ধূসর চিলেকোঠা । পর্ব ৬ । লিখছেন শেখর সরকার
ঘুরতে ঘুরতে দিব্যেন্দু কোথায় চলে যায়, সে নিজেও জানে না। এমন তো হতে পারে যে সে কক্ষনো বড় হতে চায়নি। এমনও তো হতে পারে সে জন্মই নিতে চায়নি। না চেয়েও এতো বোঝা তার কাঁধে এসে পড়েছে। শীতকালে বুড়ি তোর্সা নদীতে ছোটো ছোটো পাথর ভেসে ওঠে নদীর বুকে। দিব্যেন্দু সেই পাথরের নীচের জলের স্রোত ধরতে চায়।
দিব্যেন্দুর এখনও মনে আছে তার বাবার শ্রাদ্ধর কথা — তাদের পরিবারের কেউই সেরকম অনুষ্ঠানটি নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। গোটা সমাজ কীভাবে তার বাবাকে হেয় করতো — যেন এই মানুষটি কক্ষনো এই নিয়ামতপুরে দু’পায়ে হাঁটেই নি, তার শ্বাস কক্ষনো এই গ্রামের বায়ু গ্রহণই করেনি। একটি মানুষকে কীভাবে অন্তঃসারশূন্য করা যায়, কীভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া যায়, তার বাবাকে উদাহরণ হিসাবে না দেখলে হয়ত সে বুঝতেই পেত না। তার বাবাকে দেখে কক্ষনো তার মনে হত না যে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে স্বীকার করেছে বারংবার অবিনাশের সামনে যে তার বাবা ছিল একটু খ্যাপাটে ধরনের, আর কিছু না।
এগুলো সে সব শুনেছে খেমটি দিদার কাছে। কিন্তু, বন্ধুর সামনে মাথা নত করে স্বীকার করলেও দিব্যেন্দু জানত যে তার বাবার কোনও সমস্যা নিশ্চয়ই ছিল। দশরথের দাহক্রিয়ায় কেউ ছিল না শুধুমাত্র ঊর্মিলা আর সদানন্দ ছাড়া। সে গ্রামের ভারসাম্য নষ্ট করেছিল। এই যে ভারসাম্য — এটা কোনও সাবলীল তরঙ্গের মতো বয় না। এটার একটি নিয়মাবলী আছে। এই নিয়মকে লঙ্ঘন করার জন্য তাকে হাজার বছরের নিস্তব্ধতার শাপ দেওয়া হল। সারা রাত জঙ্গলে ঘুরে সদানন্দ আর ওসমান মিলে দাহ করার কাঠ জোগাড় করেছিল। দয়াময় পুত্রমৃত্যুর শোকে একটুকুও বিহ্বল হয়নি। দাদু-কে দেখে ভাবে এটিই হয়ত জীবনের চরম সত্য। একদিকে তার দাদুর স্থবিরতা এবং অন্যদিকে তার মায়ের দ্রুত স্মৃতিবিহ্বল হয়ে যাওয়া — কোথায় গিয়ে তার আত্মার শান্তি পাবে সে খুঁজে চলছে। মৃত্যু হল এক সমাপতন, এক কায়দা-কানুন বেঁচে থাকার, এক ব্যাকুল ব্যসন এবং ভগবানের ব্যাজস্তুতি, শেষ দৃশ্য সমাপতনের সুপারিশ এবং এক সুপ্রতিষ্ঠিত বশীকরণ। এটা কি মৃত্যুর সময়? মৃত্যু সময়ের সাথে আগমনের বার্তা নিয়ে সময়ের সাথে দেওয়া-নেওয়া করে। মৃত্যুকে সংরক্ষণ করা একটি রীতি। এই রীতি যদিও একটি ব্যর্থ রীতি। পুরো নিয়ামতপুর স্মৃতির কঙ্কাল, হাড় নিয়ে বসে আছে। মৃত্যু — এই নিয়ামতপুরের শিল্পী — কি শুধু একটি মুখ-ই আঁকতে পারে? মৃত্যু কি সব মুখকে সমান ভাবে দেখে? মৃত্যুর চিন্তা এবং তাকে বাস্তব রূপ দেওয়া এক নিপুণ কাজ। মৃত্যু পরিপালন আর পরিধারণ দুটোই করে থাকে। একদিন হঠাৎ করে অতিথির ন্যায় এসে ভেলায় করে বুড়ি তোর্সা-তে এসে ডুবিয়ে দিয়ে যাবে। দশরথের মৃত্যু কি সেরকম কিছু ছিল?
দিব্যেন্দু সে ব্যাপারে এখনও অবগত নয়। সে বুড়ি তোর্সা নদীর পাড়ে বসে দু’টো পা কে জলের নীচে ডুবিয়ে বসে থাকে। বসে বসে সে অনেক কিছু ভাবে। সে ভাবে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক অবিনাশের সাথে, সে তার পরিবারের ইতিহাসকে ডেকে নিয়ে আসে। এক সাথে সব স্মৃতি ভিড় করে আসে। সে এতো সব চিন্তাকে বাধা দিতে অপারগ। তার ছোট্ট মাথায় মনে হয় এখনই এক বিস্ফোরণ হবে। নদীর মধ্যে পা-টা রেখে নিজেকে শীতল রাখার চেষ্টা করে। নদীর ভেতরে তাকালে দেখা যায় বালির সাথে পুঁটিমাছগুলো মনে হয় এক সাথে মিশে গিয়েছে। হঠাৎ করে সে দেখে নদীর অপর পাড়ে এক তৃষ্ণার্ত শেয়াল জলপান করছে। সে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ শেয়ালটির দিকে। দাঁত খিঁচিয়ে জল পান করে আবার ঝোপের ভেতর চলে গেল। দিব্যেন্দু বুঝতে পারল না এতো অল্প সময়ের মধ্যে কী হল। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান যেন এক সাথে সে দেখতে পারল। একটি প্রাণী মানুষের দৃষ্টির গোচরে এসে কীভাবে আবার নিজের অন্তর্ধানে চলে যায় — কতটা নিপুণতার সাথে। মানুষের জীবনের রীতি হয়ত অনেকটা এরকমই হয়ে গিয়েছে। সমাজের সাথে একজন ব্যাক্তি কতটুকু নিজের সম্পর্ক বজায় রাখবে সেটা আর সমাজের ওপর নির্ভর করে না বরং তা এখন সম্পূর্ণ এক ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের রূপ নিয়েছে। লোকের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলা আর কোথায়? সব এখন লোক ভুলতে বসেছে মনে হয় দিব্যেন্দু অনুভব করে। সকালের মিঠে রোদটা গা বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল। নদীর উপরের শান্ত জলের স্রোতের নীচে বয়ে চলছে একাধিক দৃশ্যমান প্রেম — শুধু একটি স্ফুরণ চায়।
দিব্যেন্দু বালুর তীর বরাবর হেঁটে চলছে। মাঝে মাঝে পা বালির ভেতরে ঢুকে পড়ে, সাবধানে চলতে হয়। দূরে কেউ মনে হয় দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখেই চলছে — কিন্তু সে দেখতে পারছে না। দিব্যেন্দু আর দেরি না করে এগিয়ে চলল। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখে কিছু লোকজন মাছ ধরছে। তবে বড়শি বা জাল দিয়ে নয়। এই পদ্ধতিটিকে বলে পুকুর মারা। নদীর জল কম যেখানে কিছু লোক অর্ধনগ্ন অবস্থায় শুধু গামছা পরে পুরো জায়গাকে কর্দমাক্ত করে জল ছেঁকে মাছ ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু নদীর পাড় বরাবর বীজতলা বানানোর কারণে, মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। দিব্যেন্দু কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলল। তবে একটু কান পাতলেই শোনা যায় তার মা-কে নিয়ে আলোচনা করছে লোকগুলো। যেন পুরো গ্রামে আর অন্য কোনও বিষয় নেই। বাঁশের সাঁকো অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। শুকনো আধা ভাঙ্গা বাঁশগুলো ধরে। কিন্তু হঠাৎ করে তার পা পিছলে গেল।
দিব্যেন্দু নদীর মধ্যে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ সে জলের ভেতর ডুবে রইল। জল যদিও খুব কম, তবুও তার মনে হয় এই গ্রাম থেকে যদি পলায়ন করতে হয়, বর্তমানে পাতাললোকই একমাত্র সম্বল। নদীর ভেতরে দিব্যেন্দু অনেক কিছু দেখতে পায়। সবুজ কর্দমাক্ত শ্যাওলা, ক্রমশ শীর্ণ হয়ে যাওয়া নদীর শ্বাসাঘাত, বালির চিকচিক যেটা অনেকটা তার মায়ের কপালের টিপের মতো — এসবই দেখতে পেল ক্ষণের মধ্যে।
নদীর থেকে উঠে ভেজা শরীর নিয়ে দিব্যেন্দু হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে শুনতে পারল কিছু লোকের কোলাহল, একটি লোককে কেন্দ্রবিন্দু করে। পাশে গিয়ে যা দেখতে পারল তা কিছুটা তাকে স্তম্ভিত করে দিল। সদানন্দকে কিছু লোক কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সদানন্দের পুরো শরীর কাদাতে পূর্ণ এবং ধুতিতে কোনও সাদা রং খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সদানন্দ তার পুরো শরীর এলিয়ে দিয়েছে — শরীরে কোনও শক্তি নেই। প্রায় পনেরো মিনিট পর সম্বিত ফিরল। কিন্তু সেভাবে কোনও কিছু সঠিক ভাবে বলতে পারল না। শুধু একটি জিনিস আবছা মনে আছে যে, ধানক্ষেত থেকে হঠাৎ করে একজন অতর্কিতে বের হয়ে হাঁসুয়া দিয়ে মাথার ওপর আঘাত করল। হাত দিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার কারণে আঘাতটি সেরকম ঘাতক হয়ে উঠেনি।
বাবাকে রক্তরঞ্জিত হতে দেখে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার কনক মজুমদারকে ডেকে আনা হল। কনক মজুমদার তার চোখের ভাঙ্গা চশমাটি নাকের ডগাতে এনে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে, মাথাতে একটি ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বিছানা থেকে ওঠার সময় বললেন, “তুমার বাবারে কিছুদিন বিছানাত থাকতে লাগব বুঝলা, বেশি কাম করতে দিবা না। ওষুধ কিছু লেইখ্যা দিতেছি, কাল-পরশু গিয়া নিয়া আসবা।” সদানন্দ কোনও আকার-ইঙ্গিত করছে না। কনক মজুমদার ধুতির কোঁচা এক হাতে ধরে আর পুরনো ছিঁড়ে যাওয়া চামড়ার ব্যাগটি আরেক হাতে ধরে রওনা হল। ঘরে পড়ে রইল শুধু দুই বন্ধু আর সদানন্দ। প্রায় রাত অব্দি বাবার শুশ্রূষা করল অবিনাশ। ভোর বেলা উঠে বাবাকে একটু চা করে দিল। লাল চা আর তেল মাখানো মুড়িতে নিরাসক্ত মুখ লাগিয়ে, সদানন্দ যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। দিব্যেন্দু আর অবিনাশ সারারাত ঘুমতে পারেনি। পাছে যেন কনক মজুমদার এসে দেখতে না পারে যে কেউ দেখার নেই।
ভোর বেলা উঠে অবিনাশ দেখল বাড়ির সামনে কিছু ভিড় জমা হয়েছে। তাতে কিছু গ্রামের চেনা মুখ-ও দেখা যাচ্ছে। দোকানের সামনে বসার জায়গাতে বসে আছে নির্মল মজুমদার। নির্মল সাথে অবিনাশ আগে কোনও কথা হয়নি। সকাল সকাল হাতে একটা সিগারেট নিয়ে আর মাথায় এবড়ো-খেবড়ো চুল নিয়ে হাজির। তাকে ঘিরে কিছু লোক জটলা পেকেছে। সামনে দিব্যেন্দুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল — “তোমার বন্ধুর বাবার কী হয়েছে? এখন কেমন আছে?” দিব্যেন্দু কিছু উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। নির্মল কিছুটা আচম্বিত হয়ে গেল। নির্মল সোজা দোকানের দরজাটা দিয়ে বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির ভেতরে অতর্কিতে ঢুকে সোজা দেখা করতে গেল সদানন্দর সাথে। তবে নির্মল জানে যে সে কিছুটা অসামঞ্জস্য পরিবেশে প্রবেশ করেছে। তার এই গ্রামে প্রবেশ অনেকেই পছন্দ করেনি। গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে তো কেউই তার শুভাকাংক্ষী নয়। তাকে এই গ্রামে মূলত একজন বহিরাগত হিসাবেই দেখা হচ্ছে। তবুও গ্রামের প্রধানের আহত হওয়ার খবরটি শুনে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতে পারেনি। সদানন্দের ঘরে প্রবেশ করে সে কিছুটা হকচকিয়ে গেল। একজন গ্রাম-প্রধানের বাড়ির এরকম অবস্থা সে ভাবতে পারেনি। এই কিছুদিনের মধ্যে এখানে অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত-প্রধানের সাথে তার দেখা হয়েছে এবং এমনকি তাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতও হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে নির্মলের একরকম আলাদা অনুভূতি। সদানন্দকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আর কথা বাড়াল না। সোজা গিয়ে ঘরের টেবিলে এক পুঁটলি ফল রেখে দিল। আর ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে অবিনাশের কানে ফিসফিস করে কিছু বলল।
— তোমার বাবার যা হয়েছে তাতে আমি খুব দুঃখিত। আমি আজই সমাদ্দার বাবুর সাথে কথা বলব। তুমি চিন্তা করবে না। তবে তোমার বাবাকে বলে দিও এই আক্রমণ আর পুকুর খোঁড়ার কাজের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। বাবাকে কিছুদিন আরামে থাকতে বলবে, ঠিক আছে?
— বাবাকে কে আক্রমণ করল?
— সেটা কিছুদিন না জানলেও কোনও ক্ষতি নেই।
আমরা আর কোনও কথা বলব না। আমরা হয়ত কথা বলব ফিসফিস করে যখন আমাদের চিৎকার করে কথা বলে উচিত। যখন আমাদের ফিসফিস করে কথা বলা উচিত হয়ত আমরা তখন গ্রামে সন্ধ্যা আরতির সময় পোষা কুকুরের মতো চিৎকার করব। আমাদের বলার অনেক কিছু থাকবে, কিন্তু আমরা কেন কথা বলব? আমাদের বলতে চাওয়া কথাগুলো জমে থাকবে চিলেকোঠা ঘরে, দুপুরের খাঁ খাঁ করা রোদে পোড়া গোরুর শুকনো জিভে।
(ক্রমশ)