উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩৫। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

অন্তরীক্ষর দিনকাল

জীবনের বেলা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। হাঁটছি সন্ধ্যের দিকে। এই সে উড়নচন্ডী-জীবনের পরিক্রমা, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কেউ বেঁচে থাকেন স্মৃতির গহ্বরে, কেউ হারিয়ে যান। কত মানুষের সঙ্গে সখ্য, বৈরিতা না থাকলেও মালিন্যের সংখ্যাও বুঝি কম নয়। হাঁটার পথে হোঁচট খাবো না, তা কি হয়? হয় না তো। এই পথের পাঁচালিতে কেউ জোর করে স্থান দখল করেননি, যিনি এসেছেন আপনি এসেছেন। তাকে ডেকে আনার দরকার পড়েনি। এই রচনার পড়ন্ত বেলায় যেমন এসে পড়লেন কৃষ্ণনগরের তুহিন দত্ত তার মৃত্যু-সংবাদ নিয়ে। সখ্য ছিল না ঠিকই, কিন্তু পরিচয়ের আগল ভেঙে একটু তো এগিয়েছিলেন। ছিলেন নাটকের মানুষ। ‘সংলাপ’ নামে একটি নাটকের দলের কান্ডারি। একদা মুদ্রিত নাটক করলেও পরবর্তীকালে নিজেই নাটক লিখেছেন। কত অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরি করেছেন তিনি। বেশ কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী রত্না প্রয়াত হন। তিনিও অভিনয় করতেন। বার্ধক্যের জীর্ণতা তাকে গ্রাস করেনি বলেই শুনেছিলাম। হয়তো ভুল ছিল সেই সংবাদ। কিন্তু অসুস্থ তো ছিলেনই। সে তো অনেকেই থাকেন। তুহিনদাও ছিলেন। আর ছিলেন বলেই আছেন। কৃষ্ণনগরের নাট্যচর্চায় প্রবলভাবে আছেন এই আদ্যন্ত কৃষ্ণনাগরিক।

এভাবেই থেমে যায়। থেমে যেতে হয়। কিন্তু সব থামা তো থেমে যাওয়া নয়। কোনও কোনও থেমে যাওয়ার ভিতরে থাকে নতুন করে চলার ইঙ্গিত। এই যেমন ‘অন্তরীক্ষ’ পত্রিকার জন্মলগ্নে হয়েছিল কোনও এক পঁচিশে বৈশাখ। পত্রিকার জন্ম হয়েছিল যেমন অকস্মাৎ, মৃত্যুও তো হতে পারতো তেমনই। মহানগর কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রান্তসীমায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার গা ঘেষে ঠাকুরপুকুর জনপদ। প্রাচীন এই জনপদে কিছু বছর আগে পর্যন্ত মালিন্যের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট। নব্বই দশকের প্রায় শেষের দিকে আলাপ হল কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। ওরা কবিতা লেখে। অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত। তখন দশকের কবি স্নেহাশিস শুকুলও এখানে বসবাস করতে শুরু করেছি। আমিও ঠাঁই গেড়েছি এখানে। আলাপের কিছুদিন পরেই ওদের মনের ইচ্ছাটা টের পেলাম। ওরা একটা পত্রিকা করতে চায়। কিন্তু দিশা পাচ্ছে না। সে বোধহয় ১৯৯৬-৯৭ সাল। পথপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই ঠিক হল পঁচিশে বৈশাখ পত্রিকা বেরোবে। ঠিক হল চার পৃষ্ঠার ডিমাই সাইজের কাগজ। আপাতত শুধু কবিতা থাকবে। সম্পাদক কে হবে? প্রস্তাব দিলাম, সকলেই সম্পাদক।

অনির্বাণ বলল, তা হল নাকি? একজন-দুজন তো হোক।

বললাম, তুমি সম্পাদক।

সামনে ছিলেন ‘সমকাল’ নাট্য গোষ্ঠির পরিচালক, অভিনেতা সোমেন মন্ডল। এ জি বেঙ্গলে কাজ করতেন। তিনিও গোপনে কবিতা চর্চা করতো। প্রস্তাব দিলাম, অনির্বাণ আর সোমেন দা সম্পাদক হোন, আর সৃজন গোমেশ প্রকাশক।

ওরা জোর করল আমার নামটা রাখতে। ওদের ইচ্ছা পূরণ হল। চায়ের গেলাস হাতে কার কার কবিতা রাখা হবে, কীভাবে হবে, কতটাকা খরচ হবে, প্রেস কোথায় – এসব ঠিক করার মাঝেই অনির্বাণ উধাও হয়ে গেল। ফিরে এলো নগদ টাকা আর বিজ্ঞাপন নিয়ে। ওর এক বন্ধুর দোকানের বিজ্ঞাপন। পঁচিশে বৈশাখের ভোরে রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রির সে কী উত্তেজনা ওদের। এই উত্তেজনা এবং পত্রিকা বিক্রি ভালো হওয়াটা ওদের অক্সিজেন দিল। তোড়জোর শুরু হল পরের সংখ্যার। ঠিক হল বছরে চারটে সংখ্যা বেরোবে। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই পত্রিকার অবয়ব বদলালো। হলো বইয়ের মাপে। ছাপাখানার পরিভাষায় একের আট ডিমাই সাইজ। বের হলো কয়েক সংখ্যা। লিটল ম্যাগাজিন যেমন হয়। এরই মধ্যে সোমেনদা ঘরে এলেন। এলো হীরক  মুখোপাধ্যায়, অনির্বাণের সঙ্গী হয়ে। পত্রিকা মাঝে মাঝেই রূপ বদল করছে। কখনো বড়, কখনো ছোট। এলো অলঙ্করণ। তরুণ শিল্পী গোদাল চৌধুরী কলমের আঁচড়ে ছবি আঁকলেন কবিতার। এরই মধ্যে নিদারুণ অর্থসংকট। ছাপাখানায় ঋণ। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অনির্বাণ কোথা থেকে টাকা সংগ্রহ করে সে যাত্রা রক্ষা করল। পরের সংখ্যায় পত্রিকার আসন্ন মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হল। ততদিনে সম্পাদনার পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছে এই উড়নচণ্ডীর ঘাড়ে। ইতিমধ্যে এসে পড়েছে সঞ্জয়। ব্যাংক কর্মচারী। সে কিছু বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে লাগল। ওদিকে সৃজন  গোমস কেটে পড়েছে। সে ইংরেজি কাগজ বের করতে শুরু করেছে। তৈরি হল একটা দল। অনির্বাণ ঘোষ, হীরক মুখোপাধ্যায়, সঞ্জয় চৌধুরীকে নিয়ে। সঞ্জয়ের নাম ছাপা হতে শুরু হল প্রকাশক হিসাবে। পত্রিকা পৃথুলা হল। আকাশে ওড়ার বাসনা নিয়ে যে তরুণ  নবীনরা ‘অন্তরীক্ষ’ শুরু করেছিল, তারা নানা ব্যস্ততায় আর সময় দিতে পারলো না। সঞ্জয় বদলি হতে হতে ইচ্ছেটা সত্যিই অন্তরীক্ষে মিলিয়ে গেল। এখনও ইচ্ছে জাগে, কিন্তু সময়ের বড় অভাব। অনির্বাণ ঘোষ শিশু সাহিত্যিক হিসাবে নাম করে ফেলল। তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর সে আরও ব্যস্ত কবি হয়ে যায়। নিজেই একটা পত্রিকা বের করতে শুরু করে। ক্রমশ অন্তরীক্ষ প্রায় কুড়ি বছর পথ চলার পর আপনা থেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। থামতে না চাইলেও থেমে যেতে হয়।

তবুও কেউ কেউ তো ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠে, দীর্ঘ ঘুমের পর। অন্তরীক্ষ ও এভাবে জেগে ওঠে কখনো কখনো। করোনাকালীন সময়ে পত্রিকা ‘অনলাইন’ হলো। অনির্বাণ দায়িত্ব নিল। কিন্তু তার ব্যস্ততার কারণে আবার ঘুমিযে পড়ল পত্রিকা।

এক উড়নচণ্ডীর সঙ্গে আরও চার উড়নচণ্ডী মিলে পত্রিকা নিয়ে নানা কসরৎ চলেছে বেশ কিছুদিন। একবার ঠিক হল প্রতিমাসে পত্রিকা বেরোবে। বের হল। প্রতিমাসে থাকতো একজন প্রবীণ কবির সাক্ষাৎকার। বেশ মনে আছে, মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ছিল কবি স্বদেশরঞ্জন দত্তর সঙ্গে কথালাপ। স্বদেশদা পঞ্চাশ দশকের কবি। গল্পও লিখতেন। রবীন্দ্র সরোবরে একটি ঘর নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি। চাকরি করতেন কলকাতা পুরসভায়। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল লেখক সংঙ্ঘের সঙ্গে। তিনি আমাদের বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন। সময় পেলেই তার বাশদ্রোণীর বাড়িতে হাজির হতাম। কতদিন বিনা বিজ্ঞপ্তিতে হাজির হয়েছি। হয়তো পেতাম, হয়তো পেতাম না। চলতো নানা কথার আড্ডা। বয়স একদিন তাকে নিয়ে পাড়ি দিল অন্যকোথাও। পৃথিবীর অগোচরে।

মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা যে কত কঠিন, তা টের পেয়েছিলাম কিছুদিন পরেই। টান পড়ল অর্থের। পত্রিকা যতজন কেনেন, বিনে পয়সায় দেওয়ার থেকে তার চেয়েও বেশি। স্বদেশদাকে দেখেছি নিয়মিত পত্রিকা পয়সা দিয়ে কিনতেন। প্রণব চট্টোপাধ্যায় পত্রিকার মূল্য চুকিয়ে দিতেন না ঠিকই, কিন্তু মাঝে মধ্যে হাতে গুঁজে দিয়ে বলতেন, এটা রাখো। পত্রিকা বের করতে খরচ হচ্ছে তো।

পত্রিকার জন্য অর্থ খরচ করার এই প্রবণতা বামপন্থী লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যেতো। আবার অনেক সোচ্চার বামপন্থীকে দেখেছি বিনে পয়সায় পত্রিকা না দেওয়ার জন্য অনুযোগ করেছেন। দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে দুটো ভাগ লক্ষ্য করতাম। একদল ছিল বাম ঘেঁষা দক্ষিণপন্থী। হয়তো বামফ্রন্ট সরকারে থাকার ফলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ছদ্মবেশ ছিল ওটা। তবে তারা দান দিয়ে পত্রিকা কেনার চেষ্টা করতেন। আর পুরো দক্ষিণপন্থীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।

মূলত আর্থিক কারণেই মাসিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। ‘অন্তরীক্ষ’ ফিরে এলো অনিয়মিত সংখ্যায়। ক্রমশ সে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল। ‘অন্তরীক্ষ’ হারিয়ে গেল নিঃসীম অন্তরীক্ষে। পড়ে রইল স্মৃতি-বিস্মৃতি আর পুরনো সংখ্যার ঝাঁপি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *