কাফিরনামা । পর্ব ৬। লিখছেন রাণা আলম

‘কলকাতার মধ্যেই সে আরেক কলকাতা। অলিতে-গলিতে বোমা-বন্দুকের কারখানা। বোরখা আর হিজাবের আড়ালে কঠিন চোখের চাহনিতে মেপে নিচ্ছে অচেনা আগন্তুক কে। যেকোনো মুহুর্তে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে কলকাতার উপর জিহাদী নির্দেশে’।
বছর দু-এক আগের কথা। ঠিক এইরকমই সুললিত সুসজ্জিত বাক্যবন্ধে মেটিয়াবুরুজের মুসলমানেরা কতটা ভয়ঙ্কর তা বুঝিয়ে পরিকল্পিত বার্তা ছড়ানো হয়েছিল সোসাল সাইটে। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল তাদের সংগঠিত বিদ্বেষের প্রচারের মাধ্যম হিসেবে এরকম বেশ কিছু তৈরী করা গল্প ছড়িয়েছিল। এবং সাধারণ শিক্ষিত ভদ্রপোশাক পরা মানুষজনের একটা বড় অংশই তা বিশ্বাস করতে উদগ্রীব ছিলেন। এমনিতেই অবশ্যি তারা বিশ্বাস করতেই চান।
বাসে-ট্রেনে-ট্রামে মাস্ক নামিয়ে পান চিবোতে চিবোতে লোকে পার্ক-সার্কাস আর খিদিরপুরের নাম শুনে বাঁকা চোখে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দেওয়ালে পানের পিক ফেলে কন,’
‘ওরা ওরকমই বুজলেন কিনা। হেব্বি ডেঞ্জারাস…’
নিজের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে বোঝার চেষ্টা করে গেছি এই ‘হেব্বি ডেঞ্জারাস’ কথাটার মানে কি? শহর কলকাতায় ফেজ টুপি, দাড়িওয়ালা মুসলমান মানেই অ্যান্টি সোসাল এলিমেন্ট-এরম ভাবার চল রয়েছে। পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, রাজাবাজারে পুলিশ ঢুকতে পারেনা। সূর্মা মাখা চোখে ওরা কথায় কথায় ছুরি-ছোরা বের করে। চারটে করে বিয়ে করে। গন্ডা গন্ডা বাচ্চা পয়দা করে। পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়।
এর বাইরে আছে গুড মুসলিম। অর্থাৎ, যারা দাড়ি রাখেন না, মাথায় ফেজ টুপি পরেন না, প্রাত্যহিক জীবনে নিয়মিত ধর্মাচরণ করেন না, যাদের সুরত-হাল দেখে টাইপো মুসলমান বলে হদিস না পাওয়াতে, নাম শোনার পর অবাক বিস্ময়ে সংখ্যাগুরু সহনাগরিক শুধাবেন,
‘আপনি মুসলমান? তবে যে আগে বললেন বাঙালি?’
বাঙালি মুসলমান তখন মাথা চুলকে ভাবতে বসে এই ‘বাঙালিত্ব’ কবে থেকে ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জুড়ে গেলো। এমনিতেই সে রোজার মাসে তারাবীর নামাজে নিত্যি কামাই দ্যায়, হারাম-হালাল মানেনা বলে ভাই-বেরাদরেরা তাকে ‘সহি’ ভাবতে চান না, তার উপরে যে পরিচয়ে সে বাঁচতে চেয়েছে, তাতেও সংখ্যাগুরু কপাট লাগিয়ে রেখেছে।
তা যাকগে, বাঙালি মুসলমান ফসিল হয়ে বাঁচবে নাকি রূপম ইসলাম, তার বিচার ভব্যিষত করবে। তবে খুদাতলার আজব চিড়িয়াখানায় হরেক কিসিমের মানুষ মেলে। বিশুদ্ধ বামুন সন্তান, অনুপম ভট্টাচার্যি, আমাদের অনুপম দা, তাদেরই একজন।
শহর কলকাতায় যারা রক্তদান সংক্রান্ত অতি জরুরী বিষয় নিয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান, অনুপম ভট্টাচার্য তাদেরই একজন। এবং ব্লাডমেটস, কোয়েস্ট বা লাইট হাউসের মত রক্তদান সংক্রান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির নিঃশব্দ নিরলস পরিশ্রম না থাকলে ফি বছর রক্তের অভাবে বহু রুগী মারা যেতেন।
তা অনুপম দা গেল হপ্তায় কাফিরনামা’র এক কিস্তি পড়ে হাঁক দিলেন (ফোনের ওপারে গলাটা সেরমই শোনায় আর কি),
‘চলো একদিন মেটিয়াবুরুজ যাওয়া যাক। তোমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ওখানকার মানুষজনেদের সাথে আলাপ করাও হবে’।
আমি একটু আপত্তি-টাপত্তি করছিলাম। মেটিয়াবুরুজ যেতে হলে যাদবপুর থেকে বেহালা হয়ে যেতে হয়। আর শ্রীভৃগুর রাশিফলে এ হপ্তায় আমার আফ্রিকা যাত্রা নাস্তি কিনা। কিন্তু অনুপম দা’ও খাঁটি বামুন সন্তান। মোবাইল না দেখেই গায়ত্রী মন্ত্র আওড়াতে পারেন। ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন। কইলেন,
‘চলো ভাই। কলকাতার সেরা বিরিয়ানী খাওয়াবো’।
মুর্শিদ জানেন, এই কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানী না থাকলে আমি নির্ঘাত অ্যাদ্দিনে ইউনাইটেড নেশনস এর প্রেসিডেন্ট অথবা তৃণমূলের ব্লক সভাপতি, কিছু একটা কেউকেটা হয়েই যেতাম। কিন্তু দুনিয়াতে এখনও চন্দ্র-সূর্য ওঠে, সাবির রেজালা বানায়, তাই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেরেফ বিরিয়ানীর টানে মেটিয়াবুরুজ রওনা দিলাম অনুপম দা’র সাথে। সাথ দিলেন অজয় দা আর সুমন দা।
মেটিয়াবুরুজ আর পাঁচটা ঘিঞ্জি মুসলিম জনবসতির থেকে আলাদা কিছু নয়। কলকাতা কর্পোরেশনের গাড়ি এসব জায়গার ঠিকানা ভুলে যায়। রাস্তার পাশে ময়লা পড়ে থাকে। মানুষকে ঘেটোর মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়। ঘিঞ্জি এলাকায় কোনো বেআইনী কাজ হলে অনায়াসে গোটা মহল্লাকে অ্যান্টি-সোসাল বলে সহজেই দাগিয়ে দেওয়া চলে।
এমনিতে মেটিয়াবুরুজে প্রায় গোটা মহল্লা কাপড়ের ব্যবসার সাথে যুক্ত। তাই লেখাপড়ার বিশেষ একটা চল নেই। ইস্কুল পাশ করার আগেই তারা ব্যবসায় ঢুকে যায়। যদিও ব্যবসার কন্ট্রোল থাকে মাড়োয়ারীদের হাতেই। জিএসটি আর লকডাউনের সময় এখানকার মুসলমান ওস্তাগর আর কাপড়ের ব্যবসায়ীরা অনেক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। সদাহাস্যময় দুলাল ভাই শোনাচ্ছিলেন লকডাউনের সময়কার গল্প,
‘জানেন, লকডাউনের সময় এখানকার কোনো মানুষ একবেলাও না খেতে পেয়ে থাকেনি। ব্যবসায়ীরা চাল-ডালের যোগান দিয়েছেন সবার জন্য’।
দুলাল ভাই নিজের কথা বলেন নি স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু এই মানুষটাও ব্যবসায় লস খেয়েও লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের জন্য বস্তার পর বস্তা চালের যোগান দিয়ে গেছেন বলে শুনেছি।
দুপুরের দাওয়াত ছিল সাবির ভাই এর বাড়িতে। এলাকার অন্যতম বড় ব্যবসায়ী। খুব সাধারণভাবে থাকেন।খুব নম্র ভদ্র মানুষ। অতিথিকে কাজের লোক দিয়ে খাওয়ানোর নিয়ম নেই তাদের বাড়িতে। বাড়ির ছেলেরাই পরিবেশন করলেন, এঁটোকাঁটা হাতে করে তুলে নিয়ে গেলেন। এবং মেটিয়াবুরুজের মানুষজন জানেন কারুর হৃদয়ে প্রবেশ করার সহজতম রাস্তা হল পাকস্থলী দিয়ে।
দস্তরখান বিছিয়ে খাওয়া শুরু হল। সুগন্ধী মশলা চায়ের পর শুরুতেই দুরকমের কাবাব এলো স্যালাডের সাথে। তারপরে গোস্ত বিরিয়ানী। যারা বিরিয়ানী খান বা ভালোবাসেন তাদের খাদ্যাভাসে সমস্যা না থাকলে গরুর গোস্তের দম বিরিয়ানী খেয়ে দেখবেন। আমার সাড়ে তিন দশকের দুনিয়াদারির অভিজ্ঞতায় হরেকরকমের বিরিয়ানী খেয়েছি। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের মত এত ঝরঝরে এবং সুস্বাদু বিরিয়ানী আর খাইনি। সাধারণতঃ, বিরিয়ানীর গোস্তের স্বাদ থাকেনা, কিন্তু এই বিরিয়ানীতে গোস্তের স্বাদ দুর্দান্ত। তারপরে এলো রায়তা আর বাস্কিনস রবিন্সের আইস্ক্রীম এবং বহুজাতিক ঠান্ডা পানীয়। এরপরে ছরকমের মরসুমি ফলের টুকরো আর আটরকমের ড্রাইফুট। শেষপাতে দুলাল ভাই দুটো বড় বাটি নিয়ে এলেন। ভাবলাম এইবারে বোধহয় নাপাম কি নিউক্লিয়ার বোমা বেরোবে। তার বদলে বেরোলো দুরকমের পিঠে। ভাপা এবং ভাজা।ভাপা পিঠেতে নারকোলের পুর দেওয়া ছিল আর ভাজা পিঠেটাকে সংখ্যাগুরু চিনির রসে ভেজালে মালপোয়া বলে চেনে।
এবং এতকিছু খাওয়ানোর পরেও সাবির ভাই অত্যন্ত কুন্ঠাভরে বলছিলেন যে ব্যস্ততাহেতু তারা আজ কিছুই আয়োজন করে উঠতে পারেন নি। আমরা যেন কিছু মনে না করি।
খাওয়া শেষে দুলাল ভাই এর দহলিজে আড্ডা বসলো। আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন ইমাম, ফারুখ আর সুজাউদ্দীন ভাই। বাঙালি আড্ডায় বসে রাজা-উজির মারে। আমাদের আড্ডাও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মেটিয়াবুরুজের কাপড়ের ব্যবসা সরকারের কাছে পরিকাঠামোজনিত সাহায্য পেলে যে দেশের ভিতরে খুব উজ্জ্বল জায়গায় চলে যেত সেটা বলছিলেন তারা।
খুব কম মানুষই জানেন মেটিয়াবুরুজের দুলাল ভাই, সুজাউদ্দীনরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কলকাতায় রুগীদের জন্য রক্তের যোগান দ্যান। তাদের ফেসবুক পেজে সেলেব্রিটির তকমা জোটেনা, খবরের কাগজে ছবিসহ নাম ওঠেনা, কিন্তু তাদের ফেজটুপি আর দাড়িওয়ালা মুখ দেখলেই সংখ্যাগুরুর বাঙালির একটা অংশ আতংকে ভোগে। এই বোধহয় জোব্বার তলা থেকে ছুরি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপরে। সাতপুরুষে সীমান্তের ধার-কাছে না যাওয়া মানুষটিও অকারণ ইসলামোফোবিয়ায় ভোগেন। ক্যানো ভোগেন তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন না।
নামাজের সময় হওয়াতে সাবির ভাই আগেই বিদায় নিয়েছিলেন। ফেরার পথে দুলাল ভাই হাত ধরে বললেন, ‘আবার আসবেন। ভালো করে দেখবেন আমাদের মেটিয়াবুরুজকে।‘
ফেরার পথে গাড়িতে অনুপম দা বলছিলেন,
‘জানো ভাই। মানুষ খুব সহজেই ঘৃণা করতে পারে। এই মেটিয়াবুরুজের মানুষগুলোকে নিয়ে কত্ত বদনাম ছড়িয়ে আছে কলকাতায়। আমি এই রক্তদান শিবিরের কাজ নিয়ে এতবার এখানে এসেছি। এই আনুষগুলো এত দিলখোলা আর অতিথি পরায়ণ যে ভাবাই যায় না। আমার অপারেশনের সময় পরিবারের সদস্য হিসেবে সই করেছে মেটিয়াবুরুজের সাহেব-এ-আলম। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে সারাক্ষণ আগলে রেখেছে আমার ছেলে কে। অথচ এদের সাথে একফোঁটাও না মিশে, একবারও না জেনে কি সহজে আমরা এদের নামে বদনাম রটাই বলো’।
আমি তখন জানালার বাইরের দিকে চেয়েছিলাম। অনেকসময় কিছুই বলার থাকেনা। এই সময়টাও ঠিক সেইরকমই একটা সময়।
‘নফরত বহুত আসানি সে বিক যাতি হ্যায় সাহাব,
ইয়ে প্যার হ্যায়, জিসে সমঝনেওয়ালা নেহি মিলতা’।