অক্সিজেন। পর্ব ২৯। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

জল ও বরফ

শেষ অবধি ষোলই জুলাই রাহুল স্ফিতি ভ্যালির ইউনাম শৃঙ্গে অভিযানের জন্য কুহুরা সবাই মিলে রওয়ানা দিল।শৃঙ্গের উচ্চতা ছহাজার একশ এগারো মিটার মানে কুড়িহাজার ফুট । সোমাদি আর কুহু ছাড়া দলে আর কোন মেয়ে ছিল না।যাওয়ার আগে সোমাদি দুটো কথা বলেছিল ওকে। যাওয়াটা নিশ্চিত, কিন্তু পাহাড়ে ফেরা সবসময়েই অনিশ্চিত।এটা মনে রেখো।

আর পথে তোমার মেয়েলি শারীরিক সুবিধে অসুবিধের দায় তোমাকে নিজেকেই নিতে হবে।পথে বেরোলে ওগুলো নিয়ে দলের কেউ মাথা ঘামাবে না। কোন আলাদা সুবিধেও আশা করা যাবে না।।

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অবধি কোন নিশ্চয়তা ছিল না।মা ভরসা দিলেও বাবাকে ওভাবে রেখে যেতে পা সরছিল না ওর। তবু শেষ অবধি ব্যাগ পিঠে ষ্টেশনের দিকে ট্রেন ধরতে রওয়ানা দিতে পারল ও।

আঠারো জুলাইএর ভোরে ওরা  পৌঁছেছিল চন্ডীগড়ে।স্টেশনে নেমে খাবার যোগাড় করা হল।হাওড়া থেকে পনেরো  জনের একটা দল ষোলই জুলাই রাতে ট্রেনে উঠেছিল।কুহু ছিল কনিষ্ঠতম সদস্য।যাওয়া শুরু হল। আসানসোল থেকে আগের দিন চারজনের একটা দল রওয়ানা দিয়েছিল।আসাম থেকেও একটি ছেলে এসেছিল। মানালিতে সবাই একসঙ্গে হল।সাড়ে বারোটায়  মানালি পৌঁছে সবাই ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নিল।তারপর সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হল।

ট্রেনের জার্নি বেশ মজার হয়েছিল।হাসি গল্পে অতটা সময় যে কিকরে কেটে গেল বোঝাই যায়নি। সতেরো তারিখ ট্রেনে সারাদিন কাটিয়ে আঠারোয় চন্ডীগড়ে নেমে আগে থেকে ঠিক করা গাড়িতে ওঠা হয়েছিল।সারাক্ষণ সবার হাতে স্যানিটাইজারের বোতল ।মুখে মাস্ক।সারাপথে সবকিছুতে স্যানিটাইজা্র স্প্রে করতে করতে আসা হয়েছে। ট্রেনে খাবারের কোন অভাব হয়নি।সবাই নানা ধরণের খাবারের জিনিস নিয়ে গিয়েছিল।লাঞ্চ ডিনারের কোনকিছুই কিনতে হল না।কুহুকে মা কিনে দিয়েছিল মিষ্টি,বিস্কুট,চানাচুর ,শসা ,আম। আর মীরা কাকীমা এক প্যাকেট নাড়ু বানিয়ে দিয়েছিল।কাজু কিসমিস লজেন্সের তিনটে প্যাকেট সঙ্গে ছিল।ওর সঙ্গে আনা সব খাবারটাই ও বার করে  ওদের হাতে তুলে দিয়েছিল ট্রেনে।

শুধু লজেন্স,কাজু আর কিসমিসের প্যাকেট অক্ষত পড়েছিল ব্যাগে। সোমাদি বলেছিল,“ওগুলো পাহাড়ে ওঠার জন্য সঙ্গে থাক। এখন তাকিয়েও দেখিস না, কেমন।”

সোমাদি মানুষটাকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে কুহু।সংসারে একরকম।আর পথে একেবারে অন্যরকম।কয়েকদিন আগেও আলাপ ছিল না।এখন একেবারে কাছের মানুষ।কিছু কিছু মানুষ হয়ত এমনই হয়।সম্পর্ক কদিনেই বেড়ে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ তে দাঁড়িয়েছে। এখন সহজে ও সবটা বলতে পারে,আগে যা ওর কল্পনায় ছিলনা।

সোমাদি ট্রেনে ওর পাশের সিটেই শুয়েছিল।পুরো কামরায় ও্দের দলের উনিশজন  ছাড়া আরো বাইরের পাঁচজন ছিল।তারা অন্য দিকে সরে গিয়েছিল।সারাদিন সবাই মিলে হই হই ,খাওয়া দাওয়া। রাতে কাছাকাছি শুধু ওরা দুজন।

ট্রেনে শুয়ে শুয়ে সোমাদি বলছিল “আমার খুব পাহাড়ের নেশা।বাড়িতে বাড়ির মত থাকি।বাড়ি ছেড়ে আসি যখন আর বাড়ির কথা ভাবিনা।তুইও বাড়ির কথা এ কদিন মাথায় আনিস না।তাহলেই দোটানা হবে।পাহাড় টের পাবে।”

ও বলেছিল “তোমার শেষ কথাটা বুঝলাম না।পাহাড় কী মানুষ? যে সে টের পাবে। টের পেলেই বা কী?”

“অনেককিছু। পাহাড় সবটা চায়। সবটা।আরো দিন যাক ঠিক বুঝতে পারবি।”কথা শেষ করেই পাশ ফিরে চোখ বুজেছিল সোমাদি।আর ও ঘুম না আসা চোখে ভাবছিল কী বলতে চাইল মানুষটা?

মানালিতে সেদিন থেকে পরের দিন আবার গাড়িতে করে যাওয়া হল জিস্‌পা।জিস্‌পাতে মানালির মাউণ্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট।ওখানেও পাহাড়ে চড়া শেখানো হয়।এ পি জে আব্দুল কালামের নামে ইন্সটিটিউট।এসময় একেবারেই ফাঁকা পড়ে আছে।

মাঠে টেন্ট করে থাকার কথা ছিল, কিন্তু বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া খারাপ হওয়ার জন্য ইন্সটিটিউটের ইন্‌চার্জ একটা হস্টেল রুম খুলে ওখানেই থাকতে বললেন।।ওপরে নীচে খাট। সোমাদি আর ও নীচে শুয়েছিল।একটা এজেন্সী সব ব্যবস্থা করায় সঙ্গে ছিল দুজন পোর্টার,আর দুজন কুক।তারা আগেই তাদের টেম্পোতে চেপে জিস্‌পা  গিয়ে চমৎকার  ভুনা খিচুড়ি রান্না করেছিল।ওরা পৌঁছে খেয়েছিল পেট ভরে।

পরের দিন ভরতপুর বেস ক্যাম্পে যাওয়া হল।সারাটা রাস্তা কুয়াশায় ঢাকা।ওখানে বৃষ্টি হয়না।তবু বৃষ্টি হচ্ছিল।খারাপ রাস্তা।গাড়ি ধীরে ধীরে ভরতপু্রে পৌঁছল।  ষোল হাজারের কাছাকাছি উচ্চতা, প্রবল ঠান্ডা। সেদিন ওখানে পৌঁছে তাঁবু খাটিয়ে ফেলল সবাই মিলে।কয়েকটা ছোট তাঁবু,আর একটা বিরাট বড় তাঁবু।সেই তাঁবুতেই খাওয়ার টেবিল,ছোট ছোট টুল পাতা।খাওয়াদাওয়ার পর কুহুরা সবাই মিলে পাহাড়ে  হাঁটতে গিয়েছিল।ফিরে একসঙ্গে সবাই মিলে চা স্যুপ মুড়ি চানাচুর খাওয়া হল।রাতে খাওয়াদাওয়ার পর নিজের নিজের ম্যাট পেতে স্লিপিং ব্যাগে শুল সবাই।এক একটা টেন্টে ছজন করে শোওয়ার ব্যবস্থা।

কুহু ট্রেনিং এর সময় এসবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।কিন্তু এখন অনেককিছুই নতুন লাগছে।কেননা মানুষগুলো কুহুর একেবারেই অচেনা।ট্রেনিং এর পরিবেশে সবাই প্রায় একবয়সী, শিখতে এসেছিল ।একসঙ্গে পড়াশুনো,তারপরে ট্রেনিং।দায়িত্ব নিজের নয়।

কিন্তু এবারের ট্যুরে দায়িত্ব যার যার নিজের।ভুল করলে জীবন যাবে,ঠিক করলে  সম্মান জুটবে কপালে।কুহু বুঝতে পারছিল, সোমাদি না থাকলে ওর একার পক্ষে কিছুতেই সবটা সামলানো সম্ভব ছিলনা।চোখকান খোলা রাখছিল ও,যাতে এবারের শৃঙ্গে ওঠার অভিজ্ঞতা থেকে সবটা বুঝে নিতে পারে।এরপরে সোমাদির মত সঙ্গী না মেলার সম্ভাবনাই প্রবল তো।

পরের দিন ভরতপুরেই থাকা হল।কিন্তু সেদিন সকাল নটা নাগাদ বেস ক্যাম্প থেকে এক এক করে কিছু কিছু জিনিষ সবাই ক্যাম্প ওয়ানে রেখে এলো।যেমন টেন্ট,খাবারদাবার,পাহাড়ে ওঠার কিছু সরঞ্জাম।সবার মত কুহুকেও যেতে হল পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে। কিছুটা পাহাড়ে চাপার উত্তেজনা, আর বাকিটা  আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও বটে।নটায় রওয়ানা দিয়ে বারোটায় পৌঁছে যাওয়া, আবার ফেরা।ফেরার সময় লাগল দেড় ঘন্টা।ওইদিন বরফ পড়ছিল,তাই বেশিক্ষণ না বসেই সঙ্গে সঙ্গে ফেরা হল। আসলে ওই ক্যাম্প ওয়ানে যাওয়াটা একটা পরীক্ষার মত ব্যাপার।কুড়িজনই কি ভালভাবে যেতে পারল? পরেও কি তারা পারবে?সেসব কিছুই বুঝে নেওয়া।

আসানসোল থেকে আসা চারটি ছেলে ক্যাম্প ওয়ান থেকে ঘুরে এসেই জানাল, “আমরা আর কাল যেতে পারব না।যাত্রা স্থগিত করে দিচ্ছি। এখান থেকেই ফিরে যাব।”

বাকি ষোল জনের মধ্যে আরো দুজন যাবে না বলল।তারাও বেস ক্যাম্পে থেকে গেল। কিন্তু পরদিন যখন কুহুরা পাহাড়ে উঠবে,আসানসোলের একটা ছেলের কান থেকে ব্লিডিং শুরু হল।ওয়েদার খুব খারাপ ।বৃষ্টি পড়ছে। তাই আসানসোলের  সব ছেলেরাই ওকে নিয়ে যে ট্রাভেলা গাড়িটা ছিল সেটা চেপে মানালি নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ওদের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে আর তার বাবা ফিরে যাবে বলল ।ওরা দুজনও ওদের সঙ্গে মানালি ফিরে গেল।তারপর বেলা হতে আর একটা ছেলেও বমি করতে শুরু করল।তখন আর গাড়ি নেই।তাকে কীকরে মানালি পাঠিয়ে দেওয়া যাবে ভাবতে বসল সবাই।

ধাবাতে গিয়ে খোঁজ করে জানা গেল, চারটে নাগাদ একটা বাস লে থেকে আসে।সেটা কেলং যাবে। কেলং থেকে গাড়ি করে মানালি যাওয়া সম্ভব।তখন ওকে বাসে মানালি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। অন্য আর একটা ছেলে যে বেস ক্যাম্পেই থেকে যাবে ভেবেছিল,তাকে ওর সঙ্গে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল সবাই ।

সেদিন বাকি বারোজন ক্যাম্প ওয়ানের উদ্দেশ্যে  রওয়ানা দিল। ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছে আবার একজন বয়স্ক প্রফেসর বললেন আমার চেষ্ট পেন শুরু হয়ে গিয়েছে,আমি এখান থেকেই  ফিরে যাব।

টিমের নেতা তাকে বললেন, “আপনি এলেন কেন?” আসলে ওর সঙ্গে ফিরে যাওয়ার কেউ নেই তো। তখন আর  একজন বয়স্ক মানুষ ওনার সঙ্গে নেমে গেলেন।

শেষপর্যন্ত দেখা গেল যে দশজন ওপরে উঠবে,তার মধ্যে কুহুও আছে। ক্যাম্প ওয়ান থেকে যারা ফিরে গেল, তারা বেস ক্যাম্পেই নেমে গেল। এবার দশজন যাত্রা শুরু করল।তখন  ভোর সাড়ে চারটে বাজে। ওই ভোরে, অন্ধকারেই যাওয়া শুরু হল। প্রত্যেকের মাথার হেলমেটে আলো,হাতে আলো জ্বলছে।সেই আলোতে দেখে পথ চলা শুরু হল। ওই রাস্তাটাকে বলে বোল্ডার জোন ।বড় বড় বোল্ডার ডিঙিয়ে যাওয়া, একেবারে অন্ধকার। গাছপালা কিছুই নেই।হাঁটতে হাঁটতে ওরা এগোচ্ছে।ওপরে উঠছে ক্রমশঃ।

সেদিন নীল আকাশ।সাদা বরফ চারদিকে।সুর্য ওঠার পর বরফ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল।পায়ের তলায় সাদা বরফ, সেই বরফ গলতে শুরু করছে।হাতে স্টিক পায়ে বিশেষ জুতো। এগোনর সময় কুহুর সঙ্গে সোমাদি নেই। আছে একটি কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে, নাম আনন্দ। সে হাঁটতে পারছিল না প্রথম থেকেই। সোমাদি ওই আনন্দের সঙ্গে ওকেই হাঁটতে বলে নিজেরা এগিয়ে গিয়েছে আগেই ।

আনন্দের চেহারাটি গোলগাল।কিছুটা যাবার পরই সে আর যেতে চায়না।ইচ্ছে ছিল বলে এসেছে,সামর্থ্যে কুলোচ্ছে না।সে যতবার না বলে কুহু ততবার তাকে সাহস যোগায়।শেষে কুহু রেগে গিয়েই বলল, “আনন্দ, তুমি আগে বলোনি কেন?আমি তাহলে সোমাদিদের সঙ্গে চলে যেতাম।এখন এই রাস্তায় আমি একা কীকরে যাব?তুমিও নতুন পাহাড়ে এসেছ,আমিও প্রথম পাহাড়ে উঠছি।কোন অভিজ্ঞতা নেই।আমি একা কিছু তেই যাব না।তোমাকে যেতেই হবে।”

কুহুর ধমকানিতে কাজ হল।আনন্দ আবার হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু কিছুটা যাবার পর আনন্দ বলল, “ আমি ব্যাগ বইতে পারছি না কুহুদি। ব্যাগটা বরফের ওপর রেখে যাব?”

কুহু ওকে বলল, “এখানে আর কে নেবে?রাখো। ফেরার সময় নিয়ে যাব।”

আনন্দ  খেয়াল করল না যে ওর জলের বোতল ব্যাগেই থেকে গেল।এবার একটা বোতল দুজন মানুষ।কিছুক্ষণ পরেই জল ফুরিয়ে যেতে প্রবল জলকষ্ট শুরু হয়ে গেল।ছেলেটি আর কিছুতেই যাবেনা।কিন্তু কুহুও ওকে ছাড়বে না।একটু করে বরফ আর ব্যাগ থেকে নেওয়া বাদাম মুখে দিয়ে  কোনরকমে নিজেদের টানতে টানতে ওরা যখন পৌঁছল ,তখন সবাই পৌঁছে ওদের জন্য চিন্তা করছে।

কুহু কোনরকমে বলল,“আমাদের জল দাও।জলের অভাবে আমরা মরতে বসেছি।”

ওদের সবাই জল দিতেই খানিকটা চাঙ্গা হয়ে কুহু শিখরে ওঠার জন্য আবার চেষ্টা শুরু করল ।

আর আনন্দ, শিখরের ঠিক নীচেই বসে বলল “আমি কিছুতেই আর উঠতে পারব না।এখানেই ছবি তুলি?”

শেষ অবধি পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছল কুহু।আনন্দ ছাড়া বাকি সবাই উঠেছিল। আধঘন্টার মত  ওখানে ছিল ওরা ।একটা হলুদ পতাকা উড়ছিল পতপতিয়ে।ঠাকুরের  একটা ছবি রেখে ফুল দিয়ে পুজো করা হল। তারপর লজেন্স বাদামের প্রসাদ ভাগ করে খেল সকলে।

কুহুর ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল বাবার মুখ,মায়ের মুখ ,দিদি আর শক্তিদার মুখ।আরো অনেক মুখ ভিড় করছিল।ও ঠেলে সরালো তাদের।

স্থির হয়ে ওখানে দাঁড়াবার পর দুচোখ দু’এক সেকেন্ড বন্ধ রেখেছিল ও।টের পাচ্ছিল দুচোখ বেয়ে জল নামছে।অবশেষে ওর পাহাড় চূড়া জয়ের অভিযান শুরু হল। শেষপর্যন্ত ও যে সব বাধা ঠেলে পাহাড়ে উঠতে পেরেছে,এই বোধ, ওকে বড় ভরসা দিল যে। কুহু টের পাচ্ছিল ওর  কান্নার কিছুটা  জল হয়ে মিশে যাচ্ছে বরফে।

আনন্দ উঠল না আর।বাকি সবাই উঠেছে। টিম লিডার বিশ্বদা বললেন, এই জায়গার সবটাই সামিটের অন্তর্গত।তুমিও সামিট করেছ আনন্দ।নিশ্চিন্তে ছবি তুলে নাও।

ওরা যখন  ইউনাম পাহাড়চূড়োয় পা ফেলেছে ,তখন দশটা বাজে।ঠিক ছঘন্টা লেগেছে ওদের পৌঁছতে।এবার ফেরা। ওঠার সময় বরফ ছিল শক্ত।নামার সময় বরফ গলতে শুরু করে দিয়েছে।

সোমাদি ওর কাঁধে হাত রেখে বলছিল, “ফেরাটাও একদম সহজ নয়।বরফ গলতে শুরু করেছে এবার।তবে আমি জানি কুহু ,তুই পারবি।সাবধানে ফিরে চল।নরম বরফ কিন্তু আরো ভয়ংকর! কোথায় অতলস্পর্শী ফাঁদ পাতা আছে কেউ জানে না।”

ফেরার সময় জলের অভাব ওদের ফেরাটাকে আরো কঠিন করে দিল।সূর্য পুরোপুরি তার কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে।খানিকটা পর থেকেই তার প্রভাবে বরফ গলে যাচ্ছে ।কুহু যেখানে পা রাখছে, সেখানেই পা ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে।এরপরে ওরা  এগোবে কেমন করে?

এসব ক্ষেত্রে ট্রেনিংসেণ্টারের কিছু নির্দেশ আছে।ছোটবেলায় খেজুর বা নারকেল পাতার চওড়া অংশে বসলে বন্ধুরা টেনে নিয়ে যেত।এখানে যাওয়ার পদ্ধতি এক।তবে নিজেকে নিজেই গড়িয়ে  নিয়ে যেতে হবে হাতের সাহায্যে।

আর একটা পদ্ধতিও আছে। সেটা হল শুয়ে পড়ে, শরীর গড়াতে গড়াতে নীচে নামা।ছোটবেলায় শোনা  সেই বুড়ির, মেয়ের বাড়ি যাওয়ার গল্পে ছিল কুমড়ো গড়ানোর কথা।বুড়ি মেয়ের বাড়ি যাচ্ছে।পথে বাঘ সিংহ সবাই তাকে খাবে বলল। সে কথা দিয়ে গেল ফেরার পথে সে যখন মেয়ের বাড়ির যত্নে মোটাসোটা হয়ে আসবে, তখন সবাইকে ষে নিজেকে খেতে দেবে।তাহলেই ওদের তাকে খেয়ে তৃপ্তি হবে।এখন যেন তারা তাকে পথ ছেড়ে দেয়।

ফেরার পথে চালাকি করে বুড়ি এক কুমড়োর মধ্যে ঢুকে গড়াতে গড়াতে ফিরল। বুঝতে না পেরে একমাত্র শেয়াল বাদে সেইসব জন্তুরা তাকে পথ ছেড়ে দিল।ভারী সুন্দর গল্প। বরফের ওপর গড়াতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তেই গল্পটা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছিল ওর। সোমাদি ওকে বললেন বসে গড়ানোর থেকে শুয়ে গড়ালে বেশি  সুবিধে হবে।শুয়ে গড়ানোই ভাল।

একটু পরেই হঠাৎ কুহুর নজরে এলো সোমাদিও সবকিছু সমেত বরফ জমিতে গড়াতে শুরু করেছে । ও নিজেও তখন সোমাদির পেছন পেছন গড়াতে শুরু করল।

মাঝেমাঝে শোওয়া অবস্থা থেকে উঠে ওরা বোঝার চেষ্টা করছিল, ঠিক পথে এগোচ্ছে নাকি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সুযোগমত সবাই অন্যদের ভিডিও তুলছে।

তবে একটা ভারী অদ্ভুত কান্ড হল।আনন্দ ওর বরফে ফেলে যাওয়া ব্যাগ ফেরার পথে  কোথাও দেখতে পেলনা। সোমাদি বারবার বলছিল, “অদ্ভুত কান্ড,ব্যাগ এপথে কে নেবে?নিশ্চয়ই আমাদের আগে যে গ্রুপ নেমেছে তাদের কীর্তি।”

আনন্দ বলল, “এমনও তো হতে পারে,বরফে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।” সে যাই হোক ব্যাগ আর পাওয়া গেলনা।না পেলেও পাহাড়ের পথে ওটুকুর জন্য ওদের মনখারাপ হল না। যেখানে যে কোন মুহূর্তে প্রাণ হারাতেই পারে, সেখানে সামান্য ব্যাগে কী আর এসে যায়!”

আনন্দের নানা জিনিসের সঙ্গে কুহুর একটা ফ্লাস্ক ছিল। ও ভাবছিল, হারিয়েছে একটা সামান্য ফ্লাস্ক। কিন্তু পেয়েছে এমনকিছু, যা ও কখনও সত্যি সত্যি  পাবে ভাবেনি। ওর সেই ছোটবেলার স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে।এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ২৯। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *