উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৫। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

গত পর্বের পর

নির্জনে সুরের খেলা

একটু আগে সত্যদার কথা বলেছি। সত্যদা- মানে সত্য মজুমদার। পেশায় প্রযুক্তিবিদ, নেশায় বেহালা বাদক। বেহালা ছিল তাঁর আনন্দ, তাঁর আবেগ। সুরের সাধনায় তিনি নির্জন হয়ে যেতেন নিজের ভিতর। বোধ হয় তাঁর কখনো মন খারাপ করত না। কখনো মন এপাশ-ওপাশ করলেই বেহালায় ছড় টেনে সুরের নদীতে সাঁতার কাটতেন। ডুব সাঁতার। স্নাত হলে কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টির আঁচল ছড়িয়ে দিতেন নীলিমে। তারপর মৃদু হেসে বলতেন, হলো।

বলার কিছু থাকে কি ? শুধু তাঁর সঙ্গে স্নাত হওয়া ছাড়া। সুরের এই ঝর্ণাতলায় স্নান ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে! সুরের মতোই তাঁর গভীর দু-চোখে ছিল আলোকবর্ণ। মাঝে মাঝে মনে হত, সারাদিন লোহা-লক্করের সঙ্গে সহবাস করেও একটা সুরেলা  মন কী ভাবে পুষে রাখা যায় হৃদয় কোঠরে! পরে বুঝেছি, সুর ও সঙ্গীত পারে মানুষকে এভাবে গড়ে তুলতে।

কোন ছোট্টবেলা থেকে দেখেছি  তাঁকে। যখন আমরা পুব-পাকিস্তানের দর্শনায় ছিলাম, বাবা দর্শনার কেন অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কলে ছিলেন, সেখানেও ছিলেন তিনি। যখন আমরা চলে এলাম এপারের পলাশীতে, তিনিও এলেন। রামনগর কেন অ্যান্ড সুগার কোম্পানী। সত্তর দশক পর্যন্ত রমরম করে চলত। পলাশীর চিনি বিদেশে রপ্তানী হত। বাংলার বাজারে আসতো। সত্তরের দশকেই মূলত শ্রমিক অসন্তোষ, একই সঙ্গে আখ চাষীদের উৎপাদনে অনীহা, এই কারখানাকে দুর্বল করে দিল। এখন কারখানা থাকা না থাকার মধ্যে ঝুলছে। কত মানুষ কাজ করতেন সেখানে ! কত দপ্তর ! কত আবাসন ! সব মিলিয়ে যেন একটা উপনগরী। কোম্পানীর নিজস্ব হাসপাতাল, সমবায়িকা। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে একটি বিদ্যালয়। এই উপনগরীর গায়ে গা লাগিয়ে দুটি গ্রাম – তেজনগর আর পলাশী। চিনি কারখানার এই উপনগরীকে বলা হল মিল নগরী বা মিল কলোনী।

পলাশীতে এসেও সঙ্গীত সাধনা অব্যাহত ছিল সত্যদার। এই মিল কলোনির পরিধির মধ্যেই ছিল একটা বড় পুকুর। লোকে বলত কালীন্দ, তার পারে ইংরেজ বিজয়ের স্মারক, আর সরকারি ডাকবাংলো। এই পুকুরে দু প্রান্তে দুটি ঝুরি নামা শতাব্দী প্রাচীন বটগাছ। একটি  মনুমেন্টের পাশে, অন্যটি মিল কোয়ার্টারের গায়ে। দুটি বটগাছই ছিল বালক-বালিকাদের খেলার জায়গা। বটের ঝুরি ধরে দোল খাওয়া। দোল খেতে খেতে কতবার যে ঝুরি ছিঁড়ে ধপাস, তার ইয়ত্তা নেই। তা সেই বটতলায় ছিল কালীর স্থান। সেখানে ঘটা করে কালীপূজা হত। আর কালীপূজো উপলক্ষে হত বিচিত্রানুষ্ঠান, নাটক। দু’তিন ধরে চলত। সেই নাটকের নেপথ্যে শোনা যেতো তাঁর বেহালা। আবার মিল আবাসনের অন্য একটি দিকে এক অশ্বত্থ গাছের নীচে যখন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন হত, সেখানেও বালকদের তালিম দিয়ে গান গাওয়াতেন। এভাবেই তিনি শুধু মিল কলোনি নয়, আশেপাশের গ্রামের‍ও শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন। সেই একই ধারা বজায় ছিল বীরভূমের আমোদপুরে এসেও। আমৃত্যু। সুরের সঙ্গে বসবাস আর অমায়িক ব্যবহার তাঁকে সম্মাননীয় করে তুলেছিল।

সত্যদার মতোই আরেক সাধকের সন্ধান মিলেছিল পলাশীতেই। সুগার মিলেই কাজ করতেন মান্না বাবু। দীর্ঘ বছরের অচর্চায় নামটা হারিয়ে গেছে। শুধু পদবিটা জেগে আছে শুশুকের মতো। ছড়ানো ছিটানো মিল কলোনির পুব প্রান্তে হাসপাতাল। তার সামনে একটা বিস্তৃত মাঠ। মাঠের এক পাশ থেকে শুরু হয়েছে শ্রমিক আবাসন। অন্যপাশে বিস্তৃত আমবাগান, যা তেজনগর গ্রামের সীমানা। এই মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেয়ে সাদা সিঁথি পথ। গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় রমণক্লান্ত বিধবার মতো নেতিয়ে আছে। সেই পথের একধারে, আমবাগানের কোল ঘেঁষে একাকী দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিল ঘেরা একটি বাড়ি। তার হাত চারেক দূরে বিশালাকায় তেঁতুল গাছ, অন্যদিকে কয়েক পা এগিয়ে বেলগাছ। এই একাকী নির্জন আবাসে থাকতেন মান্না বাবু। বলতাম মান্না কাকু। চাকরি করতেন কোম্পানির অফিস ঘরে। চলতি কথায় ঘড়ি ঘর। বাকি সময় নানা কাজ তাঁর। স্বপাকে আহার। সংসারী হয়েও সংসারবিহীন তাঁর যাপন। অন্যকোনও জেলায় থাকতেন তাঁর পরিবার। পলাশীতে তিনি ধ্যানস্থ ঋষি। ছোটদের কাছে আকর্ষণ ছিল তাঁর গবেষণাগার। সদর দরজা, তিনি থাকাকালীন অবস্থায় হাট করে খোলা। প্রবেশ প্রস্থান অবাধ। কোনও দিন বিরক্ত হতে দেখিনি তাঁকে। নিজের কাজ করতে করতেই উত্তর দিতেন নানা প্রশ্নের। সহাস্যে। যেন তিনি মজা পেতেন।

আমরা যাওয়া আসার পথে কখনও-সখনও ঢুকে যেতাম তাঁর ঘরে। লুঙ্গি পরে কালি গায়ে তিনি তখন কোনও রেডিও নিযে নিরীক্ষা করছেন। ঘরে একটা চৌকির উপর নানা আকার-প্রকারের রেডিও। কেউ কেউ হয়তো সারাতে দিয়েছেন। তখন ভাল্‌ব রেডিওর যুগ। একদিন দেখি একটি বড় রেডিওর গায়ে একটা কালো গোলাকৃতি সুইচ লাগাচ্ছেন। বাড়িতে আলো জ্বালানো, পাখা চালানোর জন্য ওরকম কালো-সাদা সুইচ ব্যবহার করা হত। সেই সুইচ লাগিয়ে দিলেন রেডিওর গায়ে। তারপর একটা বড় তার ঘরে বাতি জ্বালানোর সুইচ কেটে প্লাগ লাগানোর যে সকেট থাকে তাতে গুঁজে দিলেন। বেশ চলল – আকাশবাণী কলকাতা। বার দুই সুইচ অফ-অন করে দেখে নিলেন ঠিকঠাক শব্দ বেরোচ্ছে কিনা।

কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি করলেন ?

-ডাইরেক্ট করে দিলাম।

মিল কলোনির কালো রেডিও খারাপ বলেই দিয়ে এলো মান্নাবাবুকে। তিনি হাসিমুখে সারিয়ে দিতেন। কোনও পারিশ্রমিক নিতেন না। এটা ছিল তাঁর প্যাশান। শুধু রেডিও নয়, পাশের ঘর যেটা ছিল শোবার ঘর, একটা চৌকির ওপর সামান্য বিছানা পাতা, আর একটা কাঠের হাতলঅলা চেয়ার সেঘরটায় ছিল অদ্ভুত। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে তার সানাই, বেহালা, চৌকির এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে তানপুরা। একধারে হারমোনিয়াম বসে আছে আলগোছে। একমাত্র কাঠের টেবিলের ওপর তবলা। একটা কাঠের বেঞ্চির উপর বাক্স-প্যাঁটরার ওপর শুয়ে থাকত সেতার। অনেকটা বয়স পেরিয়ে এসে সঙ্গীত সাধক ভি. বালসার ঘরে এরকম দেখেছিলাম। তবে সেটা ছিল তাঁর মিউজিক রুম। গণসংগীত শিল্পী অজিত পান্ডের বাড়িতেও দেওয়া বাদুড়ের মতো ঝুলত নানা বাজনা। একটা রাশিয়ান বাজনাও দেখেছিলাম এখন দেখতে দেখতে সেই হাফ প্যান্ট বয়সে দেখা মান্না বাবুর কথা মনে পড়ত। একজন নির্জন প্রবাসী সুরসাধক।

মান্নাবাবুর বাড়িতে মাঝে মাঝে বসত গানের আসর। বেশ রাতে। এলাকার সংগীত সাধকরা আসতেন। চলত শাস্ত্রীয় সুরের চর্চা। তিনি নিজেও কণ্ঠচর্চা করতেন। অনেকরকম বাজনা ছিল তাঁর অধিগত। পাড়ার দু-একটা মেয়ে রোববার সকালে তাঁর কাছে গান শিখত। শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতেও তালিম দিতেন। এই সুরের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ল উড়নচণ্ডীও। কী কারণে জানি না, তার সানাইয়ের দিকেই তার মন গেল। মাত্রা কাকুর তত্ত্বাবধানে চলল বছর খানেকের চর্চা। তারপর পড়াশুনোর স্বার্থে পলাশী ত্যাগ করার পর সে বাসনায় ছাই পড়ল। অন্য আকর্ষণে পলাশী সরতে লাগল। ক্রমশ ধূসর হয়ে গেলেন মান্না কাকু।

পশ্চিমবঙ্গ তখন অগ্নিগর্ভ। নকশালপন্থী বিপ্লবীদের জাগরণের কাল। বাংলার মাঠে ঘাটে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে। চলছে খতম অভিযান। বাতাসে বারুদের গন্ধ। কম্যুনিষ্ট বিপ্লবীদের গ্রাম দিয়ে শহর দেবার দিনগুলোতে উড়নচণ্ডী হাজির হয়েছিল পলাশীতে। মিল কলোনিতে হাজির হতেই বুকের ভিতর স্মৃতিরা কঁকিয়ে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ছেড়ে যাওয়া বাসস্থান, কালীদহ, হাসপাতাল ছুঁয়ে মান্না কাকুদের আবাসের সামনে যেতেই কানে ভেসে এলো তাঁর সানাইয়ের সুর। খোঁজ করতেই জানা গেল, আমরা পলাশী ত্যাগের বছর খানেক পরেই মান্নাকাকু স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন অবসর নিয়ে। সেই থেকে এই বাড়ি সজল চোখে অপেক্ষা করছে নতুন আবাসিকের। নতুন ঘড়িবাবুও কেউ আসেননি। সহকারীর পদন্নোতি ঘটেছে।

তবে রাত-বিরেতে এই বাড়িতে পা পড়ত পুলিশের। সন্দেহ কেউ বোমা বাঁধছে কি না। যদিও পলাশী মিল অঞ্চলে আর এস পি দলের প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল। ছিল কংগ্রেসের দাপট। ফলে সি পি আই (এম)-এর তেমন প্রভাব ছিল না। তবুও পুলিশ হানা দেয় মাঝে মাঝে। আর তখনই একদা আবাস মরমে মরে যায়। অপেক্ষা করে নতুন অতিথির।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *