোগাড় করে করে আনতাম। স্কুলের পার্শ্ববর্তী সিনিয়র কাকা বা দাদাদের সাহায্যে গড়ে উঠতো মঞ্চ, গ্রীন রুম। দর্শকাসন সবুজ স্কুল মাঠ। ঠাকুরকে সবাই প্রার্থনা করতাম সন্ধ্যায় যেন কালবৈশাখী ঝড় না আসে। গান, কবিতা, বক্তৃতা আর নাটকে জমজমাট হয়ে উঠতো সে রবীন্দ্র- নজরুল সন্ধ্যা। গ্রামের বয়স্ক মানুষ মঞ্চে উঠে প্রতি বছর একটি ছড়া বলতেন। সে ছড়ার একটি লাইন আজো মনে আছে। ‘পট -পটাং পট-পটাং পট-পটাং পট / পেটটি ফেটে বেরিয়ে গেলো মস্ত ছাতুর মঠ।’ আর দয়াল পালের বাঁধা গান — ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।’
গ্রামের সমস্ত মানুষ সে আনন্দ উপভোগ করতো। গ্রামেও সিনিয়ররা প্রতিবছর করতো নানান যাত্রাপালা বা নাটকের অভিনয়। ‘রক্তে বোনা ধান’, ‘মা মাটি মানুষ’, ‘দেবী গর্জন’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘নবান্ন’, ‘ময়লা আঁচল’, ‘কাজল রেখা’, ‘রূপবান কন্যা’, ‘নয়ন তারা’ কত না তাদের নাম। মাঝে মাঝে গ্রামে আসতো গণনাট্য সংস্থার কোনো না কোনো প্রযোজনা। বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, ভৈরব গাঙ্গুলী, মহাদেব হালদার, অগ্রদূত প্রভৃতি নামের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। একবার এলো এক অদ্ভূত নাটকের দল। যাদের সাজসজ্জা, মঞ্চ, আলো, মাইক কিছুই লাগলো না। আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। অভিনেতারা আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করে চললেন অভিনয়। মনে আছে তাঁরা সেদিন করেছিলেন বাদল সরকারের ‘ভোমা’ নামক নাটকের অভিনয়। এ নাটককে বলে ‘পথ নাটক’ কাকার কাছে শুনে নিয়েছিলাম। পরে কাকা গল্প বলেছিলেন বিখ্যাত পথ নাট্যকার সফদর হাসমির কথা। শুনে ছিলাম তিনি দিল্লীর রাজপথে নাটক করতে গিয়ে একদিন ছুরিকাহত হয়ে প্রাণ হারান। সে নাটক ছিলো নাকি প্রতিবাদের। ভেবে পাইনি নাটকের জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে।
সেবার আমাদের মুসলমান পাড়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘আপাং দুলাল’ যাত্রা পালা। সন্ধ্যা বেলা থেকেই শুরু হয়ে গেছে বাজনা। ক্ল্যারিওনেট, ফ্লুট, ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বাদকেরা মাথা নাড়াতে নাড়াতে জমিয়ে তুলছেন আসর। মাইকে ঘোষণা চলছে — ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয়ে যাচ্ছে আমাদের যাত্রা পালা ‘আপাং দুলাল’। শ্রেষ্ঠাংশে দীন, ইজরায়েল, হালিম, বাসু, সুবল আরো অনেকে। বিশেষ আকর্ষণ চাপড়া থেকে আসছে অভিনেত্রী মিস চায়না। আপনারা শিঘ্র চলে আসুন। যথা সময়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। বৃদ্ধ রাজার দুই মাতৃহীন পুত্র আপাং আর দুলালকে নিয়ে নতুন রাণীর ষড়যন্ত্র চলছে। এমন সময় গ্রীনরুম থেকে ভেসে আসছে একটা কোলাহল। গিয়ে দেখি সুবল দাস ঝামেলা করছে। তার বক্তব্য সবাই সমান চাঁদা দিয়েছি। বাকিরা ভাড়া করা ঝলমলে পোশাক পড়লে সে কেন পাবে না। অধিকারী সুজা কাকা বোঝাচ্ছে ‘তুই চাকর। তোর এই ছেঁড়া গেঞ্জির পোশাক পড়তে হবে। চাকর কখনো ওসব পড়েনা।’ সুবলের কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বক্তব্য — ‘যাত্রা দেখতে আমার বউ আর শালি এসেছে। তাদের সামনে এই পোশাকে ইজ্জত থাকবেনা।’ যাই হোক তাকে বুঝিয়ে মঞ্চে পাঠানো হলো। তারপর আর এক বিপত্তি। সেনাপতি একজনের পেটে তলোয়ার চালিয়েছে। খোঁচা খেয়ে সে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু আলতা ভেজা নেকড়া খুঁজে না পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সংলাপ শুরু করেছে — ‘মরিনাই আমি মরিনাই, আমার আলতার প্রয়োজন।’ সে কথা শুনে আমাদের কী হাসি। যাত্রার শেষে দুষ্টু রাণীর শাস্তি। কিন্তু দীনুর অদ্ভূত উচ্চারণে সংলাপ — ‘আজা মশাই, আজা মশাই আণীর পায়ি অক্ত।’ আমরা মজা করে পরে এই সংলাপের সঙ্গে জুড়তাম — ‘অক্ত নয়, অক্ত নয়, নাল অঙ।’ এই অপভ্রংশীয় উচ্চারণে বেশ আমোদ হতো। বিবেকের গান দিয়ে শেষ হলো সে যাত্রাপালা। ঘুম চোখে গ্রাম্য মানুষ তার পর সেঁধিয়ে গেল আপন আপন গহ্বরে।
আমরা যখন হাইস্কুলে পড়ি সেই সময় অভিনয় করেছিলাম – ‘দেনা পাওনা’, ‘ফেরিওয়ালা’, ‘বেকারের জ্বালা’ নামে কয়েকটি নাটক। ‘বেকারের জ্বালা’ নাটকে একটা ডায়লগ ছিলো — ‘বাবা, তুমি যেদিন ফুলের মালা গলায় দিয়ে জন্মের মতো অফিস থেকে বিদায় নিলে…।’ এটাই পরিতোষ বলতো — ‘বাবা, তুমি যেদিন ফুলের গলা মালায় দিয়ে জন্মের মতো অফিস থেকে বিদায় নিলে…।’ জলিল কাকার সংলাপটা আজো মনে আছে — ‘হাড় খেয়েছ,মাংস খেয়েছ আর কী খাবে কষাই? ফক্কা সব ফক্কা।’ একথা বলতে বলতে তার সেই কান্না মিশ্রিত হাসি আজো লোম খাঁড়া করে দেয়। আমার নিজের একটা সংলাপ বেশ মজাদার ছিলো।
— নাম কি তোর?
— আজ্ঞো, বাঁশকাবাড়ি কঞ্চিচরণ শ্রীমান শিবুপাল।
শুধু গ্রামে নয়। এই নাটকের কলশো-ও করেছিলাম আমরা কবি বিজয় লাল প্রবর্তিত লোকসেবা শিবিরের গদাধরের মেলায়। বড় আন্দুলিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণী তখন আমি। বন্ধুদের প্রশংসায় আত্মহারা হয়েছিলাম। পরে চাকুরী সূত্রে কলকাতার কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্যের কারণে দেখেছি অসংখ্য নাটক। ‘সতেরই জুলাই’, ‘মুখোশ’, ‘চিটেগুড়’, ‘ঈপ্সা’, ‘সিনেমার মতো’, ‘নাটক ফাটক’, ‘অটো’, ‘ইঁদুর মানুষ’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রভৃতি নাটক দেখে বুঝেছিলাম কাকে বলে নাইট্য কলা। হাসি পেতো ছোটোবেলার সেইসব নাট্য রঙ্গের কথা মনে করে। কিন্তু সে আমোদে কোনো খাদ ছিলো না। সে নাটকে কোনো নাটক ছিলোনা। ছিলো গ্রাম্য মানুষের সরলতায় ভরা রসপিপাসা। আচার্য ভরত তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’টা পরিমার্জন করবেন ভাবতেন হয়তো ইন্দ্রের সভায় বসে মরপৃথিবীর মৃত্তিকালীন মানুষদের সে সব অভিনয় দেখে।
(ক্রমশ)