কাগজের নৌকো। পর্ব ৩। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

পৌষ মাসের সকাল, বেলা প্রায় ন’টা কিন্তু উত্তরবাংলার এই মফস্বল শহরের আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, অভিমানী আষাঢ়ের জলভরা মেঘ নয় বরং বিগতস্পৃহ মানুষ যেমন ভবহাটের দুয়ারে আপনমনে দাঁড়িয়ে থাকেন তেমন ধূসর বর্ণে অস্তমিত কুসুমরৌদ্র, চঞ্চলা বাতাস বইছে চরাচরে, আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আসিফ টাউন ইস্কুলের খেলার মাস্টারমশাই মানববাবুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার আজ টসে জিতলে কি ব্যাট নেওয়া ঠিক হবে?’

সামান্য চিন্তিত স্বরে মানববাবু বললেন, ‘দ্যাখ, আমাদের প্ল্যান ছিল প্রথমে ব্যাট করব, এখন যা ওয়েদার দেখছি তাতে’, একমুহূর্ত চুপ করে থেকে আসিফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর কি মনে হয়?’

 

ক্লাস ইলেভেনের আসিফ ইস্কুল টিমের অধিনায়ক, নিজে ডানহাতি ব্যাটসম্যান, ইতিমধ্যে জেলা স্তরে প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসাবে যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছে। এই টুর্নামেন্টে দুটি শতরান আর তিনটে অর্ধশতরান সহ দশটা ম্যাচে রান প্রায় ছ’শো সত্তর-এর আগে বিগত আটাশ বছরে যা কেউ কখনও করতে পারেনি, সর্বোচ্চ রান ছিল দুলাল গোস্বামীর, ছ’শো কুড়ি, তাও সেই উনিশশো তিয়াত্তর সালে, দুলাল পরে বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলেছিল, এবারেও সকলে মনে করছে আসিফের বাংলা দলে স্থান হবেই, তার খেলা দেখতে আজ জেলা স্তরের এই ফাইন্যাল ম্যাচে বাংলার একজন নির্বাচকও মাঠে উপস্থিত থাকবেন অথচ কিশোর ছেলেটি অচঞ্চল, অস্থায়ী ড্রেসিংরুমের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘বল করাই উচিত কিন্তু আমাদের ফাস্ট বোলার তেমন নেই তাছাড়া লিগের দুটো ম্যাচ হেরেছি রান তাড়া করার সময়, প্রথমে ব্যাট করে একটা বড়ো স্কোর তুলে দিতে পারলে মনে হয় ওরা চাপে পড়ে যাবে।’

–ঠিকই বলেছিস, তাহলে তাই কর। আমাদের ব্যাটিং অর্ডার একই থাকছে।

–স্যার, আজ আমি ওপেন না করে ওয়ান ডাউনে যাই?

আসিফের কথা শুনে দলের বাকি খেলোয়াড়রা একটু যেন অবাকই হল, ওপেনার হিসাবে সে অপ্রতিম-কুড়ি ওভারের ম্যাচে প্রথম চার ওভার ফিল্ড রেস্ট্রিকসনের সুযোগ নিয়ে দ্রুত রান তুলতে সিদ্ধহস্ত, সে কিনা এরকম উত্তেজনায় থমথমে ম্যাচে ওপেন করবে না! মানববাবু নিজেও কলকাতায় ক্লাব স্তরে ক্রিকেট খেলেছেন, অনেক সময় বড়ো ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের উৎকণ্ঠা যে স্বাভাবিক তা খুব ভালো করেই জানেন কিন্তু আজ এই ম্যাচে আসিফের উপর তিনি অনেকটা নির্ভর করে রয়েছেন, প্রতিপক্ষ ‘সুরবালা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ আঠাশ বছরে কখনও এই টুর্নামেন্ট জেতেনি ফলে তারাও আজ মরিয়া, আন্ডারডগ হিসাবে তাদের উপর প্রত্যাশার চাপও অনেক কম। শেষ মুহূর্তে হঠাৎ জেতা টিমের ব্যাটিং অর্ডার বদল মোটেও ভালো নয়, এমন সিদ্ধান্তে খেলোয়াড়দের মনে দ্বিধা জন্ম নেয় তবুও সরাসরি প্রস্তাব নাকচ না করে আসিফের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? এনি নিউ প্ল্যান?’

–স্যার, আমি আজ একটা দিক ধরে খেলতে চাইছি।

–জানি, দ্যাট ওয়াজ আওয়ার প্ল্যান কিন্তু তুই ওপেন করেও একটা দিক ধরে রাখতে পারবি, ওয়ান ডাউন যেতে চাইছিস কেন?

অভিজ্ঞ অধিনায়কের মতো সতেরো বছরের কিশোর সামান্য হাসল তারপর দলের প্রত্যেকের মুখের উপর একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘দুটো কারণ স্যার, এক-অর্ণব গত ম্যাচে ফিফথ ডাউন নেমে উনিশ বলে চল্লিশ রানের যে ঝোড়ো ইনিংস খেলল তাতে আজ ও যদি সেরকম একটা কিছু করতে পারে তাহলে আখেরে আমাদেরই লাভ আর দুই-হঠাৎ ওকে ওপেনে দেখলে সুরবালার গেম প্ল্যান খানিকটা হলেও আপসেট হবে, আমি ওদের এই ধাক্কাটা প্রথমেই দিতে চাই।

–আর যদি তোর এই টোটকা কাজ না করে তাহলে?

‘তাহলেও আমাদের ক্ষতি কিছু নেই আমি ওয়ান ডাউনে নামছি তাছাড়া আরও একটা কথা’, আসিফকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মানববাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী কথা?’

আরও একবার মহাদেবের জটার মতো মেঘমালার দিকে চেয়ে আসিফ বলল, ‘এই ওয়েদারে বল সুইং হবেই, অর্ণব প্রথম থেকেই অবিনাশকে আক্রমণ করতে পারবে আর যদি সফল হয় তাহলে ম্যাচ আমাদের পকেটে স্যার!’

দামী ব্যাটসম্যানের অহংকে সামান্য আঘাত করার জন্যই মানববাবু মৃদু হেসে শুধোলেন, ‘কেন তুই অবিনাশকে আক্রমণ করতে পারবি না?’

হিমশীতল জলের মতো শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল আসিফের, ‘স্যার এই ম্যাচ আমাদের দুজনের ডুয়েল নয়’ , একমুহূর্ত চুপ করে থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ী গলায় বলল, ‘উই হ্যাভ টু উইন দিস ট্রফি। সকলে জানে আমাদের ইস্কুল লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয়, আজ হেডস্যার যেন উঁচু গলায় সবার সামনে বলতে পারেন, আমার ছেলেরা জিতেছে। আমি কেউ নই স্যার এখানে, জাস্ট আ টিম প্লেয়ার।’

পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির কিশোর আসিফ মোহাম্মদের মুখ মেঘাবৃত কুসুম আলোর স্পর্শে উজ্জ্বল, সেদিকে তাকিয়ে মানববাবুর মনে হল, ঠিকঠাক সুযোগ পেলে এই ছেলে একদিন ইন্ডিয়া টিম লিড করবে!

 

কালেকটার আপিসের বড়ো মাঠ আজ জনসমুদ্রে উত্তাল, উনিশশো ষাট সাল থেকে শুরু হওয়া এই জেলা টুর্নামেন্ট ঘিরে মানুষের উৎসাহের অন্ত নাই,আজ রবিবার ছুটির দিন হওয়ায় ভিড়ও অনেক বেশি, চারদিকে সারি সারি দোকান বসেছে, ঘুঘনি, ফুচকা, চায়ের দোকান, ঝালমুড়ি-সব মিলিয়ে রথযাত্রার মেলার মতো নিস্তরঙ্গ মফস্বল যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। মাঠটিও ভারি মনোরম, নতুন ঘাসে মলমল গালিচার উপর যেন ‘পিচ’কে একটুকরো খয়েরি দ্বীপের মতো দেখাচ্ছে, মাঠের চারদিকেই কনক্রিটের গ্যালারি-প্রায় চার হাজার লোক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারে, বামদিকে গ্যালারির ওপারে কিছুটা পথ গেলেই নদীচর, এখন শীতকালে মহানন্দা ম্রিয়মান, ঘাটে অলস দু-একটি নৌকো লেগে রয়েছে, ধূ ধূ বালুচরের উপর দিয়ে বয়ে আসছে উত্তরপথগামী বাতাস, ডানপাশে দীর্ঘকায় দেবদারু গাছে ঢাকা কুমারীর সিঁথির মতো পথটি চলে গেছে রেল ইস্টিসানের দিকে, তারও পরে ধীরে ধীরে কমে এসেছে জনপদের উচ্ছল প্রকাশ, দিকচক্রবালরেখা অবধি বিস্তৃত শষ্য প্রান্তরের কাছে মাথা নিচু করে মুখ নামিয়েছে চুম্বন প্রত্যাশী আকাশ-অল্পক্ষণ চেয়ে থাকলে মনে হয় মায়াচরাচর এখনও কত অপরূপ আর এই সামান্য আয়োজনেই উত্তরের নির্জন মফস্বলকে রূপসী তরুণীর মতোই অহঙ্কারী দেখায়।

 

মাঠের অদূরে বিশেষ এবং সম্মাননীয় অতিথিদের জন্য তৈরি মঞ্চের উপর পাশের চেয়ারে বসে থাকা এসডিও সাহেবকে বাংলার নির্বাচক সুশীল সমাদ্দার সামান্য হেসে বললেন, ‘মশাই এখানে এসে মনে হচ্ছে ব্রিটেনের কোনও কান্ট্রি সাইডে কাউন্টি দেখতে এসেছি, আকাশও তেমনই ঘোলাটে, এখনই হয়তো গ্রেস সাহেব ব্যাট করতে নামবেন!’

এসডিও মৈত্র সাহেবও মৃদু হেসে বললেন, ‘গ্রেস না থাকলেও নেভিল কার্ডাস কিন্তু রয়েছে!’

–কীরকম?

মঞ্চের নিচে একজন কালো কোট আর সাদা ধুতি পরা প্রৌঢ় মানুষকে দেখিয়ে মৈত্র বললেন, ‘ওই যে দেখছেন, জগন্নাথ পাল, নিজের একটা কাগজ রয়েছে, সেখানে শুধুই খেলার খবর থাকে, গত ম্যাচে টাউন ইস্কুলের আসিফ সেঞ্চুরি করায় কী হেডলাইন করেছিল জানেন?’

কৌতুকের সুরে সুশীলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী?’

–আসিফের শতরান প্রমাণ করল স্কোরবোর্ড শুধুই গাধা নয়!

 

স্কোরবোর্ডের দুপাশে দুটি অস্থায়ী ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে মাঠে পা দিল দুই অধিনায়ক আসিফ আর অবিনাশ, কয়েক হাজার মানুষের করতালির শব্দে মুহূর্তের জন্য গমগম করে উঠল মাঠ-যেন জেলা স্তরের কোনও ম্যাচ নয়, আসলে টস করতে নামছেন ভারত আর ইংলন্ডের অধিনায়ক, আজ আম্পায়ার দুজনও এসেছেন কলকাতা থেকে, দুজনেরই প্রায় দুশোটির বেশি রঞ্জি ম্যাচ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, পিচের ঠিক আগে প্রধান আম্পায়ার বিকাশ প্রসাদ হেসে দুই অধিনায়কের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘গুড মর্নিং!’

কয়েক আকাশে উঠতেই অবিনাশ বলে উঠল, ‘হেড!’

নিচে মাটির উপর মুদ্রা পড়তেই তিনজনে ঝুঁকে দেখলেন অশোকস্তম্ভ জ্বলজ্বল করছে, প্রসাদ অবিনাশকে অভিনন্দন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সো জেন্টলম্যান হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’

প্রায় ছয় ফুট লম্বা বাঁহাতি ফাস্ট বোলার অবিনাশ ভট্টাচার্য ক্ষণমাত্র অপেক্ষা না করে উত্তর দিল, ‘ফিল্ডিং স্যার।’

অবিনাশের কথায় সামান্য বিস্মিত হল আসিফ, সুরবালার যা ব্যাটিং তাতে রান তাড়া এবং আত্মহত্যা প্রায় সমার্থক, পিচের দিকে একবার ভালো করে তাকাল, ভালোই ঘাস রয়েছে কিন্তু এই ধরণের ম্যাচে সাধারণত ব্যাটিং উইকেট হয়, তাহলে কি সবুজ পিচ আর মেঘাবৃত শীতল সকালের জন্যই এমন সিদ্ধান্ত?

ভাবনাটিকে ডালপালা মেলতে না দিয়ে সাবলীল মুখে ড্রেসিংরুমের দিকে রওনা দিল আসিফ, অবিনাশ দু হাত তুলে টিম ডাকতে শুরু করেছে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মুখ ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘গুড লাক!’

মুখ না ফিরিয়েই অবিনাশ বলল, ‘আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি!’

কোনও কথা না বলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল আসিফ, এই সময় অবিনাশের মতো রাগী বোলারকে কিছু বলা মানেই সেটি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে।

 

সুরবালার ড্রেসিংরুমে গেম কোচ দেবাশিষ বাবু অবাক হয়ে পাশে দাঁড়ানো সহ-অধিনায়ক মনোজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘টস জিতলে তো ব্যাট নেওয়ার কথা, অবিনাশ হঠাৎ ফিল্ডিং নিল কেন?’

–আমিও তো স্যার কিছু বুঝতে পারছি না!

–তোকে বলেনি কিছু?

মাথা নেড়ে মনোজ বলল, ‘না স্যার, টসে যাওয়ার আগে আপনার সামনেই তো কথা হল।’

বিরক্ত মুখে দেবাশিষ বাবু বললেন, ‘ডাক তো একবার ওকে, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! সব সময় ওর এই গোয়ার্তুমির ফল আমাদের ভুগতে হয়। ডাক ওকে।’

খেলা শুরুর আগে অবস্থা বেগতিক দেখে মনোজ ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘স্যার, ব্যাটসম্যান নেমে পড়ছে, আমাদেরও যেতে হবে এবার,আমি বরং মাঠে নেমে ওকে বলব যাতে ব্রেকে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করে।’

দেবাশিষ বাবুর জন্য আরও একটি চমক অপেক্ষা করছিল, দেখলেন আসিফের জায়গায় অর্ণব ওপেন করতে নামছে, গত ম্যাচে ছেলেটির ওইরকম ভয়ঙ্কর ব্যাটিং-এর কথা মনে পড়ায় বিস্মিত কণ্ঠে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘আজ সুরবালার কপালে দুঃখ আছে।’

 

সুশীল সমাদ্দার ওপেনিং-এ আসিফকে না দেখে কিছুটা হতাশ গলায় বাম পাশে বসা জেলার প্রাক্তন বোলার অমিত সেনকে বললেন, ‘আসিফ ওপেন করে বলে শুনেছিলাম, আজ তো নামল না!’

অমিত মোটামুটি বছর দশেক জেলা স্তরে খেলে পাঁচ ছয় বছর হল অবসর নিয়েছেন, খুব আহামরি কিছু নয়, ডানহাতি স্পিনার হিসাবে চলনসই বলা যায়, তিনিও একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘তাই তো দেখছি। হয়তো ওয়ান ডাউনে নামবে।’

 

মাঠে নেমেই অবিনাশের পাশে এসে মনোজ চাপা গলায় বলল, ‘স্যার হেব্বি খেপেছে তোর ওপর, ব্যাটিং বাদ দিয়ে বোলিং নিলি যে!’

মনোজের দিকে না তাকিয়ে নিচু গলায় অবিনাশ উত্তর দিল, ‘স্যারের কথা পরে ভাববি, এখন খেলায় মন দে। সবাইকে ডাক এখানে।’

দশ জন অবিনাশকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল, খেলা শুরুর আগে এমন মানববৃত্ত এখানকার মানুষ আগে কখনও দেখেনি, দুই ব্যাটসম্যানও যেন কিছুটা হতভম্ব, আম্পায়ার বিকাশ প্রসাদ উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে একবার হাতঘড়ি দেখে উঁচু গলায় বললেন, ‘টেন মিনিটস মোর, উই উইল স্টার্ট বাই শার্প নাইন থার্টি।’

 

অবিনাশ বৃত্তের মধ্যে সকলের মুখের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘শোন, আমাদের টার্গেট কুড়ি ওভারে ওদেরকে আশির মধ্যে শেষ করব। কেউ কিছু বলবি?’

উইকেট কিপার জীবন ঠাণ্ডা মাথার ছেলে, নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘আসিফের কথাটা ভুলে যাসনা।’

–ভুলে যাইনি, আই উইল হ্যান্ডল হিম। তোরা শুধু মাথায় রাখিস একটা মাছিও যেন ফিল্ডিংয়ে না ফসকায়, প্রতিটা রান আজ মূল্যবান।

মনোজ জিজ্ঞাসা করল, ‘বোলিং কি তুই ওপেন করবি?’

–হ্যাঁ, নেক্সট চেঞ্জ পার্থ।

‘পার্থ?’, অবাক গলায় জীবন শুধোল, ‘দুজন ফাস্ট বোলার দিয়ে শুরু করবি? আমরা তো তোর সঙ্গে উল্টো দিকে দেবব্রতর স্পিন দিয়েই শুরু করি, এতদিন তো তাই চলে আসছে, আজ হঠাৎ শেষ বেলায় বদল করবি?’

‘অন্যদিন তাই করি, কিন্তু আজ করব না, দেবু পরে আসবে।’, এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অবিনাশ আত্মপ্রত্যয়ী গলায় বলল, ‘আর কথা নয়, চল! মনে রাখিস আজ আমরা জিতব।’

 

বোলিং মার্কে যাওয়ার আগে বিচিত্র ফিল্ড সাজাল অবিনাশ, জেলা স্তরে তো দূরের কথা আজ অবধি ভারতের জাতীয় দলের কোনও বোলারও এমন ফিল্ড সাজানোর কথা চিন্তাও করেনি, অবাক হয়ে গোটা গ্যালারি দেখল ডানহাতি অর্ণবের জন্য তিনটে স্লিপ, একটা গালি, একটা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, কভার একস্ট্রা কভার, সিলি মিড অফ আর মিড অফ নিয়ে অনসাইড সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রেখে বোলিং মার্কের দিকে হাঁটা শুরু করল অবিনাশ। আলো ও ছায়ার আলপনায় ঝিমঝিম বাতাসে ভরে রয়েছে মাঠ, বিগতরাত্রির অস্পষ্ট কাজলের মতো বিবর্ণ আকাশ, আম্পায়ার বিকাশ প্রসাদ তাঁর সুদীর্ঘ ক্রিকেট পরিচালনার জীবনে একজন কিশোরের এত স্পর্ধা কখনও দেখেননি, ওঁর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল একটি মাত্র শব্দ, ‘আমেজিং!’

 

নির্বাচক সুশীল সমাদ্দার বিস্মিত কণ্ঠে ডানপাশে মৈত্র সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেটা কি পাগল?’

অমিত সেন পাশ থেকে জবাব দিলেন, ‘ওকে এদিকের ছেলেরা মাঠে কী নামে ডাকে জানেন?’

মুখ ফিরিয়ে সমাদ্দার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নামে ডাকে?’

–ন্যাটা রয়, রয় গিলক্রিস্ট!

সোজা হয়ে বসে সমাদ্দার শুধোলেন, ‘খুব জোরে বল করে নাকি? বাঁ হাতি?’

সামান্য হেসে অমিত বললেন, ‘দেখুন, নিজের চোখেই দেখুন, আমি ছেলেটিকে অনেকদিন থেকে খেয়াল করছি, ভিতরে মশলা আছে।’

–কী নাম?

–অবিনাশ, অবিনাশ ভটচায!

 

টাউন হলের ড্রেসিংরুমও ঈষৎ চঞ্চল, মানববাবু আসিফের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে কৌতুকের সুরে বললেন, ‘অবিনাশের আজ সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছে!’

আসিফের মুখ কঠিন, কোনও উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘আজ গোথাম শহরের ম্যাচ হবে, অনেকদিন পর আবার জোকার জেগে উঠেছে।’

 

প্রথম বলটি আউট সুইং, নির্বিঘ্নে ব্যাট তুলে ছেড়ে দিল অর্ণব, পরের বলও তাই, দুটিই নিজের গ্লাভস থেকে ফেরত পাঠাল জীবন, উইকেটের পেছনে মোটামুটি দূরত্বে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারল অন্তত একশো চল্লিশ কিলোমিটার বেগে প্রতিটি বল ছুটে আসছে, তৃতীয় বল নিয়ে বোলিং মার্কে যাওয়ার সময় গ্যালারির দিকে একবার তাকাল অবিনাশ, সাদা রুমাল নাড়ছে কে যেন, অস্পষ্ট অবয়ব, তবে হাত নাড়ার আদলটি ভারি চেনা, ঠোঁট কামড়ে উইকেটের দিকে ছোটা শুরু করল, দেহ সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, বল ছাড়ার পরমুহূর্তে অর্ণব দেখল গুড লেংথ স্পটে পড়ে সামান্য লাফিয়ে প্রেমিকার আলতো আদর হয়ে বলটি হতবাক ব্যাট স্পর্শ করে অলৌকিক নদীচরের বাতাসের মতো প্রথম স্লিপের হাতে পৌঁছে গেল, বিকাশ প্রসাদ আপিল হওয়া মাত্র তর্জনী আকাশের দিকে তুললেন, টাউন হলের স্কোর দাঁড়াল শূন্য রানে এক উইকেট, বোল্ড বাই অবিনাশ কট বাই আকাশ।

 

আসিফের ছোটখাটো শরীরটি মাঠে পা দিতেই গর্জন করে উঠল গ্যালারি, কোনওদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে আসছে আসিফ, হঠাৎ কী মনে হওয়ায় একবার মুখে তুলে ডানদিকে গ্যালারির দিকে তাকাল, অস্পষ্ট একটি সাদা রুমাল উড়ছে বাতাসে, হাতটিকে চিনতে পারল আসিফ, মনে মনে ব্যাট তুলে একবার সেদিকে দেখাতেই মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি, খুব নির্ভার মনে হল নিজেকে, আপনমনে অস্ফুটে বলল, আজ দেখিয়ে দাও!

ওয়ান ডাউনে আসিফকে নামতে দেখে মঞ্চের উপর অমিতের দিকে তাকিয়ে সমাদ্দার বললেন, ‘দিস ইজ রিয়েলি টাফ সিচুয়েশন।’

মৃদু হাসলেন অমিত, ‘বাংলার হয়ে খেলাবেন, এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে কেমন খেলে একবার দেখবেন না?’

‘আপনি কি আসিফকে পছন্দ করেন না?’, সামান্য যেন রূঢ় শোনাল সমাদ্দারের গলা।

–কেন করব না, আসিফ যথেষ্ট ভালো ব্যাট তবে মজা কী জানেন এই অবিনাশ ছেলেটির হয়ে কথা বলার কেউ নেই। এমন বোলিং এখানে কেন বর্তমান বাংলা টিমে কেউ করে?

প্রাক্তন স্পিনার অমিত সেনের কথার কোনও জবাব না দিয়ে সোজা মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাংলা রাজ্য ক্রিকেট দলের অন্যতম প্রভাবশালী নির্বাচক সুশীল সমাদ্দার।

 

(ক্রমশ)

সায়ন্তন ঠাকুর
লেখক | + posts

জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্বলে। সায়ন্তন মূলত মূলত গদ্য লেখেন। প্রকাশিত বইপত্তর-- নয়নপথগামী(উপন্যাস), শাকম্ভরী(উপন্যাস), বাসাংসি জীর্ণানি(গল্প সংকলন)।

1 thought on “কাগজের নৌকো। পর্ব ৩। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

  1. এক নিঃশ্বাসে তিন কিস্তি পড়লাম।পরের পর্বের অপেক্ষায়।বেশ ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *