উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২৫। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

তাহাদের কথা

পাঁচালি যখন লিখছিই তখন আরও দু-চার জনের কথা অল্পস্বল্প বলে নেওয়া যাক। এরা প্রত্যেকেই উড়নচন্ডীর এককালীন শিক্ষক, কিন্তু পরে নানা কারণে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একটু আগে সে লরেন্স স্যারের কথা বলেছি, তার সম্পর্কে দু কথা আগে বলি। বোধ হয় আগেও তাঁর প্রসঙ্গ এসেছে। লরেন্স স্যার ছিলেন পেশায় শিক্ষক। নেশায় শিল্পী। ভালো গান গাইতেন। দরদ দিয়ে গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত। বাজাতে পারতেন অর্গান, পিয়ানো, অ্যাকোডিয়ান, মাউথ অর্গান বা হারমোনিয়াম। ডন বস্কো স্কুলে ব্যান্ড শেখাতেন। প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি কৃষ্ণনগর কলেজ মাঠে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে ডনবস্কো স্কুলের ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডের সঙ্গে অ্যার্কোডিয়ান কাঁধে ঝুলিয়ে মাঠ পরিক্রমা করতে দেখা যেতো তাঁকে। বাজাতেন দেশাত্মবোধক গান। ভালো ছবি আঁকতেন। অভিনয় করতেন। কৃষ্টিসংসদে দীর্ঘদিন সংগীত পরিচালকের কাজ করেছেন। কল্লোল, অঙ্গারসহ বিভিন্ন নাটকের মঞ্চ স্থপয়িতা ছিলেন লরেন্স স্যার। পরে তিনি কৃষ্টি  সংসদে নাটক পরিচালনাও করেছেন। শহরের বিশেষ পরিচিতি ছিল তাঁর। তবে তিনি ছিলেন মিশন ঘেঁষা। মিশনের কাজ ছিল তার কাছে অগ্রাধিকার। সেজন্যই বোধ হয় কলকাতায় চিত্রবাণীতে ডাক পেয়েও উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। নিজের শহর ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাননি। দেহ রেখেছেন শহরের মাটিতেই।

লরেন্স স্যারের থেকে বোধ হয় একটু বড় ছিলেন আস্তন সুব্রত মন্ডল। আস্তন বা অ্যান্টনি স্যার নামেই ছাত্রমহলে খ্যাত। তিনিও ডনবস্কো স্কুলের শিক্ষক। মৃদুভাষী। ইংরেজিতে বলা যায় লো-ভয়েস। লিখতেন গল্প, কবিতা। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, লরেন্স স্যার, মানে সমরেন্দ্র লরেন্স বিশ্বাস ছিলেন ‘মিলনবীথি’ পত্রিকার সম্পাদক। নিজেও লিখতেন কবিতা, প্রবন্ধ। কিন্তু লেখাটা তিনি সিরিয়াসলি নেননি। তবে আন্তন স্যার কিন্তু নিয়মিত লিখতেন। অনেক পরে প্রেসে অনুবাদের কাজও করেন। দুই বাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি গল্প লিখতেন। একটা ছদ্মনাম ছিল তার। সেই নামেই লিখতেন। কলকাতায় দু-চারজন প্রকাশকের সঙ্গেও ছিল যোগাযোগ। লিখেছেন বাংলা পাঠ্যপুস্তক। কিন্তু এক সময় দেখা গেল তিনি আর লিখছেন না। তাঁর গল্পগুলি নিয়ে বই করার কোনও প্রয়াসও করেননি। ফলে সেসব কালের গর্ভে চলে গেছে। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার গল্পগুলো নিয়ে বই করছেন না কেন?

উত্তরে শুধু মৃদু হেসেছিলেন। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগেও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমন জীবন উদাসী মানুষ খুব কম দেখা যায়। এই উদাসীনতা নিয়েই তিনি জীবনরাজ্য ত্যাগ করেন।

কিন্তু রবীন স্যার এমন ছিলেন না। পুরোনাম রবীন্দ্র জেমস বিশ্বাস। তিনি লিখতেন রবীন্দ্র বিশ্বাস অথবা রবীন বিশ্বাস। ছোটখাটো চেহারার মানুষটার ছিল খিপ্রগতি। শহরে প্রথম ডিভিসনে ফুটবল খেলেছেন। ছিলেন কৃষ্ণনগর ডনবস্কো স্কুলের বাংলা শিক্ষক। ছাত্ররা আড়ালে বলতো ‘ছোট রেলগাড়ি’। নিয়মিত নাটক লিখতেন, আর সেইসব নাটক ক্যাথলিক যুবকদের তালিম দিয়ে অভিনয় করাতেন কৃষ্ণনগর চার্চের সুবৃহৎ মঞ্চে। পরিচালক হতেন তিনি নিজে। এই নাটকে দুজনের উপস্থিতি দর্শকদের দারুণ আনন্দ দিত। একজন তিনি নিজে, অন্যজন লরেন্স স্যার। দু’জনের অনবদ্য অভিনয়ে জমজমাট হয়ে যেতো এবং অবধারিত ভাবে দুজন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রে থাকতেন। যে সব ষাটোর্ধ মানুষ এখনও বেঁচে আছেন, তাদের স্মৃতিতে এইসব নাটক অমলিন হয়ে আছে। তবে বেশিরভাগ নাটকে ছিল ইংরেজি সাহিত্যের ছাপ। কেউ কেউ বলতেন রবীন স্যার ইংরেজি সিনেমা দেখে নাটক লিখতেন। হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তখন তো সমস্বরে বেশি ইংরেজি সিনেমা দেখা হতো না। টিভি বা সেলফোনও ছিল না। হতে পারে তিনি কলকাতায় এসে দেখতেন। তবে শুধু বিদেশি কাহিনি নয়, বাংলায় গ্রাম-শহরের কাহিনি নিয়েও অনেক নাটক লিখেছিলেন। তার কিছু কিছু চাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। একবার তার বাড়িতে বসে কথা বলতে বলতে দেখেছিলাম অনেকগুলি বাঁধানো খাতা। কয়েকটি নাটকের। একটিকে ছিল ছোটগল্প। খান কুড়ি হবে। সামনের পাতায় তিনি প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন নীল কালিতে। বইয়ের নামও লিখেছিলেন তখনকার প্রচলিত অক্ষর শৈলিতে। পেয়েছিলাম একটা উপন্যাস। কিন্তু যেসব প্রকাশ করার কোনও তাগিদ অনুভব করতেন কিনা জানা যায়নি। তবে তার দেবান্তরের পর নিশ্চয় পরপ্রজন্ম সেসব পুরনো কাগজ-বই-খাতা কেনার ফিরিওয়ালার ঝুলিতে দিয়ে দিয়েছে। তবে তিনি অমর হয়ে আছেন যীশুর জীবনী অবলম্বনে প্যাশন প্লে ‘মানবত্রাতা’ লিখে। এটি গত পঞ্চাশ বছর ধরে নিয়মিত অভিনীত হয়ে চলেছে কৃষ্ণনগর চার্চ প্রাঙ্গণে। সেই নাটকের ভিডিও সংস্করণও ছড়িয়ে আছে দেশে বিদেশে। এভাবেই রয়ে গেলেন রবীন স্যার।

শিবুর জন্য দু-কলম

শিবুকে নিয়ে আগে কিছু বলেছি কি? মনে হয় না। উড়নচন্ডী সমগ্র জীবনে যত বন্ধু পেয়েছে বা পেয়েছিল, শিবুর সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। আচ্ছা, পেয়েছিল বলা হল কেন? এখনও কি উড়নচন্ডী নতুন বন্ধু পাচ্ছে না? হয়তো পাচ্ছে, কিন্তু সকলেই শিবু নয়। অমন আন্তরিক বন্ধু আর পেলাম কই? ও ছিল বর্ণিল চরিত্রের মানুষ। উচ্চতা পাঁচ ফুটের নীচে, ফর্সা গায়ের রঙ, এক মাথা কোঁকড়ানো চুল, সরু গোঁফ। মুখের হাসিটা বোধহয় নিজের মধ্যে একা হয়ে গেলেও বিলীন হয় না।

কোথায় কি ভাবে আলাপ হয়ে গেল এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, সেসব মনে নেই। তবে মনে হয় আলাপ বোধ হয় ছিলই। হয়তো অন্য জন্ম থেকে। ও পড়তো রামবক্স চেৎলাঙ্গিয়া স্কুলে। ওই স্কুল সম্পর্কে একটা দুর্নাম ছিল, যারা নাকি কোনও স্কুলে সুযোগ পেতো না, তারা রামবক্সতে ভর্তি হতো। তবে ওদের ফুটবল দল ছিল বেশ ভাল। শিবু স্কুলের দলে ফুটবল খেলতো। প্রতি বছরই স্কুল দলে দেখে অনেকে বলতো, খেলার জন্য ও পরীক্ষা দেয় না। কথাটা কতটা সত্যি জানি না। তবে ওকে নিয়মিত স্কুলদলে দেখা যেতো। আর জজ কোর্টের মাঠে ছোটদের শিল্ড খেলায় ওর ক্ষিপ্রগতিও লক্ষ করা যেতো। ওখানে খেলা হতো সর্বোচ্চ চার ফুট দশ ইঞ্চির বালকদের জন্য। শিবু বেশ কয়েকবছর কোনও একটি ক্লাবের হয়ে খেলতো। নিন্দুকেরা বলতো শিবু চারফুট দশ ইঞ্চির ওপরে আর উঠছে না। আমরা যখন ওই মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছি, শিবু তখনও খেলছিল।

সেই শিবু একদিন বড় হয়ে গেল। স্কুল ছাড়ল। বেশ কিছু বছর পর ভর্তি হল কৃষ্ণনগর কমার্স কলেজে। বয়স বাড়ল, কিন্তু উচ্চতা সেভাবে বাড়ল না। মাঠ থেকেও বিদায় নিয়েছে। মন দিয়েছে গান-বাজনায়। ভাল তবলা বাজাতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যেতো তবলিয়া শিবুকে। ওদের একটা গানের স্কুল ছিল। ‘গাতালি’ ওর বড়দা গান শেখাতেন, তবলা শেখাতেন। তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তার দুই মেয়েও বেশ গাইতো। প্রতি বছর বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তীর আসর বসতো। সরস্বতী পুজোয় বসতো গানের আসর। ওদের বাড়ি ছিল কাঠুরিয়া পাড়ায়। ওদের বাড়ির অনুষ্ঠানে মিঠু দা, সুবীর, ভাস্বতী সান্যাল আর আমি কত যে কবিতা বলেছি।

সেই শিবু একদিন বন্ধু হয়ে গেল। ও তখন কুহেলি নামে একটা নাটকের দল করেছে। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস মানে শিবুই। পরিচালকও সে। তখন বোধ হয় দু-একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছে। দেখিনি সেসব। একদিন বলল, সে ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ’ নাটক করবে। কোনও একটা বই থেকে সে নাটক করবে। আমাকে মঞ্চের দায়িত্ব নিতে হবে। অভিনয় করবে কে? সে নিজে করবে দীনেশ চরিত্র। বিনয় আর বাদল খুঁজে বেড়াচ্ছে ছবির সঙ্গে মুখ মিলিয়ে। অবশেষে দুজনকে সে খুঁজে পেল। কোনও দিন তারা মঞ্চে ওঠেনি। শিবু তালিম দিয়ে তৈরি করে নিল। খুঁজে পেল চার্লস টেগার্ট। অভিনয় করেছিল প্রবীর বসু মানে ভূতি। সে কিছুদিন কলকাতা পুলিশে চাকরি করেছিল। অভিনয়টা সে ভালই জমিয়ে ছিল। এগোচ্ছিল বেশ। সমস্যা হল আলো নিয়ে। মঞ্চে ট্রেন দুর্ঘটনা দেখাবে। এরকম আরও কিছু। এমন আলোকশিল্পী কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? এমন সময় জানা গেল রানাঘাটে একজন আছেন। তার নাম গোরা। ছোটা হল রানাঘাট। তাকেই বায়না করা হল। অনেক পরিশ্রমের পর শেষ পর্যন্ত নাটক হল। উৎরে গেল বেশ। প্রশংসিতও হলো। তারপর সেই শেষ। শিবু আর নাটকের দিকে এগোয়নি। গান-বাজনার দিকেই ছিল। ওদের স্কুলে সে তবলা শেখাতো। আর বাকি সময় আড্ডা। একদিন ও সংসারী হলো। বিয়ে করলো এক দিদিমণিকে। তিনি আবার ক্যাথলিক। সে বিয়ে করতে যাবে গ্রামে। আমরা জনা পাঁচ-ছয় বরযাত্রী। পরিবারের লোকজন ছাড়া। বৌভাতে প্রবেশ দরজা করতে হবে। একটু অন্যরকম হবে। দায়িত্ব পড়ল এই উড়নচন্ডীর ওপর। একটা নাটকের মঞ্চসজ্জার ফ্রেম পেলাম। তাতে বাঁশপাতার কাগজ মারা হল। তার উপর চাঁদমালা আর গোলার ফুল দিয়ে সাজানো হল। মাঝে মাঝে আলপনা এঁকে দেওয়া হল। এমন প্রবেশ দরজা দেখে সকলেই রুচির তারিফ করলো শিবুর। সেও বন্ধুভাগ্যে গর্বিত। দিদিমণি, বিশেষত বিজ্ঞানের দিদিমণির প্রভাবে শিবু শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপন করতে শুরু করল। ততদিনে সে একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছে। আমরাও নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিয়েছি। ওদের পরিবারেও এলো নানা সমস্যা। ওর মা মারা গেলেন। ভাইঝিদের বিয়ে হয়ে গেল। দাদা মারা গেলেন। মেজদা প্রায় চিরদিনই শহরে থাকেন না। থাকেন কলকাতার কাছেই। একদিন ওর স্ত্রীও চলে গেল। এক শিশুপুত্র নিয়ে শিবু নিস্তেজ জীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠল। উত্থান-পতন বিহীন এক নিরালম্ব জীবন। ক্রমশ পুত্র-পুত্রবধূ-পৌত্র নিয়ে যখন সে সামান্য হাসতে শুরু করলো, তখনও সে চলে গেল এই জীবনভূমি ত্যাগ করে। তবুও শিবু ঘুরে বেড়ায় শহরের পথে বন্ধুদের স্মৃতিচারণে, এই যেমন এখন শিবু আমার সামনে। হাসছে। বলছে, কেমন আছিস?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *