ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।

0

(গত পর্বের পর)

ভারতেও ব্যক্তিগত দল তৈরী করে ক্রিকেট খেলার সূত্রপাত আজ থেকে নয়। সেই উনিশ শতক থেকেই ভারতের রাজা মহারাজারা ব্যক্তিগত দল তৈরী করে ক্রিকেট ম্যাচ খেলে বেড়াতেন সারা ভারত জুড়ে। পাতিয়ালার মহারাজা রাজেন্দ্র সিং পাতিয়ালা দল তৈরী করে ১৮৯৮/৯৯ নাগাদ ভারত সফর করিয়েছিলেন। সেই দলে স্বয়ং রঞ্জি ছিলেন। তিনি খেলোয়াড়দের কোচিং করানোর জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রাঙ্ক ট্যারান্টকে নিয়ে আসেন। তাঁর পুত্র ভূপিন্দর ও পৌত্র যাদবেন্দ্র ভারতের হয়ে খেলেন, যাদবেন্দ্র ভারতের হয়ে সরকারী টেস্ট খেলেছেন এবং বেসরকারী টেস্টে অধিনায়ক হন। এহেন পাতিয়ালার দল কলকাতায় খেলতে আসে ১৮৯৮/৯৯ নাগাদ। সেবার তাঁরা রেঙ্গুন অবধি গিয়েছিলেন।

এরপরেও প্রাইভেট দল তৈরী করেন লর্ড উইলিংডন। ইনি বোম্বের লেফটেন্যান্ট গভর্নর থাকা কালীন প্রাইভেট দল বানিয়ে গোটা দেশ ঘুরে ঘুরে খেলতেন। একবার প্রভাব খাটিয়ে ভারতের ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে বানানো টিমকে ‘ইংল্যান্ড’ নাম দিয়ে ভারতীয়দের নিয়ে বানানো ‘ভারত’ নাম দিয়ে খেলিয়ে দেন। প্রথম ম্যাচে জিতে গেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে তথাকথিত ইংল্যান্ড চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হওয়ার মুখে চলে যায়, অবশেষে পাতিয়ালার মহারাজা ভূপিন্দর কে অনুরোধ করে উইলিংডন ম্যাচ ড্র করান। এরপরে আর ‘ইংল্যান্ড’ দল বানানোর সাহস দেখাননি।

দেশীয়দের মধ্যে প্রাইভেট টিম বানানোয় বাংলার মহারাজারা কম ছিলেন না। যেমন কোচবিহারের মহারাজার দল। একসময় আজকের কলকাতার উডল্যান্ড নার্সিংহোম ছিল তাঁদের মাঠ। কোচবিহারের দল ছিল দুর্দান্ত। প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৭,৯৫২ রান ও ১৫১২ উইকেট নেওয়া ফ্রান্সিস ট্যারান্ট, হ্যাম্পশায়ারের জ্যাক নিউম্যান ( ১৫,৩৬৪ রান ও ২০৫৪ উইকেট), উইকেট কিপার ওয়াল্টার লিভেস ( ৩৮২টি ক্যাচ ও ২৬৬টি স্টাম্প) ছাড়াও ছিলেন বিধু মুখার্জী, মনি দাস, বরোদার মহারাজ কুমার ধৈর্য্যশীল রাও গায়কোয়াড়, সুধন্য কুমার বোস, প্রকাশ ঘোষ, প্রতুল ব্যানার্জি, প্রফেসর শৈলজা রায় (CAB এর প্রতিষ্ঠা সদস্য ও সুকুমার রায়ের খুড়তুতো ভাই)। অধিনায়ক ছিলেন কোচবিহারের রাজকুমার প্রিন্স ভিক্টর নীতেন্দ্রনারায়ণ (কেশব সেনের নাতি)। ইতিহাস রচিত হয়েছিল ইডেনে। সেই প্রথম ভৌগলিকভাবে বাংলা থেকে কোনোও দল প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলল।  ক্যাপ্টেন নিজেই বাঙালি। দলের সাত জন বাঙালি। এতজন বাঙালি তখনও পর্যন্ত একসঙ্গে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেনি। এর আট বছর আগে প্রিন্স হিতেন্দ্রনারায়ণ সমারসেট দলের হয়ে খেলেছিলেন, কিন্তু একা। এবার ৭ জন। সেই ১৯১৭ সালে ৭ জন বাঙালি হারাল এগারোজন ইংরেজের দলকে। একই দলে রাজকুমার-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-দলিত একসঙ্গে খেলল ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে। এবং দলটি জিতল। যদিও মূল কৃতিত্ব ফ্রান্সিস ট্যারান্টের, কিন্তু মনে রাখতে হবে, তিনিও উপনিবেশের মানুষ। অস্ট্রেলিয়া।

নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্র নারায়ন রায় ১৯০৬ সালের দিকে একটি ক্রিকেট দল গড়ে তোলেন।  তিনি পি ভিটাল, জেএস ওয়ার্ডেন, পি শিবরাম ও কে সেশাচারির মত ক্রিকেটারদের দলে আনেন।  তিনি দক্ষিণ কলকাতার পুরোনো বালিগঞ্জের কাছে বন্ডেল রোডে ৪৫ একর জমি কিনে একটি ক্রিকেট মাঠ নির্মাণ করেন। মাঠটার নাম হয় নাটোর গার্ডেন। মাঠটা সেই যুগে কলকাতার খ্যাতনামা ইডেন গার্ডেনকেও পাল্লা দিত।

মহারাজ ক্রিকেটের মাঠকে একটি শুধুই খেলার মাঠ হিসেবে না দেখে, একটি যুদ্ধের ময়দান হিসেবে দেখতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের তাদের প্রিয় খেলাতে হারিয়ে দেওয়া। তিনি তাঁর দলকে প্রশিক্ষন দিতে প্রখ্যাত ক্রিকেটার সারদারঞ্জন রায়কে সঙ্গে নেন। পরবর্তীকালে, সারদারঞ্জন রায়ের তিন ভাই মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমোদারঞ্জন বাংলা ও তদুপরি ভারতের ক্রিকেট উন্নয়নে নাটোরের মহারাজার দলে কাজ করার জন্য যোগ দেন।

দলের খেলোয়াড় নির্বাচন করার সময়, মহারাজা কখনো বর্ণ, গোত্র বিবেচনা করতেন না। উচ্চবর্ণের ক্রিকেটার বাদ দিয়ে নিম্ন-বর্ণের হিন্দু মনি দাসকে দলে নিয়ে তিনি উচ্চবংশের তাচ্ছিল্যের শিকারও হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বালু, শিবরাম, গণপত ও বিঠঠল তাঁর দলে খেলেন। কোচবিহার দল অবশ্য চল্লিশের দশক অবধি খেলেছিল। তবে এই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় ভিজিয়ানাগ্রাম, পাতিয়ালা, আলীরাজপুর, মানভাদর, বরোদা, হোলকার প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য।

এঁদের মধ্যে ক্রিকেটে ‘নাম’ হয়ে ওঠেন  একজন রাজপুত্র। ভিজিয়ানাগ্রামের  মহারাজ কুমার। আসলে বড় জমিদার পরিবার। নামেই মহারাজকুমার। তিনটি  টেস্ট  খেলেছেন ভারতের হয়ে, ইংল্যান্ডের মাঠে সেই তিনটি টেস্টে ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, অথচ তাঁর থেকে খারাপ ক্রিকেটার ভারতে এসেছে কিনা সন্দেহ।

ভিজিয়ানাগ্রাম হল দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের একটি খুব ছোট দেশীয় রাজ্য।  নিজের ভাগ্নের সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে তিনি তার জন্মভূমি ছেড়ে উত্তর প্রদেশের বেনারসে চলে আসেন। প্রায় এক হাজার মাইল দূরে অঞ্চলটি   ভিজিয়ানাগ্রাম রাজবাড়ির মালিকানাধীন জমিদারি ছিল। সেখানে প্রাসাদের ক্রিকেটমাঠে তার ব্যক্তিগত পিচে খেলতেন। এখানেই  ডগলাস জার্ডিনের দল তাদের সফরের একমাত্র পরাজয় বরণ করেছিল যা ১৯৮৫ সালে রবি শাস্ত্রীর নেতৃত্বাধীন অনূর্ধ ২৫ ভারতীয় দলের বিরূদ্ধে পরাজয়ের আগে ইংল্যাণ্ডের কোনও দলের ভারতের মাটিতে টেস্ট বাদে একমাত্র হার।

ভিজি প্রায়ই নেতৃস্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে দল বানিয়ে একটি ম্যাচ, একটি মরসুম বা এমনকি একটি সফরের পর্যন্ত করতেন।  ভারত টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়ার পরে ঠিক হয়েছিল ১৯৩০-৩১ এম সি সি ভারত সফর করবে। কিন্তু গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য সফর পরিত্যক্ত হয়। তখন ভিজি সার্টফ্লিফ, জ্যাক হবস, নাইডু ভ্রাতৃদ্বয়, মুস্তাক আলিদের নিয়ে দল গড়ে ভারত ও সিংহল সফর করেন। খেলোয়াড়রা অপেশাদার হলেও প্রচুর উপহার পেয়েছিলেন।

ভিজির পৃষ্ঠপোষকতার কারণ ছিল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি চেয়েছিলেন ১৯৩২ এর দলে থাকতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এই সফরের শেষের দিকে ভারতীয় ক্রিকেট একটি অশান্তিতে পড়েছিল যার আন্তর্জাতিক পরিণতির জন্য  সাংঘাতিক কলঙ্কিত হয়েছিল গোটা একটা দশকের ভারতীয় ক্রিকেট। অশান্তির একেবারে কেন্দ্রে ছিলেন ভিজি।

১৯৩২ সালের ভারতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন পোরবন্দরের মহারাজা। বহুজাতিক দল ভারতকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য যা দরকার তা উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট বিচক্ষণ ছিলেন পোরবন্দর। সামাজিকভাবে তিনি একজন অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ক্যাপ্টেন ছিলেন, একজন ক্রিকেটার হিসেবে তিনি খুবই নিম্নমানের ছিলেন। প্রথমশ্রেণির খেলায় চার ম্যাচ খেলে তিনি করেন ০, ২, ০, ২, ২, গড় ০.৬৬। তার সম্পর্কে বলা হয় যে তিনিই একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার, যাঁর ইংল্যান্ডে  করা রানের চেয়ে বেশি রোলস-রয়েস গাড়ি ছিল।

তাই টেস্টের জন্য সেই যুগের ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার সি কে নাইডু  অধিনায়ক হন। আসলে এই সফরে অধিনায়ক পোরবন্দর, সহ অধিনায়ক ওঁর শ্যালক লিম্বডি নামক দেশীয় রাজ্যের ঘনশ্যামজী এবং ডেপুটী সহঅধিনায়ক হন ভিজি। চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ও অপ্রয়োজনীয় এই পদ অস্বীকার করে তার হতাশাকে ঢাকতে ভিজি বলেন দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে তিনি এই সফরে যাবেন না।

সমস্যার পুনরায় সূত্রপাত  ঘটে ১৯৩৬ সালের সফরের দুই বছর আগে, পতৌদি সিনিয়র নবাব যখন ভারতে ফিরে আসেন। ভোপালের নবাবের জামাই, যার প্রভাব ভারতীয় বোর্ডে অপরিসীম, চেম্বার অফ প্রিন্সেস, পতৌদি ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য স্পষ্টভাবে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর জার্ডিনের বডিলাইন সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয়েছিল,  তার প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরিও (খুবই ধীরগতিতে) করেন। বডিলাইনের প্রতিবাদে দল ছাড়েন, ভারতে ফিরে ভারতের হয়ে খেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত ঘোষণা করেন। মনে হচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটে তার ত্রাণকর্তা খুঁজে পেয়েছে।

রঞ্জি ভারতের হয়ে খেলতে পারেনি,  তার সময়ে ভারত টেস্ট খেলতো না, খেললেও তিনি খেলতেন না বলাই বাহুল্য।  তিনি তার ভাইপো দলীপকে ভারতের পক্ষে খেলতে দেননি। ২৯ অক্টোবর ১৯৩৪ -এ পতৌদি অধিনায়ক  নির্বাচিত হন l।

কিন্তু পতৌদি স্বাস্থ্য সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন ছিলেন। ফলে ভিজি হলেন অধিনায়ক এবং এর স্বাভাবিক ফল হলো ভারতের ব্যর্থতা। অপছন্দের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করলেন ভিজি। কখনও উপঢৌকন দিয়ে রান করা, নাইডু কে অশ্রাব্য কথা বলা বাকা জিলানিকে টেস্ট খেলানো, মুস্তাক আলীকে নির্দেশ দেওয়া মার্চেন্ট কে আউট করে দেওয়ার জন্য (মুস্তাক মানেননি নির্দেশ), আর অমরনাথের সঙ্গে ঘটানো ঘটনা তো সর্বজনবিদিত। এমনকি শুঁটে ব্যানার্জীকে কোনও টেস্ট খেলাননি তিনি, শুঁটে কোনও গোষ্ঠীতে ছিলেন না বলে।

এই সকল সঙ্কটের উৎস হল ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী যখন আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন, তখন ভারতবর্ষের একমাত্র বড়ো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট প্রতিযোগিতা অর্থাৎ বোম্বে কোয়াড্রাঙ্গুলার (তখন পেন্ট্রাঙ্গুলার হয়নি) ট্রফির বন্ধ হয়ে যাওয়া। টুর্নামেন্টটি সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে তৈরি হত। দলগুলির নাম ছিল হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, ইউরোপিয়ান ইত্যাদি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই প্রতিযোগিতাটি বন্ধ হয়ে গেলে ভিজিয়ানাগ্রাম এবং লর্ড উইলিংটনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবর্ষে আরেকটি প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটে। তার নাম লর্ড উইলমিংটন ট্রফি। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়ে গেলেও তার কাপের নামকরণ লর্ড উইলমিংটন হবে নাকি অন্যকিছু হবে, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। লর্ড উইলমিংটন ট্রফি নামে প্রতিযোগিতাটি শুরু হলেও শেষে টুর্নামেন্টটির কাপ দান করেন পাতিয়ালার মহারাজা ভুপিন্দর সিংহ এবং সেই টুর্নামেন্টের নামকরণ করা হয় রঞ্জি ট্রফি, যা ১৯৩৩-৩৪ সাল থেকে খেলা শুরু হয়। সেইসময়, যেহেতু পাতিয়ালার মহারাজার প্রভাবে টুর্নামেন্টের নামই বদলে গিয়েছিল, তাই পাতিয়ালার মহারাজার সঙ্গে ভিজিয়ানাগ্রামের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ ছিল। দু’পক্ষই আসলে দু’টি পৃথক দল তৈরি করে সারা ভারতবর্ষে খেলে বেড়াত এমনটা আগেই বলা হয়েছে। ভিজিয়ানাগ্রাম তার দলের নাম দিয়েছিল ফ্রি লুটার্‌স। পাতিয়ালা তার দলের নাম দেয় রিত্রিভার্স।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফ্রি লুটার্‌স দলের হয়ে খেলতে এসেছিলেন কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান অলরাউণ্ডার স্যার লিয়ারি কনস্টানটাইন, যাকে লিয়ারি কনি বলেই অনেকে চেনেন। স্যার লিয়ারি এইসময় একটি ম্যাচে বডিলাইন বোলিং শুরু করেন, যার প্রতিবাদ করেন তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটার লক্ষ্মীরাজ পুরুষোত্তম দাস জয়। অধিনায়ক আলিরাজপুরের মহারাজার কাছে এই ব্যাপারে তিনি নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন। লিয়ারি বিষয়টিকে প্রথমে আমল দেননি। কিন্তু পরে যখন একঝাঁক খেলোয়াড় খেলতে অস্বীকার করেন, তখন বাধ্য হয়ে আলিরাজপুরের মহারাজা লিয়ারি কনিকে বডিলাইন বোলিং করতে বারণ করেন। সেইসময় থেকেই এই ধরণের ব্যক্তিগত দলগুলিকে নিয়ে একধরণের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। ফ্রি লুটার্‌স, রিট্রিভার্স  ভারতবর্ষে একাধিক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেললেও কোনোভাবেই তাদের দ্বারা খুব বড়োমাপের কোনো উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়নি কেবলমাত্র ক্রিকেটের প্রসার ঘটানো বাদে। কারণ এই সমস্ত দলগুলি, অর্থাৎ প্রাইভেট দলগুলির সঙ্কট ছিল সর্বজনবিদিত। এই ব্যক্তিগত দলগুলি ইচ্ছামতো খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি করা হত। এদের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো খেলোয়াড় থাকলেও সেই খেলাগুলির মান সবসময় যে ঠিক থাকতো, এমনটা নয়। এই ধরণের প্রাইভেট সফরগুলি যখন ক্রমশ সঙ্কটের মুখে পড়তে শুরু করে, সেইসময় বোর্ড কর্তৃক প্রাইভেট সফর বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এতদসত্বেও ১৯৩৫/৩৬ এ পাতিয়ালা মহারাজার উদ্যোগে অস্ট্রেলিয়া ও ১৯৩৭/৩৮ এ লর্ড টেনিশনের দল ভারত সফর করলে বোর্ডের উদ্যোগে বাধা পরে। এর ফল ছিল মারাত্মক।

১৯৩৮ সাল। সারা দুনিয়া জুড়ে আতঙ্কের পরিস্থিতি। কখন যুদ্ধ লেগে যাবে তার অপেক্ষা চলছে দমবন্ধ করে। এমতাবস্থায় ইংল্যান্ড সফরে গেল অস্ট্রেলিয়ার দল। এদিকে ভারত থেকে ইংল্যান্ড পাড়ি দিল বাইশজনের দল; নাম ‘রাজপুতানা’। নামেই রাজপুতানা। জনা আষ্টেক খেলোয়াড় ছিল রাজস্থান থেকে। বাকি কিছু গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, সিন্ধ প্রভৃতি রাজ্য থেকে। বাংলা থেকেও দুজন ছিলেন। সফরটির মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন একজনই। ডব্লুডি বেগ। খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন কার্তিক বসু, কমল ভট্টাচার্য, লালা রামজী, বিজয় হাজারের মতো ক্রিকেটার। এর মধ্যে হাজারে একটু জুনিয়র। কার্তিক বসু তখন ফর্মের চূড়ায়। লালা রামজী খেলোয়াড় জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। বছর তিনেক আগেই জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির খেলা খেলে ফেলেছেন, ৩৮ বছর বয়স। বাকিদের মধ্যে দীপচাঁদ, চন্দুলাল বাঁকের, রামপ্রকাশ মেহরা, আত্তিক হুসেন প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড় হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেছেন। কেরিয়ার মধ্যগগনে চলে গেছে আব্বাস খান ও গোপালদাস আদবানীর। দুজনেই বেসরকারি টেস্ট খেলেছেন ভারতের হয়ে। প্রথমজন সিলোনের বিরুদ্ধে,

দ্বিতীয়জন লর্ডটেনিসনের দলের বিরুদ্ধে। এছাড়া তাজম্মুল হোসেন ছিলেন, ছিলেন সি কে নাইডুর থেকেও বয়স্ক ক্রিকেটার আজিম খান, তখনই তিনি ৪৯ বছর বয়সে পৌঁছে গেছেন। এককালে সেমপার, লালা রামজীর মতো ফাস্ট বল করতেন, খান সালামুদ্দিনের সমকালীন এই ফাস্ট বোলার প্রথম শ্রেণির কেরিয়ার শুরু করেন ৩১ বছর বয়সে এবং এগারোটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৩৬ উইকেট তোলেন। আসলে দল প্রথম শ্রেণির স্তরের ছিল না, মাইনর কাউন্টি বা ভালো ক্লাব টিমের সাথে লড়তে পারত। কিন্তু সবসময় সব কিছু ঠিক হয় না। উল্টে বলা যায় কিছুই ঠিক হয় না। এটা তেমনি একটি ট্যুর ছিল।

১৯৩৪ সালেই ডব্লুডি বেগ বোর্ডের কাছে এই সফরের জন্য আবেদন করেন। বোর্ড সচিব ডি. মেলো সম্পূর্ণ ভাবে নাকচ করেন। তাঁর মত ছিল এই বেসরকারি সফরকে মদত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই বোর্ডের। ইমপিরিয়াল ক্রিকেট কাউন্সিলও বেসরকারি সফর চায় না। বোর্ড সচিব তাঁর বক্তব্যের সমর্থন পেলেন সংবাদপত্রগুলি থেকে। ফলে বেগ পিছিয়ে গেলেন।

কিন্তু পরের বছরেই (১৯৩৫/৩৬) পাতিয়ালার মহারাজা রাইডারের অস্ট্রেলিয়া দলকে ভারতে এনে হাজির করলেন। এরপর ভারত গেল ভিজির নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে। ১৯৩৭-৩৮ মরশুমে আবার লর্ড টেনিসনের দল এল ভারতে। চূড়ান্ত ব্যর্থ ও বিতর্কিত ইংল্যান্ড সফর বা দু’-দুটি বেসরকারি সফর ভারতের ক্রিকেটের উৎকর্ষে সাহায্য কিছুটা নিশ্চিত ভাবে করলেও বোর্ডের পক্ষে খুব লাভজনক ছিল না। কিন্তু দুটি বেসরকারি সফর বোর্ড অনুমতি দেওয়ার ফলে বেগের সম্মতি পেতে দেরি হল না। ৫০০০ টাকা প্রদান করে বাইশজনের রাজপুতানা চলল বিলেত সফরে। বলা হল খেলোয়াড়রা ৫০০ টাকা করে পাবেন এই সফরে।

গন্ডগোল শুরু হল ১১ মে ইন্ডিয়ান জিমখানার সঙ্গে খেলায়। তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়ম অনুযায়ী অতিথি দলকে লাঞ্চ এবং চায়ের খরচ নিজেদের দিতে হত। খবরে প্রকাশ, এই বিষয়টি রাজপুতানা দলকে জানানো হয়নি প্রথমে। যখন জানানোহয় তখন খুব খারাপভাবে জানানো হয়। ফলে রাজপুতানা মাঠে নামতে অস্বীকার করে। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা শুরু হলে জিমখানার পক্ষ থেকে দুজন রাজপুতানা দলের সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে যান, ফোনেও কথা হয়, সমস্যার আপাত সমাধান হয়, কিন্তু সকাল দশটার পরিবর্তে খেলা শুরু হয় দুপুর দু’টো কুড়ি নাগাদ। শুধু তাই নয়, টসে জিতে হাতে পর্যাপ্ত সময় পেলেও প্রথমে রাজপুতানা লাঞ্চ খেতে রাজি হয়নি। নিজেরা ব্যাটিং করে মাত্র ১১৮ রান করে, তারই মধ্যে সাড়ে তিনটেয় লাঞ্চ হয়।

এর পর জিমখানা ভালো ব্যাট করে। এর মধ্যে ছ’টার সময় টি ব্রেক হয়। এত কিছুর পরেও জিমখানা যখন ১১২/১, পর্যাপ্ত আলো ছিল, সবে মাত্র সন্ধ্যে সাতটা বাজে, তখন আর খেলতেই রাজি হয়নি রাজপুতানা দল। দুই ভারতীয় দল বিলেতের মাটিতে এক অস্বাভাবিক অখেলোয়াড়চিত আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। আমরা পরে দেখব এরপরে কী অস্বাভাবিক সমস্যা শুরু হয়। শুধু এইটুকু বলে রাখি বোর্ডের কাছে বিষয়টি জানালে তাঁরা পরিষ্কার বলে দেন তাঁদের কিছু করার নেই।

১৩ মে গ্রাসহপার দলের সঙ্গে দুদিনের ম্যাচে রাজপুতানা ভালোই খেলে। কিন্তু এই ম্যাচের পর থেকেই সম্ভবত অধিনায়কত্ব ও দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে দলাদলির অভিযোগ উঠতে শুরু করে এবং দলের মধ্যেই সমস্যা তৈরি হয়। সেই সমস্যা মাথায় নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলতে নেমে যায় রাজপুতানা।

সমস্যা যে ভালো মতো পেকে উঠেছে তা বোঝা গেল ২০ ও ২১ মে-র  দুদিনের ম্যাচে স্যার জে কান’স ইলেভেনের সঙ্গে ম্যাচে। এরপর থেকেই শুরু হয় আর্থিক সঙ্কট। ২৪ তারিখ নাগাদ সংবাদ আসে রাজপুতানা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। সম্ভবত এই কারণে ৩০ মে মি. ফ্রাঙ্কের দলের বিরুদ্ধে ও ৩ জুন অলডারশট কম্যান্ড দলের বিরুদ্ধে খেলতে নামেনি রাজপুতানা।

এরপরে আগে থেকেই পরপর ম্যাচ ক্যান্সেল করতে থাকে রাজপুতানা। তারই মাঝে ১৫০ পাউন্ড পাবে এই চুক্তিতে তাঁরা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে ৪-৬ জুন খেলতে নামে। এর পর আর একটাও ম্যাচ খেলেনি রাজপুতানা। যার মধ্যে উইলটশায়ার, ইস্ট নোরফোক, ওয়েস্ট নোরফোক, ডারহ্যাম,বার্কশায়ার, গ্রেভস এন্ড, হাউজহোল্ড ব্রিগেড, ফোকস্টোন, নর্থ অফ দ্য মিডলসেক্স, ল্যাঙ্কশায়ার, এমনকি ভারতীয় জিমখানা দলের সঙ্গে ফিরতি ম্যাচ অবধি ক্যান্সেল হয়।

অবশেষে ২ জুলাই রাজপুতানা ভারতে ফেরার জাহাজ ধরে। সফর শুরু হওয়ার আগে থেকেই বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় জে সি মৈত্র সমালোচনা করছিলেন এবং সাবধান করছিলেন এই বলে যে ভিজির দলের সফর থেকেও শিক্ষা হয়নি বোর্ডের। এরপর যখন বোর্ড দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে, তিনি তখন পরিষ্কার বোর্ডকে সমালোচনা করেন ও হস্তক্ষেপ কামনা করেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়াও এই নিয়ে আওয়াজ তোলে এবং বিদেশে ভারতীয় ক্রিকেটের সম্মানহানি হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব এর সমাধান প্রয়োজন।

বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায় যখন ৬ জুলাই টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ইন্ডিয়ান জিমখানার পক্ষ থেকে সমস্ত সমস্যার সূত্রপাত হিসেবে লাঞ্চ ও টি ব্রেকের জন্য নিজেদের খরচ করতে বলার খবরটিকে অস্বীকার করা হয়। উল্টে আতিথেয়তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁরাই নেন বলে দাবী করেন।

আক্ষরিক অর্থে এই ছিল প্রাক স্বাধীনতা যুগের প্রাইভেট দলের চেহারা। অনেকটাই আজকের ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের। কিন্তু অপরিণত, অসংগঠিত ও অপেশাদার। এরপরে আমরা দেখবো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেসরকারি ব্যক্তিগত উদ্যোগ।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *